অনন্য এক স্বাধীনতা দিবস

অনন্য এক স্বাধীনতা দিবস

২০২৩ সালের ১৫ই অগস্ট, আমরা ভারতবাসী হিসেবে উদযাপন করলাম ৭৭ তম স্বাধীনতা দিবস বা স্বাধীনতার ৭৬ বছর। 

১৫ই অগস্ট আমাদের স্বাধীনতা দিবস, আনন্দের এক দিন। যদিও যথার্থ স্বাধীনতা এল কি না সে নিয়ে তর্ক উঠতে পারে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান, কাজের অধিকার, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, মানুষের মতো বাঁচার অধিকার এখনও বহুদূরে। পাঁচতারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নির্মমভাবে নিগৃহীত হয়ে ছাত্র মৃত্যুর ঘটনা ঘটে গেল এই স্বাধীনতার মাসেই। এখনও ডাইনি প্রথা, তুকতাক, মাদুলি, জলপড়া বন্ধ করা গেল না। তবে সবটাই কি অন্ধকার? তা তো নয়। ভারতের চন্দ্রযান, মানুষের চন্দ্রাভিযানের ইতিহাসে প্রথমবার সফল অবতরণ করেছে চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে। 

দেশ আজ বহু ক্ষেত্রেই স্বনির্ভর। প্রযুক্তি এবং কৃষিতে অগ্রগতি হয়েছে, তবে তার সুফল শ্রমিক এবং কৃষক কতটা পেয়েছেন তা খুব স্পষ্ট নয়। বিপুল সম্পদ কেন্দ্রীভূত হচ্ছে কয়েকটি মাত্র শিল্পগোষ্ঠীর হাতে। ধনরাশির অসম বণ্টনজনিত পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ থেকে বিপ্লবের জন্ম দেওয়ার মতো বলিষ্ঠ নেতৃত্বের দেখা আমরা এখনও পাইনি। 

ক্রীড়া ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক কালে উল্লেখযোগ্য সাফল্যর পরিমাণ খুব কম নয়। যদিও অনেকে বলবেন, বিশাল আয়তন ও জনসংখ্যার এই দেশে সেই সাফল্য এখনও অপ্রতুল। 

১৫ই অগস্ট মানে দেশভাগেরও যন্ত্রণা, সহস্র শহিদের আত্মবলিদানে দেশ পেল টুকরো হওয়া স্বাধীনতা। কারা যেন দেশপ্রেমের আবেগকে সওদা করে দিল! কাঁটাতারের দাগের দগদগে ঘা এই দেশকে বুকের ভিতর চিরকাল বহন করতে হবে। থাক এ সব মনখারাপের কথা।  

১৫ই অগস্ট, আঠারো নম্বর মলরোড এস্টেটের এক আবেগের নাম: 

দেশের ভিতর ছোট্ট যে দেশ, সেই আঠারো নম্বর মলরোড এস্টেট, ভারত সরকারের দমদম আয়ুধ কারখানার কর্মী আবাসন। সেখানেই আমাদের বেড়ে ওঠা। প্রেম, বন্ধুত্ব, বিরহ, শোক সব হাত ধরাধরি করে চলেছে। একটু যেন বেশি বেঁধে বেঁধে থেকেছি আমরা।

সেই দেশের সব নাগরিক, আমরা যারা আঠারো নম্বরিয়ান, তাদের কাছে ১৫ই অগস্ট, এক অন্য আবেগ। সকাল বেলা, নার্সারি স্কুলের সামনে পতাকা উত্তোলন, লাড্ডু বিতরণ। একটু বাদেই শুরু হয়ে যাবে স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে আয়োজিত বহু আকাঙ্ক্ষিত ওয়ান ডে ফুটবল টুর্নামেন্ট। উত্তেজনায় থরো থরো সেই বহু প্রতীক্ষিত মাহেন্দ্রক্ষণ, জলের ট্যাঙ্ক প্রান্ত থেকে কাশিনাথ দাসের নেতৃত্বে এগিয়ে আসছে আঠারো নম্বর মলরোড এস্টেট ফুটবল ক্লাবের ধুরন্ধর ফুটবলাররা। মাঠের চার পাশে তখন তিল ধারণের জায়গা নেই। মা, কাকিমারা ভিড় জমিয়েছেন সবার আগে এবং সঙ্গে জলপরিরা। চকিত চাহনিতে তাদের কারও চোখ ছুঁয়ে যাচ্ছে কোনও তরুণ তুর্কির চোখের পাতা। থাক, সে অন্য গল্প; অন্য কোনওদিন।

মাঠে নেমে তারক, টিঙ্কু, গোরা, মেনদা, শঙ্কররা ফুল ফোটাবে। হ্যাঁ, বছরে এই একদিনই শঙ্কর তার নামের আগে বসা পাগলা বিশেষণ ঝেড়ে ফেলে দেবে। সারা বছর যে শঙ্কর, সাদা জামা, সাদা প্যান্ট, হিল তোলা জুতো পরে মিঠুন সাজার আপ্রাণ চেষ্টা করতে করতে, অনভিপ্রেত উপাধি লাভে ‘পাগলা শঙ্কর’ হয়ে গেছে, সেই আজ রক্ষণে মহাদেব হয়ে উঠেও ঝটিকা আক্রমণে হানা দেবে বিপক্ষ দুর্গে। আজ আর, ও পাগলা শঙ্কর নয় মোটেই। তারক, টিঙ্কু জুটির (কখনও বদলি খেলোয়াড়  মেনদা) চকিতে জায়গা বদল, পায়ের সূক্ষ্ম কারুকাজে বিপক্ষকে নিয়ে ছেলেখেলা করার পর, বিদ্যুৎ ঝলসানো শটে কেঁপে যাবে অসহায় প্রতিপক্ষর জাল। রক্ষণের কেন্দ্রস্থলে গোরার স্থিতধী উপস্থিতি আর অমোঘ ফাইনাল পাস বাড়ানোর কুশলী দক্ষতা আপামর আঠারো নম্বরবাসীকে শান্তি দেবে।

বিপক্ষ দল খোলস ছেড়ে আক্রমণে উঠবে বটে, কিন্তু ততক্ষণে আঠারো নম্বর অধিনায়ক কাশিদা বট গাছের মতন ঝুরি নামিয়ে দিয়েছে গোল পোস্টের সামনে। কোনও এক অজানা কারণে তেঁতুলতলা প্রান্তের গোলপোস্টে কাশিদা তখন অতিরিক্ত দুর্ভেদ্য হয়ে উঠেছে। আঠারো নম্বরের প্রাচীন অরণ্য প্রবাদ বলে, সেই কৃতিত্বের সিংহভাগ আসলে নাকি এক সিংহীর, যিনি ওই প্রান্তের মাঠের ধারের এক ছাদে দাঁড়িয়ে আঠারো নম্বর অধিনায়ককে বরাভয় প্রদান করতেন।

একসময় পশ্চিম আকাশে সিঁদুর মাখিয়ে ১৫ই অগস্টের সূর্য অস্তাচলে যাবে, ফাইনাল শেষে কাশিদার হাতে কাপ উঠবে, আকাশ বাতাস মুখরিত করে আমরা বলে উঠব, “থ্রি চিয়ার্স ফর…।”

তারপর রান্না হবে মাংস-ভাত, শাল পাতা পেতে আমরা ক্লাবের সামনে বসে যাব লাইন দিয়ে, তেমন মাংস ভাত আর জীবনে খেলাম না। হোক না একটু নুন কম বা বেশি, ভাত কি একটু কম সিদ্ধ হয়েছিল? কী এসে যায় তাতে! চেহারাগুলো সব আবছা হয়ে যায়, স্মৃতির সরণিতে পলি জমে, তবু সব শেষ হয় না, রেশ রয়ে যায় প্রাণে। একটা করে ১৫ই অগস্ট আসে, বুকের ভিতর চুপকথারা ফিসফিসিয়ে বলে দিয়ে যায়, ‘শেষ নাই রে, শেষ নাই যে।’

আর আমি সেই, না ভুল হল; আর আমরা সেই বুকের গহিনে ডুবুরি নামিয়ে একটা একটা বালি দশ আঙুলে ছেনে, মুখে মাথায় মাখি, দেখি সেইসব বালিকণা কখন মুক্তো হয়ে ঝরে পড়ছে, আমরা সেই ধারাপাতের নীচে অঞ্জলি পাতি, অন্তরে কে গান গেয়ে ওঠে, ‘ও আমার দেশের মাটি…।’

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *