বিপ্লবী-দার্শনিক মানবেন্দ্রনাথ রায়ের জীবনের পরবর্তী অধ্যায়: বিশ্বের আহ্বান

বিপ্লবী-দার্শনিক মানবেন্দ্রনাথ রায়ের জীবনের পরবর্তী অধ্যায়: বিশ্বের আহ্বান

নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য নাম পাল্টে হলেন ‘মানবেন্দ্রনাথ রায়’। নামের অর্থ রইল একই, কিন্তু ‘ভট্টাচার্য’ থেকে ‘রায়’-এ পদবির এই পরিবর্তন মানবেন্দ্রনাথের জীবন ও দর্শনের এক গভীর পালাবদলের সূচক হয়ে উঠল: নিতান্ত ব্রাহ্মণ্য-পরিচয়কে অস্বীকার করে তুলনামূলক বর্ণচিহ্নমুক্ত পদবি (‘রায়’ মূলত উপাধি, বিভিন্ন বর্ণের মানুষেরই থাকতে পারে এই পদবি) গ্রহণ করার মাধ্যমে মানবেন্দ্রনাথ এবার অতিক্রম করবেন হিন্দু-জাতীয়তাবাদের সীমাবদ্ধ পরিসর; তাঁর চিন্তা ও কর্ম-প্রয়াস হয়ে উঠবে বিশ্বমুখী।
আমেরিকায় মানবেন্দ্রনাথকে আশ্রয় দিলেন বিপ্লবী যাদুগোপাল মুখোপাধ্যায়ের ভাই, বিখ্যাত সাহিত্যিক ধনগোপাল মুখোপাধ্যায়। ধনগোপালের আতিথ্যে স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাস পাও-অল্টো শহরে থাকার সময় মানবেন্দ্রনাথের সঙ্গে পরিচয় হয় ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের উজ্জ্বল ছাত্রী ইভলিন ট্রেন্টের, যিনি ক্রমে হয়ে উঠবেন তাঁর প্রণয়ী ও স্ত্রী। আমেরিকায় থাকাকালীন ভারতের সশস্ত্র জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম থেকে তাঁর মানসিক দূরত্ব সূচিত হয়। প্রথমত, মানবেন্দ্রনাথের নিজস্ব বয়ান-অনুযায়ী, যতীন্দ্রনাথের মৃত্যু তাঁকে নির্ধারিত দায়িত্ব ও কর্তব্যপালনের দায় থেকে মুক্ত করেছিল (Memoirs 35)। দ্বিতীয়ত, জাপানে তিনি রাসবিহারী বসু ও চীনা-নেতা সান-ইয়াৎসেনের সঙ্গে দেখা করেন। তাঁরা মানবেন্দ্রনাথকে, যতক্ষণ-না পর্যন্ত জাপান সারা এশিয়া-ব্যাপী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য শক্তি-সঞ্চয় করে উঠতে পারছে ততক্ষণ, ভারতের স্বাধীনতা-অর্জনের লক্ষ্য থেকে বিরত থাকতে বলেন। এ ছাড়া, অরবিন্দ ঘোষের সক্রিয় রাজনীতি থেকে অবসর নিয়ে আধ্যাত্মিক-জীবন বেছে নেওয়াতেও তিনি গভীরভাবে হতাশ হয়েছিলেন।

ইভলিন ট্রেন্ট রায়
যতীন্দ্রনাথের মৃত্যু তাঁকে নির্ধারিত দায়িত্ব ও কর্তব্যপালনের দায় থেকে মুক্ত করেছিল
অরবিন্দ ঘোষের সক্রিয় রাজনীতি থেকে অবসর তাঁকে হতাশ করেছিল

যাই হোক, আমেরিকায় তাঁর সঙ্গে বিশিষ্ট আমেরিকান র‍্যাডিক্যালদের সাক্ষাৎ হয়; তিনি সমাজতন্ত্রের আদর্শের সঙ্গে পরিচিত হন। সে-দেশে লালা লজপৎ রাই-এর উৎসাহে কার্ল মার্কসের ডাস ক্যাপিটাল অধ্যয়ন করেন; আমেরিকার ‘সোশ্যালিস্ট ব্রাদারহুড’-এর প্রথম ভারতীয় সদস্য হন। ব্রিটিশ ও আমেরিকান পুলিশ একযোগে তাঁর গতিবিধির উপর নজর রাখত, ফলে বারবার বাসা ও শহর পাল্টাতে হত তাঁকে। ১৯১৭ সালের মার্চ মাসে আমেরিকান পুলিশের হাতে ধরাও পড়েন, আবার সতর্কীকরণের পর মুক্তি পান। সে-মাসেই স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট ড. ডেভিড জর্ডনের লিখে-দেওয়া পরিচয়পত্র নিয়ে নিউ ইয়র্ক থেকে মেক্সিকো পাড়ি দেন মানবেন্দ্রনাথ।
১৯১৭ সালের ১৫ জুন মানবেন্দ্রনাথ রায়ের মেক্সিকো আগমন। ততদিনে তিনি পুরোপুরি সমাজতন্ত্রী—শুধুমাত্র ভারত নয়, বিশ্বজুড়ে শোষিত মানুষের মুক্তির অন্বেষণে রত। মেক্সিকোতে আসার ঠিক আগেই আমেরিকার প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসনকে লিখেছেন খোলা চিঠি, যেখানে তিনি সমাজতান্ত্রিক দৃষ্টিতে ভারতে ব্রিটিশ-শাসনের স্বরূপ উন্মোচনের প্রয়াস নেন, ব্যাখ্যা করেন ভারতে বিপ্লবী আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি। এশিয়-উপনিবেশগুলির রাজনৈতিক স্বাধীনতাই যে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার একমাত্র পথ—এই বিশ্বাস থেকে মানবেন্দ্রনাথ সরে এলেন সমাজতন্ত্রের প্রভাবে। যাই হোক, মেক্সিকোতে তীব্র আমেরিকা ও ব্রিটিশ বিরোধিতার আবহে মানবেন্দ্রনাথ সুঅভ্যর্থনা পেলেন, মেক্সিকোর তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ও তাঁর সরকার তাঁকে দিলেন নিরাপত্তাদানের প্রতিশ্রুতি। মেক্সিকোর সমাজতান্ত্রিক নেতা জেনারেল আলভারাডোকে উদ্দেশ করে লেখা ড. জর্ডনের যে-চিঠিটি মানবেন্দ্রনাথ সঙ্গে করে এ-দেশে এনেছিলেন, তার প্রভাবে মেক্সিকোর সমাজতান্ত্রিক গোষ্ঠী তাঁকে সাদর অভ্যর্থনা জানাল। তিনি স্প্যানিশ শিখতে শুরু করলেন এবং এখানকার সরকারি সংবাদপত্র থেকে এল রচনা-প্রকাশের আমন্ত্রণ। মেক্সিকোয় মানবেন্দ্রনাথের খাদ্যাভ্যাস, জীবনযাত্রা, শিল্পবোধ, দর্শন ও চিন্তাধারায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছিল। সান ফ্রান্সিস্‌কো বা নিউ ইয়র্কে যে পালাবদলের সূচনা, তা-ই যেন পরিপূর্ণ বৃত্তে পৌঁছল এই দেশে। স্মৃতিকথায় মানবেন্দ্রনাথ লিখেছেন, “In a sense, Mexico was the land of my rebirth. … [There] I acquired a new outlook on life; there was a revolution in my mind—a philosophical revolution which knew no finality.” (Memoirs 217)।

এ-দেশে আসার পর ভারতবর্ষে বিপ্লবী অভ্যুত্থানের পুনরায় একটি সুযোগ এল। মেক্সিকোর প্রেসিডেন্ট কারাঞ্জিয়ার সহযোগিতায় ও জার্মানের অর্থসাহায্যে চিন থেকে বিপুল অস্ত্রশস্ত্র কেনার পরিকল্পনা করলেন মানবেন্দ্রনাথ। সেই মতো তিনি চিনের উদ্দেশ্যে রওনাও দিলেন। তবে ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা-সংক্রান্ত কিছু অনিশ্চয়তা দেখা দিলে, এই পরিকল্পনা ত্যাগ করে তিনি মেক্সিকোয় প্রত্যাবর্তন করেন। স্মৃতিকথায় লিখেছেন, সেই পুরনো অভিযানের স্বপ্ন তাঁকে আর রোমাঞ্চিত করতে পারেনি, বরং মেক্সিকোয় নতুন ‘political career’ গঠনে তিনি বেশি উৎসাহিত ছিলেন। এরপরেই মেক্সিকোর রাজনীতির সঙ্গে তাঁর ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে-পড়া। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধসমূহে মানবেন্দ্রনাথ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী শোষণ থেকে সম্পূর্ণ লাতিন আমেরিকার মানুষকে মুক্ত করার উদ্দেশ্যে সমাজতন্ত্রের ভিত্তিতে রাষ্ট্রগুলির পুনর্গঠন ও সকল রাষ্ট্র নিয়ে একটি সংঘ (লাতিন আমেরিকান ইউনিয়ন) গড়ে তোলার কথা বলেন। তাঁর এই পরিকল্পনায় প্রেসিডেন্ট কারাঞ্জিয়া চমৎকৃত হন। ১৯১৭ সালের শেষের দিকে আমেরিকার সঙ্গে মেক্সিকোর সম্পর্ক নানা কারণে তিক্ত হয়ে ওঠে; আমেরিকার নানাবিধ চাপে পর্যুদস্ত হয়ে পড়েন প্রেসিডেন্ট কারাঞ্জিয়া। তখন মানবেন্দ্রনাথ তাঁকে একটি সোশ্যালিস্ট পার্টি গঠনের পরিকল্পনার কথা জানান, যে-পার্টি দেশের আপামর শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ করে দেশব্যাপী ধর্মঘটের মাধ্যমে আমেরিকার অর্থপুষ্ট পেট্রোলিয়াম শিল্পকে অচল করে দিয়ে আমেরিকার উপর তৈরি করবে পাল্টা-চাপ। প্রেসিডেন্ট এই অভিনব পরিকল্পনা গ্রহণ করলেন এবং ১৯১৮ সালের ডিসেম্বর মাসে মেক্সিকো শহরে ‘সোশ্যালিস্ট পার্টি অফ মেক্সিকান রিজিয়ন’-এর প্রতিষ্ঠা হল, যার সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হলেন মানবেন্দ্রনাথ রায়।

১৯১৯ সালের মে মাসে মাইকেল বোরোদিন নামের এক রাশিয়ান কমিউনিস্ট মেক্সিকোতে আসেন ও নানান নাটকীয় ঘটনা-পরম্পরায় মানবেন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা হয়। সে-বছরই অগাস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে ‘মেক্সিকান সোশ্যালিস্ট পার্টি’র একটি বিশেষ অধিবেশনে ওই দলটি ‘কমিউনিস্ট পার্টি অফ মেক্সিকো’ নামে আত্মপ্রকাশ করে। সেই অধিবেশনে রাশিয়া থেকে লেনিন একটি বার্তা পাঠান, যা সদস্যদের সামনে পাঠ করেন বোরোদিন। নভেম্বর বিপ্লবের পর রাশিয়ার বাইরে প্রতিষ্ঠিত এটিই বিশ্বের প্রথম কমিউনিস্ট পার্টি, যার প্রতিষ্ঠা হয়েছিল মূলত মানবেন্দ্রনাথেরই পরিকল্পনা ও উদ্যোগে। 

কমিউনিস্ট আন্দোলনে মানবেন্দ্রনাথ: রাশিয়া ও চিন

মাইকেল বোরোদিনের মাধ্যমে লেনিন রাশিয়ায় অনুষ্ঠিতব্য কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের দ্বিতীয় কংগ্রেসে মানবেন্দ্রনাথ রায় ও মেক্সিকান কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যদের নিমন্ত্রণ করেন। ১৯২০ সালের এপ্রিল মাসে মানবেন্দ্রনাথ তাঁর স্ত্রী ইভলিন ট্রেন্ট-সহ মস্কো পৌঁছলেন, মে দিবসে বক্তৃতা দিলেন মস্কোর সমাবেশে। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের যে-আদর্শে তিনি দীক্ষিত হয়েছিলেন আমেরিকায়, বিশ্বের মানব-মুক্তি নিয়ে যে-পরিকল্পনায় চালিত করেছিলেন তাঁর চিন্তাশক্তিকে, রাশিয়ায় এসে এবার সেই পরিকল্পিত পথের বাস্তবায়নের সুযোগ এল। মানবেন্দ্রনাথ লিখেছেন, “For the first time, I came in contact with a mass revolutionary movement and practised speaking as a form of revolutionary political activity.” (Memoirs 350)
মস্কোতে আসার পথে কিছুদিন বার্লিনে থাকার সময় ভারতে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পথ-নির্দেশের তাগিদে মানবেন্দ্রনাথ রচনা করেছিলেন ইন্ডিয়ান কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো। সেখানে তিনি বলেন, ভারতে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে গড়ে-ওঠা জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে ও দেশব্যাপী ছড়িয়ে-পড়া সাধারণ মানুষের ক্ষোভকে সারা বিশ্বের প্রেক্ষিতে প্রোলেতারিয়েতের শ্রেণিসংগ্রামে পরিণত করতে হবে, এবং ভারত ও ইংল্যান্ড—উভয় দেশের শোষিত শ্রেণিকেই এই লক্ষ্যে একযোগে কাজ করতে হবে। সে-সময় ভারতের বিপ্লব-পরিস্থিতিকে মানবেন্দ্রনাথ সমগ্র বিশ্বের পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে প্রোলেতারিয়েতের শ্রেণিসংগ্রামের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে দেখতে চাইছিলেন।
তাঁর এই বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গির জন্যই কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের দ্বিতীয় কংগ্রেসে (জুলাই-অগাস্ট, ১৯২০) লেনিনের সঙ্গে তাঁর বিরোধ হল। লেনিন মনে করেছিলেন, ভারতের মতো উপনিবেশগুলিতে যে-জাতীয়তাবাদী আন্দোলন চলছে, তা প্রকৃতিগতভাবে বুর্জোয়াশ্রেণি দ্বারা পরিচালিত হলেও, সে-দেশের কমিউনিস্টদের সেই আন্দোলনকে ব্যাহত করা উচিত নয়। কেননা, জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের পথে দেশগুলির রাজনৈতিক স্বাধীনতা-অর্জনের পরেই রাশিয়া ও ইউরোপের অন্যান্য দেশের প্রোলেতারিয়েতের নির্দেশিত পথে সেখানে বিপ্লব সংঘটিত হতে পারবে। অর্থাৎ লেনিনের দৃষ্টিতে, আগে রাশিয়া ও ইউরোপের দেশগুলিতে বিপ্লব হবে, পরে তা ছড়িয়ে পড়বে অনগ্রসর কৃষিপ্রধান দেশগুলিতে। মানবেন্দ্রনাথ এই মতামত মানতে চাননি। তাঁর মতে, যেহেতু ইউরোপের বেশির ভাগ দেশের পুঁজির মূল উৎসই তাদের উপনিবেশগুলি থেকে আহৃত সম্পদরাশি, তাই উপনিবেশে ও ইউরোপের দেশগুলিতে একই সঙ্গে বিপ্লব সংগঠিত হতে না-পারলে বিশ্ববিপ্লব ফলপ্রসূ হবে না। ইউরোপে ও রাশিয়ায় আগে বিপ্লব হলে, সেখান থেকে বিতাড়িত পুঁজিবাদের ভূত এশিয়ার কৃষিপ্রধান দেশগুলির ঘাড়ে চাপবে। সুতরাং, এশিয়ার উপনিবেশগুলিতে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে শ্রমিক ও কৃষক শ্রেণির তীব্র শ্রেণিসংগ্রামে পরিণত করতে হবে। সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গেই আক্রমণ করতে হবে পুঁজিবাদকে, না-হলে রাজনৈতিক স্বাধীনতা-অর্জনের পর দেশের সাধারণ মানুষের অবস্থার কিছু মৌলিক পরিবর্তন হবে না। লেনিন ও মানবেন্দ্রনাথের এই পরস্পরবিরোধী মতামত দুটি কংগ্রেসের কার্যবিবরণে লিপিবদ্ধ হয়, এবং দুটি দৃষ্টিভঙ্গিরই একটি সংশোধিত রূপ পার্টিলাইন হিসেবে গৃহীত হয়। কমিউনিস্ট পার্টির উপনিবেশ-নীতি সংক্রান্ত এই বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গিকেই পরবর্তীকালে মানবেন্দ্রনাথ ১৯২২ সালের চতুর্থ কংগ্রেসে বিস্তারিতভাবে তুলে ধরেন। ওই কংগ্রেসেই লেনিন ও ট্রটস্কি-র সঙ্গে তিনিও লেনিন-প্রতিষ্ঠিত-কমিনটার্নের এক্সিকিউটিভ বডি-তে নির্বাচিত হন। মতের কিছু পার্থক্য থাকলেও মানবেন্দ্রনাথ চিন্তক হিসেবে লেনিনের কাছ থেকে যথাযোগ্য সম্মান ও সম্ভ্রম আদায় করতে পেরেছিলেন, লেনিন তাঁকে মনে করতেন “the symbol of revolution in the East” (G. D. Parikh, ‘Intrduction’, Memoirs vi)।

রাশিয়াতে অন্যান্য সাথী সহ মানবেন্দ্রনাথ (বাঁদিক থেকে চতুর্থ)
লেনিন
ট্রটস্কি

লেনিন, ১৯২০ সালে, মানবেন্দ্রনাথকে তাসখন্দে ‘ইন্ডিয়ান মিলিটারি স্কুল’-এ পাঠান। সেখানকার ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান আর্মির কিছু পলাতক সৈন্য ও ইরানি বিপ্লবীদের সংগঠিত করে লাল ফৌজের এক আন্তর্জাতিক বাহিনী গড়ে-তোলার উদ্দেশ্যেই ছিল এই প্রেরণ। সে-বছর ১৭ অক্টোবর, তাসখন্দে মানবেন্দ্রনাথের উদ্যোগে গঠিত হয় ‘কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়া’। পরের বছর মস্কোতে পূর্বদেশীয় কমিউনিস্টদের শিক্ষিত করার উদ্দেশ্যে স্তালিনের নেতৃত্বে ‘কমিউনিস্ট ইউনিভার্সিটি অফ দ্য টয়েলার্স অফ দ্য ইস্ট’ স্থাপিত হলে, মানবেন্দ্রনাথ হন সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক নির্দেশক, আর তাঁর স্ত্রী সেখানে নিযুক্ত হন শিক্ষিকা হিসেবে। পরবর্তী কয়েক বছর তিনি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কমিউনিস্ট পার্টির অবিসংবাদী নেতা হিসেবে বিভিন্ন কর্মধারায় জড়িয়ে পড়েন। তার মধ্যে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য হল, তাঁর চিন-অভিযান।
১৯২৭ সালে মানবেন্দ্রনাথ কমিনটার্ন ডেলিগেশনের নেতা হিসেবে বিপ্লব-সংগঠনের উদ্দেশ্যে চিনে এলেন। আমার আগেই দেখেছি, ভারত ও চিনের মতো উপনিবেশগুলিতে নেতৃত্বে-থাকা জাতীয়তাবাদী দলের সঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টির সম্পর্কের প্রকৃতি নিয়ে তাঁর নিজস্ব উপলব্ধি পার্টির ঘোষিত নীতির থেকে কিছুটা পৃথক ছিল। সেই সূত্রেই চিনে সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী আন্দোলনে রত জাতীয়তাবাদী কুওমিনটাং দলের সঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টির প্রস্তাবিত সম্পর্ক নিয়ে কমিনটার্ন ডেলিগেশনের অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে—যাঁর মধ্যে ছিলেন মানবেন্দ্রনাথের একসময়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু বোরোদিন—তাঁর তীব্র বিরোধ হয়। মাও-সে-তুঙের মতো চিনা কমিউনিস্ট নেতারাও তাঁদের ভারত-বিরোধী মনোভাবের জন্য মানবেন্দ্রনাথের নেতৃত্ব মেনে নিতে পারেননি। চিনে কৃষি-বিপ্লব ঘটাতে চেয়েছিলেন মানবেন্দ্রনাথ, কিন্তু তাঁর সহযোগী ও চিনের স্থানীয় নেতৃবৃন্দ এই পরিকল্পনা বিবিধ কারণে বাতিল করে দেন। রাশিয়া থেকে স্তালিনের সমর্থন পেলেও বোরোদিনের মতো চিনে-দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা ও চিনা কমিউনিস্টদের বিরোধিতায় মানবেন্দ্রনাথের নেতৃত্বে চিনে বিপ্লব-প্রয়াস ব্যর্থ হয়। কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে মানবেন্দ্রনাথের তিক্ততার সেই শুরু।

চিন থেকে ফিরে এসে মানবেন্দ্রনাথ উপনিবেশসংক্রান্ত একটি থিসিস লেখেন, যা ‘ডিকলোনাইজেশন থিওরি’ নামে পরিচিত। কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের ষষ্ঠ অধিবেশনের (১৯২৮) জন্য রচিত এই থিসিসে তিনি বলেন, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি নিজের গরজেই ভারতকে রাজনৈতিক স্বাধীনতা বা ‘ডোমিনিয়ন স্টেটাস’ দেবে, কারণ নিজের স্বার্থেই ব্রিটিশ বুর্জোয়া শ্রেণি ভারতীয় বুর্জোয়াকে তার বিস্তৃত ব্যবসার অংশীদার করে নেবে, আর এভাবেই ইউরোপীয় পুঁজিবাদ হাত ধরবে কৃষিপ্রধান দেশগুলিতে নব্য-উদিত দেশীয় পুঁজিবাদের। এই তত্ত্বের জন্য ষষ্ঠ অধিবেশনে অনুপস্থিত থেকেও মানবেন্দ্রনাথ তীব্রভাবে সমালোচিত হন। লেনিনের মৃত্যুর পর নতুন নেতা স্তালিনের উগ্রপন্থাও তিনি মেনে নিতে পারেননি। সেই সময় মানবেন্দ্রনাথ, তাঁর পূর্বপরিচিত কিছু জার্মান কমিউনিস্টদের ফ্যাসিবাদ-বিরোধী কাজকর্মকে খোলাখুলি সমর্থন জানান। রাশিয়ার নেতৃত্ব তখন ফ্যাসিবাদের বিপদ সম্পর্কে সম্যক ওয়াকিবহাল ছিল না, তাই কিছু জার্মান কমিউনিস্টের ওই বিশেষ অবস্থান ছিল তাদের ঘোষিত নীতির পরিপন্থী। মানবেন্দ্রনাথ-সমর্থিত ওই জার্মান কমিউনিস্টরা কমিনটার্নে স্তালিনের আধিপত্যকে মানতে পারেননি, এবং রাশিয়ার কমিনটার্ন-অনুমোদিত ‘কমিউনিস্ট পার্টি অফ জার্মানি’ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আলাদা সংগঠন তৈরি করেছিলেন। অবশেষে, পার্টি-লাইনের বিরোধিতার অভিযোগে মানবেন্দ্রনাথ রায়কে ১৯২৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে কমিউনিস্ট পার্টি থেকে বহিষ্কার করা হয়। আন্তর্জাতিক রাজনীতির জটিল আবর্তে বিপর্যস্ত মানবেন্দ্রনাথের এবার ঘরে ফেরার পালা। ইতিমধ্যে ১৯২৮ সালে ইভলিন ট্রেন্টের সঙ্গে তাঁর বিবাহবিচ্ছেদ সম্পন্ন হয়েছে। 

পুনরায় স্বদেশ

মস্কোতে থাকাকালীন মানবেন্দ্রনাথ ভারতে সমমনোভাবাপন্ন বিপ্লবীদের সঙ্গে নানাভাবে যোগাযোগ রাখতেন। স্বদেশে কমিউনিস্ট আন্দোলনকে সঠিক উপায়ে সংগঠিত করার জন্য নির্দিষ্ট পরিকল্পনাও তাঁর ছিল। ১৯২১ সালে আহমেদাবাদে জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশন উপলক্ষে কমিউনিস্টদের কর্তব্য নির্দিষ্ট করতে একটি ইস্তাহার রচনা করে ভারতে পাঠিয়েছিলেন। তাঁর পরিকল্পনামাফিক এ-দেশে প্রদেশ-ভিত্তিক ছোট-ছোট কমিউনিস্ট গোষ্ঠী তৈরি হয়। কংগ্রেসের মধ্যে সমাজতান্ত্রিক মনোভাবাপন্ন নেতাদের সঙ্গে তাঁর আগে থেকেই যোগাযোগ ছিল।
ইস্তামবুল ও করাচি হয়ে মানবেন্দ্রনাথ মুম্বাই পৌঁছলেন ১৯৩০ সালের ১১ ডিসেম্বর। তখন তাঁর ছদ্মনাম ড. মাহমুদ। এরপর সাত মাস উত্তরপ্রদেশ, মুম্বাই ও নানা জায়গা ভ্রমণ করে সংগঠনের কাজ তত্ত্বাবধানের পর ১৯৩১ সালের ২১ জুলাই ‘কানপুর ষড়যন্ত্র মামলা’-এ (১৯২৪) জড়িত থাকার অভিযোগে তিনি গ্রেফতার হলেন। এই মামলায় মানবেন্দ্রনাথ-সহ মুজফফর আহমেদ, এস এ ডাঙ্গে, শওকত ওসমানি, নলিনী গুপ্ত প্রমুখ কমিউনিস্ট নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ভারতে শাসক-বিরোধী বিপ্লব-পরিকল্পনার অভিযোগ আনা হয়েছিল। ১৯২৯ সালে ‘মীরাট ষড়যন্ত্র মামলা’-তেও মানবেন্দ্রনাথের নাম জড়ায়। মূলত তাঁর লেখা একটি চিঠির সূত্র ধরেই ব্রিটিশ সরকার রাশিয়ার প্রত্যক্ষ মদতে ভারতের কমিউনিস্টদের সরকার-বিরোধী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকার অভিযোগ করে, যদিও চিঠিটির সত্যতা প্রমাণিত হয়নি। যাই হোক, মানবেন্দ্রনাথের জীবনের পরবর্তী ছয় বছর কাটল দেশের বিভিন্ন জেলে।
এই ছয় বছরে তিনি তাঁর চিন্তাভাবনাকে নতুন করে যাচাই করলেন, এবং সমাজতান্ত্রিক আদর্শকে ভারতবর্ষের প্রেক্ষিতে প্রয়োগ করার পন্থা অনুসন্ধান রত হলেন। এ-বিষয়ে তাঁর উপলব্ধিগুলি দ্রুত নথিভুক্ত করলেন, যা পরবর্তীকালে বিভিন্ন গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। ওইসব গ্রন্থাদিতে ভারতীয় দর্শন, বিজ্ঞান, বস্তুবাদ, নারীত্বের ভারতীয় ধারণা, ফ্যাসিবাদের প্রকৃতি ইত্যাদি বহুমুখী বিষয় নিয়ে তাঁর নিজস্ব মতামতের সন্ধান মেলে। ভারতীয় ইতিহাস ও দর্শনকে তিনি বিচার করলেন বস্তুবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে; বিশ্বের ইতিহাসে ইসলামের ভূমিকাকে ব্যখ্যা করলেন যুক্তিবাদের আলোয়। ভারতের তৎকালীন পরিস্থিতি সম্পর্কেও তিনি গভীরভাবে ভাবছিলেন: তাঁর মনে হয়েছিল, চিনের মতোই ভারতের জাতি-মুক্তি একমাত্র কৃষিবিপ্লব, জমিদারি-উচ্ছেদ ও জমিপুনর্বন্টনের মাধ্যমেই সম্ভব। তিনি এও মনে করেছিলেন যে, এ-দেশে বিপ্লব-সংগঠনে মডেল হিসেবে রাশিয়ার বিপ্লবকে অনুসরণ করলে চলবে না, বরং ফরাসি বিপ্লবের সময় জ্যাকোবিনদের কর্মপদ্ধতিকেই ভারতের পরিস্থিতিতে কাজে লাগাতে হবে। ১৯৩৪ সালে তিনিই ভারতবর্ষে প্রথম সংবিধান-রচনার প্রস্তাব দেন, যা পরের বছর হয়ে উঠবে জাতীয় কংগ্রেসের ঘোষিত দাবি। এই কয়েক বছরে তিনি ইউরোপীয় কৃষক সমিতির সম্পাদিকা এলেন গটস্‌চেককে নিয়মিত চিঠি লিখতেন। ১৯৩৭ সালে কারামুক্তির পর এঁকেই তিনি বিবাহ করেন।

ভারতের অবস্থা ও ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা সম্বন্ধে তাঁর মৌলিক ভাবনাচিন্তা তাঁকে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে নেতৃত্বকারী কংগ্রেস ও মার্কসবাদে বিশ্বাসী কমিউনিস্ট পার্টি—উভয় শিবির থেকেই বিচ্ছিন্ন করেছিল। উপনিবেশ-বিষয়ক যে-থিসিসটির জন্য তিনি মস্কোতে কোণঠাসা হয়েছিলেন, যে-নীতির জন্য তাঁকে চিনে বিপ্লব-প্রয়াসে ব্যর্থ হতে হয়েছিল, সেই চিন্তাকে তিনি জাতীয় কংগ্রেসে প্রয়োগ করতে চেয়েছিলেন। কংগ্রেসের জাতীয়তাবাদী চরিত্রকে পাল্টে ফেলে তাকে সমাজতান্ত্রিক ছাঁচে ঢেলে সাজাবার পরিকল্পনায়, জেল থেকে মুক্ত হওয়ার পর ১৯৩৬ সালে তিনি কংগ্রেসে যোগ দেন। সে-সময় তিনি কংগ্রেসের বিভিন্ন অধিবেশনে অংশ নিলেন, সারা ভারত-জুড়ে দিলেন অসংখ্য বক্তৃতা, একাধিক রাজ্যে যুব-সম্মেলনে সভাপতিত্ব করলেন। কংগ্রেসের মধ্যে বামপন্থার সমর্থকদের তিনি সংগঠিত ও শক্তিশালী করতে চাইলেন। কিন্তু ১৯৩৯ সালে কংগ্রেসের ত্রিপুরী অধিবেশনের পর, নির্বাচনে জয়লাভ করেও গান্ধিজির তীব্র চাপে ও বিরোধিতায় সুভাষচন্দ্র বসু যখন কংগ্রেস-সভাপতির পদ থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হলেন, তখন কংগ্রেসের মধ্যে বামপন্থী শক্তির গভীর পরাজয় ঘটল দক্ষিণপন্থার কাছে। মানবেন্দ্রনাথ এই পরাজয় মানতে পারেননি। সুভাষচন্দ্র বসুকে লিখলেন, “The logical conclusion of that unreasonableness is that you must sacrifice yourself on the altar of unity of the Congress, under Gandhian leadership” (Smareen Roy 116)।
গান্ধিজির নেতৃত্বকে তিনি তীব্র অপছন্দ করতেন: তাঁর মতে গান্ধিজি-পরিচালিত আন্দোলন বুর্জোয়া শ্রেণির আধিপত্যকেই বিস্তৃত করবে, এবং মতবাদ হিসেবে গান্ধিবাদ পশ্চাৎপদ, সুতরাং মানব সভ্যতার প্রগতি-বিরোধী। কিন্তু কংগ্রেস তথা ভারতে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে গান্ধিজির প্রভাব ও আধিপত্য ছিল অবিসংবাদী। তবে জওহরলাল নেহরু-কে মানবেন্দ্রনাথ কিছুটা পছন্দ করতেন; কংগ্রেসের করাচি অধিবেশনে মূলত মানবেন্দ্রনাথের উদ্যোগেই জওহরলাল-সহ অন্যান্য নেতারা শ্রমিক-কৃষকদের মৌলিক অধিকার রক্ষাকে কংগ্রেসের অন্যতম উদ্দেশ্য হিসেবে চিহ্নিত করেন। কংগ্রেসে জওহরলালের বিরোধী শিবিরের নেতারা একসময় মানবেন্দ্রনাথকে জওহরলালের পরিবর্ত-বামপন্থী নেতা হিসেবে তুলে ধরতে চাইলে, মানবেন্দ্রনাথ এই প্রস্তাব পত্রপাঠ নাকচ করেছিলেন। যাই হোক, কংগ্রেসের সভাপতির পদ থেকে সুভাষচন্দ্র বসুর পদত্যাগের দিন, ১৯৩৯ সালের মে-দিবসে, মানবেন্দ্রনাথের সভাপতিত্বে বামপন্থী মনোভাবাপন্ন কংগ্রেসি-সদস্যদের নিয়ে গঠিত হল ‘লিগ অফ র‍্যাডিকাল কংগ্রেস-মেন’। পরের বছর কংগ্রেস সভাপতির পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে মানবেন্দ্রনাথ নির্বাচনে হেরে গেলেন। এরপরেই ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিন্ন হয়। পরে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি কংগ্রেসের কাছে ফ্যাসিবাদ-বিরোধী সংগ্রামে ব্রিটিশ সরকারকে সাহায্য করার প্রস্তাব দেন, কিন্তু কেউ কানে তোলেনি তাঁর কথা।

ভারতীয় কমিউনিস্টরাও মেনে নেননি মানবেন্দ্রনাথের নেতৃত্ব। রাশিয়ার নির্দেশে-চালিত ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টিতে তাঁর কমিনটার্ন-বিরোধিতার কারণে তিনি ব্রাত্যই থেকে গেলেন। জাতীয় কংগ্রেস ও কমিউনিস্ট পার্টি—দুই পক্ষ থেকে প্রত্যাখ্যাত মানবেন্দ্রনাথ রায় ১৯৪০ সালের ডিসেম্বর মাসে পূর্ব-গঠিত ‘লিগ অফ র‍্যাডিকাল কংগ্রেস-মেন’-কে কংগ্রেসের ছত্রছায়ার বাইরে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ রাজনৈতিক দলে পরিণত করেন। নতুন দলটির নাম হয় ‘র‍্যাডিকাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি’।

নতুন পথ ও নিঃসঙ্গ পথিক

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসিবাদী জার্মানের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ সরকারকে সমর্থনের প্রশ্নে মানবেন্দ্রনাথের সঙ্গে ‘অল ইন্ডিয়া ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস’-এ জাতীয়তাবাদী ও বামপন্থী সদস্যদের মতাদর্শগত বিরোধ হল। ১৯৪১ সালের নভেম্বর মাসে মানবেন্দ্রনাথ তাঁর অনুগামীদের নিয়ে ওই সংগঠন ত্যাগ করে প্রতিষ্ঠা করলেন ‘ইন্ডিয়ান ফেডারেশন অফ লেবার’। অভিজ্ঞতা ও রাজনৈতিক দূরদৃষ্টিতে তিনি বুঝতে পারছিলেন, ভারতের রাজনৈতিক স্বাধীনতা এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। ক্ষমতা-হস্তান্তরের পরবর্তী মুক্ত ভারতের ভিত্তির পরিকল্পনায় তিনি নিজেকে নিয়োজিত করলেন। এ-বিষয়ে তাঁর দুটি লেখা গুরুত্বপূর্ণ: People’s Plan for Economic Development of India এবং Draft Constitution for Free India । ‘ইন্ডিয়ান ফেডারেশন অফ লেবার’-এর জন্য লিখিত প্রথম গ্রন্থটিতে তিনি ভারতে কৃষিক্ষেত্রে পর্যাপ্ত অর্থবিনিয়োগের প্রস্তাব দেন। তিনি মনে করেছিলেন, ভারতের মতো অনগ্রসর দেশে একমাত্র কৃষিক্ষেত্রের উন্নতিসাধনের মাধ্যমেই সংখ্যাগরিষ্ঠের দারিদ্রের সমস্যা মিটবে, এবং তার সঙ্গে শিল্প-বিকাশের উপযোগী বাজার গড়ে উঠবে। দ্বিতীয় গ্রন্থটি, অর্থাৎ ভারতের প্রস্তাবিত সংবিধানে, তিনি ভাষা ও সংস্কৃতির নিরিখে এ-দেশের রাজ্যগুলির পুনর্বন্টন চেয়েছিলেন, সওয়াল করেছিলেন নবগঠিত রাজ্যগুলির প্রশাসনিক স্বাধীনতার পক্ষে। তাঁর পরিকল্পনামাফিক, রাজ্যগুলির প্রধান হবেন প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকের ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত রাজ্যপাল বা গভর্নর। ভারতের ভাষা ও সংস্কৃতির বিপুল বৈচিত্র্যকে পূর্ণ স্বীকৃতি দিয়েছিল তাঁর সংবিধান।
মানবেন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন, ভারতে ক্ষমতা-হস্তান্তরের সঙ্গে-সঙ্গে এখানকার শ্রমিক-কৃষকদের অবস্থার উন্নতিকল্পেও কিছু পদক্ষেপ গৃহীত হোক। ১৯৪৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে, ইংল্যান্ডের লেবার পার্টির সঙ্গে এ-ব্যাপারে কথা বলতে তিনি র‍্যাডিকাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির সদস্য এ কে পিল্লাইকে সেখানে পাঠালেন। মানবেন্দ্রনাথ লেবার পার্টিকে সতর্ক করে দিতে চেয়েছিলেন যাতে ভারতে ক্ষমতা-হস্তান্তরের মাধ্যমে বিদেশি সাম্রাজ্যবাদের পরিবর্তে দেশীয় পুঁজিবাদের বিকাশ না-হয়। বিষয়টি বোঝাতে ইংল্যান্ডে একাধিকবার সদস্য প্রেরণ করলেও, মানবেন্দ্রনাথের উদ্দেশ্য সফল হয়নি। ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে র‍্যাডিকাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির সকল প্রার্থীর হার হল। মানবেন্দ্রনাথ সক্রিয় রাজনীতি থেকে অবসর-গ্রহণ করে দেরাদুনে প্রতিষ্ঠা করলেন ‘ইন্ডিয়ান রেনেসাঁস ইন্সটিটিউট’। ১৯৪৭ সালের ১৫ অগাস্ট, ক্ষমতা-হস্তান্তরের দিন, প্রকাশ করলেন Thesis of Radical Democracy যা ‘New Humanism’ নামেও পরিচিত। পরের বছর ডিসেম্বর মাসে তিনি র‍্যাডিকাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টিকে ভেঙে দিয়ে ‘র‍্যাডিকাল হিউম্যানিস্ট’ আন্দোলন-বিকাশের সিদ্ধান্ত নিলেন।

এরপর থেকে ১৯৫৪ সালে মৃত্যু পর্যন্ত রাজনীতির জটিল পরিসর ও জনজীবনের উত্তপ্ত আবহ থেকে মানবেন্দ্রনাথ নিজেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছিলেন। দেরাদুনে কাটিয়েছিলেন অবসরজীবন। তবে মানুষ ও সমাজ নিয়ে নিরন্তর চিন্তায় তিনি ছিলেন অক্লান্ত। নতুন দার্শনিক মতবাদের প্রবর্তন করেছিলেন, যাকে আমরা ‘র‍্যাডিকাল হিউম্যানিজম’ নামে চিনি। উদারনীতিবাদ ও প্রথাগত সমাজবাদের তৃতীয় বিকল্প হিসেবে তিনি এই বস্তুবাদী মতবাদকে কল্পনা করেছিলেন, যার ভিত্তি ছিল মানবতাবাদ, যুক্তিবাদ, নীতিশাস্ত্র ও ব্যক্তির স্বাধীনতার ধারণা। পদার্থবিজ্ঞানের সাম্প্রতিকতম তত্ত্বকেও তিনি তাঁর মতবাদে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। মার্কসবাদের তথাকথিত বৈজ্ঞানিকতাকে এড়িয়ে তিনি একে নীতিশাস্ত্র হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন। প্রচলিত সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ব্যক্তির উপর পার্টির আধিপত্যকে অস্বীকার করে মানবেন্দ্রনাথ ‘ব্যক্তিক স্বাধীনতা’-কেই র‍্যাডিকাল হিউম্যানিজমের মূল লক্ষ্য হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। মার্কসবাদের গভীর অধ্যয়ন মানবেন্দ্রনাথকে এই মতবাদের সীমাবদ্ধতাকে চিনতে শিখিয়েছিল। রাশিয়ায় অনুশীলিত মার্কসবাদের আক্ষরিক ও ডগম্যাটিক ব্যাখ্যা মানবেন্দ্রনাথকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি, তিনি বরং জার্মানি ঐতিহ্য-সম্মত মার্কসবাদের উন্মুক্ত-পাঠকে আন্তরিকভাবে গ্রহণ করেছিলেন। নতুন মতবাদ হিসেবে র‍্যাডিকাল হিউম্যানিজমে স্বীকার করে নিয়েছিলেন ইউরোপীয় রেনেসাঁস ও আঠারো শতকের জ্ঞানদীপ্তি বা এনলাইটেনমেন্টের অবদান। “Man is the measure of all things”—প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক প্রোটাগোরাসের এই উক্তির আলোতেই নিজস্ব মতবাদকে দেখতে চেয়েছিলেন মানবেন্দ্রনাথ রায়।
অনেকের মতে, মানবেন্দ্রনাথের এই মতবাদ কল্পনাপ্রবণ ও ইউটোপিয়ান। তবে তাঁর চিন্তার ব্যাপ্তি ও অভিনবত্বকে অস্বীকার করতে পারেননি কোনো সমালোচক। ইংরেজি, ফরাসি, স্প্যানিশ, জার্মান ইত্যাদি সতেরোটি ভাষায় তিনি দক্ষ ছিলেন, লিখেছেন ষাটেরও বেশি গ্রন্থ ও প্রচুর পুস্তিকা। আমাদের দুর্ভাগ্য, আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রেক্ষাপটে বিস্তৃত কর্মকাণ্ড ও ভারতসংক্রান্ত গভীর মৌলিক চিন্তা-ভাবনা সত্ত্বেও মানবেন্দ্রনাথকে আমরা মনে রাখিনি। ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি রাশিয়া-নির্ধারিত পথে চলেছে, মার্কসবাদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভারতীয় চিন্তক তাঁদের দলীয় কর্মসূচিতে অবহেলিত ও পরিত্যক্ত। অথচ, হো-চি-মিনের মতো নেতা, যিনি মস্কোতে মানবেন্দ্রনাথের ছাত্র ছিলেন, তাঁরই দেখানো-পথে ভিয়েতনামে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে সামাজিক বিপ্লবে পরিণত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এই পথটিকেই মানবেন্দ্রনাথ ভারত ও চিনে প্রয়োগ করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু নানাবিধ কারণে তাঁর পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়েছিল। তবে, রাজনৈতিক পথে কাম্য সাফল্য না-এলেও, দার্শনিক ও দ্রষ্টা হিসেবে মানবেন্দ্রনাথ রায় বিশ্বের চিন্তাজগতে ভারতবর্ষের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অবদান হিসেবে পরিগণিত হবেন, এ-কথা নিঃসংশয়ে বলে যায়।

মানবেন্দ্রনাথ রায় ও তাঁর স্ত্রী এলেন গটস্‌চেক ও সুভাষচন্দ্র

উদ্ধৃতির উৎস (উদ্ধৃতির ক্রম অনুযায়ী)

১। Manabendranath Roy, M. N. Roy’s Memoirs. Bombay: Allied Publishers Pvt. Ltd., 1990
২। Smareen Roy, M. N. Roy: A Political Biography. Hyderabad: Orient Blackswan, 1997

দ্রষ্টব্য:

বর্তমান প্রবন্ধে উপরে-উল্লিখিত বইগুলি ছাড়াও আরও কিছু গ্রন্থ থেকে তথ্য সংগৃহীত হয়েছে, যেমন:

  1. A. K. Hindi, M. N. Roy: A Man Who Looked Ahead, Vol. 1 (Ahmedabad: The Modern Publishing House, 1938);
  2. G. P. Bhattacharjee, Evolution of Political Philosophy of M. N. Roy (Kolkata: The Minerva Associates, 1959);
  3. Sobhanlal Dutta Gupta, ‘M. N. Roy: An Intellectual with a Difference’ (The Bengali Intellectual Tradition:
  4. From Rammohun Roy to Dhirendranath Sen, Edited by Amal Kumar Mukhopadhyay, Kolkata: K P Bagchi & Co., 2015),
  5. সংসদ বাঙালি চরিতাবিধান, প্রথম খণ্ড (কলকাতা: শিশু সাহিত্য সংসদ প্রা. লি., ২০১০)।

তথ্যসূত্র দিতে গেলে প্রতিটি বাক্যের শেষে সংখ্যা চিহ্নিত করতে হত; পাঠকের বিড়ম্বনার কথা বিবেচনা করে শুধুমাত্র উদ্ধৃতিগুলির উৎস উল্লেখ করা হল।

চিত্রঋণ – অন্তর্জাল 

জন্ম ১৯৮৬। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ, এম ফিল, পি এইচ ডি; গবেষণা করেছেন প্রখ্যাত অধ্যাপক চিন্ময় গুহর তত্ত্বাবধানে। পেশায় একটি সরকার-পোষিত কলেজের অধ্যাপক। এশিয়াটিক সোসাইটি জার্নাল, ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি জার্নাল, অনুষ্টপ ইত্যাদি পত্রপত্রিকায় ইংরেজি ও বাংলা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশিত প্রবন্ধ-গ্রন্থ: যুগান্তরের চিঠি: ব্যক্তিত্ব ও সাহিত্য (ধানসিড়ি, ২০১৫)। স্থানীয় ইতিহাস নিয়ে বেশ কিছু মৌলিক গবেষণাধর্মী প্রবন্ধের লেখক ও একটি গ্রন্থের সহ-সম্পাদক। সম্পাদিত গ্রন্থ: বিগত যাপন: একটি পারিবারিক আখ্যান (ধানসিড়ি, ২০২১)। গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাকের বাংলা প্রবন্ধ ও বক্তৃতার সংকলন (অপর: লেখা ও কথার সংকলন, অনুষ্টুপ, ২০২২)-এর প্রস্তুতি, সম্পাদনা ও প্রকাশনার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। গত কয়েক বছর ধরে সত্যজিৎ রায়ের ঐতিহাসিক ছবিগুলি নিয়ে তাঁর বিশ্লেষণধর্মী প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়ে চলেছে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়; ওই বিষয়ে একাধিক বক্তৃতা দিয়েছেন বিভিন্ন সেমিনারে। অধ্যাপক ছন্দক সেনগুপ্তের সহযোগী হিসেবে সম্পাদনা করেছেন অনুষ্টুপ-প্রকাশিত অনুষ্টুপের সত্যজিৎ (২০২৩) গ্রন্থের।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *