চার ফোঁটা একাত্তর

চার ফোঁটা একাত্তর

১.
সুরের মূর্ছনায় ভেসে যাচ্ছে ছোট্ট চালাঘরটি। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনছেন শ্রোতারা, চোখ মুদে রয়েছেন কেউ কেউ, সঙ্গীত সরোবরে সম্পূর্ণই নিমজ্জিত! দরবারী রাগ, ধ্রুপদী, কানাড়া, শ্রুতি কানাড়া, সিন্ধি, কাফি। এছাড়া চলে রবীন্দ্র সঙ্গীত, নজরুল গীতি, অতুলপ্রসাদী, শ্যামা, রামপ্রসাদী, এমনকি ইসলামী সঙ্গীত পর্যন্ত। এসবের অনেক কিছুই বোঝেন না শ্রোতারা, কিন্তু সঙ্গীতের অমিয় সুধা ঠিকই উন্মাতাল করে তোলে তাদের।
কখনো কখনো সাম্যের গান, দেশের গানও শোনান তিনি। নজরুলের ‘বল বীর / বল উন্নত মম শির / শির নেহারি’ আমারি নতশির ওই শিখর হিমাদ্রির!’ অথবা রঙ্গলালের ‘স্বাধীনতা-হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে / কে বাঁচিতে চায় / দাসত্ব শৃঙ্খল বল কে পরিবে পায় হে / কে পরিবে পায়’ ফুটিয়ে তোলেন গানে গানে। সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির সমর্থক হলেও গান নিয়েই কাটিয়ে দিয়েছেন সারাটা জীবন। কিন্তু সময়টা যে বড্ড জটিল! পিঁপড়ের মত পিষে মারছে মানুষ, একটু নিজের মত করে বাঁচার স্বাধীনতা থাকবে না মানুষের?
বলিহার। নওগাঁ জেলার সদর উপজেলাতেই অবস্থিত। এখানকার বিখ্যাত জমিদারদের কথা কে না জানে! পুরনো জমিদারবাড়িটি এখনো টিকে আছে বলিরেখার মত! সেই বলিহার সরগরম হয়ে উঠেছিল একাত্তরেও।
নওগাঁ ছিল মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে সেই ভাগ্যবান লোকালয়গুলির একটি, যেগুলি আক্ষরিক অর্থেই ছিল মুক্ত। কিন্তু পাকিস্তানী হানাদাররা একসময় রাজশাহী পর্যন্ত চলে এলে মুক্ত নওগাঁকে টিকিয়ে রাখতে তৎপর হয়ে উঠেন মুক্তিযোদ্ধারা, যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করতে ১৯শে এপ্রিল নওগাঁ সদর উপজেলার বলিহার ইউনিয়নের মূল ব্রিজটি উড়িয়ে দেন তারা।
ভীষণ সংকটে পড়ে যায় পাক হানাদারগণ। কী উপায়! কী উপায়! নাহ্‌, সমাধানসূত্র তো রয়েছে হাতের কাছেই! লাখে লাখে নিরীহ মানুষের বুক ঝাঁঝরা করে দিতে যাদের বাঁধেনি, একটি পুরনো জমিদারবাড়িকে হত্যা করতে তাদের আটকাবে? একে একে খুলে নেয় তারা বলিহার জমিদারবাড়ির দরজা-জানালা-কলকব্জা; আর এভাবে ২৩ শে এপ্রিলের মধ্যেই ব্রিজ পুনঃস্থাপন করে ফেলে পাকিস্তানি হায়েনারা। এরপর আর যায় কোথায়? মুহূর্তের মধ্যেই বিপুল বেগে ঝাঁপিয়ে পড়ে। মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে না পেয়ে আক্রোশ মেটানোর জন্য বেছে নেয় বেসামরিক নারী-পুরুষ-শিশু-বৃদ্ধকে। আর বলিহার গ্রামটিও ছিল বলিহারি ধর্মান্ধ পাক সেনাদের জন্য! নব্বই ভাগ হিন্দু অধ্যুষিত! হিন্দু রক্তপানের নেশায় জিহবাগুলি লকলক করতে থাকে পাকিস্তানি হানাদারদের!
বলিহার গ্রামের শতশত হিন্দু বাড়ি জ্বলছে। আগুনের শিখা আকাশকে ঢেকে ফেলেছে প্রায়। পাকিস্তানি হানাদার ও তাদের দেশীয় বশংবদেরা নির্বিচারে চালিয়ে যাচ্ছে হত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ।
ওরই মাঝে জমিদার বাড়ির ছেলে, মানিককিশোর, বাড়ির পশ্চিমদিকে লুকিয়ে পড়লেন। স্ত্রী ও পুত্রদের আগেই পাঠিয়ে দিয়েছিলেন কলকাতায়। কিন্তু নিজে যাননি। সত্তর বছর বয়স, তবু একজন শিল্পী হয়ে পালাবেন তিনি? আর তাছাড়া তিনি সারাজীবন ধরে এই শিক্ষাই কি দেননি যে, সঙ্গীতের কাছে হার মানে সমস্ত হিংসা-দ্বেষ, সুরের স্বর্গীয় পরশে গলে যায় পাষাণ হৃদয়?
খুনের নেশায় পাকিস্তানি হায়েনারা তখন মরিয়া, কিছুক্ষণের মধ্যেই ধরে ফেলে তারা মানিককিশোরকে, মারতে মারতে নিয়ে আসে বলিহার বাজারে, এরপর ঢুকিয়ে দেয় সামনের চালাঘরে। এরপর প্রেতোল্লাস!
পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয় মানিককিশোরের গায়ে। আস্তে আস্তে পুড়ে যেতে থাকে মানিককিশোরের প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, চামড়া, হাড়, মাংস – কয়লা হওয়ার আগ পর্যন্ত।
জমিদারবাড়ির ছেলে মানিককিশোর নান্যাসী। তবু মন ছিল না জমিদারীতে, বৈষয়িক কোন বিষয়ে। সঙ্গীত সুধার টানে ঘর ছাড়েন। বাংলার কিংবদন্তী আলাউদ্দিন খাঁর কাছেও দীক্ষা নিয়েছিলেন। ১৯৫০ সালে প্রজাস্বত্ব আইন বলবৎ হলে জমিদারী হারান মানিককিশোর; শোকে ভাসবেন কি, উল্টো হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন! যেন সুবিধেই হল মানিককিশোরের, সংগীত-জমিনে আরও নিবিষ্ট আবাদের পেয়ে গেলেন অনিঃশেষ অবকাশ। হয়ে উঠলেন নওগাঁর সাংস্কৃতিক দুনিয়ার অঘোষিত জমিদার!
উনিশশো একাত্তর সনের ৬ই মে, সেই মানিককিশোর সত্তর বছর বয়সে জীবন্ত বলি হলেন বলিহার বাজারের সেই চালাঘরটিতে, যেখানে টিনের চাল বেয়ে নামত সুরের বৃষ্টি, ফোঁটায় ফোঁটায় ভিজিয়ে দিত চালার তলায় আশ্রয় নেয়া ভাগ্যবান শ্রোতাদের! হয়ত বড় ভালবাসতেন চালাঘরটিকে, সে কারণেই সেই চালাঘরের যূপকাষ্ঠেই অগ্নিস্নান করে সেদিন অমরলোকে পৌঁছে গিয়েছিলেন শহীদ মানিককিশোর, সপ্তাকাশ জুড়ে তখন বেজেই চলছিল কোন ধ্রুপদী রাগ!


২.
চট্টগ্রামের একটি প্রত্যন্ত গ্রাম আঁধারমানিক। এই গ্রামেরই ছেলে হীরেন্দ্র তখন বাইশ বছরের টগবগে যুবক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়ানক দাবানল ছড়িয়ে পড়েছে সারা পৃথিবীতে। পুড়ছে মানুষ, গাছপালা, পশু-পাখি, ঘরবাড়ি, অফিস-আদালত। বিশ্বযুদ্ধের স্ফুলিঙ্গ একসময় ছড়িয়ে পড়ে বাংলাদেশের চট্টগ্রামেও। তরুণ হীরেন্দ্রের রক্ত গরম হয়ে উঠে। শরীরে বেয়ে নামতে থাকতে উষ্ণ প্রস্রবণের ধারা। কালবিলম্ব না করে যোগ দেয় ব্রিটিশ-ভারত সেনাবাহিনীতে।
সেই যে যোদ্ধার পোশাক গায়ে উঠল, তা আর ছাড়তে পারেননি ৪৭’ এর দেশভাগের পরও। দায়িত্ব পান তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের কুষ্টিয়া পুলিশ স্টেশনে। ৭১’ সনে হীরেন্দ্র মহাজন চৌধুরীর কাঁধে চাপে পিরোজপুরের দুর্নীতি দমন ব্যুরোর দায়িত্ব। কিন্তু সেই সময়ই শুরু হয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধ, বাঙ্গালীর হাজার বছরের আরাধ্য স্বাধীনতা সংগ্রাম।
হীরেন্দ্রের বয়স বাড়লেও স্বাধীনতার স্বপ্ন ও সাধ একটুও ম্লান হয়নি। রক্তে রয়ে গেছে এক আজন্ম যোদ্ধার বীজ। ইতিহাসের এই হিরণ্ময় সময়ে নিজেকে ঘরবন্দী করে রাখতে পারেননি হীরেন্দ্র। ইতিহাসের অমোঘ নিয়মে আবারো নামলেন যুদ্ধে, তবে এবারের মিশন কিছুটা ভিন্ন। নিজে যুদ্ধ করার চেয়ে মুক্তিযোদ্ধা তৈরিকেই তার কাছে বেশী গুরুত্বপূর্ণ মনে হল। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য নিজ উদ্যোগেই ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করলেন। শিখিয়ে দিতে লাগলেন নিজের সারাজীবনের তিল তিল করে শেখা সমস্ত রণকৌশল।
এদিকে হীরেন্দ্রের পরিচয় স্থানীয় রাজাকারদের মাধ্যমে অল্পদিনেই পৌঁছে গেল পিরোজপুরে অবস্থান নেয়া পাক বাহিনীর ক্যাপ্টেন এজাজের কাছে। ঐ সময়টিতে হীরেন্দ্রের পরিবার নিরাপত্তাজনিত কারণে পিরোজপুর শহর থেকে অনেক দূরের একটি প্রত্যন্ত গ্রাম পোড়াগোলা’র জনৈক কৃষ্ণকমল ভট্রাচার্যের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তো, ক্যাপ্টেন এজাজের নির্দেশে পিরোজপুরের টাউন দারোগা স্থানীয় রাজাকারদের সাহায্যে দ্রুতই পৌঁছে যান পোড়াগোলার বাড়িতে।
সময়টা ১৯৭১, ২২ শে মে, রাত প্রায় চারটা। ঐদিন পিরোজপুরের পোড়াগোলা থেকে হীরেন্দ্রকে তুলে নেয় ঘৃণ্য রাজাকারের দল। দিনের আলো ফুটতেই হীরেন্দ্রকে দাঁড় করিয়ে দেয়া হয় বলেশ্বর নদীর পাড়ে। তীব্রবেগে ছুটে আসে হায়েনা-রূপি হানাদারদের গুলির ঝাঁক। কিন্তু সামরিক কায়দা-কানুন জানা হীরেন্দ্র প্রায় সঙ্গে সঙ্গে নদীতে ঝাঁপ দেন, যদিও তার হাতে গুলি লাগে। এ অবস্থাতেই অমানুষিক কষ্ট সহ্য করে এবং অদম্য মনোবলের উপর ভর করে ডুব দিয়েই পাড়ি দেন অনেকটা পথ। এভাবে একটানা অবিরাম চলার পর পাশের গ্রামের এক জলাশয়ে গিয়ে থামেন। সেখানকার এক খন্ড কচুরিপানার নীচে আশ্রয় খোঁজার চেষ্টা করেন ক্লান্ত-শ্রান্ত হীরেন্দ্র।
কিন্তু পাক বাহিনীকে ফাঁকি দিলে কি হবে, আশে-পাশে মুখচেনা রাজাকারদের তো অভাব ছিল না। তারা ঠিকই গিয়ে উপস্থিত হয় হীরেন্দ্র যে জলাশয়টিতে আশ্রয় নিয়েছে সেখানে। পাকবাহিনীর সদস্যরা উপান্তর না দেখে জলাশয়েই গুলির বৃষ্টি ছুঁড়তে শুরু করে। এক সময় লাল বর্ণ ধারণ করে জলাশয়টি, আর হীরেন্দ্রের হিরণ্ময় দেহটিও ভেসে উঠে! আর এভাবেই আবির মেখে পরিসমাপ্তি ঘটে বাংলার এক হীরেন্দ্রের, এক আঁধারমানিকের।
হীরেন্দ্রের শেষ কথা ছিল: ‘দেশ স্বাধীন হবেই।‘ হীরেন্দ্র তার কাছে ট্রেনিং নেয়া মুক্তিযোদ্ধাদেরও সবসময় বলতেন, ‘দেশ স্বাধীন হবেই।‘
মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তী পালিত হয়েছে ঘটা করে বছর দুয়েক আগেই। কিন্তু স্বাধীন হয়েছে আসলে দেশ? যদি তাই হবে, তাহলে কেন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার-প্রার্থী কোন তরুণকে শুনতে হবে সে বিধর্মী, সে নষ্ট তরুণ?
হীরেন্দ্রের মুখে একটি কথা নাকি প্রায়ই শোনা যেত, তা হল: “Try to do something for the distressed people.” আসুন আমরা আমাদের চারপাশের ‘distressed people’ দের জন্য কিছু করি।

৩.
প্রথম চিঠিটির উপর লেখা ছিল: Addressee left.
দ্বিতীয় চিঠিটির উপর লেখা ছিল: Addressee gone to India.
কিন্তু কি হয়েছিল আসলে লোকটির? উনিশশো একাত্তরের সেই উত্তাল সময়ে কি ঘটে গিয়েছিল তার জীবনে? তিন চিল্লা সমাপ্ত করে এসেছেন যিনি, যার রয়েছে শ্মশ্রুমণ্ডিত মুখ ও জোব্বা-পরিহিত এক সফেদ অবয়ব? যিনি ছিলেন এক সরকারী প্রকৌশলী, আর যার কর্মস্থল ছিল রেলওয়ে ডিপার্টমেন্টের পার্বতীপুর অফিস এবং বসবাস রেল কোয়ার্টারের নিরাপদ ডেরায়? কোথায় গিয়েছিলেন তিনি?
হ্যাঁ, তিনি ছিলেন ধর্মানুরাগী এবং একই সঙ্গে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ; তিনি যখন সৈয়দপুরে চাকুরীরত ছিলেন, অসাধারণ সংকল্পের জোরেই নাইট কলেজে পড়াশুনো করে বি.কম. প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন।
কিন্তু সময়টা ভিন্ন, একেবারেই অন্যরকম। সত্য যে, তিনি রাজনীতির সাথে কোন সংস্রব রাখেন না সত্য। কর্তব্যনিষ্ঠায় তিনি অবিচল, তাও সত্য। খোদার কাছে নিজেকে এবং নিজের পরিবারকে সোপর্দ করে দিতে চাইছেন, সেও সত্য। কিন্তু সময়ের ডাক এড়িয়ে যাওয়া যায়? সময় যে সব থেকে বড় সত্য!
একাত্তরের ২৫ শে মার্চ দিনাজপুরের পার্বতীপুরে গুজব ছড়িয়ে পড়ে, কাছেই বগুড়ার শান্তাহারে কিছু বাঙালি কর্তৃক ব্যাপক বিহারী নিধন চলছে। এ খবর প্রচণ্ড উত্তেজনা সৃষ্টি করে পার্বতীপুরে, কারণ এখানেও শান্তাহারের মতই ব্যাপক বিহারী আবাদ ঘটেছিল, পাকিস্তানি জান্তার সহায়তায় তারা স্থানীয় বাঙালি সম্প্রদায়ের (শান্তাহারে যারা সংখ্যালঘু হিসেবেই বিবেচিত ছিল) উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল সর্বশক্তি নিয়ে!
চোখের সামনে এমন নির্যাতন ভীষণ দগ্ধ করছিল বাঙালি প্রকৌশলী সৈয়দ সরওয়ার আলম সোহরাবকে! তার অধস্তন রেলের অনেক কর্মচারীও এই নির্যাতনের হাত থেকে নিষ্কৃতি পাচ্ছিল না। কয়েকজন কর্মচারীর মধ্যে প্রতিশোধের আগুন গনগন করে উঠে, যুদ্ধে যাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে উঠে তারা। কিন্তু যুদ্ধে গেলে তাদের পরিবারগুলির কী হবে? তাদের টুকরো টুকরো করে ফেলবে না পাকিস্তানি বাহিনী এবং তাদের দেশীয় দোসর রাজাকার, বিহারী এবং শান্তির কমিটির সদস্যরা?
ভীষণ চিন্তায় পড়ে ঐ যুদ্ধগামী তরুণেরা শরণাপন্ন হলেন সোহরাবের। এই অবস্থায় তিনিই দিতে পারেন তাদের যুদ্ধে যাওয়ার ছাড়পত্র। তিনি শুধু স্থানীয় রেলের সবচেয়ে বড় বাঙ্গালী বাবুই নন, তার আছে ধর্মান্ধ পাকিস্তানিদের ভোলাতে দাড়ি এবং জোব্বার ইমানি চিহ্ন এবং সর্বোপরি, অনেক বড় একটি বাংলো, যেখানে তাদের রেখে যাওয়া পরিবারের নিরাপদ অবস্থান নিশ্চিত হতে পারে!
কিন্তু ঐ যে সময়টা বড্ড অন্যরকম! আর তার ডাক! সোহরাব তার স্ত্রী এবং ৪ পুত্রকন্যার জন্য মাত্র একটি ঘর রেখে বাকী ৬ টা ঘরই দিয়ে দিলেন আশ্রিতদের জন্য।
খবর চাপা থাকে না। এটিও থাকল না, বিশেষ করে সেই সময়ে, যখন রাজাকার আর বিহারীরা খবরের সন্ধানে ছুটে বেড়াচ্ছে সবখানে, শুঁকে বেড়াচ্ছে আগাপাছতলা এঁটো! বিহারীরা তাকে কয়েকবার ওয়ার্নিং দিয়ে গেল।
কিন্তু কানই দিলেন না তিনি। বরং আশ্রিতদের সেবায় পরিপূর্ণ নিয়োজিত থাকলেন সস্ত্রীক। হয়ে উঠলেন তাদের অঘোষিত অভিভাবক। আসলে তিনি তো খারাপ কাজ করছেন না। কিছু অসহায় লোককে আশ্রয় দিয়েছেন। আর আশ্রিতের সেবাই কি আল্লাহর ধর্ম না? তিনি মনে মনে শুধু আল্লাহকে ডাকেন, এই দুর্যোগ থেকে, এই বিপদ থেকে আল্লাহ্‌ যেন সবাইকে পানাহ্‌ দেন! অতি দ্রুত!
সেদিনও এশার নামায পড়ার নিয়তেই বদনা থেকে পানি ঢালছিলেন, কিন্তু ওযুটা সম্পূর্ণ করার আগেই কয়েকজন বিহারী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে এসে দাঁড়াল তার সামনে। তাদের সাথে যেতে বলল, মেজর সাহেব নাকি ডেকেছেন।
তিনি আল্লাহ্‌র কাছে তো আগেই সমর্পণ করেছেন নিজেকে, তাই উত্তেজনার ছিটেফোঁটাও দেখা গেল না তার মধ্যে, শান্তভাবে জবাব দিলেন, ‘একটু অপেক্ষা কর, নামাযটা পড়েই আসছি’।
নামাযের বিরতি দেয়ার সময় নেই উন্মত্ত বিহারীদের, এক অত্যুৎসাহী বিহারী তার গালে বেয়নেট চার্জ করলে স্রোতের মত রক্ত বেরুতে লাগল!
রেলে তখনও মাল বহনের জন্য কিছু কয়লার ইঞ্জিন ছিল। টেনে হিঁচড়ে তাকে তোলা হল এঞ্জিনে।
কি সাধনা, কি শ্রম দিয়েই না ইঞ্জিনিয়ারিং শিখেছিলেন। রেলেও অনেক বছর ছিলেন তিনি। ইঞ্জিন নিয়েই কাজ করতেন। কিন্তু কখনো কি ভেবেছিলেন ইঞ্জিনের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম যন্ত্রপাতির শরীরে ঢুকে পড়বেন?
বয়লারের ফায়ার-প্লেস দাউ দাউ করে জ্বলছিল! যখন একজন বিহারী ঢাকনাটা সরিয়ে দিল, গনগনে আগুনের আঁচে কাছে দাঁড়ানো পর্যন্ত যাচ্ছিল না! তাই খুব দ্রুত কাজ সারতে হয়েছিল বিহারী দলটিকে। তার মাথাটি ফায়ার-প্লেসের কাছে ঠেলে দিয়ে মুহূর্তেই নিক্ষেপ করা হল কুণ্ডের মধ্যে। তার স্ত্রীও কিছুক্ষণের মধ্যেই সঙ্গী হবেন তার, একই কুণ্ডে! ঢাকনাটি অবশ্য দুজনকে ঢোকানোর পর আবার টেনে দেয়া হয়েছিল! ভেতরে পুড়ছিলেন আলাহ্‌র কাছে নিজেদের পূর্ণাঙ্গ সোপর্দ করা দুজন নরনারী!
আল্লাহ না কি তার সবচেয়ে প্রিয় বান্দার জন্যই সব থেকে কঠিন পরীক্ষা রাখেন! যখন এমন অগ্নিপরীক্ষা ঘটছিল রেলের বাঙালি প্রকৌশলী সৈয়দ সরওয়ার আলম সোহরাব ও তার স্ত্রী আঞ্জুমা বেগম রানুর, তখন সেই আগুন নিশ্চয়ই শীতল হওয়ার নির্দেশ পেয়েছিল, আর ঐ আশ্রিত মানুষগুলোর অশ্রুধারা টলটল করে পড়ছিল সেই ফায়ার-প্লেসের জ্বলন্ত কুণ্ডে!

৪.
তার দুই বছরের মেয়ে সোমাকে ডাকার জন্য তার কাছে অনেকগুলো নাম ছিল, যখন যে নামে ইচ্ছে হত, সেই নামেই ডাকতেন। অন্ত্যজের প্রতি তার ভালবাসাটা এত তীব্র ছিল যে, মনে হয় একটি মাত্র নামে সে বন্দী হয়ে থাকতে চায়নি, ছড়িয়ে পড়তে চেয়েছে রংধনুর মত! সেই তাকেই যখন পরিবার-পরিজন ছেড়ে চলে আসতে হল পশ্চিম পাকিস্তানের লাহোরে ট্রেনিংয়ের উদ্দেশ্যে, স্ত্রীকে লিখলেনঃ “…my only consolation – I have come here to serve you and my sweet Shoma, my soul, better.”
ঝিনাইদহ কে.সি. কলেজের ছাত্র লতাফত হোসেন জোয়ার্দার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর যখন তার ইংরেজী বিভাগের করিডর দিয়ে হেঁটে যেতেন, তখন মেয়েরা তন্ময় হয়ে তাকিয়ে থাকতো তার দিকে; তার ফর্সা রং, খাড়া নাক, বুদ্ধিদীপ্ত বড় বড় চোখ, মাথা ভর্তি চুল থেকে তারা চোখ ফিরিয়ে নিতে পারতো না। এম .এ. পরীক্ষা শেষে ঢাকার পার্শ্ববর্তী কাপাসিয়া কলেজে অধ্যাপনার কাজে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু মাস ছয়েকের মধ্যেই প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে সুযোগ পেয়ে যান অস্ট্রেলেশিয়া (বর্তমানে রূপালি) ব্যাংকে। নিশ্চিতভাবেই একজন ব্যাংকারের আয় একজন অধ্যাপকের থেকে বেশী ছিল; না হলে, লতাফতের এমন একটি পেশা বেছে নেয়ার কথা নয়, যেখানে শুধু যন্ত্রের মত কাজ করে যেতে হয়, পরিবারকে দেয়ার মত সময় খুব কমই মেলে। এর মধ্যেও লতাফত তার সোমার জন্য একটুখানি সময় ঠিকই বের করে নিতেন – রাতে বাসায় ফিরে মেয়েকে কোলে করে আবার বেরিয়ে পড়তেন, রিকশায় চড়ে চক্কর দিতেন ছোট্ট ব্রাহ্মনবাড়িয়া শহরটা, যেখানে বদলি হয়ে এসেছিলেন ব্রাঞ্চ ইনচার্জের দায়িত্ব নিয়ে ।
কিন্তু যতই দিন গিয়েছে, তার ব্যাংকার চোখে খুব পরিষ্কার ধরা পড়েছে পূর্ব পাকিস্তানের সাথে পশ্চিম পাকিস্তানের তীব্র অর্থনৈতিক বৈষম্য! পূর্ব পাকিস্তানের কাঁচামালে শিল্প কারখানার রোশনাই বয়ে যাচ্ছিল পশিচম পাকিস্তানে। সোনার বাংলা শ্মশান কেন, এ প্রশ্ন নিশ্চয়ই তাকে খুব পোড়াত! একটা সময় তীব্র এক দহন তাকে সম্পূর্ণ বেষ্টন করে, আর ফিরিয়ে আনে পুরনো পেশায়! ১৯৭০ এর আগস্টে বরিশালের কলসকাঠিতে, আর তারপর ১৯৭১ এর ফেব্রুয়ারিতে কুস্টিয়ার দর্শনা কলেজে যোগ দেন অধ্যক্ষ হিসেবে। মুক্তিযুদ্ধের ঠিক আগ দিয়ে সর্বশেষ এই পোস্টিংটি মনে হয় নিয়তি চক্রে বাঁধা ছিল; না হলে, কেনই বা তার বাসা ও কলেজ ভবন – দুটোই ব্যবহৃত হবে মুক্তিযোদ্ধাদের বড় আশ্রয় কেন্দ্র হিসেবে! সীমান্ত পারাপার করা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য চাই খাবার, এবং একই সঙ্গে খবরও। সহকর্মীদের নিয়ে লতাফত কমিটি করে ফেলেন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হতেই। এপ্রিল থেকে জুলাই – এই সময়টাতে তিনি কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, দর্শনা, ঝিনাইদহ, যশোর ছুটোছুটি করে বেরিয়েছেন। পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর গতিবিধি, পরিকল্পণা ইত্যাদি সংগ্রহ করে এনে পৌঁছে দিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধাদের!
লতাফত ফুল খুব ভালবাসতেন। দর্শনার বাসায় একটি ফুলের বাগান ছিল যেখানে মেয়েকে নিয়ে খেলা করতেন রোজ। তার কলেজটাও তার কাছে ছিল এক ফুলের বাগান, তার ছাত্রেরা যেখানে ফুল হয়ে ফুটে থাকতো! যখন বাবা তাকে সীমান্ত পার হয়ে ভারতে আশ্রয় নিতে বলতেন, লতাফত বলতেন, “আমার ছেলেরা যুদ্ধ করছে। এদের ফেলে কি করে যাই।“ সেজন্যই ১৯৭১ এর ৩১ জুলাই শনিবার সকালে কৈ মাছ আর লাউশাকের ভর্তা দিয়ে ভাত খেয়ে যখন ঝিনাইদহের কাষ্টসাগর গ্রামের বাড়ি থেকে দর্শনায় ফিরতে চাইলেন, কেউ বাঁধা দিতে পারেননি! কারণ তার যে রয়েছে অনেক অনেক কাজ! যে কাজ তিনি ব্যাংকে বসে করতে পারতেন না, যে কাজের জন্য তিনি সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বিসর্জন দিয়েছেন! দেশকে ভালবাসার কাজে সেই যে তিনি বেরুলেন, আর ফেরেননি। মুক্তিযুদ্ধের ৫২ বছর পার হয়ে গেছে, এখনো পর্যন্ত তার খোঁজ মেলেনি!

তথ্যসূত্র: স্মৃতি: ১৯৭১, রশীদ হায়দার
…………………………

মোহাম্মদ কাজী মামুনের জন্ম ফরিদপুরে। শৈশবের আনন্দমুখর সময় কেটেছে মাদারিপুর জেলায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ম্যানেজমেন্ট নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। বর্তমানে ফিন্যান্স ও ব্যাংকিং সংস্থায় উচ্চপদে কর্মরত। বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে আর্থিক বিষয়াদির উপর প্রবন্ধ, লিখেছেন, সাহিত্য পত্রিকায় ছোট গল্প প্রকাশিত হয়েছে। বাবার একটি ব্যক্তিগত ছোট লাইব্রেরী ছিল যার বই-পাঠ শৈশবেই সাহিত্যের প্রতি ভালবাসা সৃষ্টি করে, আর কৈশোরে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সাথে যোগযোগ সেই সাহিত্যপ্রেমকে আরো উস্কে দেয়। লেখালিখির মাধ্যমেই সমাজ-জীবনে নিজের ভূমিকাটি রেখে যেতে চান।

3 Comments

Avarage Rating:
  • 0 / 10
  • Madhumita Roy , January 15, 2023 @ 5:51 am

    একাত্তরের মর্মান্তিক ঘটনাবলী যেন চোখের সামনে জ্বলজ্বল করে উঠলো।
    লেখককে ধন্যবাদ 🙏

  • Bratik Bandyopadhyay , January 15, 2023 @ 6:21 am

    লেখাটি পড়লাম, ভীষণ সুন্দর লাগলো। এই সময়কালের ব্যপারে আমি অত্যন্ত সেন্সিটিভ। ইলিয়াস সাহেবের উপন্যাস আর গল্প পড়ে। চমৎকার লিখেছেন আপনি, খুব মনকাড়া লেখা।

  • Nayan Basu , January 20, 2023 @ 12:34 pm

    পড়ে কষ্ট হলো। ভালো লিখেছ মামুন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *