অগ্রজ-প্রতিম সুমিত রায়

গীতবিতান.নেট চালাবার লোক খুঁজছে সু্মিতদা। মাস ছয়েক আগে অবসর.নেট পাত্রস্থ হয়েছে। সেই ওয়েবসাইট আমরা দুজনে মিলে শুরু করেছিলাম, গীতবিতান পুরোটাই সুমিতদা’র তৈরি। বিস্তর খোঁজখবর করে একজনকে পেয়ে নামধাম দিয়ে মেসেজ পাঠালাম। সুমিতদা’র শরীর ভাল যাচ্ছে না, তাই ফোনটা আর করলাম না। লিখলাম, কিছু ‘জিজ্ঞাস্য থাকলে ফোন কোরো।’

দু’দিন বাদে সুমিতদা’র ফোন। “কেমন আছ, সুমিতদা?” অন্য প্রান্তে বীথি, সুমিত-দা’র স্ত্রী। ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলা, “সুমিত নেই, সুজন।”
এরপরের কথাগুলোর এক বর্ণও মনে নেই।…

সুমিতদা আর আমি বেল ল্যাব্‌স-এ যোগ দিয়েছিলাম একই দিনে – সুমিতদা নেপারভিল-এ, আমি কলম্বাস শহরে। সালটা ছিল উনিশশো সত্তর। বন্ধুত্বের শুরু অবশ্য বছর তেরো পরে – যখন দু’জনে বদলি হয়ে এলাম নিউ জার্সিতে। বাংলা ভাষা নিয়ে দু’জনেরই পাগলামি ছিল, সেই সুবাদে জড়িয়ে পড়লাম নানান ‘কু-কর্মে’ (সুমিতদার কথায়)। কম্পিউটার তখন এসে গেছে, সুমিতদার মাথায় চাপল কম্পিউটারে লেখার জন্য বাংলা ফন্ট তৈরি করবে। কাজ শুরু হল, করছে সুমিতদা, আমার কাজ এক-আধ সময় সঙ্গত দেওয়া। অর্থাৎ, এটা দেখতে ভাল লাগছে না, ওটা একটু ছোটো কর – এইসব বলা। এই ‘হরফ’ ফন্ট নিয়ে ‘অবসর’-এ আগে একটা লেখা হয়েছে, ‘অবসর.নেট’ কী ভাবে শুরু হল, সেটাও সেই লেখায় ছিল, তাই এখানে অন্য কিছু লিখি।

সুমিতদা ছিল ‘নো-ননসেন্স’ ম্যান। আজেবাজে কথা সহ্য করতে পারত না। কেউ বাজে বকতে শুরু করলে, তর্কাতর্কি না করে জিজ্ঞেস করত “এটা কি আপনার ওপিনিয়ন, মানে বিশ্বাস, না এর পেছনে কোনো তথ্য আছে? এটা আপনার বিশ্বাস হলে সময় নষ্ট করব না।” কথাটা আমি সুমিতদাকে একাধিক বার বলতে শুনেছি।

আরেকটা গল্প আছে, সেটা অবশ্য আমি নিজে শুনিনি। এক পার্টিতে বিই কলেজের এক প্রাক্তনী নাকি বলেছিলেন, ‘রবীন্দ্রনাথকে বিশ্বকবি বলার কোনো অর্থ হয় না, কারণ বিশ্বের প্রথম দশজন কবির লিস্টে রুমি বা লি পো থাকলেও রবীন্দ্রনাথ নেই।’ কথাটা শুনে ‘টেগোরাইটিস’ রুগী সুমিতদা মন্তব্য করেছিল, ‘বিশ্বকবি’ বলে কিছু আছে কিনা জানি না, তবে ‘বিশ্ববখাটে’ আছে, আর এই রুমেই সে আছে।’ এটার সত্যতা নিয়ে সুমিতদাকে যখন জিজ্ঞেস করেছিলাম, সোজা উত্তর পাইনি।

সুমিতদা গান ভালোবাসত। নিউ জার্সিতে রুবিদি (বনানী ঘোষ)-র গানের স্কুল ‘অন্তরা’-র প্রচার এবং প্রসার নিয়ে আদ্যন্ত রবীন্দ্র-প্রেমী সুমিতদা’র ব্যস্ততা ছিল দেখার মতো। একে গান, তাঁর ওপর রবীন্দ্রসঙ্গীত। দু’তিনটে রবীন্দ্র-মেলা পর্যন্ত হয়ে গেল, যার অন্যতম উদ্যোক্তা ছিল সুমিতদা। আমাকে অবশ্য গানের ছাত্র করতে পারেনি, যদিও চেষ্টার কমতি ছিল না। রবীন্দ্র-মেলার স্মারক-সংখ্যা ‘রবি-বর্ণালী’ প্রকাশের সময় পালাতে পারিনি – কাজে লাগতে হয়েছিল!

‘অবসর’ চালাতে গিয়ে আমাদের মধ্যে মতান্তর মাঝে মাঝেই হত, কিন্তু মনান্তর নয়। ‘অবসর’-এর জন্মলগ্ন থেকে আমি সম্পাদক, সুমিতদা প্রযুক্তিবিদ। সুমিতদার কথায়, ‘তুই লেখক আর পাঠকের হ্যাপা সামলাবি, আমি টেকনিক্যাল সমস্যা।’ নিতান্তই কৃত্রিম বিভাগ – ‘অবসর’ চলত আমাদের যুগ্ম-প্রচেষ্টায়। ‘অবসর’-এ বহু ভালো ভালো লেখক এসেছেন সুমিতদার আমন্ত্রণে – পারিশ্রমিক বা সাম্মানিক দেবার ক্ষমতা আমাদের ছিল না। যাঁরা লেখা দিতেন, ভালোবেসেই দিতেন নিজেদের পত্রিকা মনে করে। পরে কেউ কেউ সম্পাদক-মণ্ডলীতে যোগ দিয়েছেন, কেউ কেউ উপদেষ্টার দায়িত্বও পালন করেছেন।

আমরা দুজনেই দুজনের লেখা পড়ে মতামত দিতাম, নিজের লেখার পরিমার্জনা করেছি সুমিতদা’র কথা শুনে। সুমিতদার লেখা ছিল ঠাস-বুনুনি ‘ক্লাসিক বাংলা’ – এদিক ওদিক ওজনদার শব্দ দিয়ে গাঁথা অত্যন্ত সুপাঠ্য রচনা। মাঝে মাঝে অবশ্য ডিকশনারি খুলতে হত মর্মোদ্ধারের জন্য। তখন বুঝতে পারতাম ভাব-প্রকাশের জন্য সেটিই ছিল মোক্ষম শব্দ। তবে কতগুলো শব্দের ওপর সুমিত-দা’র বাড়াবাড়ি রকমের দুর্বলতা ছিল, যেমন ‘চেষ্টিত’ কথাটা। লেখায় ‘চেষ্টিত’ চোখে পড়লেই আমি চ্যাঁচামেচি করতাম।
“চেষ্টিত করতে হবে কেন, চেষ্টা করতে হবে লিখতে পার না?”
সুমিত-দা গজ-গজ করত, “কেন খারাপটা কী, কথাটায় তো বাঁধুনি আছে, প্রচেষ্টার ভাবটা কেমন স্পষ্ট ফুটে উঠছে।”
বার বার আমার তাড়া খেয়ে, শেষে ‘চেষ্টিত’ আর লিখত না। পরে মাঝে মাঝেই অনুযোগ করেছে, “তোর জন্য আমার লেখার ফ্লো কমে যাচ্ছে!”
বাজে কথা, ফ্লো মোটেও কমে যায়নি, ওই বিশেষ শব্দ বাদ দিয়েও সাহিত্য ও সঙ্গীত নিয়ে বহু সুপাঠ্য প্রবন্ধ সুমিত-দা লিখেছে ‘অবসর’-এ – পরশুরাম, দিলীপকুমার রায়, শরদিন্দু, প্রমুখদের নিয়ে নানান আলোচনা। বাংলায় ভালো প্রবন্ধ বেশি চোখে পড়ে না, বিশেষ করে এ-যুগে। গায়ক বা লেখকের বিশাল কর্মকাণ্ড থেকে নির্যাসটুকু বার করে, তার বিশ্লেষণ ক’জন করতে পারেন?

শারীরিক ভাবে একাধিক বার ধাক্কা খেয়েছে জীবনে… হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক, ইত্যাদি অনেক ঝড় ওর দীর্ঘ দেহ সামলেছে। গান ছিল সুমিতদা’র প্রাণ, শারীরিক কারণে সুর উপভোগ করার ক্ষমতা যখন প্রায় লোপ পেল, একটা প্রবন্ধ লিখল ‘বধিরতা’ নিয়ে – তথ্যপূর্ণ, কী অপূর্ব লেখা! গান শোনা বন্ধ হল, সেটা পুষিয়ে নিতে বই পড়ার গতি বাড়ল বহু গুণ। নতুন লেখা না লিখে শুরু করল অনুবাদ করার কাজ। ‘অবসর’-এ জনপ্রিয় একটি বইয়ের এক কিস্তি অনুবাদ বেরোল। লোকে পড়ে মুগ্ধ। সুমিতদা লেখা পাঠিয়েছে, আমিও খেয়াল করিনি। পরে দেখি বইয়ের কপিরাইট রয়েছে। লেখাটি নেট থেকে দ্রুত সরিয়ে নিয়ে বললাম, “সুমিতদা, এটা আর বার করা যাবে না, বন্ধ করে দিচ্ছি।”
“সেকী! আমি তো আরও তিন-চার কিস্তি লিখে ফেলেছি, দারুণ ফুর্তি হচ্ছে লিখতে।”
“তা হোক, ‘অবসর’-এ তুলব না।”
রাগ করল সুমিতদা। “তোকে নিয়ে তো আচ্ছা ঝামেলা, ভারি আমার সম্পাদক হয়েছিস, ভালো কিছু লিখতে চাইলেই ব্যাগড়া দিস! অনুবাদ করেছি, তাতে আবার কপিরাইট কী? ওসব অনুমতির তোয়াক্কা করি না।”
“আমি করি, হ্যাপা তো আমাকে সামলাতে হবে।”
পরে অবশ্য সুমিতদা বুঝল। গীতবিতান.নেট যখন করছে, মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করত, “হ্যাঁরে, এটা দিলে কি ঝামেলা হবে?”
“কী আর হবে, তুমি তো অনুমতির তোয়াক্কা করো না।”
“আরে না, সিরিয়াসলি বল।”

সেই কথাটাই এখন বার বার মনে পড়ছে… অনুমতির তোয়াক্কা কি সুমিত-দা সিরিয়াসলি করত? অনুমতি না নিয়েই তো কেমন দুম চলে গেল!

সদ্য প্রয়াত সুজন দাশগুপ্ত ছিলেন পাঁচ দশকের বেশি আমেরিকা প্রবাসী। গোয়েন্দা একেনবাবু-র মানস-পিতা এবং অবসর.নেট-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও প্রাক্তন সম্পাদক। রম্যরচনা, ধাঁধা, উপন্যাস ও রহস্যকাহিনীর ওপর গোটা পঁচিশেক বই আছে।

1 Comment

Avarage Rating:
  • 0 / 10
  • BHASKAR SINHA , June 19, 2021 @ 6:43 pm

    অত্যন্ত কাছের এবং অসংখ্য গুণের অধিকারী একজন মানুষের স্মৃতিচারণা দরদী মন‌ নিয়ে কত সুন্দরভাবে করা যায় আপনার লেখাটির প্রত্যেক লাইনে তা’ অনুভব করলাম। আপনার কলমের পরিমিতিবোধ ঈর্ষণীয়।

    ∆ ভাস্কর সিংহ | ভোপাল | মধ্য প্রদেশ | ভারত
    20-JUN-2021

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *