রবে নীরবে, হৃদয়ে মম

রবে নীরবে, হৃদয়ে মম

২০১১ সালটা বাঙালির কাছে ছিল বেশ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ওই বছরটি ছিল বেশ কয়েকজন বাঙালি মনীষীর জন্মসার্ধশতবর্ষ – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, নীলরতন সরকার, কাদম্বিনী গাঙ্গুলি। নানা বিজ্ঞান পত্রিকায় এঁদের নিয়ে লেখালেখি করছিলাম। আগরতলা থেকে প্রকাশিত “জ্ঞান বিচিত্রা” পত্রিকাতে প্রকাশিত হয়েছিল কাদম্বিনী গাঙ্গুলিকে নিয়ে আমার লেখা একটি প্রবন্ধ। সেই সময়কালে ইন্টারনেট ও মোবাইল ফোনের বহুল ব্যবহার শুরু হয়ে যাওয়ায় মাঝে মাঝে পাঠকের মতামত পাচ্ছিলাম ফোনে বা ই-মেইলে। ততদিনে ব্যক্তিগত চিঠিপত্র লেখার প্রচলন পুরোপুরি হারিয়ে গিয়েছে। বাড়িতে পিওনের দেখা পাওয়া যেত ব্যাঙ্কের চেকবই বা কোনও বিমা সংক্রান্ত কাগজপত্র পৌঁছে দেওয়ার জন্য।

কিন্তু সেদিন বিস্মিত হলাম স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে সাধারণ ডাকে আসা একটা খাম পেয়ে। দিনটা ছিল সম্ভবতঃ ৮ জুলাই, ২০১১, শুক্রবার। সাদা অফিস খামের মধ্যে চিঠি। কিন্তু কার? স্পষ্ট অক্ষরে নীল কালিতে লেখা আমার নাম ও ঠিকানা। আর খামের বামদিকে একটু নীচে লেখা – “প্রেরক, শঙ্কর সেন, কোলকাতা।” কে শঙ্কর সেন? কী আছে খামে? খাম ছেঁড়ার আগে মনে নানা ভাবনা ঘুরতে শুরু করল। এ কোনও জ্যোতিষী নয়তো? হুমকি দিয়ে চিঠি লেখেনি তো? কারণ, ২০০১ সালে অন্য এক পত্রিকায় জ্যোতিষ বিরোধী প্রবন্ধ লিখে কয়েকজন জ্যোতিষীর কাছ থেকে হুমকি-চিঠি পেয়েছিলাম। অবশ্য সেগুলো ছিল সবই পোস্টকার্ডে। এতদিন পরে কি ওই বিষয়েই কোনও এক জ্যোতিষী শঙ্কর সেন হুমকি দিয়েছে? ভাবতে ভাবতে খুলেই ফেললাম খাম। দেখি ছাপানো রাইটিং প্যাডে লেখা আড়াই পাতার একখানি চিঠি।

চিঠিটি ৩ জুলাই ২০১১ তে লেখা। চিঠির আংশিক বক্তব্য এইরকমঃ

‘“অসামান্যা বঙ্গকন্যা” শ্রীমতী কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়-এর জীবনী অনেক জায়গাতেই পড়েছি – কিন্তু ‘জ্ঞান বিচিত্রা’-য় আপনার লেখাটি পড়ে বিশেষ ভালো লাগলো – কারণ লেখাটি সার্বিক। এর জন্য আমার শ্রদ্ধা গ্রহণ করবেন।

Dec 19, 2010 তারিখে ইংরাজী সংবাদপত্র ‘টেলীগ্রাফ’-এ একটি লেখা বেরিয়েছিল যেটায় কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়ের বিষয়ে Florence Nightingale-কে যুক্ত করা হয়েছে; এই referenceটা অন্য কোথাও পাইনি; আপনার জ্ঞাতার্থে নীচে দিলাম – যদি আপনার কাজে লাগেঃ

………………………………………

এই প্রসঙ্গে আমার একটি প্রস্তাব আপনার কাছে রাখছি। ২০০২ খ্রী-র জানুয়ারি মাস থেকে আমার দুই (আমেরিকাবাসী কৃতি) ছাত্র-এর সহযোগিতায় আমি ‘অবসর’ নামে একটি non-profit Portal শুরু করেছি বাংলায়। আমাদের condition ছিল পৃথিবীর যে কোনও স্থান থেকে এই site দেখা যাবে বিনামূল্যে। অবশ্যই এর মধ্যে কোনও রাজনীতি থাকবে না যার জন্য আমরা সরকারের কোনও অনুদান না নিয়ে আমাদের সাধ্যমতো এটা চালাচ্ছি।

শুনে খুসী হবেন, বর্ত্তমানে প্রতিদিনই ৫০০০-৬০০০ ‘হিট’ হচ্ছে এই পোর্টাল। ‘অবসর’-এ ‘কাদম্বিনী’ সম্বন্ধে একটা ছোট লেখা আছে যেটা ‘ভারতকোষ’ মারফৎ আমরা পেয়েছিলাম।

………………………………………………………………

যদি আপনি অনুমতি দেন তবে যথাযোগ্য acknowledgement মারফৎ [জ্ঞান বিচিত্রা কে] আপনার নামেই লেখাটি দেওয়া হবে। এর ফলে অর্থকরী কোনও লাভ হবে না – তবে প্রচার হবে।

যদি আপত্তি থাকে জানাবেন – আমি কিছুই মনে করবো না।

শুভেচ্ছা ও প্রীতি জানবেন।”

মনে আছে, চিঠিটি পড়ে কয়েকদিন একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম। যে-সে লোক নন, আমাকে লিখেছেন প্রফেসর শঙ্কর সেন, যিনি কিনা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রাক্তন বিদ্যুৎ, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও অপ্রচলিত শক্তি দপ্তরের মাননীয় মন্ত্রী, সিকিম প্ল্যানিং কমিশনের সদস্য এবং আসামের মুখ্যমন্ত্রীর প্রাক্তন শক্তি উপদেষ্টা। আমি কোনও প্রতিষ্ঠিত লেখক ছিলাম না তখন, এখনও নই। শখের বিজ্ঞান-সাহিত্য চর্চা। আর তাই প্রফেসর শঙ্কর সেনের মতো এক নামী ব্যক্তিত্বের চিঠি, তাও আবার দু’চার লাইনের নয়, আড়াই পাতার, আমাকে এক অদ্ভুত ভালোলাগায় আপ্লুত করে রেখেছিল। এমন মানুষ যখন লেখেন যে আমার লেখা তাঁর “বিশেষ ভালো” লেগেছে তখন নিজের লেখার উপর আস্থা জন্মাতে বাধ্য। আমারও জন্মেছিল।

শুধু কি তাই? তিনি আমার জ্ঞাতার্থে সাত মাস আগে প্রকাশিত টেলিগ্রাফ পত্রিকা থেকে একটি নিবন্ধের অংশ লিখেছেন সতেরো লাইন ধরে। আমি তাঁর পূর্বপরিচিত নই। কখনও বাক্যালাপ হয়নি। অথচ সেই তিনি আমাকে সমৃদ্ধ করার জন্য এত প্রবীণ বয়সেও এতগুলো লাইন লিখেছেন। একজন নবীন লেখকের প্রতি একজন খ্যাতিমান প্রবীণ বিদ্বজ্জন এর চেয়ে বেশি আর কী করতে পারেন আমার জানা নেই। আর তাছাড়া, তিরাশি বছর বয়সে গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ পেপার কাটিং করে সংগ্রহ করার শখ এবং তা অচেনা কোনও নবীন লেখককে অবগত করানোর প্রচেষ্টা এক বিরল গুণ বলে আমার বিশ্বাস। প্রফেসর শঙ্কর সেন এই বিরল গুণের মানুষ ছিলেন।

তিনি আরও জানিয়েছিলেন যে ২০০২ খ্রী জানুয়ারি মাস থেকে তাঁর দুই আমেরিকাবাসী কৃতি ছাত্রের সহযোগিতায় তিনি ‘অবসর’ নামে একটি non-profit Portal শুরু করেছেন। তিনি ওই পত্রিকায় আমার নিবন্ধটি প্রকাশ করার অনুমতি চেয়েছিলেন। বলা বাহুল্য, আমি তাঁকে লেখা একটি কৃতজ্ঞতাজ্ঞাপক জবাবি পত্রে নিবন্ধটি প্রকাশ করার সম্মতি জানাই। তারপর, তাঁর পত্রের লেটার হেডে মুদ্রিত মোবাইল নম্বরে ফোন করার জন্য অনেকবার উদ্যোগ নিয়েও শেষ মুহূর্তে বিরত হই স্রেফ নিজের ক্ষুদ্রতার সঙ্কোচে। তাঁর মতো বটবৃক্ষের কাছে আমার মতো একটা নগণ্য তৃণকে কীভাবে উপস্থাপন করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। শেষে, মানসিক জোর বাড়ালাম নিজেকে এই বলে – পাহাড় এসেছে মহম্মদের কাছে, তাহলে মহম্মদ কেন পাহাড়ের কাছে যেতে দ্বিধা করছে? কয়েকদিন পর ফোন করেই ফেললাম। ওপার থেকে ভেসে এলো – শঙ্কর সেন বলছি। তারপর নিজের পরিচয় দিয়ে চিঠির প্রসঙ্গ তুললাম। প্রায় বারো-তেরো মিনিট কথা হল। প্রথমে কথা বলার ক্ষেত্রে আমার জড়তা থাকলেও একটু পরেই তা কেটে গেল।

উনি বললেন, “আমার তো অনেক বয়স হয়েছে, তাই আপনার সাথে দেখা করা সম্ভব হবে না। যদি সম্ভব হয়, কলকাতায় এলে আমার সাথে একবার দেখা করবেন। সবিস্তার আলোচনা হবে।” আমি “তুমি” সম্বোধন করার অনুরোধ জানালেও উনি “আপনি”তেই থেকে যান। এত বড়ো মাপের মানুষ, অথচ উনি আমার কাছে এসে দেখা করতে পারছেন না বলে যেন ‘অপরাধী’! আমাকে তাঁর সাথে দেখা করতে বলার মধ্যে যে কুণ্ঠা অনুভব করলাম তাতে আমি আরও বেশি লজ্জিত ও বিস্মিত হলাম। যাঁরা প্রকৃত অর্থেই বড়ো মাপের মানুষ হন তাঁরা বোধহয় এতটাই সাধারণ হন।

আমি এতটাই অকর্মণ্য ও উদাসীন যে প্রফেসর শঙ্কর সেনের মতো মানুষের সাথে ফোনালাপের কথা কয়েকদিনের মধ্যে বেমালুম ভুলে গেলাম। কেবল তাঁর সেই পত্রটি সযত্নে রক্ষিত করেছিলাম একটি ফাইলে। কিছু দিন পর সেটার কথাও আর মনে রইলো না। এ হল আমার কুখ্যাত স্বভাব – একটা কাজের মধ্যে ডুবে গেলে অপরাপর কথা স্মৃতির অতলে চলে যায়। এতটাই স্মৃতির অতলে চলে গেল যে ফেসবুকের সূত্র ধরে দু’বছর পর যখন তাঁর আমেরিকাবাসী দুই কৃতি ছাত্রের অন্যতম ড. সুজন দাশগুপ্তের সাথে আলাপ হল এবং তাঁর অনুরোধে যখন “অবসর” ওয়েব পত্রিকায় ২০১৪ সালে বিশেষ “রবি-স্মরণ-শ্রবণে, শ্রাবণে” সংখ্যায় প্রথম প্রবন্ধ লিখলাম “বিজ্ঞানের স্পর্শ – গানে, কবিতায়” তখনও একবারের জন্য মাথায় এলো না প্রফেসর শঙ্কর সেনের পত্র বা তাঁর সাথে ফোনালাপের কথা। ক্রমে সুজনবাবুর পাশাপাশি “অবসর”-এর সাথেও সখ্যতা বেড়েছে। ২০১৪ থেকে শুরু করে নানা বিষয়ে লেখা আমার প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে “অবসর”-এ। কিন্তু কী আশ্চর্য, প্রফেসর সেনের কথা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় বা বামফ্রন্ট আমলে বিদ্যুতায়ন প্রসঙ্গে বহুবার অন্যদের সাথে আমার আলোচনায় এলেও তাঁর ও “অবসর”-এর সম্পর্ক এবং তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করার অঙ্গীকারের কথা আর আমার একবারের জন্যও মাথায় এলো না!

৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ তাঁর প্রয়াণের সংবাদ শুনলাম টিভিতে। পর দিন সংবাদপত্রে পড়লাম তাঁর প্রয়াণের সংবাদ। এতদিন পরে তাঁর সাথে আমার সাক্ষাৎ করার অঙ্গীকারের কথা স্মৃতিপটে ভেসে উঠল। নিজের ঔদাসীন্য ও অকৃতজ্ঞতার জন্য নিজেকে চরম ধিক্কার দিলাম। তাঁর সেই পত্রখানি যে কোন ফাইলে রেখেছিলাম তা আর মনেও করতে পারছিলাম না। কয়েক ঘন্টা ধরে অনেক খুঁজে হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দিলাম। তাহলে কি তাঁর লেখা পত্রখানিও আমার উদাসীনতার শিকার হয়েছে! নিজের গালে চপেটাঘাত করতে ইচ্ছে করছিল।

তাঁর প্রয়াণের দু’মাসের বেশি সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পর আমার পুরোনো পেপার কাটিং-এর কভার ফাইলে একটি কাটিং খুঁজতে গিয়ে পুনরাবিষ্কৃত হল প্রফেসর সেনের লেখা সেই অমূল্য পত্রখানি। আবারও নিজেকে চরম ধিক্কার দিলাম। তিনি পার্থিব জগতে নেই – কিন্তু তিনি তাঁর কাজ, তাঁর ব্যক্তিত্ব, তাঁর মতাদর্শের মধ্যে দিয়ে বাঙালির মননে উজ্জ্বল হয়ে রয়েছেন। আমার হৃদয়ে তাঁর ক্ষণিক স্মৃতি নীরব উপস্থিতি হয়ে জাজ্বল্যমান থাকবে আজীবন।

বেড়ে ওঠা, স্কুলের পড়াশুনা কাকদ্বীপে। লেখালেখি,গানবাজনার চর্চা শৈশব থেকেই। ১৯৯২ সালে উদ্ভিদবিদ্যায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি। বর্তমানে কাকদ্বীপের কাছে একটি উচ্চমাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষক। পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চের একজন সক্রিয় সংগঠক। ছড়া, কবিতা, গল্প, নাটিকা, প্রবন্ধ নিয়মিত প্রকাশিত প্রথম সারির বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *