তপন সিংহ: মানুষ ও সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ চলচ্চিত্র পরিচালক
‘মহাভারতের লঘু-গুরু’ গ্রন্থে বিশিষ্ট পুরাণ বিশেষজ্ঞ নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী ‘পাণ্ডু’ সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে তামাম পৃথিবীর ‘মধ্যম ভ্রাতা’দের উদ্দেশে যে বিষাদ ব্যক্ত করেছেন তা খুব সঙ্গত। রবীন্দ্রসঙ্গীতের বিশিষ্ট শিল্পী পূর্বা দাম সম্পর্কেও আমার অনুরূপ কথা মনে হয়। সুচিত্রা মিত্র, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় ও নীলিমা সেন – তিনি যেন এই বিখ্যাত ‘ত্রয়ী’র ছায়াবৃতা! অথচ, রবীন্দ্রনাথের গানের স্বর্ণময় ইতিহাসে তাঁরও ‘আসন পাতা’ সমানভাবে। চলচ্চিত্রেও কিন্তু একজন ‘মধ্যম’ আছেন। তপন সিংহ। এক্ষেত্রে নিশ্চয় ‘ত্রয়ী’র কথা বলে দিতে হবে না!
সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন এবং ঋত্বিক ঘটক – বিখ্যাত এই তিন (ত্রয়ী) চলচ্চিত্র পরিচালকের সমসাময়িক বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার তপন সিংহ জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৯২৪-এর ২ অক্টোবর (মৃত্যু : ১৫ জানুয়ারি, ২০০৯)। তাঁকে বলা যায়, সাহিত্যধর্মী চলচ্চিত্র নির্মাণে পথিকৃৎ চলচ্চিত্রনির্মাতা। সাহিত্যের নন্দনবনে তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন গল্পের সন্ধানে এবং বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে বিচরণ করে বহু বিচিত্র, শৈল্পিক ও রসোত্তীর্ণ চলচ্চিত্র আমাদের উপহার দিয়েছেন। তাঁর ‘ধারা’ অনুসরণ করেছিলেন আরেকজন, তিনি তরুণ মজুমদার। ধ্রুপদী সাহিত্যনির্ভর চলচ্চিত্র নির্মাণে বর্তমান পরিচালকদের সদিচ্ছার অভাব এখন প্রকট। এখানে একটি প্রশ্নও মনে জাগে। পরিচালকরা আদৌ কি এখন সাহিত্য তেমন একটা পড়েন? না-পড়লে ইচ্ছেই বা হবে কেমন করে! ‘ত্রয়ী’ পরিচালকদের সঙ্গে সঙ্গে তপন সিংহ, তরুণ মজুমদার রীতিমতো সাহিত্যের পাঠক ছিলেন বলেই কিন্তু তাঁরা সাহিত্যনির্ভর বিশুদ্ধ চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে পেরেছিলেন।
বস্তুত, তপন সিংহের ছবিগুলিতে একটি শুদ্ধ, পরিশীলিত ‘রাবীন্দ্রিকতা’ লক্ষ্য করা যায়। প্রখ্যাত শিল্পকলারসিক, শিল্পসমালোচক শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়-এর সঙ্গে একটি সাক্ষাৎকারে তপন সিংহ একবার কবুল করেছিলেন যে, ব্যক্তির একক জীবনসংগ্রামের মহিমা উচ্চকিত করে তোলাই তাঁর সমগ্র চলচ্চিত্রের মূল সুর। জটিল ও যান্ত্রিক জীবনের সবচেয়ে নির্মম ট্র্যাজেডি, ‘হৃদয়’ নামক বস্তুর ক্রমবিলুপ্তি, কিন্তু তপন সিংহের একের পর এক ছবিতে পুষ্পিত হৃদয়ের বর্ণময় উন্মোচন বিরল দৃশ্যসুখের সূচনা করে। প্রায় সব প্রতিভাধর পরিচালক দর্শকের মস্তিষ্ক থেকে হৃদয়ে প্রবেশ করতে চেয়েছেন, আর তিনি অন্তর্লোক থেকে যাত্রা শুরু করতেন মস্তিষ্ক অভিমুখে, যার অভিঘাত অনেক বেশি তীব্র ও স্থায়ী। উল্লেখ করার মতো আরও একটি বিষয়, মানুষ ও সমাজের প্রতি তাঁর অসীম দায়বদ্ধতা। কাবুলিওয়ালা, অতিথি, ক্ষুধিত পাষাণ, হাঁসুলি বাঁকের উপকথা, লৌহকপাট, আঁধার পেরিয়ে, গল্প হলেও সত্যি, জতুগৃহ, ঝিন্দের বন্দী, নির্জন সৈকতে, হাটেবাজারে, আপনজন, হুইল চেয়ার, অন্তর্ধান, আতঙ্ক, ইত্যাদি বহু বাংলা ছবি যেমন তাঁর অসামান্য সৃষ্টি তেমনি এক ডক্টর কি মউত, সাগিনা মাহাতো, আদমি আউর ঔরত, সফেদ হাতি প্রভৃতি হিন্দি ছবিও তাঁর অনন্য প্রতিভার স্বাক্ষর বহন করে। রুচিশীল, পরিচ্ছন্ন, ও মানবিক আবেদনসম্পন্ন ছবি নির্মাণের মধ্য দিয়ে চলচ্চিত্রশিল্পের প্রতি তিনি যেন বারবার নিজের ‘দায়বদ্ধতা’ প্রকাশ করতে চেয়েছেন। এজন্য রূপক বা সাংকেতিকতার দুর্ভেদ্য কুয়াশায় তিনি দর্শককে বিভ্রান্ত ও ক্লিষ্ট করতে চাননি। তাঁর ছবি নিবিড় সরলরৈখিক পথ ধরে এগিয়ে চলে এবং পরিশেষে এক নিরুচ্চার তৃপ্তি হৃদয়কে শান্ত-স্নিগ্ধ ও অনুভবে ঋদ্ধ করে তোলে। অপূর্ব আবহসঙ্গীতও তাঁর ছবিগুলিকে অন্য মাত্রা দিয়েছে। আজকের চটুল ও বিকৃত পছন্দের যুগে তপন সিংহের চিরকালীন আবেদন-ঔজ্জ্বল্যে অম্লান এইসব ছবি অনেকটাই ব্রাত্য হয়ে যেন লজ্জাবনতা কিশোরীর মতো কোনও এক কোণে পড়ে আছে – একথা ভাবতেই কষ্ট হয়!
প্রসঙ্গত আরেকটি কথা। সত্যজিৎ রায় শিশু ও কিশোরদের জন্য একগুচ্ছ চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন। গুপী গাইন ও বাঘা বাইন, হীরক রাজার দেশে, সোনার কেল্লা, জয় বাবা ফেলুনাথ ইত্যাদি। তপন সিংহ পরিচালিত ‘সবুজ দ্বীপের রাজা,’ ‘সফেদ হাতি,’ কিংবা ঋত্বিক ঘটকের ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে,’ ইত্যাদিও উৎকৃষ্ট শিশু বা কিশোর চলচ্চিত্রের নিদর্শন। সন্দীপ রায় ‘ফটিকচাঁদ,’ ‘বঙ্কুবাবুর বন্ধু,’ ছাড়াও ফেলুদাকে নিয়ে একগুচ্ছ দৃষ্টিনন্দন চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। বলাই বাহুল্য, এই ছবিগুলি শিশুদের মতো বড়দেরও সমান প্রিয়। সত্যজিৎ রায়ের ‘পিকু’ কিংবা তপন সিংহের ‘কাবুলিওয়ালা’ শিশুর সঙ্গে পরিণত, বড় মানুষদের মনস্তাত্ত্বিক সম্পর্কের রসায়ন ও শুদ্ধতা অনুসন্ধানে শৈল্পিক নির্মাণ তো বটেই। মোটকথা, এক সময় শিশু ও কিশোরদের নিয়ে ভাবার মতো, তাদের মনোজগতের খোঁজ নেওয়ার মতো এবং তাদের বিশুদ্ধ আনন্দরসে সিক্ত করার মতো চলচ্চিত্র পরিচালকের অভাব ছিল না। আজ তাদের জন্যে নান্দনিক চলচ্চিত্র-নির্মাণে পরিচালকদের নিদারুণ অনাগ্রহ! জীবন ও জগৎ ক্রমশ জটিল এবং নির্মম হয়ে উঠছে, তার সুকঠিন অভিঘাত থেকে শিশুরাও মুক্ত নয়। এমন সময়ে শিশুদের নির্মল আনন্দদান করা এবং তাদের ‘সুন্দর মানুষ’ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য ‘চলচ্চিত্র’ নামক সৃজনশীল শিল্পমাধ্যমটির সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিবর্গের অগ্রণী ভূমিকা কাম্য ছিল! আসলে শিল্পের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিবর্গের মনে বাণিজ্যিক স্বার্থচিন্তা ও সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতার অনুভূতি দুটোই একই সঙ্গে না থাকলে হয় না। শিল্প ও বাণিজ্যের মধ্যে বিরোধের ধারণাটি বহুল কথিত ও বিতর্কিত। কিন্তু অনতি-অতীতে অনেক চলচ্চিত্র পরিচালকই এই ধারণাকে ভ্রান্ত প্রমাণ করেছেন। তাঁদের ছবি শিল্পের শিখর স্পর্শ করেও ব্যবসায়িক সাফল্য পেয়েছে। এই ইতিবৃত্ত বর্তমান পরিচালক ও প্রযোজকগণ সম্ভবত বিস্মৃত হয়েছেন। এখন বাণিজ্যের লক্ষ্যটাই কেবল প্রবল, আর শিল্পসৌন্দর্য প্রায় অস্তাচলগামী! উল্লেখ্য, সত্যজিৎ রায়, তপন সিংহ প্রমুখের উপরিউক্ত চলচ্চিত্রগুলি কিন্তু তাঁদের অসামান্য সৃজন-দক্ষতায় বাণিজ্যসফলও বটে। জানি না, এই হতাশাজনক অবস্থা আর কতদিন বজায় থাকবে এবং আকাঙ্ক্ষিত উত্তরণ হবে!
পরিশেষে একটি দুঃখজনক বাস্তবতার কথা বলা যাক। কয়েক বছর আগে প্ৰখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক মৃণাল সেন-এর প্রবাসী পুত্র সখেদে একটি ‘ঘোষণা’ করেছিলেন! তাঁর পিতার যাবতীয় সৃষ্টিসম্ভার তিনি তুলে দেবেন শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্কাইভে। কতটা অভিমান, কতটা যন্ত্রণা থাকলে কেউ এমন একটা ঘোষণা করতে পারে! সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক, তপন সিংহের ছবিগুলির সংরক্ষণ নিয়ে যে নিশ্ছিদ্র অবহেলা দৃশ্যমান তাতে একই দুশ্চিন্তা ও বিষণ্ণতা ক্রমবর্ধমান। ‘ধ্রুপদী সৃষ্টি’ খুব কঠিন একটি কাজ, কিন্তু তার সযত্ন সংরক্ষণ বোধহয় ততটা কঠিন নয়। শুধু একটু ‘ভালবাসা’ প্রয়োজন। সেটাও কি বিলুপ্ত হতে বসেছে ?