‘কাঞ্চন-জঙ্ঘা’

‘কাঞ্চন-জঙ্ঘা’

এক

সে অনেককাল আগের কথা, তখন আমি সদ্য বিবাহিতা নতুন বৌ। অবশ্য সদ্য বিবাহিতাই বা বলি কেন, বিয়ের পর বছর দুয়েক তো কেটেই গিয়েছিল। যদিও চোখ বন্ধ করলে মনে হয় এই তো সেদিনের কথা, চোখ খুললেই সময় তির বেগে হাত গলে বেরিয়ে যায়। যাই হোক আমি একবার চোখ বুজে ডুব দিই সেই সময়ে… 

ডিসেম্বর মাসের কনকনে ঠাণ্ডা, ট্রেনের দ্বিতীয় শ্রেণীতে চলেছি পাহাড় ঘুরতে। শাড়ির উপর শালটাকে ভালো করে জড়িয়ে সিটের উপর গুটিসুটি মেরে বসে আছি।  

পরদিন সকালে নিউ জলপাইগুড়ি পৌঁছলাম। সেখান থেকে ছোট্ট জিপে প্রায় জনা দশেক যাত্রী মিলে পাহাড়ি পথে রওনা হলাম। দার্জিলিং যাবার পথটা কিন্তু অসধারণ সুন্দর। সব বাঙালিই বোধহয় বিষয়টা সম্পর্কে অবহিত। কারণ ‘দীপুদা’র তিন নম্বর তো দার্জিলিং। সবাই এক আধবার অবশ্যই গেছে।

পাহাড় কেটে বানানো রাস্তার একপাশে পাহাড় অপর পাশে খাদ। ছোট ছোট বাঁকে গাড়ি যখন পাহাড়ের দিক ঘেঁষে চলে, মনে মনে নিশ্চিন্ত লাগে, মানে ভয়টা কম লাগে। একটা পাহাড়ও এখানে ন্যাড়া নয়। ভারতের অনেক সুন্দর সুন্দর পাহাড়ি অঞ্চলেও দেখেছি, যাবার পথের পাহাড়গুলো কেমন যেন ন্যাড়া ন্যাড়া, গাছা গাছালি বিহীন। দার্জিলিঙের রাস্তা সেদিক থেকে অনবদ্য।

যখন খাদের পাশ ঘেঁষে চলে তখন বুকটা কেমন ঢিপঢিপ করে। কিন্তু খাদের দিকে দৃশ্য ভারী মনোরম। পাহাড়ের খাঁজে পরপর ছোট ছোট কাঠের বাড়ি, সামনে ছোট্ট ক্ষেতে নানারকম গাছ গাছালি তাতে রঙ বেরঙের ফল ফুল অদ্ভুত সুন্দর লাগে। সব্জি চাষও হয়। ছোটবেলায় বইতে পড়েছি এই পদ্ধতিতে চাষ করাকে ‘ঝুম চাষ’ বলা হয়।

সবচেয়ে ভালো লাগে রঙিন পোষাক পরা নেপালি বাচ্চাদের দেখতে। সব সময় প্রাণ চঞ্চল ক্লান্তিহীন এরা। আমি বেশ কয়েকবার দার্জিলিং গেছি। প্রতিবারই এদের জীবন যাত্রা আমাকে আকর্ষণ করেছে।

পাহাড়ি পথে আরও একটা ব্যাপার ভীষণ রকম আকর্ষণীয়- আমি চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি নিচের সেই রাস্তাটা যেটা দিয়ে আমি এইমাত্র এলাম, আবার একটু পরেই যেটা দিয়ে যাব সেই রাস্তাটাও দেখতে পাচ্ছি। মনের মধ্যে রোমাঞ্চ হতে থাকে।

সেবার কপাল বোধহয় আমাদের মন্দ ছিল। কী জানি? এন জে পি থেকেই আকাশ মেঘলা। যত এগোতে লাগলাম তত মেঘলা যেন বাড়তে লাগল। পাহাড়ে ওঠার পথে মাঝে মাঝেই বৃষ্টি পেতে শুরু করলাম। আমার কিন্তু ভারী মজা হচ্ছিল। এতদিন মেঘ দেখেছি আকাশের বুকে। এই প্রথম মেঘ দেখলাম হাতের কাছে। চোখের সামনে দিয়ে ভেসে যাচ্ছে।  গাড়ির জানলার কাচে এসে ধাক্কা দিচ্ছে। মনে হচ্ছে হাত বাড়ালেই মেঘটাকে ধরে ফেলব।

কার্রশিয়াং-এর কাছে একটা গুমটি দোকানে চা খেতে ঢুকলাম। আমার মন তখন চা ছেড়ে মেঘের দিকে ধাবমান।

হাতের সামনে, মুখের সামনে মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। কী যে অপরূপ স্বর্গীয় অনুভূতি লিখে বোঝানো সম্ভব নয়। বাচ্চা বয়সটা যেন আরও বাচ্চা হয়ে গেল, হাত বাড়িয়ে মেঘ ধরলাম। কিছুই পেলাম না। ভেবেছিলাম জল পাব কিন্তু নাহ্‌।  আবার ধরলাম আবার ধোঁয়া ধোঁয়া মিলিয়ে গেল। তবু মেঘ তো ধরলাম, “মন মোর মেঘেরও সঙ্গী…” 

“উ মেমসাব চা খাইয়ে যান।”নেপালি ছেলেটা গুমটি থেকে ডাকছে।

“মেঘ ধরছি দ্যাখো, কত মেঘ ভেসে যাচ্ছে…”

আমার কাণ্ড দেখে ছেলেটা হাসছে। অন্যরাও হাসছে। কিন্তু আরেকজন রক্তচক্ষু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার হাসি উবে গেছে। বেশিক্ষণ দাঁড়াতে দিল না। হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলো, ঠাণ্ডা লেগে গেলে কী হবে? এই অচেনা জায়গায়, কী করব আমি?

অগত্যা মন খারাপ হল কিন্তু মেঘ আর ধরা হল না।

ডিসেম্বর মাস। বৃষ্টির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কনকনে  ঠাণ্ডা। গরম জামাকাপড় যা সঙ্গে ছিল সব চড়িয়েও ঠাণ্ডা কমছে না।

পৌঁছতে পৌঁছতে সাড়ে চারটে বেজে গেল।

হলিডে হোম বুক করা ছিল। সামনের দিকের একটা বসার ঘরে আমাদের বসতে দিল।

বাড়ির মালকিন বেরিয়ে এলেন একটু পরে। আজও মনে পড়ে ভদ্রমহিলা অসম্ভব রকম সুন্দরী। যেমন লম্বা, তেমন ফর্সা, তেমনই সুন্দর নাক, চোখ মুখ। ততোধিক সুন্দর তাঁর ব্যক্তিত্ব। প্রথম দর্শনেই মুগ্ধ হলাম।

ঘরের চাবি এগিয়ে দিতে দিতে আমার দিকে তাকিয়ে স্মিত হেসে বললেন, “You have chosen the coldest time.”

আমিও হেসে হেসে জবাব দিলাম, “এই সময়টাতেই যে আবহাওয়া সব থেকে পরিষ্কার থাকে!”

তিনি আবারও একগাল হেসে বললেন, “সে তো দেখতেই পাচ্ছো কেমন ক্লিয়ার ওয়েদার!”

আমি ওনার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম, “কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে পাব না, তাই না?”

তিনি আশ্বাস দিয়ে বললেন,  “দ্যাখো তোমরা তো থাকবে তিন দিন, তার মধ্যে ঠিক হয়ে যেতেও পারে। তোমাদের ভাগ্যে যদি থাকে তাহলে ঠিক দেখতে পাবে!”

একটু পরেই কফি আর বিস্কুট চলে এল। সেই সন্ধ্যায় আর কোথাও বেরোলাম না। দুদিনের ক্লান্তিতে একটা দারুণ ঘুম হল। রাতে অবশ্য গরম গরম রুটি আর চিকেন কষাতে বেশ জমে গিয়েছিল।

পরদিন বেশ ভোরে আমার ঘুম ভেঙে গেল। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি পাঁচটা বাজে। নিজেই অবাক হলাম এত তাড়াতাড়ি তো আমার ঘুম কখনও ভাঙে না! আসলে জানলার রঙিন শার্সি দিয়ে আলো এসে চোখে পড়ায় ঘুম ভেঙে গিয়েছিল।

আবার আপাদমস্তক ঢাকা দিয়ে শুয়ে পড়লাম। বেরোতে তখনও অনেকটা দেরি অতএব চিন্তা নেই।

সকালে একেবারে সাহেবি কায়দার ব্রেকফাস্ট । ডিম সেদ্ধ, বাটার টোষ্ট, কলা আর চা। পেট পুরে খেয়ে নিয়ে  আশপাশের জায়গাগুলো ঘুরে  দেখব বলে বেরিয়ে পড়লাম। সঙ্গে অবশ্য হলিডে হোম থেকে দেওয়া লাঞ্চ প্যাক ছিল। এখানেও সেই ছোট জিপ গাড়িতে যতজন ধরে ঠেসেঠুসে বসলাম।

প্রথমে দেখলাম লয়েড বোটানিক্যাল গার্ডেন। খুব সুন্দর বাগান। নানা রঙের সারিবদ্ধ ফুল গাছ, পাতা বাহার গাছ অপূর্ব লাগে। এরপর গেলাম  চিড়িয়াখানায়, উল্লেখযোগ্য কিছু পেলাম না।  তারপর একটা চা পাতা কারখানায় নিয়ে গেল। বিশাল জায়গা, অনেক লোকজন কাজ করছে। গাইড আমাদেরকে ঘুরে ঘুরে সব দেখাতে লাগল। বড় বড় মেশিন সেট করা। রাশি রাশি ‘দুটি পাতা একটি কুঁড়ি’ তুলে পিঠে ঝোলানো ঝুড়িতে  বোঝাই করে নিয়ে এসে, এক জায়গায় জড়ো করছে স্থানীয় মেয়েরা। তারপর তাকে রোদে শুকিয়ে, কাটিং করে, আলাদা আলাদা করা হচ্ছে। সেখান থেকে বাক্স বোঝাই হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে সারা পৃথিবীতে। দক্ষ যজ্ঞ চলছে যেন।    

এরপর আমাদের নিয়ে গিয়েছিল সম্ভবত কোনও উল তৈরির কারখানায়। মনে আছে কারণ এখানে একটা মজার ব্যাপার হয়েছিল।  বিশাল বড় একটা ঘরের মত জায়গায় সার সার স্থানীয় মেয়েরা বসে কাজ করছিল। অদ্ভুত ধরণের  ছোট ছোট তাঁতের মতন যন্ত্রে সুতো কাটছিল সবাই। ফর্সা ফর্সা সুন্দর মেয়েগুলোকে লাল নীল সবুজ বেগনি রঙের পোষাকে  খুব মানিয়েছিল।

এই মেয়েরা কোনও টুরিস্ট পুরুষ দেখলেই তার দিকে তাকিয়ে গান ধরছিল, “শুন শুন সাইবা শুন, পেয়ার কি ধুন, ম্যায়নে তুঝে চুন লিয়া তু ভি মুঝে চুন…”

গাইতে গাইতে নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি করছে একটু থামছে, কোনও অচেনা ছেলে ঢুকলেই আবার তারস্বরে শুরু করছে। একই গান বারবার করে চলেছে। বুঝলাম সময় বিশেষে আদম টিজিংও হয়। 

সেবার কিন্তু ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল না। তিনদিন ধরেই আকাশটা মুখ ভার করে রইল। ফলে টাইগার হিল আর যাওয়া হল না।

যেদিন চলে আসব সেদিন আকাশ পরিষ্কার হল। ফেরার বাসে উঠতে গিয়ে পা আটকে গেল, গাঢ় নীল আকাশের মধ্যে ঝকঝকে সাদা বরফের দুধসাদা কাঞ্চনজঙ্ঘা। দেখে চোখ ফেরানো যায় না।    

দেখলাম বটে মন ভরল না। বাসে উঠে পড়তে হল। 

দুই

প্রায় তিরিশ বছর পর আবার একবার রওনা হলাম সেই দার্জিলিঙের পথে। এবার ছেলের হাত ধরে। সেই দার্জিলিং মেইল  অথচ কত পার্থক্য।

বাতানুকুল কোচের মধ্যে আগের মত ঠাণ্ডা লাগে না। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন বেড রোল দেওয়া হয়। খাবারের প্যাকেট পৌঁছে দিয়ে গেছে সুইগি থেকে। জলের বোতলটাও কিনতে পাওয়া যায়। বকবক  করে আলাপ জমাবার বা খাবারে ভাগ বসাবার কেউ নেই।

এবার কিন্তু সালোয়ার কামিজ পরে আছি। বাধা নিষেধ কবেই উঠে গেছে। তবু তিরিশ বছর আগের ঘটনাগুলো চোখের সামনে দিয়ে ঘুরে যাচ্ছে।

এত সুবিধার পরেও সব সময় ছেলের সজাগ দৃষ্টি, মায়ের কোনও অসুবিধা যেন না হয়। অসুবিধার আর আছেটাই বা কী?  আমাদের এখন সর্বক্ষণের সাথী মুঠোফোনও তো হাতেই আছে।     

নিউ জলপাইগুড়িতে নেমে সুন্দর আবহাওয়া পেলাম। গাড়িও আগে থেকেই বুক করা ছিল। যাবার পথে এবারও দুচোখ ভরে পাহাড় দেখছিলাম। এবার আর মুঠোর  ভিতর মেঘ পেলাম না।

ঝাঁ চকচকে হোটেলের রিসেপ্সানে দাঁড়িয়ে একবার সেই ভদ্রমহিলার মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠল সঙ্গে কথাগুলো, You have chosen the coldest time.

জানি না আজও আছেন কী না? তখনই যথেষ্ট বয়স হয়ে গিয়েছিল। এতদিন পর সেই হোমটাও কী আর আছে?

এবার এসেছি অক্টোবরে অতএব কোলডেস্ট টাইম বলা যায় না।

এখানে সকালে ব্রেক ফাস্টে খাবারের ছড়াছড়ি। ইডলি, ধোসা, চাউমিন থেকে শুরু করে আলু পরাঠা পর্যন্ত। বুফে সিস্টেমে  যা খুশি যত খুশি খাও। 

আমার ছেলেটাও বেশ খুশি খুশি। গাড়ি বুক করে সাইড সিয়িংএ গেলাম। এবার আর সেই কারখানাগুলোয় নিয়ে গেলো না। জিজ্ঞেস করাতে ড্রাইভার বলল, ওসব এখন আর নেই।

এবার বরং রোপ ওয়ে চড়া হল। বেশ অনেকটা সময় গেল রোপ ওয়ে চড়তে গিয়ে। দুই পাড়েই অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হল। প্রচুর ভিড় ছিল।  

রোপ ওয়েতে উঠে চারদিকে তাকালাম, আহা পাহাড়ের কী অপূর্ব শোভা!  বড় গাছ, ছোট গাছ, নানা রঙের ফুল, চোখের আরাম আর কাকে বলে! এর মাঝে পাহাড়ের গায়ে অজস্র চা বাগান। ছোট ছোট এক সাইজের গাছে ভরে আছে। মেয়েরা আজও একইভাবে চা পাতা তুলছে।

সত্যি বলতে কী, আমার কিন্তু মনে মনে ভয়ও করছিল যখন নীচে দিকে চোখ যাচ্ছিল। অনন্ত অতল  খাদ। একবার যদি দড়িটা ছেঁড়ে না…

সেই জন্যই বিশেষ করে চারপাশে দৃষ্টিটাকে ঘুরিয়ে রাখছিলাম।

ফিরে আসতে বুঝলাম ড্রাইভার বাবুর একটু গোঁসা হয়েছে। আসলে আমাদের বেশ অনেকটা দেরি হয়ে গিয়েছিল। তার বোধহয় কারও সঙ্গে ঘুরতে যাবার কথা ছিল। তাই আমরা রোপ ওয়েতে উঠি এটা সে চাইছিল না।   

টাইগার হিল দেখা আমার এবারেও হল না। সবাই বলল গাড়ি যেখানে দাঁড়াবে সেখান থেকে হেঁটে অনেকটা উঠতে হবে। এখন আমার হাঁটু আমার কথা শোনে না, অবাধ্যতা করে। তাই এবারেও টাইগার হিল ছাড়তে হল।

কলকাতায় থাকতেই ছেলে বলেছিল, মা তুমি এবার যাতে কাঞ্চন জঙ্ঘা ভালো করে দেখতে পাও সেই ব্যবস্থা করেছি।

আসলে সে দার্জিলিং থেকে ঋসভে গিয়ে দুদিন  থাকার ব্যবস্থা করেছিল।  

ঋসভে পৌঁছতেও সন্ধ্যা হয়ে গেল। রাত্রির পাহাড়ের শোভাও কিন্তু আসাধারণ। গাঢ় কালো অন্ধকারের বুকে ঝিকমিক জোনাকির মত অজস্র অসংখ্য বিজলি বাতির বিন্দু ফুটে থাকে। সব বাড়ির আলো দিয়ে অনাবিল স্বর্গীয় দৃশ্য তৈরি হয়। আকাশের দিকে তাকালে সেখানেও তারার মেলা।

পরের দিন সকাল নটা নাগাদ বের হলাম- সামনে দিগন্ত জোড়া পুরু গভীর বরফের আস্তরণ- কাঞ্চন জঙ্ঘা; সূর্যের আলোয় সোনার মত ঝকঝক করছে। আলো যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসছে। সারা পাহাড় জুড়ে ছড়িয়ে আছে নিরেট সোনা। মনে হল এইজন্যই বোধহয় কাঞ্চন নাম হয়েছে। কাঞ্চন মানে যে সোনা। সোনার পাহাড়; তাই কাঞ্চন জঙ্ঘা;

ছেলে আঙুল দেখিয়ে বলল, মা দেখো দেখো, ‘স্লিপিং বুদ্ধা’; পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে।  

ওর চোখে মুখে বিস্ময় আর আনন্দ। আমি বললাম, মানে?

-ঐ দ্যাখো, মনে হচ্ছে যেন একজন মানুষ চিৎ হয়ে শুয়ে ঘুমিয়ে আছে। ঐ যে তার মাথা, তারপর বুক, তারপর পেট, তারপর পা। বুঝতে পারছো?

আমি মাথা নাড়লাম, বুঝতে পারছি। একজন শায়িত মানুষের অবয়ব পরিষ্কার কল্পনা করতে পারছি।  

এই নামটা আমি জানতাম না।  জিজ্ঞেস করলাম, এমন নাম কেন রে?

ছেলে বলল, কাঞ্চনজঙ্ঘা নামটা ভাঙলে হয় কান-চেন-জঙ্ঘা। স্থানীয় ভাষায় কান মানে মাথা, চেন মানে পেট আর জঙ্ঘা হল পা। পুরোটা জুড়ে দিলে মনে হয় একজন মানুষ যেন শুয়ে আছে। তাই এমন নাম।

আমি আবার জানতে চাইলাম, সেতো বুঝলাম কিন্তু বুদ্ধই কেন শুয়ে আছে বলছে?

আমার ছেলে বলল, এটা হয়ত এখানকার মানুষের বিশ্বাস।

কিন্তু আমার মনে হল, শুধু ভগবান বুদ্ধ কেন? আমি যদি ভাবি সেই সৃষ্টির আদিকাল থেকে দেবাদিদেব মহেশ্বর শুয়ে আছেন? সারা পৃথিবীর সমস্ত গরল শুষে নিয়ে , অমৃত ছড়িয়ে দিচ্ছেন প্রকৃতির বুকে ? অথবা ভগবান বিষ্ণু? অনন্ত শয্যায় যিনি শায়িত আছেন যুগ যুগ ধরে। যোগনিদ্রায় রক্ষা করে চলেছেন ধরণীর ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র ধূলিকণাটিকেও ?

কেনই বা নন ঈশ্বরপুত্র খৃষ্ট? হয়ত কবর থেকে বেরিয়ে এসে হিমালয়ের বুকে নিশ্চিন্ত নিদ্রায় নিমগ্ন আছেন।

অথবা কোনও পীর-পয়গম্বর?

যেই হন না কেন কোটি কোটি বছর ধরে তিনি একভাবে শুয়ে আছেন আর রক্ষা করে চলেছেন পৃথিবীকে। ঠিক যেমন ভাবে হারকিউলিস্‌ যুগ যুগ ধরে , ধরে রেখেছেন পৃথিবীকে নিজের কাঁধের উপর। একটু এদিক ওদিক হলেই পতন হবে।

আমার দেখা পূর্ণ হল। দৃষ্টি সার্থক হল।

আজকে ঐ অনন্ত যোগীপুরুষের সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে পিঁপড়ের থেকেও ক্ষুদ্র মনে হচ্ছে।

মনে মনে বললাম, আমি জানি না আপনি কে? শুধু এটুকু জানি আপনি অনন্ত, অসীম। আপনি যেই হন, আপনার ধ্যান গম্ভীর বিশালতার কাছে আমি আভূমি আনত হলাম।

সুতপা বিশ্বাস ঘোষ মূলত ছোট গল্প লেখেন। কবিতা এবং প্রবন্ধ লিখতে ভালবাসেন। অভিব‍্যক্তি নিউ জার্সি, শনিবারের আসর, সাহিত্য বিবর্তন, পাণ্ডুলিপি সহ বেশ কয়েকটি পত্রপত্রিকায় মুদ্রিত আকারে লেখা প্রকাশিত হয়েছে।

1 Comment

Avarage Rating:
  • 0 / 10
  • Manjulika Ray , January 15, 2023 @ 1:50 pm

    খুব ভালো লেখা। আন্তরিক ভাবে সহজ সরল ভাষায় পাহাড় ভ্রমণের গল্প।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *