শিল্পে সাহিত্যে সত্যজিৎ: আমার চোখে

শিল্পে সাহিত্যে সত্যজিৎ: আমার চোখে

আমাদের ছোটবেলায় জন্মদিনে বই দেবার প্রচলন ছিল বেশ বেশি। সেবার আমি ক্লাস সিক্স। পাশের বাড়ির টুলুদি দিল ‘যখন ছোট ছিলাম,’ বড়দা দিল, ‘বোম্বাইয়ের বোম্বেটে।’ এভাবেই আমার জীবনে ‘সত্যজিৎ রায়’ প্রবেশ করলেন, তাঁর ফেলুদা, গড়পার, লালমোহনবাবু, তোপসে, পুরনো কলকাতা, সত্যজিতের তোলা ছবি আর তাঁর স্কেচগুলো নিয়ে। এর আগে পর্যন্ত তাঁর পিতা-পিতামহের নামের সঙ্গে পরিচিত হলেও, তাঁর লেখা পড়িনি। 

সত্যজিতের কথা ভাবতে গেলে আজ প্রথম মাথায় আসে সিনেমা। কিন্তু সিনেমার সঙ্গেও লাইনে দাঁড়িয়ে থাকে ফেলুদা, প্রফেসর শঙ্কু, তারিণীখুড়ো, বঙ্কুবাবু, অসমঞ্জবাবুর কুকুর, পাপাঙ্গুল, আর লিমেরিকের মত ছোটদের কবিতা, বিভিন্ন গল্পে তাঁর আঁকা স্কেচ। 

বাঙালির দুই অন্যতম সেরা প্রতিভা সত্যজিৎ এবং রবীন্দ্রনাথের দেখা হয়েছিল শান্তিনিকেতনে। অবশ্যই সত্যজিৎ তখন শিশু। মা সুপ্রভা নিয়ে গেছিলেন পৌষমেলায়। সত্যজিতের মনে সাধ রবীন্দ্রনাথ প্রথম সই দেবেন তার নতুন কেনা অটোগ্রাফের খাতায়। রবীন্দ্রনাথ খাতার পাতায় কবিতা লিখে দিলেন, “বহু দিন ধরে বহু ক্রোশ দূরে…” বললেন,  “এ কবিতা ও আরেকটু বড় হয়ে বুঝবে।” নন্দলাল বসু খাতায় এঁকে দিলেন একখানা বাঘ। বাঘের লেজের মাথায় কালো রঙ করে শিশু সত্যজিৎকে বলেছিলেন, “বাঘটা রান্নাঘরে ঢুকেছিল, তাই ওর লেজ পুড়ে গেছে।” রবীন্দ্রনাথের লেখা কবিতার ফটো দেখেছিলাম ‘যখন ছোট ছিলাম’ বইএর পাতায়। সাথে ঐ লেজপোড়া বাঘখানিরও। সত্যজিৎ তখন শিশু, কিন্তু তিনি সুকুমার রায়ের ছেলে, উপেন্দ্রকিশোরের নাতি। এ পরিচয় জন্মলগ্ন থেকেই তাঁর কপালে তিলক হয়ে রয়েছে। তবে অতি বিখ্যাত পিতা-পিতামহ হলে বহুক্ষেত্রেই সমস্যা দেখা দেয়। কিন্তু তাঁর ক্ষেত্রে এ সমস্যা খুব বেশি দেখা দিয়েছিল বলে মনে হয় না। মাত্র দু’বছর বয়সে বাবা সুকুমার রায় চলে গেছেন কালাজ্বরে। দাদু উপেন্দ্রকিশোরকে তিনি দেখেননি। বড় হয়েছেন মামার বাড়িতে এবং মায়ের কড়া শাসনে। 

বিজয়া রায় ‘আমাদের কথা’ বইতে লিখেছেন, রবীন্দ্রনাথের প্ল্যানচেটে এসে সুকুমার রায়ের আত্মা ছেলের শান্তিনিকেতনে ফাইন আর্টস শেখার ব্যাপারে ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। 

মায়ের ইচ্ছায় এবং নিজের অনিচ্ছায় প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বেরিয়ে ফাইন আর্টস শিখতে সত্যজিৎ যোগ দিয়েছেন কলাভবনে। কলাভবনের শিক্ষাপদ্ধতির অনেক কিছুই পছন্দের না হলেও, শিক্ষক নন্দলাল আর বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের শিক্ষাপদ্ধতি ছিল তাঁর বিশেষ প্রিয়। এর বেশ কয়েক বছর পরে, বিনোদবিহারীকে নিয়ে করা সত্যজিতের তথ্যচিত্র ‘ইনার আই’ দেখলে বোঝা যায়, শরীরের একটি ইন্দ্রিয় না থাকলেও, ভেতরের শিল্পের আগুন কীভাবে কাদামাটিকে পুড়িয়ে শক্ত করে। বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের ম্যুরাল সম্পর্কে সত্যজিৎ বলেছেন, 

