চাঁদ উঠেছিল গগনে
আমরা যখন রওনা দিলাম তখন ভোর সাড়ে চারটে। গন্তব্য সাঁতরাগাছি স্টেশন। পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়া চাঁদও আমাদের পিছু নিল। আসলে ব্যাপারটা হল কী, বেশ কয়েক বছর যাবৎ ফাল্গুন মাস পড়লেই মনের মাঝে গুনগুনিয়ে ওঠে, “পিন্দারে পলাশের বন পলাবো পলাবো মন।” আর পলাশের জন্য মন আনচান আনচান করলেই মনের গহিন ঘরে ঘাপটি মেরে বসে থাকা বাউন্ডুলে আরএকজনা থেকে থেকে ইন্ধন যোগাতে থাকে। এবারেও একই কেস। আর পলাশ মানেই লাল মাটি আলতা ধোওয়া বাঁকুড়া পুরুলিয়া। ক্যালেন্ডারের পাতা বলল, দোল আর হোলি, পুঁজি বলতে এই দুটো দিন। ব্যাস আর কী! রূপসী বাংলার চেয়ার কারের টিকিট কেটে ফেলা গেল ঝটাপট।
ঠিক ছয়টা বেজে পঁচিশে স্টেশন ছাড়ল ট্রেন। তখনও বাতাসে ঘুম ঘুম কুয়াশা জড়িয়ে আছে। খড়গপুর, মেদিনীপুর ছাড়িয়ে ট্রেন ছুটে চলল। এরপর সিগনাল না পেয়ে শালবনি স্টেশনে বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়াল ট্রেন। স্টেশনের দূরতম প্রান্তের একলা নিরালা কংক্রিটের বসার বেঞ্চটা চোখেচোখে ইশারায় বলল, “এসো। খানিক বসেই যাও না। এমন আলসেমি জড়ানো ফাল্গুনি সকাল! কোনও তাড়া নেই তো কোথ্থাও!”
তার দিকে চেয়ে রইলাম। তার ডাকে সাড়া দিয়েই যেন মাথার উপরের সেগুন গাছটার থেকে খসে পড়া পাতারা বাতাসে ভেসে ভেসে নেমে আসছে নির্ভার। বেঞ্চটার সারা শরীর জুড়ে পরিয়ে দিচ্ছে শুকনো পাতার সাজ। কেউবা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে স্টেশন চাতালে এদিক ওদিক।
এক সময় ট্রেন আবার ছুটতে শুরু করল। নির্জন বেলাভূমির মতো পেছনে পড়ে রইল শালবনি স্টেশন। তখনও কিন্তু জানি না এরপর কী অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। গড়বেতা পেরোতেই পাল্টে গেল বাইরের দৃশ্যপট। আকাশের ক্যানভাস তখন আগুনে আগুনে ছারখার। তরঙ্গায়িত ধূ ধূ প্রান্তরে আশরীর আগুন নিয়ে সারে সারে দাঁড়িয়ে কাঙ্ক্ষিত পলাশের দল। ট্রেনের গতি কমেছে। এরপর পুরুলিয়া জংশন পর্যন্ত দুপাশে পলাশের সমারোহ নিয়ে ঝিকিঝিকি করে সে এগিয়ে চলল আলসেমি ভরে। আহা কী অপরূপ সে যাত্রাপথ!
অবশেষে পুরুলিয়া জংশন। লালটুকটক টালির ছাদের স্টেশন বাড়িটা যখন আমাদের সাদর আহ্বান জানাল তখন সূর্য মধ্যগগনে। মার্চের প্রথম সপ্তাহেই কী তার তেজ! বাতাসেও ছড়িয়ে আছে তার হলকা। স্টেশন চত্বরের বাইরে বোলেরো নিয়ে অপেক্ষা করছিল আমাদের চালক ভাই ময়ূরবাহন সোরেন। এবারের সফরসঙ্গী আমরা অষ্টবসু – মানে আমি, আমার কর্তা, আমাদের দুই কন্যে তোতা, বুলবুলি, ননদ, ননদাই, আর তাদের পুত্র ডেকা ও কন্যা ডোরা – চড়ে বসলাম তাতে। নিপোঁচ করে কাচ তুলে শীতাতপনিয়ন্ত্রক যন্ত্র চালিয়ে দিয়ে গাড়ি ছুটে চলল তরঙ্গায়িত ধূ ধূ প্রান্তরের বুক চিরে কালো পিচ পথ ধরে। দূরে আকাশের বুকে জেগে রইল ধূসর অনুচ্চ পাহাড় শ্রেণী। আর তার কোল ঘেঁষে লালে লাল পলাশের বন। পথের দুধারেও ছিল তারা বিস্তর।
আমরা চলেছি বাঘমুন্ডি। আগামী দু’দিন আস্তানা গাড়ব ওখানেই। বাঘমুন্ডি আসলে অযোধ্যা পাহাড়ের পাদদেশ। পুরুলিয়া জংশন থেকে বেয়াল্লিশ কিলোমিটার। স্টেশন থেকে মাত্র ঘন্টাদেড়েকের পথ। কিন্তু পথে বেশ কিছু দ্রষ্টব্য স্থান ঘুরে হোটেলে পৌঁছাতে চারটে বাজবে বলল ময়ূরবাহন ভাই। তারপর স্নান খাওয়া বিশ্রাম।
মিনিট পনেরো পথ পেরিয়েছি সবেমাত্র, ডেকার শরীরটা কেমন করতে লাগল। শুধু বলে, “বমি পাচ্ছে, গাড়ি থামাও।”
গাড়ি দুই পা এগোয়, একটু থামে। সে নীচে নামে। আঁতকা তোলে। চোখে মুখে জল দেয়। আবার গাড়ি এগোয়। একটা ছোটখাটো বাজার থেকে থাম্স আপ কেনা হলো। সঙ্গে ওষুধ এবং ডাক্তার মজুত। তাই কিছুটা নিশ্চিন্তি।
এভাবে খানিক পথ চলতে চলতে হঠাৎ সে ঘোষণা করে, তার ‘বড় কর্ম’ সারার প্রয়োজন। তার মামা বলে, “চিন্তা কী? চারিদিকে এত মুক্ত ধূ ধূ প্রান্তর। একটু আড়াল দেখে বসে পড়লেই হয়।”
কিন্তু সে উন্মুক্ত স্থানে মুক্তকচ্ছ হতে নারাজ। শেষে পেট্রল পাম্পের খোঁজে ময়ূরবাহনকে হন্যে হতে বলি আমরা। পেট্রল পাম্পে ‘সু’ হোক আর ‘কু’ হোক, কিছু না কিছু একটা ব্যবস্থা তো থাকবেই – এটুকু আশা। কিন্তু সে বলে, “এখানে তেমন কিছু পাবেন না। নয় পুরুলিয়া জংশনে ফিরতে হবে কিংবা বাঘমুন্ডির হোটেলে।” কিন্তু একবার বাঘমুন্ডি পৌঁছে গেলে পথের দ্রষ্টব্যগুলির উপর কাঁচি চালাতে হবে। কারণ আজ না হলে আগামীকাল আর হবে না। আগামীকাল কাল অযোধ্যা পাহাড়ের বামনি, টুর্গা ফলস ঘুরে, মার্বেল লেক হয়ে মুরুগুমার দিকে যাবার জন্য সব ব্যবস্থা পাকা করা আছে। শেষে একটা জলা মতন দেখে গাড়ি থামান হল। রাস্তার বাম দিকে জলা, জলার পাশে ঝোপঝাড়। আর রাস্তার ডানদিকে ধূ ধূ প্রান্তর।
ডেকাকে পাকড়াও করে তার মামা এগুলো ঝাড়ির পিছনে। কালো পিচের রাস্তাটা রোদে ঠা ঠা করছে। দূরে রাস্তার উপর মরীচিকার জন্য মনে হচ্ছে জলের চিকিমিকি।
আমার ছোট কন্যে ছোটবেলায় প্রথমবার এমন মরীচিকা দেখে উল্লসিত হয়ে হাততালি দিয়ে বলে উঠেছিল, “মা, ওমা, রাস্তার উপর ওই দেখো একটা নদী!”
ময়ূরবাহন গাড়ির স্টার্ট থামিয়ে দিয়ে দূরে গাছের ছায়ার বসে গেছে খৈনি ডলতে। খানিক পরে আমরাও গাড়ির কাঁচ নামাতে বাধ্য হয়েছি। দরজাও দিয়েছি হাট করে খুলে। জলার দিক থেকে অল্প অল্প ঠান্ডা মিঠে বাতাস আসছে।
মুহূর্তে দেখলাম প্রান্তরটাতে কিছু দূরে ধুলো, শুকনো পাতা, কুটিকাঠির ঘূর্ণি জেগেছে। ঠান্ডা আর গরম বাতাসের সংঘর্ষের ফলে ঘূর্ণি বাতাস সৃষ্টি হয়েছে। ছোটোখাটো টর্নেডোর আকারে সেটা এগিয়ে আসছে এদিকেই। ঝটপট জানালার কাঁচ তুলে দরজা এঁটে বসে রইলাম। খানিক তুর্কি নাচন নেচে সে ঘূর্ণি আকারে বাড়তে বাড়তে পিচরাস্তা টপকে জলার ধার ধরে এগিয়ে গেল ওদিকপানে।
তার খানিক পর আমাদের গাড়ি ছুটে চলল বাঘমুন্ডির দিকে। তবে অলরেডি তখন ঘড়ির কাঁটা দুপুর দু’টো পেরিয়েছে। পথের দুই পাশে পলাশের সমারোহ নিয়ে এক সময় এসে পড়ল পার্ডি লেক। তিন পাশ পাহাড় ঘেরা স্বচ্ছ নীল জল। নীলচে সবুজ পাহাড়ের গায়ে ধোঁয়া ধোঁয়া মেঘ জড়িয়ে আছে। চোখে অদ্ভুত এক মায়াকাজল জড়িয়ে দিচ্ছিল এসব সৌন্দর্য। চারপাশে তখন ঝিমঝিমে দুপুরের মৌতাত। লেকের বুক ছুঁয়ে উঠে আসা ঠান্ডা বাতাসের জন্য গরম বোধ হচ্ছে না অতটা। লেকের পাশের পথটা পায়ে পায়ে এগিয়ে গেছে পাহাড়ের দিকে। আমরাও এগোতে লাগলাম সে পথে। পথের পাশে শাল, শিমূল, পলাশ, বাবলার দল। কারোও কারোও গায়ে জড়িয়ে থাকা নাম-না-জানা লতায় গুচ্ছ গুচ্ছ সাদা থোকা থোকা ফুল। বসন্তের উপহার। তারা ঝিমঝিমে দুপুরের মৃদুমন্দ বাতাসে মাথা দুলিয়ে হেসে ওঠে।
মনে মনে শুধাই, “নাম কী রে তোদের?”
একদল কচি গলা কলকলিয়ে বলে, “বিজয়, টুসু, বাদল, সন্তোষ…,” আরও কত কী!
পিছন ফিরে দেখি একদল স্থানীয় কচিকাঁচার দল পিছু নিয়েছে আমাদের। আমার কর্তা আর কন্যেরা তাদের সাথে আলাপচারিতায় মেতেছে। ওদের এখন হোলির ছুটি। স্কুলে কী পড়ায়, মিড ডে মিলে কী খাওয়ায় থেকে শুরু করে ওদের হাজারটা প্রশ্ন করে চলেছেন বাবু। ওরাও খুশি মনে উত্তর দিচ্ছে। প্রশ্নোত্তর পর্ব শেষে চকলেট বিতরণ পর্ব। আর তারপর পার্ডি লেক পিছনে ফেলে পাখি পাহাড়ের পথ ধরল গাড়ি। আবছা হতে হতে মিলিয়ে গেল হাত নেড়ে বিদায় জানানো শিশুগুলির অবয়ব। লালমাটি পথের ধারে পড়ল সাঁওতালি গ্রাম। মাটির বাড়ির দেওয়ালে যত্নে আঁকা রঙিন ফুল পাতা জ্যামিতিক নক্সা। এসব অঞ্চলে সাঁওতাল, বিহোর, শবর, মুন্ডা, জনজাতির বাস।
ক্রমে বসতি ছেড়ে জঙ্গুলে পথে এগিয়ে চলল গাড়ি। এতক্ষণ শিমুল পলাশের আগুনে চোখ ঝলসে যাচ্ছিল। এবার দৃষ্টি কাড়ল নতুন একজনা। লাল রঙা পাতায় ছেয়ে আছে তার সুউচ্চ দেহ। যেন লাজুক লালটুকটুকে নববধূটি। ড্রাইভার ভাই নাম বলল, “কুসুম।” বসন্তে পুরুলিয়াতে শুধু পলাশ শিমুল একাই দিগন্তে ফাগের রঙ লাগায় তা নয়। দেখলাম রঙ্গবতী কুসুমও কম যায় না!
