দেবী ও আমরা

দেবী ও আমরা

গ্রীকদেবী আফ্রোদিতির জন্ম সমুদ্রের নোনা জলে। ঝিনুক খুলে বেরিয়ে এসেছেন তিনি, অপূর্ব সেই রূপ। বুকের উপর স্বচ্ছ একখণ্ড কাপড় জড়িয়ে আছেন, মুখ জুড়ে চমৎকার লাবণ্যের নুরে মিশেছে অপাপবিদ্ধ সারল্য। এটা এখনকার ব‌ইতে পাওয়া ছবি।

এড‌ওয়ার্ডাইন কাঠের ক্যাবিনেটের ভেতর পুরনো সাইপ্রাসের মিউজিয়ামে রাখা হলুদ পাথরের কয়েক সেন্টিমিটারের প্রত্নতাত্ত্বিক,প্রাগৈতিহাসিক আফ্রোদিতি বা ভেনাস (গ্রীক আফ্রোফ্রিদি রোমান ভেনাসের প্রতিরূপ) অন্যরকম। তিনি আসন্নপ্রসবা, স্ফীতকায় স্তনভারে ন্যুব্জ, ফলন্ত।অথচ সেই আফ্রোদিতিই যুদ্ধের দেবী হয়ে মেসোপটেমিয়া থেকে আনাতোলিয়া অবধি পৌঁছে যান। তখন তিনি অস্ত্রসজ্জিতা। 

কিন্তু কেন? কী ভাবে যিনি জীবন দান করেন তিনিই সংহারের দেবী হয়ে ওঠেন। প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন থেকে জানা যায় বর্তমান যুগের ইরাক, সিরিয়া, জর্ডন, লেবানন, টার্কি তিন হাজার খ্রিস্টপূর্বাব্দে বহু অখ্যাত যুদ্ধের ইতিহাস বহন করেছিল। আনাতোলিয়াতে তাম্র যুগের প্রথম দিকের যে চারশো পঁয়তাল্লিশ খানা কঙ্কাল খননকার্যে উদ্ধার করা হয়েছিল তাদের মাথায় চরম ক্ষত চিহ্ন বর্তমান। পুরুষ কঙ্কালগুলোর উরু এবং বুকের খাঁচায় কুঠারের আঘাত , পিঠে বর্শার ফলা গেঁথে যাওয়ার ইতিহাস। মেয়েরা সে সময় বারো বছর বয়সে মা, চব্বিশ বছর বয়সে ঠাকুমা হয়ে যেত। কিন্তু তারপরেও তাদের‌কে প্রয়োজনে যুদ্ধ করতে যেত হত। বর্ম পরে শত্রু নিধনে নামতে হত। তাদের হাড়েও শুধুমাত্র গার্হস্হ সুখের রোজনামচা নয়, কিছু কঠিন যুদ্ধ যাপনের দাগ আছে।

জীবনের প্রয়োজনে‌ই জীবনচক্র ঘোরানোর দেবীকে যুদ্ধের ক্ষেত্রে অবতীর্ণ হতে হয়েছে। এমন একজন ঈশ্বরী হয়ে উঠতে হয়েছে যিনি যুদ্ধে জয়ের টিকা কপালে এঁকে দেবেন, রণক্ষেত্রে মৃত্যুকে পরাজিত করে অমরত্ব দেবেন। কারণ তীব্র কামনা-উদগ্র বাসনা, রক্তলোলুপ যুদ্ধ প্রবণতা এবং স্বর্গীয় প্রেম সবকিছুই সেই মহীয়সী নারীর বিচিত্র রূপ। এই বৈপরীত্য শুধু দেবীই সামলাতে পারেন, আসলে তিনিই তার রচয়িতা। স্বেচ্ছায় বপন করেন দুধরনের বীজ তাঁর অধিকৃত সাম্রাজ্যে। ‘স্বাহা’ বলে আগুন প্রজ্জ্বলিত করেন যিনি, তিনিই নিয়ে আসেন নির্বাণের জল। এমনটাই তখনকার মানুষ ভেবেছে। তাদের প্রার্থনায় প্রয়োজন অনুযায়ী দেবী নানা ভাবে তৈরি হয়েছেন, আকারে আকৃতিতে বদলে গেছেন। কখনো তিনি প্রেমের প্রতিমূর্তি, কখনো বিনাশিনী। পৃথিবীর মানুষ তাঁকে সব রূপে পুজো করেছে।

দেবী ফসল রক্ষা করেন। তিনি স্বর্গের রানী। তাঁর আদেশের জন্য অপেক্ষা করে থাকে বনের হিংস্র পশু, পাখি,সাপ,নেকড়েরা। শতকোটি পুষ্পে ভরা কোল, বৃক্ষের জননী হয়ে সিংহাসনে বসে আছেন, তাঁকে ঘিরে রয়েছে শ্বদন্ত ও শিংযুক্ত শ্বাপদ …দক্ষিণ টার্কিতে এরকম মূর্তির দেখা মিলেছে। দেবী সাইবাল-কে দুশো চার খ্রিস্টপূর্বাব্দে রোমে নিয়ে আসা হয়েছিল তুরস্ক থেকে।রোমান সম্রাট তাঁর পুজো করতেন নিয়মিত। ভক্তির হাজারদুয়ার খুলে দিয়ে চাইতেন শক্তি, কামনা করতেন সম্পদ। পাথরে তৈরি অমসৃণ দেওয়ালে ছিটকে আসত পশু বলির রক্ত। মহিষের পবিত্র শোণিত ধারায় দীক্ষাদান অনুষ্ঠিত হত।

গিলগামিশের মহাকাব্য মেসোপটেমিয়া সভ্যতার অন্যতম কাব্যগাথা। সেখান থেকে জানা যায় মেসোপটেমিয়ানরা ইষ্ট দেবতা ইশতারের উদ্দেশ্যে ব্যাবিলনে একটি তোরণ নির্মাণ করেছিল। যার মাথায় খোদিত ছিল “দেবী, যিনি সকলকে পরাজিত করেন।” মেসোপটেমিয়ার ইশতার আর মিশরের ইনানার অনেক মিল। যেরকম মিল দুটো কাছাকাছি গড়ে ওঠা নদীমাতৃক সভ্যতার মধ্যে হয়ে থাকে। মিশরের ফ্যারাও যখন অসুস্থ হলেন তখন ইনানার মূর্তি তাঁর মন্দির থেকে উঠিয়ে নিয়ে এসে প্রাসাদে রাখা হল। ইনানা এমনিতে প্রলয় আনেন, চঞ্চলা…কেউ তাকে বাঁধতে পারে না, তবে প্রয়োজনে গৃহধর্ম রক্ষা করেন। অসুস্থ সন্তান যেমন মায়ের আশ্রয় চায় তেমনভাবে আকাঙ্ক্ষা করলে ভয়ঙ্কর দেবীও করুণাময়ী হয়ে কপালে হাত রাখেন। রোগ যন্ত্রণার নিশাবসানে একমুঠো ফুল নিয়ে দাঁড়ান। এটাও একটা বিশ্বাস মাত্র। যে বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে অলৌকিকতার জগত বাসনার কুসুমে সেজে ওঠে। ইনানা, ইশতার, অ্যাসটারটে এরা সবাই এক‌ই স্বর্গীয় তারার বাসিন্দা, ভেনাসের বিভিন্ন রূপ। 

গাঢ় অন্ধকারে ধু ধু আকাশের দিকে তাকিয়ে যে জ্বলজ্বলে নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে মাটিতে থাকা মানুষ ভেবেছে ঐ উজ্জ্বল নক্ষত্রলোকেই হয়ত তাদের জীবনের সুখ দুঃখ, জয় পরাজয়, শান্তি অশান্তির অনন্ত গাথা লেখা হয়। না হলে এমনি এমনি কী করে একটা সৃষ্টি চলছে? কী করে নারীর পেটে আগামী জন্মাচ্ছে, মাঠে শস্য ফলছে, সূর্য উঠেছে, চাঁদ আলোতে ভাসিয়ে দিচ্ছে? আবার যুদ্ধে প্রান্তরের গায়ে লাল দাগ, বন্যা, দাবানল , ভূমিকম্প, খরা, মহামারী তাও আছে। এই কাব্য লিখে চলেন যে কল্পলোকের মহিয়সীরা, তাঁরা অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী। তাই যাঁরা লেখেন তাদের তুষ্ট করতে হবে, অর্ঘ্য সাজাতে হবে; তাই তো যুগ যুগ ধরে এত আয়োজন।

দয়ারাম সাহানি ১৯২৬ সালে মহেঞ্জোদারোর ধ্বংসাবশেষ খুঁড়ে খুঁজে পান ১০ সেন্টিমিটার লম্বা ব্রোঞ্জের ছোট একটা মূর্তি। কপাল থেকে চোয়ালে রাখা দাড়ি পর্যন্ত ফাটল ধরা আরেকটা আবক্ষ মূর্তিও পান তিনি। প্রথম মূর্তিটি ড্যান্সিং গার্ল বা নর্তকী নামে পরিচিত, দ্বিতীয়টি কিং প্রিস্ট বা রাজর্ষি। বালুচি শৈলীর ছাঁচে ঢালা অপূর্ব মুখশ্রী, ফোলা ফোলা ঠোঁট, পিছনের দিকে অল্প হেলানো মাথা, প্রশস্ত নাক, বাঁকানো চিবুক, কোকড়ানো গোছা গোছা চুল, চওড়া কপাল আর বিশাল বড় বড় দুটো চোখ। লজ্জাহীন ভঙ্গিতে নিতম্বের উপর একটা হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে। তার নিরাবরণ দেহের অলংকার বলতে তিনটি পাথর দেওয়া হার। বাঁ হাটু ভাঁজ করা এই নগ্নিকা দেবী পার্বতী হতে পারেন? খননে প্রাপ্ত ৪২০ নম্বর সিলকে শিব পূজার প্রমাণ হিসেবে ধরে নিয়ে এই মেয়েকে কেউ কেউ বলেছেন কিশোরী পার্বতী। তবে রামচন্দ্র রাবণের সঙ্গে যুদ্ধে নামার আগে শরতে যাঁর অকালবোধন করেছিলেন, একখানা পদ্ম লুকিয়ে রেখে যিনি ভক্ত রামচন্দ্রের পরীক্ষা নিয়েছিলেন তিনি কিশোরী নন। মধ্যযৌবনা, অমিতলাবণ্যশালিনী, তেজদীপ্তা, দশভুজা মহিষাসুর নিধন যজ্ঞের প্রধান হোতা। 

বাংলায় আমন ধান চাষের জন্য প্রয়োজন হয় নিচু জলা জমি। যে জমিতে জল দাঁড়াতে পারে না। এককালে এই ধরনের জলাভূমি মহিষদের দখলে থাকত। তাই দেবী মহিষমর্দিনী হয়ে উঠে কৃষি জমি উদ্ধার করেছেন। পুরাণে দেবীর মহিষ বধের অন্য ব্যাখ্যা থাকতে পারে তবে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইকেল উইটজেলের মতে শস্যরক্ষা করার জন্যই মহিষ হত্যার প্রয়োজন হত। হিন্দুশাস্ত্রে মার্কেণ্ডেয় পুরাণে সর্বপ্রথম অসীমবলশালিনী অসুরদলিনী দুর্গাকে পাওয়া যায়। দুর্গার বর্তমান রূপের পেছনে বৌদ্ধ তন্ত্রের প্রভাব‌ও যথেষ্ট। কিন্তু দুর্গা যতই রণসজ্জা করুন‌, আলতা পরা একটি পা গিরিরাজের দেওয়া সিংহের পিঠে আরেকটা অসুরের বুকে তুলে দশখানা হাত নিয়ে ত্রিভুবন দাপিয়ে বেড়ান, বাঙালির কাছে তিনি ঘরের মেয়ে উমা। তাই তো অষ্টাদশ শতাব্দীতে লেখা শাক্তপদাবলীতে উমার আহ্বানে বাৎসল্য রস। তাঁকে বাপের বাড়ি আনানোর জন্য মা  মেনকা স্বামীকে বলেন,

যাও যাও গিরি আনিতে গৌরি 

উমা বুঝি আমার কাঁদিছে

উমার যতেক বসন ভূষণ

ভোলা সব বুঝি বেচে খেয়েছে।

বাঙালি মোটামুটি সবকিছুই নিজের মতো করে গড়েপিটে নেয়। সে চাইনিজ রান্নাই হোক কিংবা রণরঙ্গিনী দশভুজা দেবী। আমাদের দুর্গা চারদিনের জন্য বাপের বাড়ি আসেন ছেলেপুলে নিয়ে, বাক্স প্যাটরা গুছিয়ে , একদম আটপৌরে গৃহিণী হয়ে। সবাইকে আগলে আগলে আনেন সুদূর কৈলাস থেকে। দুর্গাকে আমরা বরণ করে ঘরে তুলি। ষষ্ঠীতে হয় বোধন, আমন্ত্রণ, অধিবাস। ডানহাতে কুশের অগ্রভাগ নিয়ে ত্রিনয়নে কাজল পরিয়ে বীজমন্ত্র উচ্চারণ করে চক্ষুদান হয় মায়ের। প্রাণপ্রতিষ্ঠার পর তিনখানা চোখ মেলে যে মৃন্ময়ী মূর্তি চেয়ে থাকেন, তাঁর দৃষ্টিতেও উগ্ররূপের থেকে মাতৃভাব‌ই বেশী।  

ইশতারা, ইনানা, অ্যাসটারেটের মতো দুর্গাও দেবী। তিনি দেবতাদের তেজে জন্ম নেওয়া আদ্যাশক্তি মহামায়া, শঙ্খনাদে আদিগন্ত কাঁপিয়ে অসুর নিধন করেন। ক্ষণে ক্ষণে রূপ পরিবর্তনকারী প্রতিপক্ষকে শেষ পর্যন্ত নাগপাশে আবদ্ধ করে তার চুলের মুঠি ধরেন। তার উরুতে নিজের বাঁ পা রেখে মহাদেবের দেওয়া ত্রিশূল গেঁথে দেন বুকে। ত্রিশূলের তিনটি ফলা সতঃ, তমঃ ও রজঃ মুক্তি দেয় অসুরকে। ভারতে আজ‌ও নারীকে শক্তিরূপে আরাধনা করা হয়। সারা দেশে জুড়ে ন’দিন ব্যাপী মহোৎসব চলে। অথচ সেই দেশেই ধানের খেতের পাশে রক্তাক্ত যোনির দুর্গা পড়ে থাকে। বিচার চাইতে গেলে বোবা রাতে ধুধু প্রান্তরে তার চিতা জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। কন্যা ভ্রূণহত্যাতেও আমরা সেরা দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। বাড়ির ভিতরে কিংবা বাইরে নারীর সম অধিকার এখনও অনেক মেয়ের কাছে অলীক স্বপ্ন। তাও বছর বছর পুজো হবে মায়ের… আমরা প্রার্থনা করব যেন দেবীর আজানুলম্বিত ঘন কালো খোলা চুল, আগুনের মতো ছারখার করে দেওয়ার চোখ, দীর্ঘ মরাল গ্রীবা, চাঁদের মত সুডৌল বর্তুল স্তন, মেদহীন প্রত্যয়ী কটিদেশ, তেজী জঙ্ঘার কাছে পদানত হোক অসুর….পৃথিবীর যাবতীয় অশুভ অসুর।

তথ্যসূত্র.. History of a Goddess লেখক Bettany Hughes

রুমি বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজীর স্নাতক এবং ম্যানেজমেন্টের স্নাতকোত্তর। লেখালেখির শুরু লিটল ম্যাগাজিন দিয়ে। কয়েকটি মুদ্রিত‌ সংকলনে গল্প এবং কবিতা স্থান পেয়েছে। ‘পুরাণকথা পরণকথা’, ‘শেষ চিঠি’, ‘বরফকাঠি জমজমাটি’, ‘কবিতা তোমায় ভালোবেসে’, ‘অণুতে অসীম’, ‘ফ্যান্টাসায়েন্জা’ এমন কয়েকটি সংকলন।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *