ব্যাঙ্গালোরে রবীন্দ্রনাথ
“আচ্ছা, ব্যাঙ্গালোরে নাকি রবি ঠাকুরের নামে একটা অডিটোরিয়াম আছে?”
“বাঃ, তুই এ শহরে আসতে না আসতেই সেটা জেনে ফেলেছিস? হ্যাঁ, আছে তো। তার নাম রবীন্দ্র কলাক্ষেত্র, জয় চামরাজেন্দ্র রোড বা জে সি রোডের ওপর।”
“কলকাতার রবীন্দ্রসদনের মত?”
“রবীন্দ্রসদন আর রবীন্দ্র কলাক্ষেত্র, দুই প্রেক্ষাগৃহেরই ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয় ১৯৬১ সালে, রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের প্রেক্ষিতে। কলাক্ষেত্র নির্মাণ শেষ হয়ে উদ্ঘাটিত হয় ১৯৬৩তে। কিন্তু রবীন্দ্র সদনের উদ্ঘাটন হতে ১৯৬৭ হয়ে যায়।”
“তা হলে তো বলতে হয় অন্তত এই ব্যাপারে ব্যাঙ্গালোর কলকাতার থেকে এগিয়ে?”
“রবীন্দ্র কলাক্ষেত্রের দর্শকাসন মোটামুটি ৯০০, রবীন্দ্র সদনের ১২০০। এছাড়া অ্যাকুস্টিকস ইত্যাদির গুণগত পার্থক্য থাকতে পারে। সে যাই হোক, অডিটোরিয়াম ছাড়াও, উত্তর ব্যাঙ্গালোরের একটি বিস্তীর্ণ জনবসতিপূর্ণ এলাকার নামও রবীন্দ্রনাথ টেগোর নগর বা সংক্ষেপে আর টি নগর। আরো আছে। গান্ধীবাজার এবং বাসবানগুড়ি নামে দুটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এলাকার সংযোগস্থলে একটি যানবৃত্তের নাম টেগোর সার্কেল।”
“আচ্ছা, এখানে রবীন্দ্রনাথের মূর্তিও আছে?”
“রবীন্দ্র সদনে যেমন পূ্র্ণাবয়ব আছে, তেমন নেই। মাত্র কয়েক বছর আগে ২০১৮ সালে কলাক্ষেত্র সংলগ্ন অঞ্চলে স্থাপত্য উদ্যান শিল্পবনে একটি আবক্ষ মূর্তি স্থাপন করা হয়। অতি সম্প্রতি আর টি নগর সার্কেলে আরও একটি বাস্ট উদ্ঘাটন করা হয়েছে।”
-“তাহলে বলতে হয় কবিকে এই দক্ষিণের শহর যথেষ্ট মর্যাদার আসন দিয়েছে।”
“রবীন্দ্রনাথ শুধু বাংলার নয়, বিংশ শতাব্দীর ভারত, এশিয়া, বা বলতে পারি সারা বিশ্বের অন্যতম এক যুগপুরুষ, এক রেনেসাঁ ব্যক্তিত্ব। কাজেই তাঁর সম্মানে দেশ বিদেশের বিভিন্ন প্রান্তে যে অজস্র স্মারক থাকবে তা অতি স্বাভাবিক। তবে ব্যাঙ্গালোরের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ আরেক দিক দিয়েও গুরুত্বপূ্র্ণ। এই শহরে তিনি এসেছিলেন চার বার। বেশ কিছুদিন এখানে তিনি অতিবাহিত করেন।”
“হ্যাঁ, এই সম্বন্ধে আরও কিছু বলো। শুনেছি এখানেই তিনি “শেষের কবিতা” লিখেছিলেন।”
“সে তো ব্যাঙ্গালোরে তাঁর শেষবার থাকার সময়। সে কথায় পরে আসবো। তার অনেক আগে ১৯১৯ সালেই তিনি দুবার এখানে এসেছিলেন।”
“১০০ বছরেরও ওপর। তখন কেমন ছিল এই শহর?”
“আন্দাজ করতে পারিস। এখনকার এই যানজট আর কংক্রিট আর কোলাহলের শহর দিয়ে তাকে চেনা যাবে না। বৃক্ষাচ্ছাদনের শীতল ছায়ায়, বলা যায় প্রধানত দুটি জনবসতি। একদিকে গোরাদের ক্যান্টনমেন্টকে ঘিরে, অন্যদিকে মাল্লেশ্বরম-বাসবানগুড়ি-কলসিপালায়াম এলাকা জুড়ে দেশি হিন্দু-মুসলিমদের ছড়ানো ছেটানো বসতি ঘিরে। তবে আইনত এ শহর তখন মাইসোরের ওয়াদিয়ার রাজের অন্তর্গত। তাঁদেরই দেওয়ান কান্তারাজ ঊরসের তৎকালীন সরকারি বাসভবন ছিল ব্যালাব্রুয়ি। সে বছর জানুয়ারির ১১ তারিখ রাত্রে মাদ্রাজ থেকে পৌঁছে সপারিষদ কবি এই ব্যালাব্রুয়িতে এসে উঠলেন।”
“ব্যালাব্রুয়ি? কি অদ্ভুত নাম! কানাড়া শব্দ বুঝি?” “আরে না। তাহলে আগে এই ব্যালাব্রুয়ি সম্বন্ধে দু-চার কথা বলে নিই। বসন্তনগর অঞ্চলে প্যালেস রোডের ওপর ১৭২ বছরের পুরনো এই সুরম্য বাগানবাড়িটি আজও স্বমহিমায় বর্তমান। ১৪ একর জমির মধ্যে ইউরোপীয় স্থাপত্যের এই অতি সুন্দর বাংলোটি ছাড়াও আছে বিস্তীর্ণ বাগান, যাতে আছে প্রায় ১৫০ প্রজাতির গাছগাছালি, আর অসংখ্য পাখিদের আনাগোনা। ১৮৫০ সাল নাগাদ নির্মিত এই বাড়িটি নাকি মাইসোরের প্রথম ইংরেজ কমিশনার মার্ক কাব্বন, আগা আলি আসকর নামের এক পারসি ব্যবসায়ীর কাছ থেকে কিনে নেন। মার্ক কাব্বনই ছিলেন এ বাংলোর প্রথম বাসিন্দা। ইংল্যান্ড ও আয়ারল্যান্ডের মাঝে যে আইরিস সাগর, তার ওপর একটি দ্বীপ আইল অব ম্যান। যুক্তরাজ্যের মধ্যে থেকেও আজ পর্যন্ত এই দ্বীপটি স্বয়ংশাসিত। কাব্বন সাহেব ভারতে আসার আগে ছিলেন এখানকার অধিবাসী। ইংরেজি ছাড়াও এই দ্বীপে একটি নেটিভ প্রাচীন ভাষা প্রচলিত, যাকে বলা হয় ম্যাঙ্কস ভাষা। ম্যাঙ্কস একটি কেলটিক (celtic) ভাষা। তো কাব্বন সাহেব তাঁর বাসভবনের নাম এই ম্যাঙ্কস ভাষাতেই রাখলেন ব্যালাব্রুয়ি। এর মানে করলে দাঁড়ায় ‘নদীর তীরে খামারবাড়ি।’ ওই দ্বীপে নদীর পাড়ে এরকম বাড়ী নাকি অনেক দেখা যায়। শোনা যায়, সেই সময় ব্যালাব্রুয়ির পাশ দিয়েও একটি জলস্রোত বয়ে যেতো, আর তাই এই নাম তিনি রেখেছিলেন। আজ অবশ্য সে জলস্রোত আর খুঁজে পাওয়া যায় না।”
“আশ্চর্য কাহিনি!”
“হ্যাঁ। পরপর ইংরেজ কমিশনারদের এটাই ছিল বাসভবন। ১৮৮১ সালে ইংরেজরা ওয়াদিয়ারদের সঙ্গে চুক্তি করে মাইসোরের শাসনব্যবস্থা তাঁদের হাতে তুলে দেন। তার পর থেকে বালাব্রুয়ি হয় মাইসোরের দেওয়ান, অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসগৃহ এবং রাজ-অতিথিদের বিশ্রামগৃহ। গান্ধিজী, জওহরলালের মত বহু গণ্যমান্য ব্যক্তি এখানে থেকেছেন। সুবিখ্যাত স্যার বিশ্বেশ্বরাইয়াও মাইসোরের দেওয়ান থাকাকালীন এখানে বাস করতেন। আর থেকেছিলেন আমাদের কবিগুরু।”
“ঐতিহ্যময় ভবন!”
“নিঃসন্দেহে। রবীন্দ্রনাথের ব্যাঙ্গালোর প্রবাসের সঙ্গেও জড়িয়ে আছে এর অনেক সাক্ষ্য। যাই হোক, ফিরে আসি ১৯১৯এর জানুয়ারিতে। কবির নোবেলপ্রাপ্তির পর থেকেই প্রতি বছরই দেশবিদেশের বহু জায়গা থেকে তাঁর কাছে আমন্ত্রণ আসতো সম্বর্ধনা এবং বক্তৃতামালার জন্য। কবি নিজে তো ভ্রমণরসিক ছিলেনই। দক্ষিণ ভারতেরও একাধিক শহর থেকে ডাক আসতে লাগলো, বিশেষতঃ মাইসোর রাজ্য থেকে। একটি নথি থেকে দেখা যাচ্ছে, মাইসোর বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য প্রোফেসর রাধাকৃষ্ণণ তাঁকে চিঠিতে লিখছেন, “….and the visit may be arranged in such a manner as to suit your own convenience and inclination.” যদিও কয়েক মাস আগে কবি দক্ষিণ ভারত একবার ঘুরে গিয়েছিলেন, এইসব অনুরোধ ফেলতে না পেরে তাঁকে আবার একবার ফিরতে হল। এবারের ভ্রমণসসূচীতে ব্যাঙ্গালোর এবং মাইসোর প্রাধান্য পেয়েছিল।”
“আচ্ছা, তুমি বলেছিলে, ১১ই জানুয়ারি তিনি সপারিষদ বালাব্রুয়িতে এসে উঠেছিলেন। তাঁর সহযাত্রী কারা ছিলেন?”
“তাঁর এই ভ্রমণের সঙ্গী ছিলেন জামাতা নগেন্দ্রনাথ এবং শান্তিনিকেতনের প্রখ্যাত শিল্পী ও স্থপতি সুরেন্দ্রনাথ কর। ১৮ তারিখ পর্যন্ত তাঁরা ব্যাঙ্গালোরে ছিলেন। ১২ তারিখ তিনি উদ্বোধন করেন এখনকার সিটি মার্কেটের কাছে এস এল এন হাই স্কুলের মাঠে আয়োজিত অল ইন্ডিয়া ফাইন আর্টস একজিবিসন। জে সি রোডে রবীন্দ্র কলাক্ষেত্রের উল্টো দিকে আর একটি অডিটোরিয়াম দেখতে পাবি, তার নাম এ ডি এ রঙ্গমন্দির। এই ADA বা Amateur Dramatic Association একটি বহু প্রাচীন সংস্থা। এঁরাই ছিলেন আয়োজক। অবশ্য সে বছর তাদের ছিল দশম বার্ষিকী, তারই উদযাপন উপলক্ষে এই অনুষ্ঠান। উদ্বোধনের পর তাঁরা কবির জন্য সংবর্ধনা সভার আয়োজন করেন। এই সভায় কবি যে ভাষণটি দেন, তার পাণ্ডুলিপিটি তাঁরা একটি রূপোর পাত্রে ভরে কবিকে উপহার দেন। সমগ্র অনুষ্ঠানটি নিয়ে জনগণের মধ্যে প্রভূত উদ্দীপনা ছিল। তখনকার স্থানীয় পত্রিকার রিপোর্ট বলছে, সন্ধ্যে ছটার এই অনুষ্ঠানের জন্য দুপুর বারোটা থেকে জনসমাগম শুরু হয়।”
“আচ্ছা, সেখানে তিনি কী বিষয়ে ভাষণ দিয়েছিলেন, কিছু জানো?”
“হ্যাঁ, কবি যে লেখাটি পড়েছিলেন তার শীর্ষক ছিল The Message Of The Forests। এই রচনাটি তিনি ইউরোপ-আমেরিকাতেও বেশ কয়েক জায়গায় পাঠ করেছিলেন। বার্লিনের হামবোল্ড ইউনিভার্সিটিতে ১৯২১ সালে তাঁর স্বকণ্ঠে পঠিত লেখাটির রেকর্ডিং বিশ্ববিদ্যালয় আর্কাইভে রক্ষিত আছে, এবং এখন ইউটিউবেও পাওয়া যায়।”
“তারপর?”
“পরের দিন ঐ একই জায়গায় রবীন্দ্রনাথ তাঁর আরও একটি রচনা পাঠ করেন, The Centre Of Indian Culture। এই লেখাটি তিনি মাদ্রাজেও পাঠ করেছিলেন। এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলে রাখা ভালো। তখন শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নিয়ে তিনি গভীরভাবে চিন্তা করছেন। এই রচনায় তাঁর সেই চিন্তাভাবনার রূপরেখা পাওয়া যায়। কিন্তু তার জন্য প্রয়োজন ছিল প্রভূত ধনরাশির। কবি তখন যে সব পরিভ্রমণ করছেন, তার একটি উদ্দেশ্য তাঁর ঐ বিশাল কর্মকাণ্ডের জন্য অর্থ সংগ্রহও ছিল।”
“কর্মযাত্রা?”
“কিছু মনোরঞ্জনও ছিল। এই যাত্রায় কবি লালবাগও দেখতে গিয়েছিলেন।”
“লালবাগ বোটানিকাল গার্ডেন?”
“হ্যাঁ। আরও দেখছি, বিভিন্ন স্কুল-কলেজের ছাত্রদের সঙ্গে আলাপচারিতার এক অনুষ্ঠানে তাদের সঙ্গে হালকা মেজাজে হাসিঠাট্টা করেছেন। বলছেন, There are men who are old, old not in the tenth century after Christ or tenth century before Christ, but in the 20th I mean, and some who are 57 like myself, but in reality, not older than 27।”
“ব্যাঙ্গালোরে প্রথম সফর বেশ ইন্টারেস্টিং ছিল।”
“তাই। এখান থেকে তাঁরা গেছিলেন মাইসোর। সেখানে দেওয়ান কান্তারাজ ঊরসকে কবি তাঁর The Message Of The Forestsএর মূল স্বহস্তলিখিত পাণ্ডুলিপিটি উপহার দেন। মহারাজা কলেজ, মহারানী কলেজ এবং মাইসোর ইউনিভার্সিটি পরিদর্শন করেন। মহারাজা কলেজের ছাত্ররা তাঁর বিশ্বভারতীর পরিকল্পনা শুনে নিজেদের মধ্যে চাঁদা তুলে সেই তহবিলে পাঁচশো টাকা তৎক্ষণাৎ তাঁর হাতে তুলে দিয়েছিলো। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে নিরাশই করেছিলো। তাঁর লেখায়: There is nothing of our own in it, it’s an imitation – every inch of it!”
“যাঁর মাথায় বিশ্বভারতীর মত যুগান্তকারী পরিকল্পনা, তাঁর পক্ষে গতানুগতিক ইউনিভারসিটির পরিবেশ ভালো না লাগা স্বাভাবিক।”
“ঠিক, তবে মনে হয় তিনি সেখানে আশা করেছিলেন আরও ভারতীয়তা, দেশের শাশ্বত আর লোকসংস্কৃতির আধিক্য।”
“তুমি বলেছিলে ১৯১৯শেই তিনি দুবার ব্যাঙ্গালোর এসেছিলেন।”
“তাঁর এই যাত্রারই শেষ পর্যায়ে। মাইসোর থেকে তিনি ঊটি, পলাক্কাড়, সেলম ঘুরে ২রা মার্চ আবার ফিরে আসেন এই শহরে, মহারাজ কৃষ্ণরাজা ওয়াদিয়ারের আমন্ত্রণে।”
“এবার তিনি কতদিন ছিলেন?”
“৮ই মার্চ পর্যন্ত। তবে এবারের যাত্রাটি সম্ভবত কিছুটা অপরিকল্পিত ছিল। তাঁর ফিরে যাবার কথা ছিল মাদ্রাজে। এর মধ্যে একটা ছোটখাটো ব্যাপার ঘটে। বল্লভভাইয়ের বড় ভাই বিট্ঠলভাই প্যাটেল সেই সময় আইনসভায় আন্তর্বর্ণ বিবাহ আইনসম্মত করার জন্য একটি বিলের সুপারিশ করেন এবং তাঁর এই প্রস্তাবকে সমর্থন করে মডার্ন রিভিউ পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। মাদ্রাজের উচ্চবর্ণের একটি গোষ্ঠী এতে বেজায় খাপ্পা হয়ে কবির বিরুদ্ধে সরব প্রচারে নামে। এর জন্য তাঁকে মাদ্রাজে আসা পিছিয়ে দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। মাইসোরের মহারাজার আতিথেয়তায় তিনি এক সপ্তাহ ব্যাঙ্গালোরে থেকেছিলেন, এবং দ্য নিউ ইন্ডিয়া পত্রিকায় একটি সুদীর্ঘ চিঠিতে এই বিতর্কে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্ট করেছিলেন।”
“এবার আর অন্য কোন কার্যসূচী ছিল না?”
“তাঁর পক্ষে তখন নিষ্কৃতি পাওয়া মুশকিল। এখানকার মিথিক সোসাইটির অনুরোধে ৮ই মার্চ তাঁকে একটি বক্তৃতা দিতে হয়। নৃপতুঙ্গা রোডে সোসাইটির ভবনে। কৃষ্ণরাজা ওয়াদিয়ার স্বয়ং সেখানে উপস্থিত ছিলেন। বিষয় ছিল The Spirit Of Popular Religion In India। এতে কবি বিভিন্ন ভারতীয় লোকসম্প্রদায়ের ধর্মাচরণ নিয়ে আলোচনা করেন। মিথিক সোসাইটির ত্রৈমাসিক জার্নালে এই নিবন্ধটিকে ‘a gripping one’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। মহারাজও তাঁর ভাষণে এই বিষয়ে কবির জ্ঞান ও পাণ্ডিত্যের ভূয়সী প্রশংসা করেন। এর পরই তিনি মাদ্রাজের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন।”
“তাহলে এই ছিল ব্যাঙ্গালোরে তাঁর প্রথম দুটি সফরের বৃত্তান্ত? এর পর তিনি আবার কবে এখানে আসেন?”
“১৯২২শে। তাঁর এবারের এই পরিভ্রমণ নিয়ে খুব বেশি তথ্য পাইনি। তবে দেখা যাচ্ছে সে বছর ২৬শে সেপ্টেম্বর পুনা থেকে কবি ব্যাঙ্গালোর এসে পৌঁছোন। আর পরের দিনই মাইসোর চলে যান।”
“মাত্র এক দিনের সফর?”
“হ্যাঁ। সেবার তাঁর সচিবের ভূমিকায় সঙ্গী ছিলেন ব্রিটিস কৃষি বিশেষজ্ঞ ও পরবর্তীকালের প্রখ্যাত ফিলানথ্রপিস্ট লিওনার্ড নাইট এলমহারস্ট। আরও ছিলেন গৌরগোপাল দাস। গ্রেচেন গ্রীন নামের একজন সমাজসেবক, যিনি ভারতের দরিদ্র এবং অধিকারবঞ্চিতদের নিয়ে কাজ করতে উৎসাহী ছিলেন, পরে তাঁদের যাত্রার সঙ্গী হন।”
“বিভিন্ন ক্ষেত্রের প্রতিভাশালী ব্যক্তিদের তিনি আকর্ষণ করেছেন।”
“তা বই কি। তাঁর অনুসন্ধিৎসা আর কর্মক্ষেত্রও যে বহুবিধ ছিল।”
“তা ১৯২২সের এই মাত্র একদিনের সফর মনে হয় তেমন কিছু ঘটনাবহুল ছিল না।”
“একটি বিবরণীতে দেখছি সেদিন তিনি A Vision Of India’s History শীর্ষক একটি বক্তৃতা দিয়েছিলেন। তবে কোথায় তা ঠিক জানা যাচ্ছে না। এমনও সম্ভব যে এই বক্তৃতাটি তিনি পরের দিন মাইসোরে দিয়ে থাকবেন।”
“তারপর চতুর্থ এবং শেষ বার তিনি কবে ব্যাঙ্গালোরে এসেছিলেন?”
“১৯২৮সের জুন মাসে। এবং সব থেকে দীর্ঘ সময়, প্রায় তিন সপ্তাহ, এই শহরে অতিবাহিত করেন। অথচ সে বার তাঁর এখানে আসার কোন পরিকল্পনাই ছিল না।”
“সে কি? পথভোলা পথিক?”
“সে বছর ফেব্রুয়ারি মাসে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে হিবার্ট লেকচার দেওয়ার একটি আমন্ত্রণ তিনি স্বীকার করেছিলেন। সেই উদ্দেশ্যে মে মাসে ইংল্যান্ড ও ইয়োরোপের অন্যান্য স্থান পরিভ্রমণের সূচী নিয়ে জাহাজ ধরার জন্য কবি মাদ্রাজ এসে পৌঁছোন। কিন্তু সেখানে পৌঁছে তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন, বিদেশযাত্রা স্থগিত রাখতে হয়। এই সময় তাঁর বিশ্রামের প্রয়োজন থাকলেও তিনি কিন্তু বিভিন্ন আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে নানা জায়গায় ঘুরছিলেন। কুন্নুর, মাদ্রাজ, পন্ডিচেরি, এমন কি সিংহল দেশের কলোম্বোতেও গিয়েছিলেন। এত ধকলে শরীর আরও বিকল হয়ে পড়ে। তখন আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীল ছিলেন এখানকার অধিবাসী। তিনি একজন রবীন্দ্রানুরাগীও। খবর পেয়ে কবিকে আমন্ত্রণ জানালেন এই শহরের উপভোগ্য আবহাওয়ায় স্বাস্থ্যোদ্ধারের জন্য কিছুদিন কাটিয়ে যেতে। কবি সেই অনুরোধ গ্রহণ করে অবশেষে আবার ব্যাঙ্গালোরে এসে পৌঁছোন। এবার তাঁর সঙ্গে ছিলেন মহলানবিশ দম্পতি, প্রশান্তচন্দ্র এবং নির্মলকুমারী, যাঁকে রবীন্দ্রনাথ সস্নেহে ‘রাণী’ বলে ডাকতেন।”
“শুনেছি এখন ব্যাঙ্গালোরে প্রায় ১৪ লাখ বাঙালি থাকেন। কিন্তু সেই ১৯২৮সে একজন বাঙালি এই শহরে বসবাস করেছেন, যাঁর অতিথি হয়ে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ তখনকার ব্যাঙ্গালোরে থেকে গেছেন! অথচ তাঁর সম্বন্ধে আমি কত কম জানি।”
“ঠিক বলেছিস। আমরা অনেকেই, শুধু তুই নয়। ব্রজেন্দ্রনাথ শীল, বলা যায়, তৎকালীন মাইসোর স্টেটের প্রায় প্রথম প্রজন্মের প্রবাসী বাঙালিদের মধ্যে এক অন্যতম অতি উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব। ১৯২৮ নয়, সেই ১৯২০র ডিসেম্বর থেকে ১৯৩০সের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত, অর্থাৎ ৯ বছরেরও বেশী সময় তিনি এ রাজ্যের অধিবাসী ছিলেন। যদিও তাঁর প্রাথমিক পরিচয় একজন দার্শনিক হিসেবে, সে বোধহয় কেবলমাত্র এইজন্যই যে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর স্তরে দর্শনই তাঁর বিষয় ছিল এবং ঐ বিষয়ে তিনি ছিলেন স্বর্ণপদকধারী। দর্শনশাস্ত্রেই তাঁর ডক্টরেটও বটে। কিন্তু, গণিত, স্ট্যাটিস্টিক্স, বাংলা, ইংরেজি ও অন্য ইয়োরোপীয় ভাষার, এমন কি ল্যাটিন, গ্রীক ও সিরিয় ভাষার মত প্রাচীন ভাষার সাহিত্য, সাহিত্যের ইতিহাস, নৃতত্ত্ব, সমাজতত্ত্ব, পদার্থবিদ্যা, প্রাচীন ভারতের বিজ্ঞানচর্চা, ধর্ম, সঙ্গীত ইত্যাদি এত বিষয়ে তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্য ছিল যে তাঁকে বলা হতো চলমান বিশ্ববিদ্যালয়। ইংরেজিতে polymath বলতে যা বোঝায় তাই। এই সব বিষয়ে তিনি দেশে এবং ইয়োরোপের বিভিন্ন জায়গায় বক্তৃতা দিয়েছেন, প্রবন্ধ এবং বই লিখেছেন। তিনি ছিলেন নরেন্দ্রনাথ দত্তের বাল্যবন্ধু এবং সহপাঠী। শ্রীরামকৃষ্ণের সংস্পর্শে এসে ধীরে ধীরে তাঁকে স্বামী বিবেকানন্দ হয়ে উঠতে দেখেন, এবং সেই অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধও করে গেছেন। যদিও তিনি নিজে রাজা রামমোহন রায়ের ব্রাহ্ম মতাদর্শে অধিক প্রভাবিত হয়েছিলেন।”
“কিন্তু তিনি ব্যাঙ্গালোরে আসতে গেলেন কেন?”
“কেবল ব্যাঙ্গালোর বললে ভুল হবে। মাইসোর এবং ব্যাঙ্গালোর দুই শহরেই তাঁর আবাস ছিল। তিনি কেবল এক পণ্ডিত ও শিক্ষাবিদই ছিলেন না, একজন দক্ষ একাডেমিক প্রশাসকও ছিলেন। তাঁর শিক্ষকতার শুরু সিটি কলেজে। এক বছর পরেই চলে যান নাগপুরের মরিস মেমোরিয়াল কলেজে লেকচারার হয়ে। অচিরেই তিনি সেখানকার প্রিন্সিপাল নিযুক্ত হন। পারিবারিক কারণে বাংলায় ফিরে আসতে হয়। দু’বছর পর বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজে যোগ দেন প্রিন্সিপাল হিসেবে। তাঁর আগে সাত গোরা সাহেব সহ আটজন এই কলেজের প্রিন্সিপাল ছিলেন, কিন্তু কলেজটির ক্রমাবনতি বন্ধ হয়নি। ব্রজেন্দ্রনাথ হাল ধরে প্রায় বন্ধ হবার অবস্থা থেকে কলেজটিকে স্বগরিমায় পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। ন’বছর সেখানে কাটিয়ে কুচবিহারের ভিক্টোরিয়া কলেজের প্রথম ভারতীয় প্রিন্সিপাল হিসেবে যোগদান করেন। কলেজের প্রধান পৃষ্ঠপোষক মহারাজ নৃপেন্দ্রনারায়ণের মৃত্যুর পর ব্রজেন্দ্রনাথ কলকাতায় ফিরে আসেন। সেই সময় স্যর আশুতোষ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে স্নাতকোত্তর উচ্চ শিক্ষার মহাকেন্দ্রে রূপান্তরিত করতে উদ্যোগী ছিলেন। তাঁর আমন্ত্রণে ব্রজেন্দ্রনাথ পঞ্চম জর্জ প্রোফেসরের চেয়ার গ্রহণ করেন। সাত বছর সেখানে ছিলেন।
ইতিমধ্যে এখানে মাইসোর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা হয়েছে, ভারতের ষষ্ঠ এবং কোন রাজশাসিত প্রদেশে প্রথম। তার প্রথম উপাচার্য এচ ভি নানজুন্দাইয়ার মৃত্যুর পর মহারাজা কৃষ্ণরাজা ওয়াদিয়ার খুঁজছিলেন এক উপযুক্ত ব্যক্তিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের হাল ধরার জন্যে। লিডস ইউনিভার্সিটির তৎকালীন ভাইস চ্যান্সেলর মাইকেল স্যাডলার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন সংক্রান্ত একটি সুপারিস কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে বেশ কিছু সময় ব্রজেন্দ্রনাথের সংস্পর্শে এসেছিলেন। তিনি মহারাজকে পরামর্শ দিয়ে লেখেন, “I cannot think of any scholar in the East or the West who can match Seal in respect of the range and depth of scholarship and originality of mind.” সুতরাং মহারাজা কৃষ্ণরাজা ওয়াদিয়ার ব্রজেন্দ্রনাথকে ব্যক্তিগত আমন্ত্রণ জানান মাইসোর বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয় উপাচার্যের পদভার গ্রহণ করার। ব্রজেন্দ্রনাথ শুরুতে বিশেষ আগ্রহী না হলেও পরে তাঁর বন্ধুবান্ধব এবং সতীর্থ শিক্ষাবিদদের উপদেশ গ্রহণ করে রাজি হয়ে যান। এইভাবে ১৯২০র ডিসেম্বরে তিনি মাইসোরে আসেন মাইসোর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর হয়ে। কর্মসূত্রে ব্যাঙ্গালোরে এসেও তাঁকে থাকতে হতো।
“সত্যিকারের পণ্ডিত ও দক্ষ শিক্ষাবিদ।”
“তিনি শুধু রবীন্দ্র-সাহিত্যের গুণগ্রাহীই নয়, পর্যালোচকও ছিলেন। সেই সূত্রে কবির সঙ্গে ছিল তাঁর পারস্পরিক শ্রদ্ধার সম্পর্ক। ওদিকে প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ তখন বিজ্ঞান ও গণিত, বিশেষত পরিসংখ্যান গণিতের এক তরুণ উদীয়মান প্রতিভা। তিনি রবীন্দ্রনাথ ও ব্রজেন্দ্রনাথ, উভয়ের দ্বারাই গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। ব্রজেন্দ্রনাথকে তিনি স্পষ্টতই লিখেছিলেন, I may say broadly that I owe to you the entire background of my statistical knowledge, especially in its logical aspects। আর তাঁর স্ত্রী নির্মলকুমারী তো দেশেবিদেশে স্বামীর সঙ্গে কবিগুরুর যাত্রাসঙ্গিনী ও তত্ত্বাবধায়ক। সে সব অমূল্য বিবরণী তিনি লিখে গেছেন পরবর্তী প্রজন্মের জন্য। কবি তাঁকে এতটাই স্নেহ করতেন যে বলেছিলেন, তুমি আমার শেষ বন্ধুদের মধ্যে অদ্বিতীয়। এই চার মহান প্রতিভার মিলনক্ষেত্র হয়ে রইলো ব্যাঙ্গালোর।”
“ব্যালাব্রুয়ি?”
“১৯১৯ সালে কবি যখন এসেছিলেন, তখন থেকেছিলেন ব্যালাব্রুয়ির পাঁচ নম্বর কামরায়। ঘরটির বাইরে একটি ফলকে লেখা আছে “Rabindranath Tagore stayed here in 1919”। তাঁর পরবর্তী অবস্থানের বিষয়ে কিন্তু কোন স্মারক নেই। দু-একটি লেখায় এমনও দেখা যাচ্ছে যে তিনি শীল মশাইয়ের বাসভবনে ছিলেন। কিন্তু স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ যখন তাঁর উপন্যাসে লিখেছেন “ব্যালাব্রুয়ি, ২৫ জুন, ১৯২৮”, তখন মানতে হবে যে এখানেই তাঁরা উঠেছিলেন।”
“উপন্যাস মানে, ‘শেষের কবিতা’র কথা বলছ তো?”
“যদি আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীল এবং মহারাজা নলবাদি কৃষ্ণরাজা ওয়াদিয়ার না থাকতেন, তবে রবীন্দ্রনাথের দুটি অনন্য উপন্যাস এবং বেশ কিছু কবিতার সঙ্গে ব্যাঙ্গালোরের নাম জুড়তো না।”
“দুটি উপন্যাস? এখানে তো তিনি ’শেষের কবিতা’ই লিখেছিলেন বলে জানি।”
“উপন্যাস অত কম সময়ে শুরু থেকে শেষ করা যায় কি? আসলে কুন্নুরে থাকার সময়েই রবীন্দ্রনাথ একই সঙ্গে দু-দুটি উপন্যাস লেখা আরম্ভ করেন। একটির নাম ‘তিন পুরুষ’ এবং অন্যটি হলো ‘মিতা।’ ব্যাঙ্গালোরে যখন এসে পৌঁছোন তখন দুটি উপন্যাসই ছিল আংশিকভাবে লেখা। সেবারের সফরে এখানে তাঁর অন্য কোন কর্মসূচী ছিল না, স্বাস্থ্যোদ্ধার ও বিশ্রামই ছিল উদ্দেশ্য। তাই সেই অবকাশ এই তিনটি সপ্তাহকে সৃজনশীলতার দিক দিয়ে করে তুলেছিল সব থেকে ফলপ্রদ ব্যাঙ্গালোরবাস। কবির ইচ্ছে ছিল প্রথমে ‘তিন পুরুষ’ উপন্যাসটি সমাপ্ত করবেন। প্রতিদিন তিনি যা লিখতেন, পরদিন তা পড়ে শোনাতেন প্রশান্তচন্দ্র, রাণী ও ব্রজেন্দ্রনাথকে। দুটি উপন্যাসই একসঙ্গে অগ্রসর হচ্ছিলো। কিন্তু ’মিতা’ ব্রজেন্দ্রনাথকে অনেক বেশি অভিভূত করেছিল। কোন উপন্যাসের যে এমন romantic আঙ্গিক, এমন lyrical বিস্তার হতে পারে, তা তাঁর কাছে অভিনব মনে হয়েছিলো। তিনি কবিকে অনুরোধ করেন, ‘মিতা’ই যেন প্রথমে সম্পূর্ণ করেন, কারণ উপন্যাসটি কবি কিভাবে শেষ করেন তা দেখার জন্য তিনি উদগ্রীব ছিলেন। তাই ব্রজেন্দ্রনাথ ও প্রশান্তচন্দ্রের অনুরোধে ‘মিতা’ উপন্যাসটিই কবি আগে সম্পূর্ণ করেন। এছাড়া বেশ কিছু কবিতাও লিখেছিলেন যা পরে তাঁর ‘মহুয়া’ কাব্যগ্রন্থে সংযোজিত হয়।”
“‘তিন পুরুষ’, ‘মিতা?’ কিন্তু এইসব নামে তাঁর কোনও উপন্যাস আছে বলে তো জানিনা!”
“যদিও বললাম সম্পূর্ণ করেছিলেন, কিন্তু শান্তিনিকেতনে ফিরে গিয়ে কবি ‘মিতা’র অনেক পরিমার্জনা করেছিলেন, এবং ‘তিন পুরুষ’ এরও। বিচিত্রা পত্রিকায় ১৩৩৪-এর আশ্বিন থেকে ‘তিন পুরুষ’ প্রকাশ হতে শুরু করে। দুটি কিস্তির পর কবি এর নাম বদল করে রাখলেন ‘যোগাযোগ।’ ১৩৩৫এর চৈত্র পর্যন্ত চলেছিল। ওদিকে ‘প্রবাসী’র সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় ‘মিতা’র জন্য শান্তিনিকেতনে এসে কবিকে ১০০০ টাকা অগ্রিম দিয়ে গিয়েছিলেন। অন্তিম রূপ দেবার পর রবীন্দ্রনাথ এর নাম বদলে রাখলেন ‘শেষের কবিতা’। সে বছরই এটি ধারাবাহিকভাবে প্রবাসীতে প্রকাশ পায়।”
“আচ্ছা, বুঝলাম।”
“একবার ফিরে দেখি ১৯২৮সের সেই ২৫শে জুন। সেদিন কবির ওপর যেন এক সৃজনাবেগ ভর করেছিলো। নিজের শারীরিক ক্লেশ উপেক্ষা করে, যেন এক সৃষ্টিসুখের উন্মাদনায়, দিন-রাত একাকার করে তিনি লিখে চলেছেন ‘মিতা’ বা ‘শেষের কবিতা।’
“রাণী মহলানবিশ মাঝরাত পার করে রবীন্দ্রনাথের ঘরের দরজার পাশে ঠায় আড়ালে দাঁড়িয়ে। তাঁর স্মৃতিচারণায় লিখেছেন, “এসেছিলাম রাত জেগে লেখার জন্যে ওঁকে ভর্ৎসনা করতে, কিন্তু পাছে আমার উপস্থিতিতে লেখার ব্যাঘাত ঘটে তাই প্রায় নিঃশ্বাস বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইলাম।“ রবীন্দ্রনাথ লিখছেন আর নিজেই স্বকণ্ঠে তাঁর লেখা পাঠ করছেন। ভোর চারটের সময়’ মিতা’ সমাপ্ত হলো।কবি তখন আবৃত্তি করছেন তাঁরই উপন্যাসের শেষ লাইন কটি –
তোমারে যা দিয়েছিনু সে তোমারই দান;
গ্রহণ করেছ যত ঋণী তত করেছ আমায়।
হে বন্ধু বিদায়।
ব্যালাব্রুয়ির দেয়ালগুলি সেই অসাধারণ ঊষাক্ষণের সাক্ষী হয়ে রইলো।”
“সত্যি অসাধারণ।”
“এই তো ছিল রবীন্দ্রনাথের ব্যাঙ্গালোর প্রবাসের ইতিবৃত্ত। আমরা যখন তাঁর ব্যাঙ্গালোর connection নিয়ে আলোচনা করছি, তখন এইখানে আরও দুটি ঘটনার কথা উল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না।”
“বলো, বলো।”
“ব্যাঙ্গালোরের প্রবাসী বাঙালিরা সেই পঞ্চাশের দশকেই একটি গোষ্ঠী প্রতিষ্ঠা করেন, যার নাম বেঙ্গলি অ্যাসোসিয়েসন। এখানকার বাঙালীদের সর্বপ্রথম সংস্থা। এদের সদস্যসংখ্যা ক্রমাগত এত বাড়তে লাগলো যে একসময় তাঁরা একটি স্থায়ী ঠিকানার প্রয়োজন অনুভব করলেন। ১৯৬০ সালে তাঁরা একটি জমি বরাদ্দ করার আর্জি নিয়ে হাজির হলেন শহর কর্পোরেশনের তদানীন্তন অ্যাডমিনিস্ট্রেটর আই সি এস অফিসার লক্ষণ রাও-এর কাছে। তিনি সব কিছু শুনে বললেন, জমির ব্যবস্থা তিনি করতে পারেন একটি শর্তে। শর্তটি ছিল, সেই জমিতে যে ভবন নির্মিত হবে, তার নামকরণ করতে হবে রবীন্দ্রনাথ টেগোরের নামে। বলা বাহুল্য, সংস্থার সদস্যরা সানন্দে রাজি হয়ে যান। আলসুর বা বর্তমান হালাসুরু অঞ্চলের আসায়ে রোডে অবস্থিত বেঙ্গলি অ্যাসোসিয়েসনের এই ভবনের নাম টেগোর কালচারাল সেন্টার।”
“আর অন্য ঘটনাটি?”
“এখানে চার্চ স্ট্রীটে ব্লসম নামে একটি সুখ্যাত বইয়ের দোকানের দুটি শাখা আছে। এঁদের বিশেষত্ব পুরনো বইয়ের বিপুল সম্ভার। এই দোকানের কর্ণধার শ্রী মায়ি গৌড়া ২০১০ সালে মুম্বাইয়ে ঘুরছিলেন পুরনো বইয়ের সন্ধানে। সেখানে ফ্লোরা ফাউন্টেনে হঠাৎই একটি বই তাঁর হাতে আসে। বইটির নাম Golden Book। ১৯৩১ সালে রবীন্দ্রনাথের সত্তরতম জন্মদিন উপলক্ষে আইনস্টাইন-সহ বেশ কয়েকজন বিখ্যাত ব্যক্তিত্বের শ্রদ্ধানিবন্ধের সংকলন ছিল এই Golden Book। মাত্র ১৫০০ কপি ছাপা হয়েছিলো, এটি ছিল তারই একটি। ৫০০০ টাকায় শ্রী গৌড়া এই অমূল্য বইটি কিনে নেন। কিন্তু বইটির ভেতরে লুকিয়ে ছিল একটি ততোধিক অমূল্য সম্পদ যার কথা বইটির পূর্বতন বা পরবর্তী মালিকের জানা ছিল না। পাতা ওলটাতে ওলটাতে শ্রী গৌড়া পেয়ে যান একটি বিশ্বভারতীর logoওয়ালা প্যাডের কাগজ, যাতে রয়েছে রবীন্দ্রনাথের স্বহস্তে ইংরেজিতে লেখা কয়েকটি লাইন। বিশেষ কাউকে উদ্দেশ্য করে নয়। শ্রী গৌড়ার অনুমান, হয়তো তাঁর বাণীসমেত বইটির এই কপি কবি কোন ব্যক্তিকে উপহার দিয়েছিলেন। হস্তরেখা বিশারদদের দিয়ে পরীক্ষা করিয়ে হাতের লেখা যে রবীন্দ্রনাথেরই সে বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে শ্রী গৌড়া কাগজটি ফ্রেমবদ্ধ করে রেখেছেন। অনেক প্রস্তাব এসেছিলো কাগজটি কেনার জন্য, কিন্তু তিনি বিক্রি করতে রাজি হননি।”
“কী অদ্ভুত! অনেক কিছু জানলাম আজ।”
“হ্যাঁ, অনেকক্ষণ হয়ে গেলো। আজ তবে শেষ করি। হে বন্ধু বিদায়।”
টীকা
১) একমাত্র ব্লসমের ছবিটি ছাড়া অন্য সব ছবি অন্তর্জাল থেকে সংগৃহীত।
২) উচ্চারণ ও আধুনিক নামানুসারে অন্যান্যভাবে চিহ্নিত হলেও রবীন্দ্রনাথের স্বহস্তলিখিত নামটিই আমরা রাখলাম, ‘ব্যালাব্রুয়ি।’
৩) অধিক পরিচিত বলে এবং রবীন্দ্রনাথের সময়ে ঐ নাম ছিল বলে ‘ব্যাঙ্গালোর’ নামটিই রাখা হল সর্বত্র।