…কলাভবন। আশ্রমে পৌঁছানোর পাঁচ মিনিটের মধ্যেই যাঁর ছবি প্রথম চোখে পড়ল তিনি হলেন বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়। কলাভবন হোস্টেলে একটি তিন কামরা বিশিষ্ট নতুন ছাত্রাবাসে আমার থাকার বন্দোবস্ত হয়েছিল। তিন ধাপ সিঁড়ি উঠে বাড়ির সামনের বারান্দায় পা দিতেই, দৃষ্টি আপনা হতেই উপর দিকে চলে যায়। সারা সিলিং জুড়ে একটি ছবি। গাছপালা মাঠ পুকুর মানুষ পাখি জানোয়ারে পরিপূর্ণ একটি স্নিগ্ধ অথচ বর্ণোজ্জ্বল গ্রাম্য দৃশ্য। দৃশ্য না বলে ট্যাপেস্ট্রি বলাই ভালো। অথবা এনসাইক্লোপেডিয়া। 

শ্রদ্ধা, ভালবাসা উপচে পড়ছে ছাত্রের তাঁর শিক্ষক সম্পর্কে মন্তব্যে। আমি এটুকু বুঝি, এমন ছাত্রই শিক্ষকের সম্পদ আর সে-ই পারে শিক্ষকের জ্ঞানসুধাটুকুকে আত্মস্থ করে বিকশিত করতে। 

ফিরে যাই আবার ক্লাস সিক্সে। ‘বোম্বাইয়ের বোম্বেটে’ বইয়ের নামটা বেশ পছন্দ হল। বোম্বাই মানেই তখন ঢিসুম, ঢুসুম হিন্দি সিনেমা, যা দেখা বাড়িতে একেবারেই বারণ। আমাদের ঘরে টিভি নেই। জেঠুদের বাড়িতে গিয়ে শনিবারের বিকেলের বাংলা সিনেমা কখনো কখনো অ্যালাউ করা হলেও হিন্দি নৈব নৈব চ! কোনও একদিন, আমার স্কুল ছুটি, মায়ের স্কুল আছে, বাবার অফিস। বইটা পড়ার সুবর্ণ সুযোগ পাওয়া গেল। শেষ যখন হল, তখন বিকেল। এ বইয়ে বোম্বাই আছে, সিনেমার শুটিং আছে, বম্বের হাইরাইজ আছে (যা আমার ছোটবেলার কলকাতায় বিরল) আর বোম্বেটে তো আছেই। বম্বের এবং শুটিং এর একটা ছায়াচিত্র আমার মাথায় তৈরি হয়ে গেল। এই বইটার মধ্যে একমলাটে ফাউ ছিল, ‘গোঁসাইপুর সরগরম।’ গ্রামের সন্ধেবেলা এবং যদি বিদ্যুৎ না থাকে তাহলে ব্যাপারটা কেমন দাঁড়ায়, সে চিত্রখানাও বেশ পরিষ্কার হল। মনে আছে, এরপর পড়েছিলাম ‘ছিন্নমস্তার অভিশাপ।’ রাঁচি, হাজারিবাগ, রাজরাপ্পার বর্ণনা অবশ্যই এখনকার বাচ্চারা পড়লে মেলাতে পারবে না। কিন্তু আমি রাঁচি দেখেছি আমার ক্লাস থ্রিতে। বেশ মিলে যাচ্ছিল চেনা জায়গাগুলো। তাঁর প্রতিটা ফেলুদা গল্প একটা সাধারণ বুদ্ধিমত্তা, বিচারশক্তি, যাকে আমরা ‘কমনসেন্স’ নামে চিনি – তা যেন কখন তৈরী করে দিয়েছিল। সঙ্গে উপরি পাওনা ছিল সব জায়গার একটা ছোট্ট অথচ স্মার্ট বর্ণনা যা অনেক পরেও সে জায়গায় ঘুরতে গেলে বারবার মনে পড়েছে। 

‘ফেলুদা’ লম্বায় ছয় ফুট চার ইঞ্চি। সত্যজিতের থেকে একটু বেশি হাইট। তার মূল অস্ত্র ‘মগজাস্ত্র।’ যদিও রিভলবার তার আছে। থাকতেই হয় একজন গোয়েন্দার। সে জুডো জানে। সকালে উঠে ব্যায়াম করে। বাঙালি হয়েও ভাতঘুম আর ভয় তার চরিত্রে অনুপস্থিত। কিশোর মনে ছায়া ফেলতে সে বাধ্য। স্বাভাবিক ভাবেই ভালো লাগে। পরে শার্লক হোমস পড়ার সময় বারবার ফেলুদাকে মনে পড়েছে। কিন্তু ফেলুদাকে কখনোই শার্লক হোমসের কপি বলা যাবে না। ‘লন্ডনে ফেলুদা’ গল্পে ফেলুদাই বলছে, “শার্লক হোমস ছিলেন আখেরে সব গোয়েন্দার গুরু।” এভাবেই আমার কিশোর মনে ফেলুদা যে জায়গাটা করে নিল, আজ তার নাম নস্টালজিয়া। সেকালের কিশোর কিশোরীদের নস্টালজিয়ায় ভর করেই সম্ভবত সোশ্যাল মিডিয়াতে অনেকগুলো ‘ফেলুদা ক্লাব’ জন্ম নিয়েছে।  

তখন মনে হত, আমি বিপদে পড়লেই, আমার দরকার হলেই ফেলুদা বইয়ের পাতা ফুঁড়ে বেরিয়ে আসবে! শুধু একটা চিনচিনে কষ্ট। ঐ তোপসেটাকে নিয়ে। তোপসের জায়গায় নিজেকে বসাতে কেমন যেন লাগে! একটা বোন কেন নেই ফেলুদার? কেন সব জায়গায়ই যাবে একা তোপসে? মেয়েরা কি গোয়েন্দার সাগরেদ হতে পারে না একেবারেই? 

