মুক্তিপথের অগ্রদূত: হ্যারিয়েট টাবম্যান জন্মদ্বিশতবর্ষে শ্রদ্ধা
কতই বা বয়েস মেয়েটির। এগারো বা বারো। তবু গেল ছুটে পলাতক ক্রীতদাসটিকে বুক দিয়ে আগলাতে। হিংস্র মালিকের ছোঁড়া সিসার গোলা থেকে বাঁচাতে আড়াল করতে গেল।
মনে হচ্ছে তো, গল্প লিখছি মধ্যযুগীয় বর্বরতার? না পাঠক, একেবারেই নয়। সময়কাল হিসেবে উনবিংশ শতাব্দী তখন সদ্যযৌবনা। আর স্থান আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র।
সময় বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে? ব্রিটিশ ভারতে সবে জন্মেছেন বীরসিংহের সিংহ শিশুটি।
তবে এই কালো মেয়েও বীরাঙ্গনা। প্রতিবাদে গর্জে উঠেছে, ঝাঁপিয়ে পড়েছে, সারাজীবন আগলেছে নিপীড়িত মানুষকে। আসছি একে একে সেসব কথায়।
সত্যি বলতে কী মেয়েটা অত্যাচার দেখছে আর সহ্য করছে তো বলতে গেলে সেই জ্ঞান হওয়া ইস্তক। বাবা মা দুজনেই মেরিল্যাণ্ডের তুলো বাগানের দাস। মা উদয়াস্ত করে রান্না আর বাবা কাঠ চেরাই। ভাইবোন মিলে ছিল তো আটটি… তারপর একটি একটি করে হারাধনের ছেলেদের মত কমে যায় কী করে যেন রাতের অন্ধকারে! শোনা যায় বিকিয়েছে তারা মানুষ বেচা কেনার বাজারে।
পাঁচ বছর বয়েস থেকে মেয়েটা করছে বাচ্চা ধরার কাজ। সাদা চামড়ার সাহেব আর মেমসাহেবের বাচ্চা। সে শিশু একটু কাঁদল কী না কাঁদল তার বাপ মা কষিয়ে দিল মেয়েটার গায়ে ঘা কয়েক চাবুকপেটা। দগদগে ঘা সারা শরীরে।
সারাজীবন সেই ঘায়ের দাগ মেয়েটার মন আর শরীর জুড়ে ছিল। তাই প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে গেছে অত্যাচারিতদের বাঁচাতে, রক্ষা করতে।
তো সেই পলাতক দাসটিকে বাঁচাতে গিয়েই.. ওই যা বলছিলাম এই লেখার গোড়ায়, সেই ছুটন্ত গোলা কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যভেদ করতে পারল না বটে, কিন্তু রেহাই দিল না রক্ষাকর্ত্রীকে। ফেটে গেল তার মাথার খুলি, রক্তে আর ঘিলুতে মাখামাখি চারদিক। জ্ঞানহারা মেয়েটিকে লোকে ধরাধরি করে শুইয়ে দিল তাঁত ঘরে। কখন যেন ঘুমিয়ে পড়ল সে।
জোর জান, তাই বেঁচে গেল সে যাত্রায়। কিন্তু সারাদিন কী যেন বিড়বিড় করে, বাকি সময়টা ঘুমোয়। এ মেয়ের দ্বারা কী কাজটা হবে শুনি?
তাই সে মেয়ের বাজারদর গেল পড়ে। তাকে আর কেউ দাস হিসেবে নিতে রাজি নয়।
শরীর সারতে সময় লাগল অনেক দিন। দশ দশটা বছর কেটে গেছে এতদিনে। এবার মেয়েটার বাবা মুক্তি পেল দাসত্ব থেকে। মায়ের চাকরি বদল হল। পুরনো মালিকের শর্ত অনুযায়ী ছেলেমেয়েরা আর মা এখন মুক্ত। কিন্তু নতুন তুলো বাগানের মালিক মানল না সেই নিয়ম। মা মেয়ে আর বাকি যে দু তিনজন ভাই বোন ছিল তারা সবাই মিলে আবার পরল দাসত্বের শৃঙ্খল।
বছর চারেক পর মেয়েটা বিয়ে করল এক স্বাধীন কালো মানুষকে। কিন্তু ও মাগো! দুনিয়ায় কি ভালো মানুষের সত্যিই অভাব! বিয়ের দু এক মাসের মধ্যেই খবর পেল তার ঘরের লোক বিক্রি করে দিতে চায় মেয়েটির ছোট ছোট ভাইদুটিকে।
নাহ! এবার পালাতেই হবে। ভাইদুটিকে নিয়ে পালাবার প্ল্যান করল মেয়েটি। তলে তলে অনেকদিনই সে সন্ধান রেখেছে ‘পাতাল রেলপথের’ বা underground railroad’ এর। না না পাঠক আপনি যা ভাবছেন তা নয়। এ রেলরোডে ট্রেন চলে না, এ হচ্ছে মানুষের সঙ্গে মানুষের নেট ওয়ার্কিং। শঙ্খ কবির সেই বেঁধে বেঁধে থাকার বাস্তব রূপ। এক মানুষ আশ্রয় দেয় পালিয়ে আসা দাসেদের…তারপর আরো এক সমব্যথী মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করায়, তারপর একের পর এক। নিয়ম মেনে রিলে রেস খেলার মত। পালিয়ে একেবারে মুক্তপৃথিবীতে ক্রীতদাসেরা যেন চলে যেতে পারে তার জন্যেই ঐকান্তিক চেষ্টা আর সাহায্য।
মেরিল্যান্ড প্ল্যানটেশন থেকে পালাল তিন ভাই বোন। কিন্তু ভাইদুটি ভয় পেয়ে গেল ফিরে। মেয়েটা আর পেছন ফিরল না। নব্বই মাইল উত্তরে হেঁটে এসে পৌঁছল স্বপ্নের রাজ্য পেনসিলভানিয়াতে, যেখানে দাসপ্রথা বিলুপ্ত হয়েছে প্রায় সত্তর বছর আগে।
কাজ পেল ফিলাডেলফিয়া শহরে এক বাড়িতে, পরিচারিকার কাজ, মুক্ত এখন সে।
কিন্তু শুধু নিজের মুক্তিতে কি সন্তুষ্ট থাকলে চলে? শয়নে স্বপনে জাগরণে তো শুধু ভেসে ওঠে যন্ত্রণা আর নিপীড়নের দৃশ্য।
তাই চলল ফিরে আবার দক্ষিণে। একবার, দুবার, বার বার। প্রাণের ভয় তুচ্ছ করে একের পর এক মানুষকে মুক্ত পৃথিবীতে আনার কাজ শুরু হল।
কত রকমই না ফন্দি বের করেছিল মেয়েটা। পালাত মালিকের ঘোড়া বা ঘোড়ার গাড়ি নিয়ে, যাতে সহজে কেউ অবিশ্বাস না করে। একবার খবর পেল, মালিকপক্ষ জানে যে সে একেবারে নিরক্ষর। তাই সঙ্গে রাখতে শুরু করল মোটা মোটা বই, মাঝে মাঝেই সেগুলো খুলে ভান করে পড়ার – যাতে না লোকে ভাবে যে এই মেয়ে সামান্য মূর্খ দাসী!
বাবার কাছে ছোটবেলায় অনেক রকম ভেষজ গাছ গাছড়ার ব্যবহার শিখেছিল মেয়েটা। কাজে লাগাল সেই বিদ্যেও অসুখে বিসুখে সুবিধে অসুবিধেয়। ছোটো বাচ্চাগুলোকে নিয়ে পালাতে গেলে যদি কখনও কেঁদে ওঠে, তাই ওদের ঘুম পাড়ানোর জড়িবুটি খাইয়ে চুপিচুপি পালিয়ে যাওয়া মাইলের পর মাইল।
পালাত ঠিক শনিবারে, কারণ নিরুদ্দেশ সম্পর্কিত ঘোষণা প্রকাশ হতে হতে তো সেই সোমবার, ততদিনে তো সে দলবল নিয়ে পগার পার।
তবে যাদের জন্যে এত খাটুনি তাদের সবার তো আর মেয়েটার মত মনের জোর নেই। দীর্ঘদিনের অত্যাচার ভেঙে দিয়েছে তাদের শরীর, মন। তাই তারা ফিরে যেতে চায় আবার সেই দাসত্বেই। হাতে বন্দুক তুলে নেয় মেয়েটি। ভয় দেখায়, “হয় চলো, নয় মরো। ফিরে যাওয়া চলবে না!”
শাসনে সোহাগে বুক দিয়ে আগলে পথ চলে, উত্তরের রাজ্যগুলোতে এনে ফেলতে পারলেই তো মুক্তি পাবে মানুষগুলো!
আমেরিকার দক্ষিণের রাজ্যগুলির ক্রীতদাসরা যদি কোন রকমে উত্তরের দাসত্ব মুক্ত রাজ্যগুলি মানে, ম্যাসাচুসেটস, রোড আইলান্ড,নিউ হ্যাম্পস্যায়ার, ক্যানেক্টিক্যাট, নিউ জার্সি, নিউ ইয়র্কে পালিয়ে আসতে পারতেন তবে আর দাসত্ব পালন করতে হত না। মেয়েটা তাই গোপনে নিয়ে আসত সবাইকে এই সব রাজ্যে।
কিন্তু 1850 সালের নতুন পলাতক ক্রীতদাসদের আইন আবার দিল মেয়েটাকে জোর ধাক্কা। নিয়ম হল পালিয়ে আসা দক্ষিণের রাজ্যের ক্রীতদাসদের উত্তরের রাজ্যগুলিকে অবশ্যই ফিরিয়ে দিয়ে আসতে হবে তাদের নিজেদের জায়গায়। বলাই বাহুল্য তার মাশুল হিসেবে অত্যাচারের পরিমাণ হবে সহস্রগুণ। তাই বদলাতে হল কৌশল।
এবার লক্ষ্য পাশের দেশ কানাডা। অল্প অল্প করে কয়েকশো মানুষকে নিয়ে আসে সে। উনিশ বার এই যাতায়াত ‘সুড়ঙ্গ রেলপথের’ সাহায্যে। ধরা পড়ার ভয় প্রতি মুহূর্তে। বিশেষ করে সেই যে সেবার যখন আনল বুড়ো বাবা মাকে! সরকার ঘোষণা করেছে মাথার দাম প্রথমে 12 হাজার মার্কিন ডলার, পরে বাড়িয়েছে সেটা 40 হাজারে। কিন্তু ধরা পড়ল না মেয়েটা। কেউ কি জানে কখন সে কী রূপে আসে? ছদ্মবেশ ধরে পুরুষের, কখনও বা অশীতিপর বৃদ্ধার। আর যাঁরা সত্যিই জানেন তার চেহারা তাঁরা দেবেন ধরিয়ে? কক্ষনো নয়! তাঁদের কাছে সে যে স্বাধীনতাদাত্রী দেবী!
এই অসমসাহসিনী সমুদ্রের মত বিশালহৃদয়া প্রতিবাদী মেয়েটি, বিশ্বের কাছে পরিচিত হ্যারিয়েট টাবম্যান নামে। তাঁর জীবনীকার সারা ব্র্যাডফোর্ডের বর্ণনা অনুযায়ী আমরা জানতে পারি প্রায় তিনশো কালো মানুষকে তিনি একে একে নিয়ে এসেছিলেন মুক্ত পৃথিবীতে। একটি ক্ষেত্রেও ব্যর্থ না হয়ে। তাঁর নিজের ভাষায় “I never ran my train off the track, and I never lost a passenger.”
1861 সালে যখন আমেরিকায় দাসপ্রথা অবসানের জন্য আমেরিকা ইউনিয়ন বা যুক্তরাষ্ট্র আর দক্ষিণের ১১টি বিরোধী রাজ্যের কনফেডারেটের গৃহযুদ্ধ শুরু হয়, হ্যারিয়েট নামলেন নতুন রূপে দাসত্বের বিরুদ্ধে লড়াই করতে। ফোর্ট মনরোতে পলাতক ক্রীতদাসদের সহায়তা করার জন্য তিনি নিযুক্ত হলেন। রোগীসেবা, রান্না, কাপড় জামা কাচা সব কাজ একাহাতে সামলালেন। অসুস্থ সৈন্য এবং পলাতক ক্রীতদাসদের চিকিৎসার জন্য কাজে লাগালেন ছোটবেলায় শেখা ভেষজ ওষুধের জ্ঞান। 1863 সালে, হ্যারিয়েট ইউনিয়ন সেনাবাহিনীর জন্য গুপ্তচরবৃত্তিও করেন। তিনি কনফেডারেটের সেনা সরবরাহ রুট এবং সৈন্যদের সম্পর্কে ইউনিয়ন কমান্ডারদের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রদান করে প্রভূতভাবে সাহায্য করেছিলেন।
গৃহযুদ্ধের পর, হ্যারিয়েট নিউইয়র্কের অবার্নে তাঁর নিজের জমিতে বসবাস শুরু করেন। তিনি 1869 সালে বিয়ে করলেন প্রাক্তন ক্রীতদাস এবং গৃহযুদ্ধের অভিজ্ঞ নেলসন ডেভিসকে (তাঁর প্রাক্তন স্বামী 1867 সালে মারা গিয়েছিলেন)। কয়েক বছর পরে হ্যারিয়েট গার্টি নামে একটি ছোট মেয়েকে দত্তক নেন।
হ্যারিয়েটের দরজা ছিল সকল সাহায্যপ্রার্থীর জন্যে খোলা। বাড়িতে উৎপাদিত সবজি বা ফল বিক্রি করে, শূকর পালন করে আর বন্ধুদের কাছ থেকে অনুদান এবং ঋণ গ্রহণ করে প্রাণপণে চালিয়ে গেছিলেন সব রকম জনহিতকর প্রচেষ্টা। নিজে নিরক্ষর হলেও সোচ্চার হয়েছিলেন মহিলাদের ভোটাধিকার দাবিতে এবং প্রখ্যাত ভোটাধিকার নেতা সুসান বি অ্যান্থনির সঙ্গে প্রচুর কাজ করেছিলেন। 1896 সালে, হ্যারিয়েট তার বাড়ির সংলগ্ন জমি কিনে বয়স্ক এবং অসহায় কালো মানুষের জন্য হোম খোলেন।
এত কিছু কাজের মধ্যেও ছোটবেলার সেই মাথার আঘাত কিন্তু সঙ্গ ছাড়েনি। শেষ জীবনে হল মস্তিষ্কের অস্ত্রোপচার। কিন্তু তার পর থেকেই ক্রমাগত স্বাস্থ্যের অবনতি হতে থাকে। 1911 সালে চলে যান তাঁর নিজের নামের হোমে। এরপর 10 মার্চ, 1913 তারিখে নিউমোনিয়া কেড়ে নিল হ্যারিয়েট টাবম্যানের জীবন। কিন্তু তাঁর এই লড়াই স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকল পৃথিবীর ইতিহাসে। তাঁর জীবনের ওপর লেখা হয়েছে বিভিন্ন বই, তৈরি হয়েছে চলচ্চিত্র এবং তথ্যচিত্র।
এই বছর অর্থাৎ ২০২২ সাল তাঁর জন্মদ্বিশতবর্ষ।
তাঁর কীর্তিকলাপকে শ্রদ্ধা জানাতে তাঁর প্রতিকৃতি অঙ্কিত মুদ্রা বা কয়েন তৈরি করেছেন আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের টাঁকশাল।
তথ্যসূত্র
Clinton, Catherin. Harriet Tubman, The Road to Freedom. New York: Back Bay Books, 2005.
Bradford Sarah. Harriet, The Moses of Her People. New York: Dover Publications, 2007.
সঙ্গের ছবিটি অন্তর্জাল থেকে নেওয়া