এক সময় গাড়ি থামল শালের জঙ্গলের ধারে। জঙ্গলের সবুজ শামিয়ানার উপর মাথা তুলে জেগে আছে এক ধূসর পাহাড়ের মাথা। গায়ে তার স্থির হয়ে আছে উড়ন্ত পাখির ঝাঁক। বুঝলাম এটাই পাখি পাহাড়। এই পাখি পাহাড়ের সাথে জড়িয়ে আছে চিত্ত দে নামক এক শিল্পীর নিষ্ঠা ও সংকল্পের গল্প। তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে অনুসন্ধান করে এই বর্ষীয়ান শিল্পী খুঁজে পেয়েছিলেন পশ্চিম পুরুলিয়ার অযোধ্যা রেঞ্জের এই পাহাড়টিকে। প্রথমে তাঁকে পাত্তা দেওয়া না হলেও অবশেষে 1995 সালে সরকারের কাছ থেকে অনুমতি ও অনুদান এসেছিল। তখন কলকাতার সরকারি আর্ট কলেজের এই প্রাক্তন ছাত্র স্থানীয় মানুষদের নিয়ে ছেনি হাতুড়ির সাহায্যে পাথর কুঁদে নানান পশু পাখী লতা পাতার মোটিফ ফুটিয়ে তুলেছিলেন এই পাহাড়ের বুকে। এই পাহাড় আজ প্রকৃতিপ্রেমীদের কাছে এক বড় আকর্ষণের জায়গা।
শালের জঙ্গলে গেরুয়ারঙা মাটির বুকে ঝরা পাতার রাশ। যেদিকেই তাকাই পুরাতন পাতা ঝরিয়ে গাছেদের গায়ে নব বসন্তের কচি কলাপাতা বরণ সাজ। হাল্কা সাদাটে সবুজ ঝিরিঝিরি শালের মঞ্জরীর মিষ্টি গন্ধে ম’ ম’ করছে চারপাশ।
“একা গেলি পথ খুঁজে পাবেনি, পাহাড়ে চড়ার সোজা পথ। আমার সঙ্গে সঙ্গে এসো।”
জুটে গেল আমাদের স্বনিয়োজিত গাইড সুমিত্রা হাঁসদা। আগে আগে চলল সে। হাতে শালের শুকনো ডাল। পিছনে পিছনে আমরা। শুকনো পাতার দল ঝমর ঝমর শব্দে বেজে উঠল ঘুঙুরের মতো।
মূল পাহাড়টিকে ঘিরে শালের ছায়ায় ছায়ায় এখানে সেখানে জেগে আছে ছোট ছোট টিলা। তাদের কারো কারো গায়ে ময়ূর সহ নানান পাখির অবয়ব। কারোও গায়ে কাঠবেড়ালি, কচ্ছপ, হরিণ। এমনকি কুমিরও বাদ যায়নি। সাদা ও নীল রঙের ব্যবহার করা হয়েছে মূলত। এদের পেছনে ফেলে মূল পাহাড়ের দিকে এগোলাম। আমাদের দল দুটো ভাগে ভাগ হলো। একদল রয়ে গেল নীচে। আর আমরা একদল পাহাড় চড়ার নেশায় কাঠবেড়ালির মতন পাহাড়ের গা বেয়ে উঠবার সিদ্ধান্ত নিলাম। কারণ কিছুটা না উঠলে যে অ্যাডভেঞ্চারের নেশা মেটে না!
পাহাড়ের গায়ে পথ বলে কিছু নেই যদিও। পাথরের খাঁজে খাঁজে পা রেখে ওঠা।
“মাসি সাবধানে। এইটা হাতে ধর দিকিনি।” গাইড সুমিত্রা মাসি আমার হাতে ধরায় তার হাতের শাল ছড়িটা। সে আমাকে মাসি ডাকছিল। আমিও তাকে মাসি ডাকছিলুম।মনে মনে একটু রাগ হল, থুথ্থুরি বুড়ি ভাবছে না কি আমায়! লাঠি ধরাচ্ছে যে বড়!
কিন্তু যখন দেখলাম আলগা পাথরের কুচি আর শুকনো ঝরা পাতার উপর সাবধানে পা রেখে ওঠা বেশ ঝুঁকির, আর এ লাঠি বড় কাজের, তখন মনে মনে তাকে ধন্যবাদ দিলাম।
উঠতে লাগলাম ধীরে। পা টিপেটিপে। ছড়িতে ভর দিয়ে। অতি সাবধানে। উপরের পাথরের গায়ে খোদাই করা পাখিদের দল হাতছানি দিচ্ছে।
কখনও কখনও দুটো পা রাখার পাথরের মধ্যে বিস্তর ফারাক। তখন কর্তা ও কন্যাদ্বয় আমাকে প্রায় চ্যাংদোলা করে তুলে নিচ্ছে উপরে। এভাবে পাহাড়ের বুক অবধি উচ্চতায় পৌঁছে ইতি টানা হল। কারণ এরপর ন্যাড়া পাহাড় প্রায় মসৃণ। এভারেস্ট বিজয়ের উল্লাসে পাখি পাহাড়কে ব্যাকগ্রাউন্ড করে অনেক সেলফি, গ্রুপফি তুলে টুলে নীচে নামার জন্য পা বাড়ালাম আমরা। শুকনো পাতার মিছিলে নামার পথখানি যে কতটা ভয়ঙ্কর ঠেকেছিল আমার কাছে তা বলে বোঝাতে পারব না। প্রায় সুমিত্রা মাসিকে ভর করে নেমে এলুম সমতলে।
ডেকা ঝিমিয়ে পড়েছিল। তাই এরপর হোটেল। সেখানে লটবহর নামল। আমরা নাকে মুখে দুপুরের খাবার পড়ন্ত বেলায় ঠুসে আবার চড়ে বসলাম গাড়িতে। স্টুডেন্ট হিসেবে আমি আবার খুব সিরিয়াস। সব পাতা মন দিয়ে পড়়া চাই। আমাদের তখনও তিনখানি চ্যাপ্টার বাকি। সন্ধ্যা নামার আগেই সেরে ফেলতে হবে। ডেকা আর তার বাবা রয়ে গেল হোটেলে।
গাড়ি ছুটল মাথাবুরুর দিকে। সাঁওতালি ভাষায় ‘বুরু’ মানে পাহাড়। শীতকালে এই পাহাড়ে রক ক্লাইম্বিং পাঠ নেবার জন্য তাঁবু ফেলে উৎসাহীরা। কাছেই আছে বানজারা আর টং ক্যাম্প সাইট।
পাহাড়ের গা বেয়ে অতিকায় সরীসৃপের মতন পেঁচিয়ে উপরে উঠে গেছে সিঁড়ি। বেশ খানিক উঠে রণে ভঙ্গ দেওয়া হল। বেলা পড়ে এসেছে। এরপর খয়রাবেড়া ড্যামে পৌঁছাতে সন্ধ্যা নেমে আসবে।
চড়িদা, মুখোশ গ্রাম ফেলে এগোলাম আমরা। ফেরার পথে নামব এখানে। ছৌ নাচের মুখোশ তৈরির জন্য বিখ্যাত এই গ্রাম।
কাঁচা মাটি পথে লাল ধুলো উড়িয়ে যখন আমরা ড্যামের ধারে পৌঁছালাম, ততক্ষনে সন্ধ্যা ছায়া ফেলেছে জলের বুকে। প্রায় চারপাশ পাহাড় ঘেরা ড্যামের জলে কিছু মাছ বুড়োবুড়ি কাটছে। ড্যামের পাশে হাত দশেক ফাঁকা পাথুরে জমিন। ভরা বর্ষায় মনে হয় এই শুকনো জমিটুকুও জলের দখলে চলে যায়। পাথুরে ঢালু জমিন দিয়ে নেমে এলুম জলের একেবারে কাছে। হাত ছোঁয়ালাম শীতল জলে। তারপর কিনারা ঘেঁষে একটা পাথরের চাতালে উঠে বসলাম। একপাশে হাল কলমির বেগুনি ফুল ফুটে আছে একঝাঁক। যদিও সন্ধ্যার অন্ধকারে বেগুনি রঙেতে কালসা ছোপ। সন্ধ্যার অন্ধকারে পাহাড়গুলোকেও অতিকায় প্রাগৈতিহাসিক প্রাণীর মতন ওত পেতে আছে মনে হচ্ছিল। পাহাড়ের গায়ের পলাশগুলোর আগুন বর্ণ তখন নিভে গেছে অন্ধকার তুলির পোঁচে। আকাশে ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘের পশম। সবাই অস্থির হচ্ছি ফেরার জন্য। কিন্তু কী যেন এক মোহ আবেশ জড়িয়েছে সান্ধ্যকালীন সেই পরিবেশ। আর একটু, আর একটু করে করে আরও মিনিট দশেক কাটতেই থালার মতন দোলপূর্ণিমার চাঁদটা পাহাড়ের পেছন থেকে ভেসে উঠল আকাশে।
দিনের মাঝখানটায় নানান বাধা বিপত্তিতে মনটা কিছুটা হলেও বিরক্ত হয়েছিল। এখন মনে হল যা হয় তা ভালোর জন্যেই হয়। যাত্রাপথের মধ্য ভাগে অমন বিপত্তি না হলে তো আজ জ্যোৎস্নাভেজা এমন মোহময় পরিবেশে খয়রাবেড়া ড্যামকে অনুভব করা হত না!
মুখোশ গ্রামের পথের পানে রওনা দিয়ে দেখলাম পিছু পিছু আসছে চাঁদ।