সত্যজিৎ আবোল-তাবোল আর হযবরল’র লেখক সুকুমার রায়ের ছেলে। উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী ছিলেন তাঁর ঠাকুর্দা। এগুলো জেনে ফেলেছিলাম ‘যখন ছোট ছিলাম’ বইটা হাতে পেতেই। উপেন্দ্রকিশোর সমগ্র আর সুকুমার সমগ্র বই তার অনেক আগেই মা কিনে দিয়েছিল আমায়। সত্যজিৎকে সেই স্রোতে মিশিয়ে দিলাম। অনেক ছোটবেলায় পড়া বই ‘যখন ছোট ছিলাম’ আবার পড়েছিলাম, অনেকটা বড় হয়ে। আমার বিশ্বাস তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছে, গড়পারের ইউ এন রে এন্ড সন্সের বাড়ি এবং ভবানীপুরের মামাবাড়ির যে প্রভাব তাঁর জীবনে পড়েছিল, তা সারাজীবন তাঁর বিভিন্ন কাজের মধ্যে এসেছে বারেবারে। 

বাবা সুকুমার রায় যখন মারা যান, সত্যজিতের তখন মাত্র দু’বছর বয়েস। পাঁচ বছর বয়স অব্দি ছিলেন গড়পারের ঐ বাড়িতে। তারপর মা সুপ্রভা রায়ের হাত ধরে চলে আসেন মামাবাড়ি ভবানীপুরে। মা গড়পারেরই অবলা বসুর স্কুলে ছিলেন সেলাইয়ের দিদিমনি। ছোটবেলায় দুপুরগুলো একটি শিশুর কাছে অলস দুপুর কখনওই হয় না, সত্যজিতেরও তা হয়নি। বকুলবাগানের বাড়ির মেঝে, দুপুরবেলা বারান্দা থেকে দেখা ফিরিওয়ালা, গরমের দুপুরের খড়খড়ি দেওয়া জানলার ফাঁক দিয়ে ঢোকা আলো ছায়ার খেলা। চারুলতা দেখতে গিয়ে খড়খড়ি দিয়ে চারুর বাঁদরওয়ালা দেখার দৃশ্য দেখেই আমার মনে পড়ে গিয়েছিল, ‘যখন ছোট ছিলাম’ বইটির দৃশ্যবর্ণনা। অলস দুপুরে একলা একটি বালক একাকিত্বে ভোগার আগেই হয়ত কল্পনা আর বই দিয়ে তার জগৎটাকে ভরে তুলেছিল। তিনি নিজেই বলেছেন, 

…আসলে আমার অনেকটা সময় একাই কাটাতে হত; বিশেষ করে দুপুরবেলাটা। কিন্তু তাতে আমার কোনোদিন একঘেঁয়ে লেগেছে বলে মনে পড়ে না। দশ খণ্ডের বুক অফ নলেজের পাতা উলটিয়ে ছবি দেখা ছিল এই অবসর সময়ের একটা কাজ।

মা সুপ্রভা রায় খুব ভালো গান জানতেন। ব্রাহ্ম সভাগুলোয় গান গাওয়া, একদম বাঁধা ছিল সুপ্রভা রায়ের। ছোট মাসি কনক দাশ ছিলেন বেশ বড়মাপের শিল্পী। মায়ের পিসতুতো দাদা অতুলপ্রসাদ সেনের বাড়িতে লখ্‌নৌতে যখন গিয়েছিলেন, দেখেছিলেন সেখানে নিয়মিত আসতেন বাবা আলাউদ্দিন খাঁ সাহেব। 

এক অদ্ভুত পরিমন্ডলে বেড়ে ওঠা তাঁর। গড়পারের বাড়ির ছাপাখানা আর ‘সন্দেশ’ পত্রিকা সেই ছোট্টবেলা থেকে তাঁর মধ্যে ছাপ ফেলেছিল। ছাপার ব্লক তাঁর বিভিন্ন লেখায় এসেছে। ‘সন্দেশ’ তাঁর নস্টালজিয়া, সঙ্গীত তাঁর রক্তে। পাশ্চাত্য সঙ্গীতের প্রতি তাঁর আকর্ষণ সর্বজনবিদিত। আদতে সঙ্গীতের প্রতিই ছিল তাঁর এক অমোঘ টান। এই অনুরাগ ঠাকুর্দা উপেন্দ্রকিশোরের অথবা মাতৃকুলের প্রভাব – তা বলতে পারব না। তবে সঙ্গীত, আরো সহজ শব্দে বলতে গেলে বলতে হয় ‘মিউজিক’ তাঁর ছবিতে কথা বলে। ঘরে বাইরে ছবিতে কিশোরকুমারকে দিয়ে গাইয়েছিলেন রবীন্দ্রসঙ্গীত, কারণ সন্দীপের বোহেমিয়ান স্বভাবের সঙ্গে এর থেকে বেশি ভালো কোনো শিল্পীর গলা মিলতে পারত বলে আমার আজো মনে হয় না। আবার ‘অপু’ ট্রিলজি চলচ্চিত্রগুচ্ছের ‘অপরাজিত’ ছবিতে অপুর উচ্চাশা, সর্বজয়ার তাকে নিজের অসুবিধা জানানো, অপুকে কাছে পাবার ইচ্ছের সংঘাতে, সংলাপের মাঝে বেজে ওঠেন রবিশঙ্কর। তাঁর বুননে উপন্যাস আর সিনেমা একের থেকে আরেকজন আলাদা হয়েছে অনেকবারই কিন্তু মূল সুরটুকু রয়ে গেছে একতারেতে বাঁধা। এখানেই দেখেছি একজন শাশ্বত চলচিত্রকারের মুন্সিয়ানা। তাই আজও ফিরে ফিরে দেখি সেই ঐ ছবিগুলো। মুখস্থ হয়ে যাওয়া দৃশ্যগুলো দেখেও কই ক্লান্তি তো কখনওই আসে না!

সমস্ত জিনিসের প্রতি একাগ্রতা এবং একনিষ্ঠতা সত্যজিতের চরিত্রের বিশেষ গুণ ছিল। আমার মনে হয় একাগ্রতা আর একনিষ্ঠতা থেকেই ভালবাসা জন্ম নেয়।

একবার সত্যজিৎ রায়কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, সিনেমার দিকে তিনি এলেন কী ভাবে? উত্তরে তিনি বলেছিলেনঃ 

সিনেমায় ইন্টারেস্ট আমার বহুদিন থেকেই। ভালো ছবি বার বার দেখা ও বই পড়া – প্রায় পনেরো বছর ধরে এটা আমার ঝোঁক আছে। ভালো বই পেলেই তার চিত্রনাট্য লেখা আমার বরাবরের অভ্যাস বলতে পারেন। একটি ভালো গল্প বা উপন্যাসের চিত্ররূপ দেওয়া হচ্ছে খবর পেলেই আমি স্বেচ্ছায় বসে পড়তাম সে বইয়ের চিত্রনাট্য রচনা করতে। তারপর ছবি যখন বের হল, মিলিয়ে দেখতাম আমার আর পরিচালকের চিত্রনাট্যের সঙ্গে কতটা তফাৎ। তখনো অবিশ্যি ছবি করার কোনো আইডিয়া আমার মাথায় ছিল না।     

ফিল্ম করার কোনো আইডিয়া মাথায় যখন ছিল না তখনই তিনি ফিল্ম নিয়ে এবং আরো অনেক কম বয়সে পাশ্চাত্য ক্ল্যাসিকাল মিউজিক নিয়ে মারাত্মক সিরিয়াস ছিলেন। ১৯৪৭ সালে কয়েকজন মিলে গড়ে তুলেছিলেন ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটি। সে সোসাইটির সদস্য সংখ্যা নেহাৎ হেলাফেলার ছিল না। তখনই সদস্য দাঁড়িয়েছিল, একশোর উপরে। 

নিজেই এক জায়গায় বলেছেন, “আমার মিউজিকাল মেমারি খুব ফিনোমেন্যাল ছিল। একটা পুরো সিম্ফনি আমার তিনবার শুনলে মুখস্থ হয়ে যেত।” কিংবা, “তিনকন্যার পর থেকে, যখন আমি ডিসাইড করলাম যে আমি মিউজিক করব – তবে ভীষণ কঠিন, প্রথম প্রথম ভীষণ সময়সাপেক্ষ, এখন আস্তে আস্তে একটা ফেসিলিটি এসে যাচ্ছে।”

ওপরের এই তিন চারটে অনুচ্ছেদ লিখতে গিয়ে নিজে আবার করে বিস্মিত হলাম। বই, সিনেমা, মিউজিক এগুলোকে কতটা ভালোবেসে আপন করে নিলে এভাবে ভাবা সম্ভব! 

এই কথাগুলির কোনওটা বলেছেন যখন সত্যজিৎ উনিশ কুড়ি বছরের কৈশোর পেরনো যুবক। কখনও বা তিনি বেশ কয়েকটি সিনেমা পরিচালনা করার পরের পোড় খাওয়া পরিচালক। যে বিষয়েই আগ্রহ পেতেন, সেটাকেই ভালোবেসে ফেলার সহজাত বোধ না থাকলে বোধহয় এ সম্ভব হত না।

তাঁর বাবা মা দুই পরিবারেই ছিল ক্রিকেট খেলা নিয়ে আগ্রহ। তিনি নিজেই বলেছেন, “স্পোর্টস বেশ শিকড় গেড়ে বসেছিল।” স্পোর্টসের প্রতি তাঁর ভালবাসা বিভিন্ন সময় টুকরো টুকরো হয়ে উঠে আসে সেলুলয়েডে।

ছিল অসামান্য আঁকার হাত। তাঁর নিজের ভাষায় বলতে গেলে বলতে হয় “…যে জিনিসটা ছেলেবয়স থেকে বেশ ভালোই পারতাম সেটা হল ছবি আঁকা। সেই কারণে ইস্কুলে ঢোকার অল্পদিনের মধ্যেই আমি ড্রয়িং মাস্টার আশুবাবুর প্রিয়পাত্র হয়ে পড়েছিলাম।”  

আঁকার প্রসঙ্গে বলা যায়, তাঁর সিনেমার প্রতিটি দৃশ্যের স্কেচ তিনি নিজে করতেন। লন্ডন থেকে জাহাজে ফেরার পথে, ‘আম আঁটির ভেঁপু’ বইয়ের প্রচ্ছদ করতে গিয়েই ‘পথের পাঁচালি’ ছবির সম্ভাবনা তাঁর মাথায় ধাক্কা মেরেছিল, এ আমাদের সবার জানা গল্প। তবে গল্প আর সিনেমাকে মেলানো বড় সহজ কথা ছিল না। 

১৯৫০ সালের এপ্রিল মাসে মানিককে তাঁর অফিস ‘ডি জে কিমার এন্ড কোং’ থেকে পাঠানো হল কোম্পানির হেড অফিসে, বিলেত। সস্ত্রীক। তিনি তখন কলকাতা অফিসের আর্ট ডিরেক্টর। বিলেতে গিয়ে দেখলেন সে অফিসের আর্ট ডিরেক্টর মিস্টার বল বলে এক ভদ্রলোক সত্যজিতের কাজগুলো নিজের বলে চালিয়ে দিচ্ছেন। তারপর অজস্র ঝামেলা পেরিয়ে অন্য একটি ফার্ম বেনসনে কাজ করলেন চারমাস। তারপর প্যারিস, ভেনিস, সালজবুর্গ ঘুরে ফিরে এলেন দেশে। 

বিলেতে যাওয়ার যাত্রার  শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রচুর সিনেমা দেখেছেন। সত্যজিৎ নিজেই বলেছেন, এই সময় তিনি সম্ভবত একশোর বেশি ছবি দেখেছেন। ফেরার পথে জাহাজে শুরু করলেন ‘আম আঁটির ভেঁপু’ বই পড়া ও ছবি আঁকার কাজ। তাঁর নিজের বক্তব্যেই “বই পড়া এবং চিত্রনাট্য লেখা ছিল আমার পুরনো অভ্যেস।” 

আম আঁটির ভেঁপু নিয়ে বন্ধু বংশীর সঙ্গে আলাপ আলোচনা শুরু হল। ছুটির দিন হলেই দুই বন্ধু বেরিয়ে পড়তেন গ্রাম দেখতে। এর পর শুরু হলো যুদ্ধ। আম আঁটির ভেঁপু থেকে পথের পাঁচালি হয়ে ওঠার যুদ্ধ। 

ব্যক্তিজীবনের প্রেমিকা তখন স্ত্রী। ভালোবাসার অন্য আঙ্গিক সিনেমা নিয়ে তখন দাঁতে দাঁত চেপে এগোবার লড়াই। অপু, দুর্গাকে যদি বা পাওয়া গেল, হাতে টাকা নেই। প্রযোজকরা কেউ রাজি হচ্ছেন না। হলেও পিছলে বেরিয়ে যাচ্ছেন। এমন নাচগানহীন গল্পে ভরসা নেই তাদের। নিজেদের জীবনবিমার টাকা, সযত্নে রক্ষিত আর্ট বুকগুলো একে একে বিক্রির টাকা, ধার, স্ত্রীর গয়নার বাক্স ধরে বন্ধক – কী না করেছেন! গয়না বন্ধকের কথা জানতেন না সত্যজিতের মা। রায় পরিবারের যত গয়না তাঁর ছিল, সব তুলে দিয়েছিলেন ছেলের বৌ’এর হাতে। বাক্স ধরে। সেই গয়না চুপিচুপি ছবির রসদ হল। কিন্তু তাও যে রসদে টান পড়ে! কিছুতেই কুলোয় না! 

এক আত্মীয় বন্ধুর সহযোগিতায় তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে যখন দেখা করার সুযোগ পেলেন। শোনা যায় কাহিনির শেষ দিকে হরিহর গ্রাম ছেড়ে চলে যাচ্ছে শুনে বিধান রায় বলেছিলেন, “কেন বাপু, গ্রাম পঞ্চায়েতের সঙ্গে মিলেমিশে গ্রামেই থাক না কেন!” তা সে যাই হোক, বিধান রায় শেষ পর্যন্ত অর্থসাহায্য করতে রাজি হলেন। বন্ধ হয়ে যাওয়া পথের পাঁচালির শুটিং আবার চালু হল। এরপর জয়যাত্রার গল্প শুরু হল। এরমধ্যে ভালোবাসার জন বাড়ল সংসারে। ছেলে সন্দীপ এল। 

একের পর এক সিনেমা আর পুরস্কার পৃথিবী জুড়ে। সিনেমাকে ভালোবেসে সিনেমাকে জড়িয়ে। পথের পাঁচালি ছবি এক ডজন পুরস্কার পেয়েছে – বেশিরভাগই বিদেশ থেকে। দেশে প্রেসিডেন্টস গোল্ড এন্ড সিলভার মেডেল। অপরাজিত ছবিটি পেয়েছে আটটি, সবই বিদেশ থেকে। অপুর সংসার ছবি বিদেশে জিতে নিয়েছে পাঁচটি পুরস্কার, দেশে প্রেসিডেন্টস গোল্ড মেডেল। তিনকন্যা ছবির প্রাপ্তির ঝুলিতে তিনটি দেশের সিলভার মেডেল।

সোনার কেল্লা চারটি।
চারুলতা তিনটি।
অশনিসংকেত পাঁচটি।
গুগাবাবা পাঁচটি।

দেশের প্রায় সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডক্টরেট দিয়েছিল, এক বোম্বে ছাড়া। বিশ্বভারতী দিয়েছিল দেশিকোত্তম।         

তিনকন্যা ছবির পর সত্যজিৎ সিদ্ধান্ত নিলেন মিউজিক নিজেই করবেন। যে ডিরেক্টরই মিউজিক করুন না কেন, সে মিউজিকের অজস্র খামতি সত্যজিতের চোখে ধরা পড়ত। কিছু কিছু জায়গা একেবারে ব্ল্যাঙ্ক মনে হতে লাগলো। নিজে দেশি বিদেশি দুই নোটেশনই জানতেন। রাতের পর রাত স্কোর পড়ার সঙ্গে মিউজিক শোনার অভ্যাস করে ফেললেন। 

‘দেবী’ ছবির জন্যে প্রথম শ্যামাসংগীত লিখলেন। এরপর গুগাবাবার গানগুলো বাঁধলেন নিজেই। 

সিনেমার প্রতিটি সেট বড় বড় ড্রয়িং পেপার নিয়ে মাটিতে বসে আঁকতেন। কোথায় কী থাকবে। কেমনভাবে ঘর সাজানো হবে। কোন ঘরে কোন পর্দা ঝুলবে। সেই পর্দাও স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে নিউমার্কেট থেকে পছন্দ করে কিনতেন। ক্যামেরামানের সুবিধার জন্য প্রতিটি শটের সংলাপের পাশে কোন অ্যাঙ্গেলে ক্যামেরা বসবে এবং লাইট সোর্স কোনদিকে থাকবে – সব পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে লেখা এবং আঁকা থাকত।

নিজের জন্য পরিচালকের বেশি একটা পয়সা নেওয়ার কথা কখনো ভাবেননি। এমনকি যে মিউজিকের জন্য এত পরিশ্রম তার জন্যেও নিজে কোনও পারিশ্রমিক নিতেন না। বলেছিলেন, “আমি পরিচালক হিসেবে পরিচিত হতেই পছন্দ করি।”

বিজয়া রায়ের লেখা পড়ে জানা যায়, সংসার চলার টাকা আসতো বই থেকে। ফেলুদা এবং শঙ্কু অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছিল, লেখার আলাদা ধরনে। বলেছিলেন, “লেখার সময় শিশুদের আমি বড় মানুষই মনে করি এবং তাদের মতামতের যথেষ্ট গুরুত্ব দিই।” 

বার্লিন, মস্কো, একের পর এক দেশে চলচ্চিত্র উৎসবের জুরি হবার আমন্ত্রণ পেয়েছেন। খুব কম সময়ই একা গেছেন; বেশিরভাগ ক্ষেত্রে স্ত্রী বিজয়া গেছেন সঙ্গে।

নিজের কাহিনি নিয়ে প্রথম ছবি করলেন, কাঞ্চনজঙ্ঘা। এরপর আরো ছটি – নায়ক, সোনার কেল্লা, জয় বাবা ফেলুনাথ, হীরক রাজার দেশে, শাখাপ্রশাখা, আগন্তুক। এছাড়াও টু এবং পিকু। তথ্যচিত্র করলেন রবীন্দ্রনাথ, বালা সরস্বতী, বিনোদবিহারী এবং সুকুমার রায়কে নিয়ে।

পথের পাঁচালি থেকেই শুরু যে যাত্রার, সেই যাত্রাপথে প্রতিটি সিনেমার প্রতিটি দৃশ্যের তিনি স্কেচ করেছিলেন। তাছাড়াও লাইট কোথা থেকে আসবে তার প্রতিটি অ্যাঙ্গেল সেই চিত্রনাট্যের ছবির মধ্যে আঁকা থাকতো।

তাঁর নিষ্ঠা নিয়ে আলোচনা ধৃষ্টতা আমার নেই। আমরা সবাই জানি তিনি সত্যজিৎ। কিন্তু মনে এল, কিছুদিন আগেই পড়েছিলাম তাঁর লেখা ‘হুন্ডী ঝুন্ডী শুন্ডী’, ‘সেরা সত্যজিৎ’ সংকলনে। সেখানে গুপী গাইন বাঘা বাইন সিনেমার যে দৃশ্যের বর্ণনা তিনি দিয়েছেন, তা সিনেমায় এসেছে খুব জোর দু-তিন মিনিট। সেই যেখানে, হাতে তালি দিয়ে গুপী বাঘা ভুল জায়গার নাম বলে বরফের দেশে পৌঁছে গেছে। আবার তালি দিতেই ধূধূ মরুভূমি। সেই বরফের দৃশ্যের জন্য ফেব্রুয়ারির বরফ ঢাকা সিমলায় গেছেন। সিমলা থেকে আট নয় মাইল ট্যাক্সিতে গিয়ে পাওয়া যায় ‘কুফরি গ্রাম।’ 

তাঁর ভাষায় “… আরো শ’ দু-এক ফিট উপরে উঠতেই এমন একটি জায়গায় পৌঁছলাম যেখানে তিন দিক একেবারে খোলা, স্তরের পর স্তর বরফ ঢাকা পাহাড় ছাড়া আর কিছুই দেখা যায় না।” আবার সুকুমার রায়ের ওপর তথ্যচিত্র বানাবার পরে তাঁর কোনো এক আত্মীয়া বলেছিলেন, “এইটুকু?” তিনি বলেছিলেন, “জীবনটাই তো ছত্রিশ বছরের!” 

যেখানে যতটুকু সেখানে ঠিক ততটুকু, এ বোধ থেকে তিনি কখনোই বিচ্যুত হননি। এমনকি নিজের পিতা সুকুমার রায়ের ওপর তথ্যচিত্র বানাতে গিয়েও না।

‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ আমার দেখা সত্যজিতের প্রথম সিনেমা। দেখেছিলাম খুব ছোটোবেলায়। ক্যাপ্টেন স্পার্ক আর মছলিবাবা এই দুটো চরিত্র মনে দাগ কেটেছিল খুব বেশি। ‘সোনার কেল্লা’ আর ‘পথের পাঁচালি’ দেখেছিলাম অনেক পরে নন্দনে সত্যজিৎ রেট্রোতে। এর আরও পরে ‘মহানগর’, ‘অভিযান’, ‘দেবী।’ তারপর একে একে সবগুলোই। তখন আমি বেশ বড় হয়ে গেছি। সিনেমাগুলো বেশ অন্যরকম সেটা বুঝতে পারতাম। বাড়ি থেকে যেহেতু বাধা খুব বেশি ছিল না তাই এক সিনেমা অনেকসময়ই বেশ কয়েকবার দেখেছি। 

অনেক আলোচনা হয়েছে, মন্তব্য শুনেছি, “তিনি সাধারণ মানুষের দুঃখ দুর্দশা নিয়ে ছবি করলেন কই?” “দুর্ভিক্ষ, মহামারী কেন তাঁর ছায়া-ছবিতে ছায়া ফেলতে পারল না! অন্যদের ক্যামেরায় যা ধরা পড়েছে ভীষণভাবে।” 

আমার মনে এসেছে ‘ডি জে কিমার’ কোম্পানিতে চাকরি করার সময়কাল, যখন তাঁকে লন্ডনে পাঠানো হয়েছিল, তিনি দেখেছিলেন অজস্র বিদেশী সিনেমা। সেই সময় কেউ যেন তাঁকে বলেছিল, “ক্যামেরা নিয়ে রাস্তায় নামো। সাধারণের মাঝে, তাদের সুখ, দুঃখ, দৈনন্দিন চাওয়া, পাওয়ার গল্প শোনাক তোমার ক্যামেরা। বিশেষ কোনো রঙে নয়। নিজের মনের ক্যালিডোস্কোপে ফেলে তার রঙ পরখ করো।” তাই তিনি করে গেছেন সারাজীবন। ১৯৫৫ সালে ‘পথের পাঁচালী’ দিয়ে যার শুরু আর ১৯৯১ সালে ‘আগন্তুক’ দিয়ে যার শেষ, সর্বত্র। শুধুই মানুষের জীবন খাতার খোলা পাতা, বিভিন্ন শেডে এঁকে গেছেন যেন। 

তাঁর একটি কবিতার বই ছিল – ‘তোড়ায় বাঁধা ঘোড়ার ডিম’ –  জানি না সে বই এখনো পাওয়া যায় কি না। কবিতা, ছড়া যেন তাঁর রক্তে। পাপাঙ্গুলকে এখনো ভুলতে পারিনি –  ‘নীল মাথাতে সবুজ রঙের চুল – পাপাঙ্গুল।’ লিমেরিক-এর ব্যাকরণগত ঠিক ভুল আমি বুঝি না কিন্তু সত্যজিতের সেই পাঁচ-পাঁচ লাইনের কবিতায় সবকটাই আস্ত একেকখানা ছবি। 

কঞ্জুস বুড়ো বসে গাছে, 
পাখিদের বলে, ‘আয় কাছে,
তোরা যদি ঠুকরিয়ে 
দাড়িগুলো নিস নিয়ে, 
নাপিতের খরচাটা বাঁচে।

কিংবা

একটা মোরগ, চারটে শালিকছানা,
দুই রকমের হুতোমপ্যাঁচা
একটা বোধহয় হাঁড়িচাঁচা
দাড়ির মধ্যে বেঁধেছে আস্তানা।  

আমার মাথার মধ্যে তারা যে আস্তানা গেড়েছিল, সেটা বিলক্ষণ জানি। আমি কিন্তু এগুলোর মধ্যে স্যাটায়ারিস্টের ছেলেকে বেশ খুঁজে পাই।

তাঁর লেখায় নারী চরিত্র প্রায় অনুপস্থিত। এ নিয়ে তাঁকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেছিলেন, “কী জানি! আমার বাপ ঠাকুর্দার লেখাতেও নারী চরিত্র নেই। আমার লেখাতেও তারা নেই।” তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের দুই নারী মা সুপ্রভা রায় এবং স্ত্রী বিজয়া রায়ের অস্তিত্ব ছিল তাঁর জীবনের সর্বত্র। 

তাঁর লেখায় নারী চরিত্র নেই। কিন্তু সিনেমায় ভীষণভাবে তাঁরা আছেন। সেখানে পুরুষ মানসিকভাবে কমজোরি কিন্তু নারী প্রায় দশপ্রহরণধারিণী। সিনেমায় তাঁর নারীরা প্রবল ব্যাক্তিত্বময়ী। সর্বজয়া, চারুলতা বইয়ে পড়া চরিত্রের থেকে বেশ আলাদা। দেবী ছবিতে দেওয়ালের দিকে ঘুরে পায়ের আঙ্গুল গুটিয়ে দেবীর প্রতিবাদের যে দৃশ্য, আজ অবধি কোনো দর্শকই তাকে ভুলতে পারেননি। 

তাহলে কি একলা বেড়ে ওঠার দিনগুলো তাঁকে মনে মনে এতটাই একলা করে দিয়েছিল যে লেখার ঘরের একলা কোণে নারী অনুপস্থিত?

কিশোরীরা খুব কম এসেছে তাঁর ছবিতে। পথের পাঁচালির দুর্গা কিশোরী থেকে যুবতী হবার আগেই তার মৃত্যু হয়। ‘পোস্ট মাস্টার’-এর রতন’, ‘সমাপ্তি’র মৃন্ময়ী, ‘মহানগরী’র কিশোরী বাণী, প্রতিটি কিশোরীই যেন ধীরে ধীরে নারী হয়ে উঠছে তাঁর ছবিতে। 

আমাদের ছোটবেলায় সন্দেশ পত্রিকা বন্ধ হয়ে গেছে। উপেন্দ্রকিশোরের চালু করা সন্দেশ পত্রিকা, সুকুমার রায় মারা যাবার অল্পদিন পরেই বন্ধ হয়ে যায়। সত্যজিতের কাকা সুবিনয় পরে আবার তা চালু করলেও সন্দেশ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল আবার। কিন্তু তাঁর লেখা পড়তে গিয়ে বিভিন্ন সময়ে আমার মনে হয়েছে ‘সন্দেশ’ যেন তাঁর চেতনায়। 

বন্ধ সন্দেশের যে দরজা সুভাষ মুখোপাধ্যায় আর সত্যজিৎ মিলে খুলেছিলেন, সে দরজা আদতে কেন বন্ধ হয়েছিল তা জানা খুব কঠিন কাজ। আমাদের মত সাধারণ বুদ্ধির মানুষজন মনে করেন দুটি মস্ত প্রতিভা একজায়গায় বসে একটিমাত্র কাজ শুরু করা ঠিক যতটাই সহজ, চালিয়ে যাওয়া তার থেকে অনেক বেশি কঠিন।  

তাঁর নিজের ভাষায় বলতে গেলে বলতে হয়, “সুভাষ বলেছিল, সন্দেশটা আবার শুরু করা যায়। তাই শুরু হয়েছিল। কিন্তু বন্ধ কেন হয়েছিল জানি না। আমরা দু’জনে মিলে একসঙ্গেই সন্দেশের জন্য কাজ করব, এটাই ঠিক হয়েছিল। তবে লেখকদের দেবার মত পয়সা আমাদের হাতে ছিল না।”

শুনেছি তপন সিন্‌হা তাঁকে একবার বলেছিলেন, “আপনি সিনেমা না বানালে আমরা কার সিনেমা দেখব মানিকদা?” 

কোনো হিংসা নয়, রাগ নয়, সমমনস্ক দুই মানুষের এ যেন এক অদ্ভুত ভালোবাসার কথা।

সত্যজিৎ রায়ের স্ত্রী বিজয়া রায় ‘আমাদের কথা’ বইতে বেশ কিছু কথা লিখেছেন। হৃদয় দৌর্বল্য তাঁরও এসেছিল। তবে আমার আলোচনায় সেটা থাক।

সত্যজিৎকে নিয়ে এ আলোচনায় আমার মনে একটি প্রশ্ন ঘুরেফিরে বারবার এসেছে, সত্যজিৎ কি পরিণত হচ্ছেন শুধু একটি নামে বা ঘরানায়? সত্যজিতের চলচ্চিত্র, তাঁর আদর্শ, তাঁর নীতিবোধ, আমাদের স্পর্শ করে তো আজও? সে দেখা থেকে যেন বাঙালি বিচ্যুত না হয়।   

তাঁর ভাষায় তাঁকে বলি – “মহারাজা তোমারে সেলাম।”

—————

কৃতজ্ঞতা স্বীকার

সত্যজিৎ রায়, যখন ছোট ছিলাম।

—–; ফেলুদা সমগ্র। (এ বিষয়ে একটা কথা না বললেই নয়। লেখিকা ছোটবেলায় বইগুলো আলাদা আলাদা পড়েছিল, এখন সেটা সমগ্র। ফেলুদা আর নতুন কেস নেয় না তাই।)

—–, তোড়ায় বাঁধা ঘোড়ার ডিম।

—–, বিষয় চলচ্চিত্র।

বিজয়া রায়; আমাদের কথা।

সন্দীপ রায়। আমার শিক্ষক।

সেরা সত্যজিৎ – সংকলন। আনন্দ পাবলিশার্স। 

 
বাসবদত্তার প্রথাগত পড়াশোনা কলকাতায়। ছোট থেকেই অতিরিক্ত অসুস্থ থাকার কারণে খেলাধুলোয় অংশগ্রহণ খুব একটা সম্ভব হত না। মা বাবা এনে দিতেন বই। বই গিলত মেয়েটা। সেই নেশাটাই রয়ে গেল। পরবর্তীকালে কলকাতা ছেড়ে অন্য শহরে বছর দশেক সফটওয়্যার প্রোগ্রামিং এর কাজ করেছেন। বর্তমানে স্বেচ্ছায় গৃহবন্দী গৃহবধূ। মাথায় অনেক কথা, যা কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। তা খুঁজতেই আঙুল আর ল্যাপটপের সহাবস্থান হল একদিন। আর চেষ্টা শুরু হল না বলা কথাগুলো লেখার।

1 Comment

Avarage Rating:
  • 0 / 10
  • Serena Journey Jayleen Schultz , February 11, 2024 @ 5:10 am

    Your writing is so eloquent and heartfelt It’s impossible not to be moved by your words Thank you for sharing your gift with the world

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *