তোমারি ঝরনাতলার নির্জনে
অল্প জলে পুঁটিমাছ ফড়ফড়ায় – কে না জানে! চৈতন্য হয় না তবু। আহা, আমি কত যে জানি, কত যে বুঝি। অবসর পত্রিকার নাম শুনেছি সেই কবে থেকে। পড়েছি। গুণীজনদের লেখায় সমৃদ্ধ একটি অন্যধরণের পত্রিকা। উচ্চমানের প্রবন্ধ, গবেষণাধর্মী লেখা থাকে। সেসবের রসগ্রহণ করেন বিদগ্ধ পাঠককুল। শিক্ষা নিয়ে পত্রিকার বিশেষ সংখ্যা হচ্ছে। সম্পাদক ভাস্কর বসু বললেন সংগীতশিক্ষা নিয়ে লিখতে। তাঁর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন আর কেউ নন, স্বয়ং সুজন দাশগুপ্ত।
তাঁকেও সদ্যই চিনেছি। নিউ জার্সির এক লেখক গ্ৰুপের সান্ধ্য জমায়েতে এসেছেন সুজন ও শমীতা দাশগুপ্ত। আয়োজক নিউ জার্সির সর্বজনশ্রদ্ধেয় বয়োজ্যেষ্ঠ দেবজ্যোতি চ্যাটার্জি, দীর্ঘদিন ধরে লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত। আদর করে ডেকে নিয়েছেন আমাদের মত দুই অর্বাচীনকে। অদিতি ঘোষ দস্তিদার ও আমি হাওয়ায় ভেসে, উৎসাহের সাগরে সাঁতার কেটে পৌঁছে গেছি সেই অনুপম লেখকসভায়। সেখানেই মুগ্ধ নয়নে চেয়ে চেয়ে দেখেছি অনন্য এই জুটিকে। সুশীল, সুভদ্র মানুষটি সুজন তো অবশ্যই, সুভাষ নামে তাঁকে বোধহয় একটু বেশিই মানাত। শমীতাদি ঔজ্জ্বল্য ছড়াচ্ছেন তাঁর জ্ঞান আর ব্যক্তিত্ব দিয়ে। আর সুজনদার আলো যেন হিরের দ্যুতি। সরস আলাপচারিতায় মুহূর্তের জন্যে ঝলকে ওঠে, চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়ার বদলে সোজা মনের ভেতরে ঢুকে পাকাপাকি আসন পাতে।
সেই প্রথম দেখা। সে সম্মোহন থেকে আর বেরোতে পারি না। দুই সখি মিলে বলেই চলি আর বলেই চলি! তারপর প্রায় বছরখানেক কেটেছে। তাঁর এবং শমীতাদির সান্নিধ্যে এসেছি। ঝরনাতলার নির্জনে আমাদের মাটির কলস উপচে পড়েছে। সে যে কী অনির্বচনীয় প্রাপ্তি! জীবনের পরম ধন – লেখায় তাকে ধরি সাধ্য কী?
তারপর এমন একটা প্রস্তাব! অবসরে লেখার আহ্বান! স্বপ্নেও কি ভেবেছি? তবে হ্যাঁ, গোপনে গোপনে সূক্ষ্ম একটু কলার-তোলা তো আছেই! বলতে নেই, চল্লিশ বছরেরও বেশি সংগীতের শিক্ষা একই গুরুর পায়ের তলায়। কিছু তো লিখতে পারবই!
মুশকিলটা বেধেছে শুরুয়াত নিয়ে। অভিজ্ঞতা ও শিক্ষা বলে, পাঠককে লেখার মধ্যে ঢোকাতে না পারলে সব গেল! মানুষ পড়বেই না। অর্থাৎ, চমকপ্রদ এমন কোনো জিনিস প্রথমেই নিয়ে এস, যাতে পাঠক কৌতূহলী হয়ে পড়তে শুরু করেন। কোথায় পাব তারে, খুঁজে বেড়াই এখান-সেখান। সম্ভব অসম্ভব সবার কাছে। কিছুতেই মনোমত জিনিসটি মেলে না। অবসরের জন্যে সেরা লেখাটিই যে বার করে আনতে হবে! যেমন তেমন হলে চলবে না।
“সুজনদার সঙ্গে কথা বলেছ?” সখি অদিতি জিজ্ঞেস করে।
সুজনদা? বিরাট পরিধি, বিশাল ব্যাপ্তি, সন্দেহ নেই। কিন্তু শাস্ত্রীয় সংগীত? আমি হেন পুঁটিমাছের অন্তরে সন্দেহ, দ্বিধা। তবুও জিজ্ঞেস করি নাহয় একবার!
দেখা গেল, কমলহিরের সন্ধান মিলল তাঁর কাছেই।
নিজের কাছে নিজেই মুখ লুকিয়ে বাঁচি না। মধ্যবয়সে এসেও যে অহংকার যায় না! কোথায় কোন কোণে যে একফোঁটা হলুদগুঁড়োর মত লেগে থাকে, নিজেও বুঝে উঠতে পারি না, যতক্ষন না সুজনদার মত একজন হিমালয় চোখের সামনে আসেন!
তাঁর কলম্বাস শহরের অভিজ্ঞতা দিয়েই শুরু হল আমার সংগীতশিক্ষার প্রবন্ধ। সে কাহিনি যতটাই সরস, ততটাই শিক্ষণীয়। তাকে ভিত্তি করেই ধাপে ধাপে অনায়াসে এগোল লেখা। একে একে বলছি শাস্ত্রীয় সংগীতের তাত্ত্বিক দিকগুলি। খেয়াল রাখতে হচ্ছে তা যেন সবার বোধগম্য হয়। লেখা শেষ করে সুজনদাকে পড়তে দিলাম। মতামতের অপেক্ষায় আছি। অগাধ বিশ্বাস তাঁর ওপর।
“বোঝা যাচ্ছে? সুজনদা?”
“তাল, লয়, সুর, খুব সহজ করে বুঝিয়েছ,” উৎসাহ তাঁর ভাণ্ডারে সবসময়ই মজুত, “শ্রুতিজাতি পড়লাম মন দিয়ে। ব্যাপারটা কিন্তু খুব চিত্তাকর্ষক!”
“পড়লেন?” আমি উল্লসিত, কারণ লিখে শ্রুতিজাতি বোঝানো খুব সহজ নয়। অথচ তাকে বাদ দিই বা কী করে? গান তো শুধু সুরে গাইলেই হয় না, বিভিন্ন অনুভূতিকে প্রকাশ করতে গেলে একই স্বরের স্বরক্ষেপণ বদলে বদলে যায়। সেটিই শ্রুতিজাতি।
“তুমি যে পাঁচটি শ্রুতিজাতির কথা লিখেছ, ওগুলো যদি একটু করে গেয়ে শোনাও, তাহলে পাঠক আরো ভালো করে বুঝতে পারবে।” সুচিন্তিত মতামত তাঁর।
মাথায় বিদ্যুৎঝলক! এমন তো ভাবিনি?
“সুজনদা, লেখার সঙ্গে অডিও ক্লিপ দেওয়া যায়?”
“টেকনোলজির দুনিয়ায় সব হয়।” আমি এখন শুনতে পাচ্ছি এক প্রতিভাধর টেকনোক্র্যাটের প্রত্যয়ী গলা, মনে পড়ে যাচ্ছে, নব্বইয়ের দশকে ইনি ভারতের মোবাইল কমিউনিকেশন টেকনোলজিতে বিপ্লব এনেছিলেন! সে সময় তাঁদের মত একঝাঁক প্রযুক্তিবিদের সাহায্যে সমুদ্রের তলা দিয়ে কেবল লাইন টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, ওয়্যারলেস যোগাযোগ প্রযুক্তির সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে দেশ। মনে পড়ে যাচ্ছে তাঁর শূন্য থেকে শুরু করে কম্পিউটারে প্রোগ্রাম লিখে বাংলা হরফ তৈরি করার ইতিহাস! সে সময় ইউনিকোড কোথায়!
আমি রোমাঞ্চিত হচ্ছি, নতুন দিশা দেখতে পাচ্ছি!
পাঁচটি শ্রুতিজাতি গাইলাম এবং লেখার সঙ্গে সেগুলি সুন্দর সাজিয়ে প্রকাশ করলেন অবসর পত্রিকা, যার অন্তরালে সুজন দাশগুপ্তের উজ্জ্বল উপস্থিতি!
পাঠকের আদর পেয়েছিল লেখা ও গানের এই মেলবন্ধন।
সেই প্রথম। তারপর এই শৈলী অনুসরণ করে বারবার লিখেছি, গেয়েছি। উদ্ভাবক ছিলেন তিনি। সময়ের কত আগে যে চলেছেন, ভেবেছেন, অপার বিস্ময়ে শুধু চেয়ে থেকেছি।
এবার তিনি অপরিহার্য। সংগীত নিয়ে কোনো কিছু লিখতে গেলেই আগে তাঁর সঙ্গে আলোচনা মাস্ট। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় শুধু শাস্ত্রীয় সংগীত গাইলে কীরকম হত? পারস্পরিক মত বিনিময়ে কেটে যায় বেলা, তাঁর অভিজ্ঞতার সম্পদে ভরে ওঠে আমার ভান্ডার। আমার স্থির বিশ্বাস হয়, সব ব্যাপারেই তিনি কিছু না কিছু জানেন।
“সলিল চৌধুরীর গানে মোজার্টএর সিম্ফনি কেমন শুনিয়েছিল সুজনদা? বাঙালি কী বলেছিল তখন?”
“রাহুলদেবকে নিয়ে কিছু বলুন না সুজনদা? একই পাড়ায় থাকতেন না আপনারা?”
দ্বিতীয় প্রশ্নটির উত্তরে সস্নেহ হেসে বললেন, “এই মেয়েটা হাঁড়ির কথাগুলো সব টেনে বার করে নিচ্ছে। বলি শোনো, তবে সবকিছু লিখো না বাপু!”
শোনালেন শচীনকত্তার সাদা ফিনফিনে ধুতিপাঞ্জাবি পরে প্রাতর্ভ্রমণ আর স্কুলছাত্র রাহুলদেবের কথা। গালে হাত দিয়ে একমনে শুনি আর কুড়িয়ে নিই অমূল্য রসদ। তিনি কিন্তু আড়ালেই থাকেন।
অন্তরালবর্তিনী শব্দটির পুংলিঙ্গ হয় কি? ব্যাকরণে নিশ্চয়ই হয়। বাস্তব জীবনে এই শব্দের নির্মাণ দেখেছি সুজন দাশগুপ্তের মধ্যে। কেমন করে? গল্প শোনাই একটু।
তাঁর নিজের ভাষায় তিনি ক্লাসের সব পড়ুয়ার পিছনে। কেমন করে যে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে প্রযুক্তিবিদ্যার সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে একেবারে পি এইচ ডি করে ফেললেন, তাঁর নিজেরও জানা নেই! এসব নাকি হওয়ারই ছিল না! তবু যখন হল, কুঁজোরও তো একবার চিত হয়ে শুতে সাধ যায়! সেই বাসনায় ভিজিটিং কার্ডে নিজের নামের আগে ‘ডক্টর’ কথাটি জুড়ে দিয়েছিলেন, পাক্কা দশটি ডলার খরচ করে। এতেও সন্তুষ্ট না হয়ে নামের পরে এক এক করে লিখলেন ডিগ্রিগুলি, বি এম ই, এম এম ই – যেগুলি নাকি তিনি পাওয়ার যোগ্যই ছিলেন না! তারপর একদিন বেল ল্যাব নামের বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠানে চাকরি পেলেন, আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল-এর নাম জড়িয়ে আছে যার সঙ্গে। সেখানে আবার নোবেল লরিয়েট বিজ্ঞানীর ছড়াছড়ি! প্রথম দিন আপিসে যেতেই তাঁর ম্যানেজার কার্ড দেখে বললেন, “শোনো হে ছোকরা, বেল ল্যাব-এ তোমার মত আড়াই হাজার পি এইচ ডি আছে আর বেশ কিছু নোবেল লরিয়েট। কেউই নামের সামনে পিছনে এসব লেখে না। নামের আগে ডক্টর লেখেন একমাত্র আমাদের প্রেসিডেন্ট, জিম ফিস্ক।”
পয়লা রাতেই বেড়াল মরল। সুজন দাশগুপ্ত সব কার্ডগুলো ট্র্যাশে ফেলে দিয়ে ঝাড়া হাত-পা হলেন। দশ ডলার গাঁটগচ্চা গেল বটে, কিন্তু বদলে মিলল লেজুড়বিহীন হালকা ফুরফুরে পরিচয়, যা আজীবন সযত্নে বয়ে এসেছেন, যার সুবাসে সুরভিত হয়েছে তাঁর চারপাশের মানুষজন।
তবে একটা কথা, নিজের দাশগুপ্ত পদবীটির বদলে যদি “সুজন দাশ দাশগুপ্ত” লিখতে পারতেন, তো বেশ হত। এ তাঁর নিজেরই কথা। হবে নাই বা কেন, শমীতা দাশ দাশগুপ্ত নামের সূর্যের কিরণে উজ্জ্বল হয়ে থাকতেন যে সব সময়! অপরিচিত কেউ তাঁর পদবী ভুল করলে তাই ভুলটা আর ভাঙাতেন না।
তাঁকে নিয়ে কী যে লিখি আর কীই বা না লিখি!
“তোমারই গরবে গরবিনী আমি, রূপসী তোমারই রূপে” – এ যে কোনো পুরুষের কথা, তা সুজনদাকে দেখার আগে বুঝিনি। এমন করে নিজেকে সবার নিচে, সবার পিছে রাখা যায়? তুলে আনা যায় জীবনসঙ্গিনীর প্রতিভা, বলা যায়, “আমার লেখা বুই (শমীতা)-এর তুলনায় একেবারেই এলেবেলে!” বা “বুই যে কী অসম্ভব দুঃসাহসী কাজ করেছে সারাজীবন, কত মানুষের সহায়, কেউ জানেই না।”
“আপনিই জানান না সুজনদা? আপনি ছাড়া আর কে-ই বা সবটুকু বলতে পারবে?” আমরা সশ্রদ্ধ বিস্ময়ে বলতাম। লিখতেন তিনি কিছু কিছু।
এখন সেসব কে লিখবে সুজনদা? আপনার মত করে কে তুলে আনবে এক অনন্যাকে?
এই মুহূর্তে আমার চোখ ঝাপসা। কম্পিউটারের কিবোর্ড ছুঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে।
কেন এই লেখা লিখতে হবে আমায়? কেন আমার কাছে জানুয়ারির একটা অভিশপ্ত বুধবারের সকালে অমন একটা ফোন আসবে? আমি তো প্ল্যানিং সেশনে, আবু ধাবির পাম ট্রির সাজানো ছায়ায় আরেকটা লম্বা দিনের জন্যে তৈরি হচ্ছি। হাঁটছি করিডোর দিয়ে, পাঁচ নম্বর ঘরে যাব, সকালের প্রথম সেশন। ফোন বাজছে, শমীতাদি ফোন করছে দেখছি। আচ্ছা, কল ব্যাক করে নেব, সেশনটা সেরে নিই। হাঁটছি, হোয়াটস্যাপএ মেসেজ ঢুকল। তিনটি শব্দ। আমার পা নড়ে যাচ্ছে, কুয়াশায় ঢেকে যাচ্ছে সাজানো মরুশহর, এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে আমার অস্তিত্ব!
“শমীতাদি!!!!!”
আকাশ আচ্ছন্ন হয়েছিল, থেমে গিয়েছিল সময়, আমি ছিলাম না আমার মধ্যে।
কেন হবে এসব? মানি না সময়কে। আমার পৃথিবী থেমে থাক আঠারোই জানুয়ারির আগের রাতে। আমি প্রতীক্ষায় থাকি একটা পরিচিত গলার ফোনের, “এই সংগ্রামী, কেমন আছ?”
10 Comments