হারায় না তো কভু
বাদলবেলায় শুনশান একলা ঘরের মনখারাপি প্রহরে এলোমেলো চিন্তার যখন বর্তমানকে ঠেলে সরিয়ে অতীতচারী হতে চায়, তখন মনের দরজা হাট করে খুলে অন্দরে ঢুকে আসে সারি সারি স্মৃতির মিছিল।
আসলে জীবনের অপরাহ্ণবেলায়, দৈনন্দিনতার অভিঘাতে ক্লান্তচেতনায়, ছেলেবেলার পিছুটান যখন উত্তাল, তখন ওই এলোমেলো স্মৃতির অঝোরধারাই বোধহয় দুদন্ড শান্তি জোগায়। তাই হয়ত কথায় বলে, স্মৃতি সততই সুখের! সততই সুখের? কী জানি! সবসময় নয় বোধহয়। তবে এটা তো ঠিক যে, পুরানো সেই দিনের কথা ভোলে কার সাধ্যি!
নবনীতা দেব সেন একবার তাঁর একটি রচনায় লিখেছিলেন, “বদলেছি আমরা, অনেক বদলে গিয়েছি, কিন্তু একটা জিনিস বদলায় নি, সেটি যেমন বইত,তেমনই বইছে, হু হু বয়ে যাচ্ছে স্মৃতি পথের হাওয়া…” তাই যতই ভুলে থাকো, অথবা বর্তমানে আকণ্ঠ ডুবে থাকো, মাঝে মাঝে হাওয়ার আড়ালে লুকিয়ে থাকা, নিভৃত মনের অতীত স্মৃতিরা কড়া নাড়বে। নাড়বেই। সেইসময় দুয়ার এঁটে ঘুমিয়ে থাকবে, এমন সাধ্যি কারুর নেই!
আজও তেমনই একটি অঝোর বর্ষণের নিরিবিলি অবসরে শুনি কড়া নাড়ার আওয়াজ। বাদল দিনের এলোমেলো ছাটের সঙ্গে ছন্দ মিলিয়ে ভাবনারাও আজ বড্ড এলোমেলো। তবুও ভাবলাম, খুলেই দেখি না স্মৃতির দরজাটা, কারা দাঁড়িয়ে রয়েছে দরজার ওপাশে, কেমন দেখায় আজকের প্রৌঢ়ত্বের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলির বাল্যকালের কচি কচি মুখগুলো! বর্তমানের গেরামভারি ব্যক্তিত্বের আড়ালে তাদের সেই দিনগুলির বালখিল্যপনার কাহিনিগুলোই বা কেমন ছিল?
দরজাটা একটুকু ফাঁক করতেই হুড়মুড়িয়ে ঢুকে আসে আমাদের সাবেক বাড়ির, সেই উঠতি বেলার রঙ্গমঞ্চখানা, যদিও সময়ের সঙ্গে তার পটপরিবর্তন ঘটে গিয়েছে। পড়াশুনার গুটিকতক ধাপ পেরিয়ে আমরা যে যার মতো করে এগিয়ে গিয়েছি নিজের জীবনের পথে। ওদিকে সেই শূন্যস্থান পূরণ করতে এসে গিয়েছে অন্যান্য কুশীলবরা। তবে ভরসার কথা, সেই নাট্যমঞ্চটির পরিচালকবৃন্দ, অর্থাৎ আমাদের ঠাকুমা আর তাঁর বিশ্বস্ত এবং কর্মপটু লেফটেনেন্টগণ তখনও অবধি জায়গা ছেড়ে একচুলও নড়েননি। নড়লে চলত কী করে! তখনও অবধি আরও গুটিকতক অপোগন্ডকে পার করানো বাকি ছিল যে! সেসব কথায় পরে আসছি।
আজ প্রথমেই মন জুড়ে উঠে এসেছে যে ছবিখানি, আগে সেটির কথাই বলি।
আমাদের সেই সাবেক বাড়ির গেট ঠেলে ঢুকতেই একখানি খোলা চাতাল। সেটি পেরিয়ে, দুধাপ উপরের ঢাকা বারান্দায় পাতা থাকত পেল্লায় চৌকিখানা, যেটি বছরের পর বছর প্রবল রোদের তাপে উত্তপ্ত, অঝোরধারা বর্ষণের প্রবল ছাটে ভিজে চুপ্পুস হয়ে, আর শীতসকালের তেরছা নরম ঊষ্ণতা গায়ে মেখেও, অজর অমর হয়ে বিরাজ করত পারিবারিক বৈঠকখানা হিসেবে। ঠিক কবে থেকে সেটির ওইখানে অবস্থিতি, সেই হিসেব আমাদের বাপ জ্যাঠাদেরও সঠিক জানা ছিল না। শুধু জানতাম, বাড়ির অন্দরে কোচ কেদারা সমন্বিত আসল সুসজ্জিত বৈঠকখানাটি অনাদরে ব্রাত্য হয়েই পড়ে থাকে। খুব জরুরি দরকার ছাড়া ওটির তেমন ব্যবহার হয় না।
শোনা যায়, একদা কী জানি কোন শুভক্ষণে এই বাড়িতে মহামান্য শ্রী দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের সহধর্মিণী বাসন্তী দেবীর পায়ের ধুলো পড়েছিল। এবং তিনিও এই বাড়িতে এসে ঐ চৌকিখানাতেই বসেছিলেন!
কেন অথবা কোন সূত্রে তিনি এই বাড়িতে এসেছিলেন, এবং অন্দরের বৈঠকখানায় না বসে ওই চৌকিখানাতেই কেন যে উপবেশন করেছিলেন, সেই ইতিহাস আমাদের কারোরই জানা নেই। তবে তিনি যে এসে আমাদের এবং ওই চৌকিখানাকে ধন্য করছিলেন, সেটি বেশ একখানা আত্মশ্লাঘার বিষয় হয়ে আমাদের মনের মধ্যে সদাই বিরাজ করত, তা সে নিজেরা যত তুচ্ছই হই না কেন!
যৌথ পরিবারের ওই খোলামেলা বৈঠকখানাতেই সকালবেলায় বাড়ির পুরুষদের ভাগ বাঁটোয়ারা করে সংবাদপত্র পড়া থেকে শুরু করে অফিস যাবার আগে এবং ফিরে এসে চা জলখাবার সহযোগে দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক পরিস্থিতির নরম গরম সবরকম আলোচনা ওইখানে বসেই চলত।
যবে থেকে মহালয়ার ভোরে বেতারে মহিষাসুরমর্দিনী সম্প্রচার শুরু হয়, তবে থেকেই নাকি পরিবারের সবাই ওইখানেই জড়ো হতেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ শুনতে। ধীরে ধীরে ভোর হয়ে আসত, শিউলি ঝরত টুপটাপ। পুজোর মূল সুরটি সেইদিনই বাঁধা হয়ে যেত সকলের মনে। বড় হয়ে উঠতে উঠতে বহুবার শোনা এইসব গল্প আমাদের মনের মধ্যে গেঁথে গিয়েছিল।
বেশিরভাগ যৌথ বাঙালি পরিবারের বয়স্ক সদস্যরা বোধহয় কিছুটা একই ধরনের স্মৃতির শরিক।
পুজো এলে বাঙালির মনে আরও একটি ছবি ভেসে উঠবেই। চওড়া লাল পেড়ে শাড়ি, পায়ে আলতা আর কপালে লাল টুকটুকে সিঁদুর পরা, পুজোর থালা হাতে মা জ্যেঠিমাদের উজ্জ্বল মুখচ্ছবি।
দিনকাল বদলে গেলেও, চিরাচরিত এই ছবিটি আজও অল্পবিস্তর একরকমই রয়ে গেছে, বিশেষ কিছু বদলায়নি।
অতীত, বর্তমানের এই সবকিছু নিয়েই,সাধারণ বাঙালি ছেলেপুলেদের মতো আমরাও বড় হয়ে উঠছিলাম। আমরা যতদিনে বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডিটি পার করছি, ততদিনে খুড়তুতো, জ্যাঠতুতো, পিসতুতো আরও ক’টি ছোট ছোট ভাই বোন স্কুলের গন্ডি পার হয়ে, পারিবারিক নিয়ম অনুযায়ী এই বাড়িতেই চলে এসেছে, কলেজের চৌকাঠে পা রাখতে।
সদ্য স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে এসে তাদের মন তখন কিঞ্চিৎ লাগামছাড়া। পড়াশোনার নীরস আওতা ছেড়ে মন অন্যদিকেই ছুট লাগাতে চায়।
কেউ বা পাঠ্যপুস্তক ফেলে কলেজ ফেস্ট, নাট্যচর্চা নিয়ে মাতে আবার কেউ বা পাঠ্যপুস্তকের আড়ালে লুকিয়ে কবিতা লেখে। লুকিয়েই কাব্যচর্চা চালাতে হয়, কারণ ধরা পড়লে গুরুজনদের হাতে প্রভূত লাঞ্ছনার সম্ভাবনা!
ভাইবোনদের কাছে অবশ্য কিছুই গোপন থাকে না। উলটে উঠতি কবিটির প্রচুর বাহবা মেলে! সাধে কী আর কবি বলিয়াছিলেন, “বাঙালির ঘরে যতো ভাই বোন, এক হউক হে ভগবান।” তবে মহা পরিতাপের বিষয় যে এত কিছু সত্ত্বেও ভাইটির এহেন কাব্যচর্চা, সামান্য কিছু টাকার অভাবে বেশিদূর এগোতেই পারল না।
পাড়ার সিনিয়ার দাদা, এক উঠতি কবি, প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল কিঞ্চিৎ কাঞ্চনমূল্যের বিনিময়ে ভাইটির অন্তত একখানা কবিতা কোনও একটি লিটল ম্যাগাজিনে ছাপানোর বন্দোবস্ত করে দেবে।
ভাইটির তখন সামান্য পকেটমানিটুকুই সম্বল। বড় হয়ে ঋণ শোধ করে দেবার প্রভূত প্রতিশ্রুতি দেওয়া সত্ত্বেও সেদিন বেচারি ভাইটি সেই সামান্য অর্থটুকু কর্জ করেও জোগাড় করে উঠতে পারেনি। কারণ বাকিদের অবস্থাও তথৈবচ। সে যুগে বখে যাবার ভয়ে গুরুজনরা ছেলেপুলেদের হিসেব করে টাকা পয়সা দিতেন। ফলে ভাইটির কাব্যপ্রতিভার আর ফুটে ওঠা হল না, অকালেই কাব্যকুসুম ঝরিয়া গেল। অবশ্য ততদিনে পড়াশুনার চাপও বাড়ছিল!
আজ তার বাড়িগাড়িসহ স্বচ্ছল অবস্থা, নিশ্চিন্ত নিরুদ্বিগ্ন জীবন।
কিন্তু এখন সে আর কলম ধরে না। তার বদলে এখন তার হাতে খুরপি। এখন সে বছরভর রাশিরাশি ফুল ফোটানোর নেশায় মগ্ন।
তার পিঠোপিঠি অগ্রজটি, যে স্বেচ্ছায় ‘যেতে পারি, কিন্তু কেন যাব’-র ঢঙে ‘আঁকতে পারি কিন্তু কেন আঁকব’ বলে পেন্সিল ছেড়েছিল, এখন কাজের ফাঁকে আবার পেন্সিল হাতে নেয়। হয়ত বা মনখারাপের দরিয়া পার হবার পারানি সংগ্রহ করতে। কেন কে জানে আজকাল তার পেন্সিলে কেবলই ধাবমান অশ্বের প্রতিচ্ছবি!
ভাবনার সূত্র ধরেই উঁকি মারে, সদা হাস্যময়ী দুটি মামাতো পিসতুতো অসমবয়সী বোন। সামান্যতম কারণে তাদের এতো হাসি পেত যে শেষটায় তা বাকিদের শিরঃপীড়ার কারণ হয়ে দাঁড়াত।
সেই দুই হাসিরাশিদেবীই পরবর্তী জীবনে, প্রায় হাত ধরাধরি করে হাসতে হাসতেই বড় অকালে বৈতরণী পেরিয়ে পৌঁছে গেছে আলোকমাতাল স্বর্গসভার মহাঙ্গনে।
যাবার আগে বড়টি আমার কাছে গচ্ছিত রেখে গেছে তার একখানা মহা মূল্যবান অভিজ্ঞতার কাহিনি, যেটি আমার কাছেও সমান মূল্যবান।
সে তখন ডিগ্রি কোর্সের প্রথম বর্ষের ছাত্রী। ইংরেজি বই দেখলেই তার কান্না পায়, কারণ সিলেবাসে শেকসপিয়ার এবং তাঁর ‘জুলিয়াস সিজার’ তাকে ভয় দেখাতে সদা তৎপর।
কিন্তু একদিন তার ব্যতিক্রমী আচরণ নজর কাড়লো। কেমন যেন ঘোর লাগা ভাব। সন্ধে হতেই ইংরাজি বই খুলে বসল সে।
বেশি চাপাচাপি করতে হল না, জানা গেল তাদের কলেজে একজন নতুন ইংরেজি পড়ানোর স্যার এসেছেন। তাঁর পাঠদান পদ্ধতিতে ‘জুলিয়াস সিজার’ এবং বাকি চরিত্রগুলিও নাকি একেবারে মূর্তি পরিগ্রহ করে সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে! এখন ইংরাজি পড়তে তার আর একটুও ভয় লাগছে না!
“স্যারের নাম?”
“শ্রী রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত।”
হ্যাঁ, প্রথম জীবনে তিনি কিছুদিন কলেজে শিক্ষকতা করেছিলেন। সেই স্বল্পসময়ে তিনি কত যে অর্বাচীন ছাত্রছাত্রীকে দুস্তর পারাবার লঙ্ঘন করতে সাহায্য করেছেন, সে খবর তিনি নিজেও জানেন না।
পরবর্তী জীবনে কতবার তাঁর অভিনীত থিয়েটার দেখে ঠিক ওইরকমই ঘোরলাগা অবস্থায় বাড়ি ফিরেছি! আমার মতো হয়ত আরও কতজন ঐ একই অভিজ্ঞতার শরিক হয়েছেন, তার হিসেব মেলা ভার।
আচমকাই সম্বিত ফেরে। বৃষ্টি থেমে গিয়ে রোদ উঠেছে ঝিলমিলিয়ে।
ভেজা জামাকাপড়ের খোঁজ নিতে ছোট বারান্দায় যাই।
হঠাৎ থপাস করে কিছু একটা পড়ার শব্দ। এদিকে ওদিকে চেয়ে দেখি পেল্লায় একখানা আকাশিরঙা টেডি বেয়ার আমাদের জলের ট্যাঙ্কের উপরে চিৎপাত হয়ে পড়ে রয়েছে।
শিশুবিরল এই মহল্লায় টেডি বেয়ারের আবির্ভাব ঘটে কী প্রকারে!
বিস্মিত দৃষ্টি ফেরাতেই দেখি পাশের আবাসনের পিলারের আড়াল থেকে হাসিমুখে উঁকি মারছে ওদের নতুন আসা দারোয়ানের বছর চারেকের কালোকোলো এক স্বাস্থ্যবান শিশু, পুঁতির মতো চকচকে চোখে চেয়ে আছে। বন্ধুত্ব পাতাতে চায় বুঝি!
আরে, আমিও কি চাই না?
পরিচিত এক প্রাজ্ঞ ব্যক্তি বলেছিলেন, “জীবন হচ্ছে পুরনো কাপড় দিয়ে তৈরী একখানি নকশি কাঁথা। মাঝে মাঝে ফেঁসে যেতে চায়, কিন্তু তাই বলে সেটি ফেলে দেওয়া চলে না। রিফু করে মেরামত করে নিতে হয়।”
সুযোগ তখন এসেছে, তবে তাই হোক না হয়।
সত্যিই তো, যে কাল হারিয়ে গেছে ভেবে এতক্ষণ বেদনা বিধুর চিত্তে বসেছিলাম, চেয়ে দেখি হারায়নি, তা হারায়নি!
“নবীন চোখের চপল আলোয় সে কাল ফিরে পেয়েছি…”