ডেথ ভ্যালি

ডেথ ভ্যালি

দুর্গাপুজোটা কাটল সেবার ফরিদাবাদে। শুভ ছাড়ল না কিছুতেই। বলল, “পুজোর মধ্যে কলকাতায় থেকে কী-ই বা করবেন! এখন তো আর আগের মতন প্যান্ডেল হপিং করবেন না, ফলে সেই-তো চারটে দিন আপনার কেটে যাবে ঘরের মধ্যেই। তাছাড়া আপনি তো একা মানুষ, কোনো  পিছুটান নেই, চলে আসুন আমাদের এখানে।” 

কথাগুলো মিথ্যে বলেনি শুভ। আগে আগে তো পুজোর সময় পাগলের মতন এ-প্যান্ডেল সে-প্যান্ডেল ছুটেছি ক্যামেরা নিয়ে। ছবি তুলে ফেসবুকে পোস্ট করেছি। কত কত লাইক কমেন্ট বন্ধু-বান্ধবদের!  কিন্তু এখন আর সেসব ভালো লাগে না। গত কয়েকবছর একেবারে চুপচাপ, বাড়ির মধ্যে।  তবে দূর থেকে ভেসে আসা ঢাকের আওয়াজ বড় ভালো লাগে এখনও। রংবেরঙের পোশাকে সেজে থেকে ছোটদের হৈ-হুল্লোড় নিজের ফেলে আসা কৈশোর-যৌবনকে খুব মনে করিয়ে দেয়। 

তাই চলে গেলাম ফরিদাবাদ।  সেখানে কাছাকাছি দুটো পুজোর সঙ্গে শুভ জড়িয়ে আছে বহুদিন ধরে। নাটক, গান এসবের মধ্যে। কলকাতা থেকে আমার একজন সাহিত্যিক বন্ধু সুদীপও সেখানে হাজির। সুদীপ আগে ফরিদাবাদে  থাকত। এখন ও কলকাতার বাসিন্দা। পুজো উপলক্ষে সুদীপও হাজির ফরিদাবাদে। পুরোনো জায়গার টানই আলাদা। তা কখনও পুরোনো হয় না। 

সেদিন ছিল মহানবমী। দুপুরে খাওয়া-দাওয়া পুজো প্যান্ডেলে সেরে হাতমুখ ধুয়ে প্যান্ডেলের গেটের সামনে এসে দেখলাম, শুভ আর সুদীপ কিছু একটা বিষয় নিয়ে বেশ হাত নেড়ে নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। উৎসুক হয়ে গুটি গুটি পায়ে ওদের দিকে এগিয়ে গেলাম। ‘ডেথ ভ্যালি’ এই শব্দবন্ধটা কানে এল। এবার বেশ মনোযোগী হলাম ওদের কথাবার্তা শোনার জন্য। ডেথ ভ্যালি!  মৃত্যু উপত্যকা। এরকম নামকরণ কেন হল, সেটা পরে বুঝলাম। আরাবল্লীর পাহাড়-জঙ্গল এলাকার কেন্দ্রভূমিতে একটা বিরাট লেক বা ঝিল আছে, যেটা পুরোপুরি তৈরি হয়েছে এক বিশাল মাইনিং এরিয়া খনন করে। এটাকে ‘খুনি ঝিল’ও  বলা হয়, যেখান থেকে ‘ডেথ ভ্যালি’  নামটা এসেছে।  এই ঝিলটার চারপাশে এবং তলদেশে রয়েছে শুধু বড় বড় পাথরের চাঁই। ঝিলের জল স্বচ্ছ, একেবারে ক্রিস্টালের মত। সাধারণভাবে গাড়ি নিয়ে যাওয়া যায় একটা বিশেষ জায়গা পর্যন্ত, যার পরে গাড়ি আর যায় না।  কারণ চারপাশে বড় বড় বোল্ডার ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। সেখান থেকে দেখা যায়,  ঝিলের জলের রং নীলাভ  সবুজ রঙের। এবার গাড়ি দাঁড় করিয়ে সেই লেকের জলের কাছাকাছি যাওয়া বা জলের স্পর্শ পাওয়া সাধারণভাবে যে-কোনো মানুষের পক্ষে এটা ভয়ঙ্কর শক্ত কাজ। কারণ, ইতস্তত বিক্ষিপ্ত ছোট-বড় পাথরের উপর সাবধানে পা ফেলে ক্রমশ নিচে নামাটা ভীষণ রিস্কি। পাথর গড়িয়ে যেতে পারে কিংবা স্লিপ করে নিচে পড়ে গিয়ে মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটাও বিচিত্র নয়। এছাড়া আরো একটি ব্যাপার আছে। যদি কেউ সাহস করে নিচে নামেও, সেই জলে সাঁতার কাটা বিপজ্জনক, কারণ, জলের ঘনত্ব খুবই কম। ফলে জলে ভেসে থাকা বেশ কঠিন। রীতিমতন এক্সপার্ট সাঁতারু না হলে জলে নামা উচিত হবে না। আর, লেকের তলদেশে  শুধু বোল্ডার বা পাথরের স্তূপ।  অনেক মানুষ সেইভাবে প্রাণ হারিয়েছে অতীতে। এইসব কারণেই জায়গাটার নাম হয়েছে ‘ডেথ ভ্যালি’।  এছাড়া আরও কিছু সাবধান বাণী বা  সতর্কবার্তা মানুষের মুখে মুখে ফেরে।  একা বা দু’তিনজন মিলে সেখানে যাওয়াটাও বিপজ্জনক। কারণ, স্থানীয় কিছু মানুষের দ্বারা বা অন্যান্য দুষ্কৃতিকারীর দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে, যেহেতু জায়গাটা আক্ষরিক অর্থেই একেবারে জনমানবশূন্য। বলা হয়,  সাত-আট জনের কমে সেই জায়গায় যাওয়া উচিত নয়। আবার, জংলি জানোয়ার, যেমন ছোটখাটো লেপার্ড জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসতে পারে, যদিও একেবারে প্রকাশ্য দিবালোকে তাদের আবির্ভাবের সম্ভাবনা খুবই কম। তাই দলবল নিয়ে যাওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ এবং উচিতও বটে। 

শুভ এবং সুদীপের মধ্যে এসব নিয়ে কথাবার্তা হচ্ছিল। কিছুক্ষণ বাদে শুভ’র স্ত্রী গোপা এসে যোগ দিল আলোচনায়। তারপর ওই জায়গায় যাওয়ার কথা উঠল। সেটা ঠিক কবে কখন কীভাবে, প্রথমটায় বুঝে উঠতে পারিনি। টের পেলাম একটু বাদেই। সুদীপ গাড়ি নিয়ে এসেছিল পুজোমণ্ডপে। শুভ’ও। সুদীপ বলে উঠল শুভকে, “ঠিক আছে তাহলে। আমি চলে যাচ্ছি ওই গেটটার সামনে। আপনারা চলে আসুন।” 

তারপর সুদীপ আমাকে বলল, “আপনি আসুন আমার গাড়িতে।”

একটু হকচকিয়ে গেলাম। এখন তো খাওয়াদাওয়া হয়ে গেছে, দুপুর আড়াইটে বাজে, শুভ’র বাড়িতে গিয়ে একটু বিশ্রাম করব, তাহলে সুদীপের গাড়িতে কেন, কথাটা ভেবে শুভ’র দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালাম। শুভ বলল, “ডেথ ভ্যালিতে যাচ্ছি তো সুদীপের গাড়িতে। আমার গাড়িটা বাড়িতে রেখে দিয়ে দু’নম্বর গেটের কাছে চলে আসছি আমরা। আপনিও আসুন সুদীপের গাড়িতে।” 

“ও আচ্ছা, এখনই? তাহলে তো ক্যামেরা সঙ্গে নিতে হয়।”

সুদীপকে বললাম সেটা। সুদীপ সঙ্গে সঙ্গে বলল, “তাহলে আপনি ওদের গাড়িতে চলে যান।”

আমি শুভর গাড়িতে উঠলাম। তার মানে, শুভ, গোপা, সুদীপ আর আমি। কী কান্ড! মোটে চারজন? কম হয়ে গেল না? 

ক্যামেরা নিয়ে বেরোলাম। শুভ আর গোপা সঙ্গে। তিনজন হেঁটে গেলাম দু’নম্বর গেটের সামনে। একেবারে মেন রাস্তার সামনে। দেখলাম, রাস্তার উল্টোদিকে সুদীপের গাড়ি। রাস্তা পার হয়ে গাড়িতে উঠলাম। সুদীপ ড্রাইভিং সিটে, শুভ সামনে। আমি আর গোপা পেছনে। গাড়ি ছুটলো মেন রাস্তা ধরে। কিছুক্ষণ চলার পর বাঁ দিক ঘুরল আমাদের গাড়ি। জনবসতি কিছুটা ছাড়িয়ে এসে পড়লাম সরু লালচে-বাদামি রাস্তায়। আশপাশে মানুষজন দেখতে পেলাম না। কিছুটা সমতল রাস্তা পার হয়ে এবার আমাদের গাড়িটা একটু যেন ওপরের দিকে উঠতে লাগল। রাস্তার প্রকৃতি পাল্টে গেল নিমেষে। কেমন যেন এবড়ো খেবড়ো। দু’পাশে জঙ্গল শুরু হয়ে গেল। মাঝেমধ্যে দু’একটা গরু দেখা যাচ্ছিল। তার মানে, কাছে-পিঠে কোনো গ্রাম আছে, স্থানীয়দের বসতি আছে, কিন্তু লোকজন নজরে আসছিল না। দু’একটা ময়ূরও নজরে এল। বুঝলাম, লোকালয় ছাড়িয়ে আমরা একটু জঙ্গলেই এসে পড়েছি। ইচ্ছে হচ্ছিল, গাড়ির কাচ নামিয়ে ময়ূরের ছবি তুলি। তবে দু’পাশে জঙ্গলের প্রকৃতি দেখে মনে হল, সেটা করা উচিত হবে না। আমাদের মূল লক্ষ্য তো সেই ‘খুনি ঝিল’। পৌঁছনো দরকার সেখানে আগে। তাছাড়া দিনের আলো ক্রমশ কমে আসবে, কারণ, আমরা রওনা দিয়েছি দুপুর আড়াইটে নাগাদ। সন্ধে হয়ে গেলে নানারকম বিপদে পড়ার সম্ভাবনা আছে। 

গাড়ি ছুটছে আঁকাবাঁকা রাস্তায়। কখনো কখনো দুটো রাস্তার জংশন এলে শুভ হাত দিয়ে পথনির্দেশ করছে। কারণ, শুভ বেশ কয়েকবার দশ-বারো জন বন্ধুসহ সেখানে গিয়েছিল। রাস্তাঘাট ওর চেনা। আমরা সংখ্যায় চারজন, তার মধ্যে গোপা আবার মেয়ে। বেশ একটু চিন্তা হচ্ছিল। অস্ফুটে বলেই ফেললাম, “বাবা! বেশ নির্জন জায়গা। আমরা আবার চারজন!”

শুভ হেসে বলল, “স্যার ভয় পাচ্ছেন!” বললাম, “ভয়-দুশ্চিন্তা দুটোই আছে!” সুদীপ নীরবে গাড়ি চালাচ্ছে।

একসময় গাড়ি থামল আমাদের। শুভ বলল, “এই রাস্তায় এরপর আর গাড়ি যাবে না।”

গাড়ির কাঁচের জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখলাম অসংখ্য ছোট-বড় বাঁদর গাড়িটার কাছে চলে এসেছে। এত বাঁদর একসঙ্গে দেখার সুযোগ এর আগে কখনো হয়নি। কোনো কোনোটা বেশ বড় বাঁদর, সেইরকমই কোনো কোনো বড় বাঁদরের কোলে ছোট্ট একটা বাচ্চা। মা-বাঁদরটা ওইভাবেই বাচ্চাকে নিয়ে আমাদের গাড়ির সামনে চলে এসেছে। কোনোটা আবার খুব ছোট্ট, আমাদের গাড়ির চারপাশে ঘুরঘুর করছে। শুভ জানাল ওরা খাবারের লোভে এসেছে। গোপা বলে উঠল, “ইস, সঙ্গে কিছু খাবার আনলে ভালো হত!”

সুদীপ বলল, “তাহলে আর দেখতে হত না, একেবারে ছেঁকে ধরত!”

শুভ বলল, “ছেঁকে ধরে কিনা দ্যাখো, এখনই টের পাবে!” 

আমি গাড়ির পেছনদিকে বসে, গাড়ির দরজা তখনও বন্ধ।  তা’ও দেখতে পাচ্ছি, বেশ কিছু বাঁদর দরজার সামনে এসে গেছে। তারই মধ্যে দুএকটা আবার গাড়ির কাঁচ দিয়ে ভেতরটা দেখার চেষ্টা করছে। শুভ ততক্ষণে গাড়ির সামনের দরজা খুলে দিয়েছে। ওর দেখাদেখি আমিও সাহসে ভর করে পেছনদিকে দরজা খুললাম। দুএকটা বাঁদর তখন আমার পাশ দিয়ে উঁকিঝুঁকি মেরে গাড়ির ভেতরটা দেখে চলেছে, কিছু খাবার যদি পাওয়া যায়। আমি সন্তর্পণে নামলাম গাড়ি থেকে। ওদের গায়ে পা দিয়ে ফেলি আর কি! মাটিতে পা রাখতেই ওরা কেউ কেউ ছুটে পালিয়ে গিয়ে কিছুটা দূরে গিয়ে বসে অপেক্ষা করতে লাগলো। আমি কিছুটা সামনে এগোতেই আরও একটু দূরে পালিয়ে গিয়ে বসে থাকল নিরাপদ দূরত্বে। বুঝলাম, ওরা ভয় পেয়েছে। ফলে আমার ভয় চলে গেল অচিরেই। আমরা চারজনই তখন নেমে পড়েছি গাড়ি থেকে। বাঁদরগুলো সব একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। কিছু ছবি তুললাম ওদের। একটু পরেই ওরা বুঝে গেল, আমাদের কাছে খাবার নেই। ফলে ওরা তখন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। দূর থেকে বেশ কিছুটা নিচে লেকের একটা অংশ দেখতে পেলাম। নীলাভ সবুজ জল। নীল জলের ধার বেয়ে পাথরের দেওয়াল উঠে গিয়েছে খাড়াভাবে। কিছু ছবি তুললাম। বাকিরাও ছবি তোলাতে ব্যস্ত তখন। হঠাৎ চোখ গেল আমাদের দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িটার দিকে। দু’তিনটে বাঁদর তখন গাড়ির উপর বসে মেজাজে চারপাশের দৃশ্য দেখছে। তাদের মধ্যে কাউকে কাউকে দেখলাম, গাড়ির হাতল ধরে দরজা খোলার চেষ্টা করছে। কেউ কেউ আবার গাড়ির তলায় ঢুকছে, আবার বেরোচ্ছে, মনে হচ্ছিল, ওরা নিজেদের মধ্যে লুকোচুরি খেলছে। কিছুক্ষণ ওই জায়গায় গাড়িটা রেখে আমরা হেঁটে চললাম সামনের দিকে।  কিছুটা যেতেই দেখলাম, বিরাট দুটো বড় বড় পাথর রাস্তার মাঝখানে। অর্থাৎ গাড়ি না যেতে পারার জন্য সুন্দর একটা ব্যবস্থাও বটে! ওই পাথর দুটো ছাড়িয়ে আমরা আরও সামনের দিকে এগিয়ে যাবো, এমন সময় দেখি, একটি দাড়িওয়ালা বছর তিরিশ-বত্রিশের যুবক, মাথায় পাগড়ি, মোটরবাইকে চেপে আমাদের কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়ে গেল। অনেকক্ষণ জায়গাটা ছিল জনমানবশূন্য, আমরা চারজন ছাড়া। এই ছেলেটি কোথা থেকে উদয় হল কে জানে! আমাদের লক্ষ্য করে ছেলেটি বলে উঠলো হিন্দিতে, যার বাংলা তর্জমা করলে দাঁড়ায়, “আর এগোবেন না সামনে!”

শুভ বলল, “কেন? কী হয়েছে?” 

শুভই কথা বলছে, আমরা শুনছি। 

“না, আর এগোনো যাবে না। বারণ আছে!”

“কীসের বারণ? কেন বারণ? কে বারণ করেছে?” 

ছেলেটির মুখমণ্ডলে এবার কঠিন ভাব। 

“আমি বারণ করছি। ওদিকে যাবেন না!”

আমি প্রমাদ গনলাম। ছেলেটির বডি-ল্যাঙ্গুয়েজ আমার ভাল লাগছিল না। আমরা সংখ্যায় চারজন। ছেলেটি একা, কিন্তু চারপাশ থেকে আরও আট-দশজন চলে এলে আমাদের কিছু করার থাকবে না। আমাদের মোবাইলগুলো ছিনতাই হয়ে যেতে পারে, সঙ্গে টাকাপয়সাও। আরো কত কী খারাপ হতে পারে, সে সব ধারণার বাইরে। আমি গুটি গুটি পায়ে ফিরতি পথে পা বাড়ালাম। উদ্দেশ্য, শুভও যেন তাই করে। গোপাও আমার পথ অনুসরণ করল। সুদীপ বলল, “ছেড়ে দিন শুভদা!”

কথাটা বলেই সুদীপও ফিরতি পথ ধরল।  ছেলেটির মুখ দেখে মনে হল, ও বাংলা জানে না। শুভ কথা বলে যাচ্ছে। আমি পেছনদিকে হাঁটতে হাঁটতে বললাম, “চলে এসো শুভ!”

গোপাও একই কথা বলল ফিরে যেতে যেতে। কিন্তু শুভ কথা বলেই যাচ্ছে।  

আমি, সুদীপ আর গোপা চলে এলাম গাড়ির জায়গায়। এখন শুভ এলেই হয়। গাড়িতে চেপে এবার ফেরার পথ ধরাটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। কারণ, বুঝতে পারলাম, ইচ্ছে মতন আমাদের আর কিছু করার নেই। দূর থেকে দেখলাম, শুভ কথা বলেই চলেছে ছেলেটির সঙ্গে। আমি শুভকে আরও দু’বার ডাকলাম। কিন্তু শুভ’র আর অন্যদিকে খেয়াল নেই।  কী কথা হচ্ছে ওদের মধ্যে, আমাদের বোঝার কিছু উপায় নেই, কারণ, আমরা অনেকটা দূর চলে এসেছি। মজা করে বললাম, মনে হচ্ছে, শুভ শেষ না দেখে ছাড়বে না। আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে চলেছি শুভর জন্য। 

এমন সময় শুনতে পেলাম শুভ ছেলেটিকে বলল, “তো ঠিক হ্যায়, চলিয়ে!”

বলে হাত দিয়ে ইঙ্গিত করল আমাদের দিকে। কী হল বুঝলাম না। ছেলেটি তার মোটরবাইক নিয়ে আমাদের গাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল। শুভ জোর কদমে আমাদের কাছে এসে আমাকে উদ্দেশ্য করে বলল, “উঠে পড়ুন গাড়িতে!”

আমরা তিনজন এবং শুভ গাড়িতে উঠে পড়লাম। 

শুভ সুদীপকে বলল, “ছেলেটিকে ফলো করো!”  

ছেলেটি ততক্ষণে তার বাইকে স্টার্ট দিয়েছে। বুঝলাম, কিছু একটা রফা হয়েছে শুভ’র সঙ্গে। কিন্তু সেটা কী, তখনই বুঝলাম না। শুধু দেখছি, ছেলেটি বাইক চালিয়ে সামনে এগোচ্ছে, আর, আমরা ওকে অনুসরণ করছি। 

বেশ উৎকণ্ঠা নিয়ে শুভকে বললাম, “কী ব্যাপার? আমরা কোথায় যাচ্ছি?” 

শুভ বলল, “ও আমাদের একটা জায়গায় নিয়ে যাবে, যেখান থেকে ‘ডেথ ভ্যালি’র আসল রূপ দেখা যায়!”

অর্থাৎ যে-অংশটা বিপজ্জনক সেই জায়গাটা। এবার সত্যিই একটু ভয় পেলাম। ছেলেটি ঠিক বলছে তো? গোপা বলে উঠল, “শুভ, এটা বোধহয় একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেল। কারণ, ছেলেটার চাহনি আমার ঠিক সুবিধার মনে হচ্ছিল না। কেন তুমি এসব ঝামেলায় গেলে?”  

কথাটা বলেই সুদীপকে বলল গোপা, “অ্যাই সুদীপ, তুমি গাড়ি ঘোরাও তো!” 

শুভ এসব ব্যাপারে বরাবরই একটু সাহসী। ও ক্যাজুয়ালি বলল, “আরে বাবা, কিচ্ছু হবে না। আমি এখানে বেশ কয়েকবার এসেছি, দলবল নিয়ে। ছেলেটিকে বুঝিয়েও দিয়েছি সেটা। ও বুঝেছে সেটা, আমি নতুন নই এখানে, আমারও দল আছে!” 

গোপা বেশ বিরক্তি নিয়ে বলল, “কী যে বল, তার ঠিক নেই। এখন কি সেই দলবল তোমার সঙ্গে আছে? আমরা তো মোটে চারজন!” 

শুভ বলল, “তা নেই ঠিকই। তবে একটা ফোন করলে তারা যে ছুটে চলে আসবে, ছেলেটি বেশ ভালোই বুঝেছে!”

গোপা এবার বেশ উত্তেজিত হয়ে বলল, “কীসব বলছ, তার ঠিক নেই!  আরও দশটা ছেলে যদি আশপাশ থেকে চলে আসে, তুমি ফোন করার সুযোগ পাবে? আমাদের মোবাইলগুলো সব কেড়ে নেবে তো!” 

শুভ বলল, “ওদেরও প্রাণের ভয় আছে। অতসব কিছু করতে পারবে না। নেহাত আমরা চারজন আছি তাই বাধ্য হলাম ওর বারণ শুনতে। একটা সমঝোতায় এলাম তাই!” 

গোপা বেশ অবাক হয়ে ভুরু কুঁচকে বলল, “সমঝোতা? কীসের সমঝোতা?” 

শুভ বলল, “পার হেড একশো করে চেয়েছিল। অর্থাৎ সবসমেত চারশো। সেটা দুশোতে নামিয়েছি।”

গোপা বলল, “ও বাবা! শেষ পর্যন্ত টাকা দিয়ে রফা করতে হল! কী দরকার ছিল? আমরা ফিরে যেতাম না হয়। এখন কোথায় নিয়ে যায় দ্যাখো, আমি তেমন ভালো বুঝছি না!”

হতাশ হয়ে গোপা সিটে গা এলিয়ে দিল। 

সুদীপ গাড়ি চালাচ্ছে চুপচাপ। বাইকধারী ছেলেটি আঁকাবাঁকা পথে আমাদের নিয়ে চলেছে। ওকে অনুসরণ করছি আমরা। আমারও ঠিক ভাল লাগছিল না। গাড়ি চলেছে এবড়োখেবড়ো উঁচু-নিচু রাস্তা ধরে। কোথাও কোথাও রাস্তা এত সরু যে দু’পাশের বাবলা গাছের কাঁটাবন বিচ্ছিরিভাবে ছুঁয়ে যাচ্ছে গাড়িকে। একসময় বলে উঠল সুদীপ, “গাড়িতে না স্ক্র্যাচ পড়ে যায়! চিন্তা হচ্ছে!”

ছেলেটির মোটরবাইক বেশ দুরন্ত গতিতে সামনে এগিয়ে চলেছে। রাস্তার নতুন কোনো বাঁকের মুখে এসে বাইক দাঁড়িয়ে পড়ছে হঠাৎ। ছেলেটি পেছনে ফিরে তাকাচ্ছে তখন। গোপা বলে উঠল, “ওই দ্যাখো, ছেলেটি কিছুদূর গিয়েই মাঝে মাঝে তাকাচ্ছে, যাতে ওর শিকার না ফস্কে যায়!” 

আমি হেসে বললাম, “তা নয় বোধহয়, ও হয়তো ভাবছে, আমরা রাস্তা না গুলিয়ে ফেলি। দেখছো না, বাঁকের কাছাকাছি আমাদের গাড়ি আসতেই ও আবার বাইকে স্টার্ট দিচ্ছে।“ 

শুভ হেসে বলল, “গোপা ভয়ের চোটে এখন যা নয় তাই বলছে।” 

গোপার দুশ্চিন্তা যে আমাকেও গ্রাস করেনি তা নয়। তাই বলেই ফেললাম, “ছেলেটি আমাদের ভুল পথে নিয়ে যাচ্ছে না তো? ওর কোনো খারাপ মতলব নেই তো!” 

গোপা ভয় মেশানো হাসি নিয়ে বলল, “কিছুই বিচিত্র নয় এখানে। শেষে দেখা গেল, আমরা বোধহয় ট্র্যাপড হয়ে গেলাম!”

শুভ সাহস দিয়ে আমাদের বলল, “আরে বাবা, না না। তোমরা বেশি ভয় পাচ্ছ!” 

সুদীপ চুপচাপ ছিল এতক্ষণ। এবার বলল, “বেশ অ্যাডভেঞ্চারের গন্ধ পাচ্ছি!” 

বললাম, “এসব জায়গায় দলবল থাকলে অ্যাডভেঞ্চার উপভোগ করা যায়। কিন্তু এই মুহূর্তে অ্যাডভেঞ্চার উপভোগ্য হচ্ছে না!”

গোপা বলল, “যা বলেছেন!”

হঠাৎ দূরে দেখতে পেলাম, ছেলেটি বাইক থেকে নেমে পড়ল, তারপর সেটা একপাশে রেখে আমাদের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। যেখানে দাঁড়ালো বাইকটা তার দু’পাশে ঘন জঙ্গল, সামনে খোলা আকাশ দেখা যাচ্ছে। মনে হচ্ছিল, কোনো একটা খাদের কিনারায় চলে এসেছি। শুভ বলে উঠল, “আমরা বোধহয় এসে গেছি!”

আমাদের গাড়ি গিয়ে দাঁড়াল বাইকের সামনে। সকলে নামলাম গাড়ি থেকে। আহ! একেবারে মনোমুগ্ধকর দৃশ্য! সত্যিই একটা দুর্গম খাদ নেমে গেছে নিচে। দূরে বেশ কিছুটা নিচে দৃশ্যমান হল বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে নীলাভ-সবুজ লেক। খুনি লেক! কত মানুষ মারা গেছে ওই লেকে ডুবে! শুভ বলেছিল, প্রায় একশো ফুট গভীর ওই লেক। ওরা দলবল নিয়ে এসেছিল, অবশ্য অন্য রাস্তা ধরে, যেখানে পাগড়িধারী ছেলেটি আমাদের বারণ করেছিল আর না যেতে। শুভরা সেদিন লেকের জলে পা ডুবিয়েছিল, কেউ কেউ হাঁটু-জল পর্যন্ত নেমেছিল, পাথরের গা ধরে। ছবি তুলেছিল অনেক। তবে খুবই সাবধানে, কারণ, পাথরের গা পিছলে পড়ে গেলে জলে ডুবে মৃত্যু ঘটা বিচিত্র নয়। যেহেতু জলের ঘনত্ব খুব কম, এই জলে সাঁতার কাটা খুবই শক্ত। ফলে সে চেষ্টা ওরা কেউ করেনি। 

যেখানে আমাদের গাড়ি এসে দাঁড়াল সেখান থেকে নিচে লেকের কাছে যাওয়ার কোনো প্রশ্নই ছিল না। কারণ পাথরে ভরা খাড়া জঙ্গল নেমে গেছে নিচের দিকে। বাইকধারী ছেলেটিকে দেখলাম, নিমেষে ঠিক খাদের কিনারায় রাখা একটা বিরাট পাথরের চাইয়ের ওপরে গিয়ে আরামসে দাঁড়িয়ে থাকল আমাদের দিকে পিছন দিয়ে। যেন কত সহজ কাজটা! ঠিক ওই জায়গাটায় দাঁড়ানোর সাহস আমরা কেউ কোনদিন করতে পারবো না। কারণ, যে-জায়গাটায় ছেলেটি দাঁড়িয়েছিল সেটার সারফেস এরিয়া দুতিন বর্গফুটের বেশি হবে না। আর, সেই জায়গায় ছেলেটি দাঁড়িয়ে নিচে জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে থাকল। আমরা কেউ ওই জায়গায় দাঁড়ালে মুহূর্তে ব্যালেন্স হারিয়ে নীচে পড়ে যেতাম। ছেলেটির থেকে ছ’সাত ফুট দূরত্বে আমরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। কিছু ছবি তুললাম আমরা নিজেদের মধ্যে। তারপর ছেলেটিকে ডাকা হল। ওকে নিয়েও আমরা ছবি তুললাম। কথাপ্রসঙ্গে ওর নাম জানতে চাইলাম। প্রথমটায় চুপ করে ছিল, বলতে চাইছিল না। আমরা বললাম, এরপর যখন সময় নিয়ে আসব তখন তোমার সঙ্গে তো যোগাযোগ করতে হবে, নাম না জানলে সেটা কী করে সম্ভব হবে।  তখন বাধ্য হয়ে ছেলেটি বলল, ওর নাম ‘লোটা।’তাও বলল বেশ গম্ভীর হয়ে। আর কিছুই নয়, ওকে নিয়ে ছবি তোলা, ওর নাম জানতে চাওয়ার পেছনে আমাদের একমাত্র উদ্দেশ্য, ওর সঙ্গে সম্পর্কটা সহজ করে নেওয়া, কারণ, সত্যি বলতে কী, আমাদের ভয় বা সন্দেহ কিন্তু সম্পূর্ণ যায়নি তখনও। 

এবার ফিরব আমরা। শুভকে বললাম, ছেলেটিকে টাকা দেওয়ার কথা। শুভ মানিব্যাগ খুলে দুশো টাকার নোট খুঁজছিল। আমার কাছে দুশো’র নোট ছিল। সেটা বার করে শুভকে দিলাম। শুভ সেটা লোটার হাতে দিল। লোটা আবদার করল, আর পঞ্চাশ টাকার জন্য। শুভ তাকাল আমার দিকে। আমি ইশারায় বললাম দিয়ে দিতে। লোটা সেটা পেয়ে একটু হাসল। একটা গম্ভীর লোকের মুখে হাসি দেখতে বড় ভালো লাগে, বিশেষ করে আমরা যখন গভীর দুশ্চিন্তায় ছিলাম। আমাদের সমস্ত ভয়, সন্দেহ দূর হয়ে গেল সেই মুহূর্তে। আমরা গাড়িতে উঠে পড়লাম। লোটা হেসে হাত নাড়ল আমাদের দিকে তাকিয়ে। আমরাও হাত নাড়লাম। সুদীপ স্টার্ট  দিল গাড়িতে।

৫ জানুয়ারী ১৯৫৩ কলকাতায় জন্ম। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যা নিয়ে পাঁচ বছর পড়াশোনা। নিউক্লিয়ার ফিজিক্স নিয়ে পি এইচ ডি। ১৯৯১ – ২০০২ কম্পিউটার অ্যাপ্লিকেশন বিষয়ে তারাতলার ইন্সটিটিউট অব হোটেল ম্যানেজমেন্টে অধ্যাপনা। ২০০২ – ২০১৩ কলকাতার নেতাজীনগর ডে কলেজের কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগে অধ্যাপনা। তারপর প্রথাসম্মত অবসর। অবসরের পর পাঁচ বছর ধরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গেস্ট লেকচারার। কলেজ জীবন থেকে লেখালেখি শুরু। প্রথমদিকে কবিতা, তারপর নিয়মিত গল্প লেখা বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়, বইয়ের রিভিউ। এখন পুরো সময়টা কাটে সাহিত্য চর্চায়। ‘কণিকামাত্র’ এবং ‘অণুরেণু’ অণুগল্পের দু’টি সংকলন। ‘গল্প পঞ্চদশ’ পনেরোটি ছোটোগল্পের একটি সংকলন। এছাড়া খুব সম্প্রতি প্রকাশিত একটি উপন্যাস ‘কোভিডের দিনগুলি’।

1 Comment

Avarage Rating:
  • 0 / 10
  • অরুণ দে , April 20, 2024 @ 8:43 am

    চমৎকার !
    পড়তে পড়তে বেশ গা ছমছম করছিল । লেখকের লেখায় মুন্সিয়ানা যথেষ্ট । এমন লেখা পড়তে পড়তে থামানো যাবে না ।
    লোটা চরিত্রটি ভয়ংকর । লোটার ঐ‌ শক্ত চেহারায় হাসিটি বেশ মানিয়েছে । পাঠক চেষ্টা করলেই অমন মিষ্টি হাসি উপভোগ করতে পারবে ।
    ভ্রমণ কাহিনী, পুরোপুরি গল্পের ছলে লেখা । যার ফলে লেখাটি আরো আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে । এমন লেখা বারবার পড়তে ইচ্ছে করে । লেখাটি পড়তে পড়তেই সমগ্র ভ্রমণ ঘরে বসেই যেন আমার হয়ে গেল ।
    অসংখ্য ধন্যবাদ লেখক কে । অনুরোধ , এমন লেখা অনেক অনেক লিখুন ।
    পত্রিকার সকলকে এবং লেখক কে আমার শুভেচ্ছা জানালাম ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *