স্বরলিপি লেখা রবে
লিখতে বসেছি বাংলার সর্বকালের অন্যতম সেরা গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারকে নিয়ে কিছু কথা। অথচ প্রথমেই লিখতে ইচ্ছে করছে ছেলেবেলার গল্প। এই নব্বইয়ের দশকে বেড়ে ওঠা ছেলেমেয়েদের এক দোষ। স্মার্টফোন-বিহীন সে যুগ ছিল নস্টালজিয়া তৈরির খনি।
তখনও আমার মামার বাড়িতে একটা গ্রামোফোন ছিল। তাতে দিনে একবার হলেও বাজত হেমন্ত, মান্না বা শ্যামল মিত্রের রেকর্ড। সেসব শুনে শুনে গান শোনার এক অদম্য ইচ্ছে তৈরি হয়েছিল। আমার প্রথম টেপ রেকর্ডার মামার কাছ থেকেই পেয়েছিলাম। মামা একটা নতুন টেপ প্লেয়ার কিনে পুরনোটা আমায় দিয়ে দিয়েছিলেন। গ্রামোফোনের যুগ তখন শেষ।
যাদবপুর এইট বিতে একটা ক্যাসেটের দোকান ছিল। সেখান থেকে কিনে এনেছিলাম হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের ‘এ লেজেন্ড অফ গ্লোরি,’ আর মান্না দের আরেকটা অ্যালবাম, যার নাম এখন স্মৃতির কুঠুরি হাতড়ে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সেবার পুজোর সকালগুলো কেটেছিল গানের ভুবনে, নিজের একান্ত আপন টেপ রেকর্ডারের মায়ায়। সে রেকর্ডারে টেপ জড়িয়ে গেলে ক্যাসেট বার করে কীভাবে উল্টোদিকে ঘুরিয়ে টেপটা ভিতরে ঢুকিয়ে দিতে হয়, সেসব মামা শিখিয়ে দেওয়ায় সে একেবারে আমার প্রথম পাওয়া নিজের জগত হয়ে উঠেছে।
সে সময় আমাদের মাঠে সদ্য লাগানো হয়েছে ভলিবল খেলার ফ্লাডলাইট। যখন তখন অন্যান্য পাড়ার ছেলেরা চলে আসছে দলবল নিয়ে ম্যাচ খেলতে। কটা পাড়াতেই বা অমন ফ্লাডলাইট থাকে? অতএব আমাদের প্রতাপ সংঘ ক্লাবের সদস্যদের গর্বের শেষ নেই। আমি কিন্তু কেবলই দর্শক, বা বলা ভালো সাপোর্টার। চেঁচিয়ে দলের জন্য নিজের গলা চিরে ফেলার যে কী স্বর্গীয় আনন্দ, তা সাক্ষাৎ অভিজ্ঞতা ছাড়া বোঝা কঠিন। যে দিনের কথা বলছি সেটা ছিল কালীপুজোর আগের দিন।
আমাদের ভলিবল দলের নেটের সামনে দাঁড়ায় মান্না আর বাচ্চুদা। বল একবার ওদের হাতের কাছে পৌঁছে গেলে প্রতিপক্ষের রক্ষা নেই। মিডলম্যান বলটা তুলে মান্নার হাতের কিছু ওপরে পৌঁছে দেবে। মান্না তারপর সেটা আলতো ফিঙ্গারিংয়ে একটু উঁচু করে দিতেই বাচ্চুদার বিদ্যুদ্গতির স্ম্যাশ। আমার মতই হাঁ করে তাকিয়ে থাকা ছাড়া প্রতিপক্ষের আর বিশেষ কিছু করার থাকত না বেশিরভাগ সময় । সেদিনও অন্যথা হল না। কালীপুজো উপলক্ষে নিজেদের মাঠে আয়োজিত ভলিবল চ্যাম্পিয়নশিপ প্রত্যাশিতভাবে জিতে গেলাম আমরা। সেই খুশি নিয়ে যখন বাড়ি ফিরলাম, তখন বাড়িতে এসেছে বাবার বন্ধু তাপসকাকু। তাপসকাকু আমার ভারী পছন্দের মানুষ। তাকে দেখে একেবারে কথার ফুলঝুরিতে কালীপুজোর উদ্বোধন শুরু করেছি, “আমাদের মান্না-বাচ্চুদা জুটির কাছে কোন টিম পাত্তা পায় না।”
এমন সময় জানলা থেকে ভেসে এলো একজনের গলা। আগন্তুকের সম্পর্কে বলে রাখা দরকার। তখন আমাদের গলির শেষ বাড়িতে এক নেপালি পরিবার থাকতেন। তাঁদের সকলেই বাংলা বলেন রীতিমতো দাপটের সঙ্গে। তাঁদের তিন ভাইয়ের যিনি বড়, তিনি গান বাজনা জানেন । এমনকী আমাকেও একদিন বাড়িতে ডেকে ভারী যত্ন করে ‘এক লেড়কি কো দেখা তো’ গানটা শিখিয়ে দিয়েছিলেন। আমার অমায়িক উচ্চস্বর গলা শুনে জানলার সামনে দাঁড়িয়ে কাকু বললেন, “মান্না- বাচ্চু জুটি থাকলে খেলাও গানের মতোই একেবারে সেরার সেরা হবার কথাই তো।”
আমায় অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে আবার হেসে বললেন, “গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের নাম শুনেছ?”
আমি আমতা আমতা করতে শুরু করেছি দেখে বললেন, “খালি গান শুনলে হবে? ক্যাসেটে প্রতিটা গানের গীতিকার সুরকার লেখা থাকে যে? তাঁদের কথা একটু জানা দরকার বৈকি। একেকটা কালজয়ী গানের পিছনে তাঁরাই তো মূল কারিগর? তোমার পছন্দের কয়েকটা গান বলো দেখি?”
কী আশ্চর্য! প্রথমেই যে গানদুটোর কথা বললাম, তা হল ‘মুছে যাওয়া দিনগুলি’ এবং ‘কফি হাউজের সেই আড্ডাটা।’ কাকু এখানেই থামালেন আমায়, “থাক আর বলতে হবে না, যে দুটো গানের কথা বললে, দুটোই তো গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের লেখা। ওঁর ডাকনাম কী ছিল জানো? বাচ্চু।”
এতক্ষণে কাকুর প্রথম কথাটার মর্ম বুঝলাম। আর একে একে দেখতে শুরু করলাম আমার ক্যাসেটের প্রতিটি গানের গীতিকার ও সুরকারের নাম। সেই আমার প্রথম সাক্ষাৎ গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের সঙ্গে। এর অব্যবহিত পরেই যে ঘটনাটা ঘটল সে ঘটনার সঙ্গেও যেন কাকতালীয়ভাবে ওঁর একটি অতি পরিচিত গানের জন্মরহস্যের বড়ই মিল। তাই সেটুকুও বলার লোভ সামলাতে পারছি না।
তাপসকাকু একটু বাদে বলল, “অনেক খেলা দেখেছ , এবার চল একটু কাজের কাজ করি। নিজে খেললে নাহয় একরকম । তা যখন করছ না, তাহলে আর ভলিবলে সময় নষ্ট করে লাভ নেই।”
আমাকে নিয়ে তাপসকাকু সোজা চলে গেল যাদবপুর সি আই টি মার্কেট। সেখান থেকে আমরা কিনে আনলাম তুবড়ির খোল আর মশলা। তারপর সেই রাত জেগে তুবড়ি বানানো। এরপর প্রতি কালীপুজোর দিনে তুবড়ি বানানো অনেক বছরের জন্য আমার জীবনে এক নেশায় পরিণত হয়েছিল।
এমন আরেক কাকা ভাইপোর কথোপকথনেই নাকি সৃষ্টি হয় আমার মতো অনেক অনেক মানুষের মনের খুব কাছাকাছির গান, ‘কফিহাউজের সেই আড্ডাটা।’
গৌরীপ্রসন্নের প্রিয় বন্ধু ছিলেন কিংবদন্তি সুরকার নচিকেতা ঘোষ। সেই সূত্রে ঘোষবাড়ির সকলের সঙ্গেই ছিল তাঁর সখ্যতা। পরবর্তীকালে সঙ্গীত পরিচালক হয়ে ওঠা নচিকেতা ঘোষের যোগ্য পুত্র সুপর্ণকান্তি ঘোষকে সন্তানের মতো স্নেহ করতেন নিঃসন্তান গৌরীপ্রসন্ন। এমনকি নচিকেতা ঘোষের মৃত্যুর পরেও সম্পর্ক শিথিল হয়ে যায়নি। এমনই একদিন সুপর্ণকান্তি তখন বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় মশগুল, তাঁকে ডেকে গৌরীপ্রসন্ন বললেন, “আড্ডা দিয়ে সময় নষ্ট না করে কিছু কাজে লাগালে তো হয়?”
সুপর্ণকান্তিও তাঁর গৌরীকাকাকে পাল্টা চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে বসেন, “কেন, সময় নষ্ট না করে তুমিও তো আড্ডা নিয়েই একখানা গান লিখতে পারো?”
বৃথা যায়নি এ কথোপকথন। জন্ম নেয় এক কিংবদন্তি গান। অবশ্য শেষ স্তবকটি তখন লেখা হয়ে ওঠেনি। সুপর্ণকান্তিরও নাকি আপত্তি ছিল শেষ স্তবকটি লেখার।
গৌরীপ্রসন্ন তখন কর্কট রোগে আক্রান্ত। চেন্নাই চলেছেন চিকিৎসা করাতে। ঠিক সেই সময় ট্রেন ছাড়ার আগে একখানা সিগারেটের প্যাকেটের ওপর লিখে ফেললেন,
“সেই সাতজন নেই আজ টেবিলটা শুধু আছে, সাতটা পেয়ালা আজও খালি নেই,
একই সে বাগানে আজ এসেছে নতুন কুঁড়ি, শুধু সেই সেদিনের মালি নেই।”
তারপর চেনা এক ব্যক্তির হাতে পাঠিয়ে দিলেন সুপর্ণকান্তির কাছে। সুপর্ণকান্তি সুর করলেন সে গানে প্রাণ ভরে, আর মান্না দে অমর করলেন তাঁর দরদী কণ্ঠের ছোঁয়ায়।
সিগারেটের প্যাকেট প্রায়শই নাকি প্রাণ পেয়েছে গৌরীপ্রসন্নের হাতে। এমন নজিরের গল্প আকছার শোনা যায়। এমন আরও দু-একটি কথা বলতে ইচ্ছে করছে।, কিন্তু তার আগে আরেকটা কথা বলে নেওয়া যাক। তিনি নাকি মানুষটা ছিলেন বড় ভুলো মনের। তেমন কয়েকটা উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। তরুণ মজুমদার তাঁর স্মৃতিকথামূলক ‘সিনেমা পাড়া দিয়ে’ বইতে লিখেছেন, তিনি নাকি হাঁটতে বড় ভালোবাসতেন। স্নেহ করতেন নতুনদের।
তাঁর ভুলো মনের খেসারত তিনি কম দেননি। অনেকেই নাকি তাঁর অমূল্য কাজের মূল্য দিতে ভুলে যেতেন। মুম্বাই গেলে টাকাকড়ি পাওয়া যায়। অতএব অনেকের মতো তিনিও তখন পাড়ি দিয়েছেন বম্বে (তখনও মুম্বাই হতে যোজন পথ বাকি)। সে সময় তরুণ মজুমদারের ‘পলাতক’ ছবির কাজ চলছে। হেমন্ত মুখপাধ্যায় সঙ্গীত পরিচালক। এক নতুন গীতিকারকে দিয়ে গান লেখাচ্ছেন। নতুন গীতিকার অবশ্য তাঁর কাব্যিক গানের কলির জোরে এরপর আর নতুন হয়ে থাকেননি বেশিদিন। তাঁর নাম মুকুল দত্ত। হঠাৎ নাকি একদিন এসে হাজির গৌরীপ্রসন্ন। এসে বললেন, “দিন না, একটা গান লিখি। হিন্দি লিখে কি আর মন ভরে?”
কাজেই ইগো নামক বস্তুটি তখনও তাঁর মত শিল্পীদের তেমন স্পর্শ করেনি। রাসবিহারীর রাধুবাবুর চায়ের দোকান বা মেলডি মিউজিক শপ সেসময় চাঁদের হাট। আশেপাশেই জমে উঠত শিল্পীদের আড্ডা। এমনই একদিন এক তরুণ গীতিকার তাঁর প্রথম কাজে সাফল্যের কথা জানালেন গৌরীপ্রসন্নকে। হাঁটতে ভালবাসতেন গৌরীপ্রসন্ন। তরুণ শিল্পীর সাফল্যে দারুণ খুশি কিংবদন্তি গীতিকার বললেন, “আরে এ তো দারুণ খবর। চল হেঁটে আসি।”
মানুষটা কথা বলতে বলতে হেঁটেই চলেছেন। গড়িয়াহাটের কাছাকাছি এসে তাঁর সঙ্গী বললেন, “অনেক দূর চলে এলাম কিন্তু গৌরীদা!”
এতক্ষণে খেয়াল হল তাঁর। বললেন, “দেখেছ কান্ড? কথা বলতে বলতে খেয়ালই করিনি। চল এবার ফিরি।” অতএব এবার আবার হাঁটা শুরু রাসবিহারীর পথে।
এমনটা নাকি বহুবার হয়েছে যে তিনি কোনও দোকানে হয়তো চা খেয়েছেন। পকেটে হাত দিয়ে দেখেছেন পয়সা নেই। কিন্তু চেনা দোকানি হাসিমুখে সেসব মেনে নিয়েছেন। এমনটা নাকি প্রায়ই হত কলমের দোকানে। পরনে ঢোলা পাজামা আর একখানা সাদা পাঞ্জাবি পরে যখন তখন বেরিয়ে পড়তেন গৌরীপ্রসন্ন। কোনও একদিন হঠাৎ মনে এল কোনও একটা গানের লাইন। পকেটে হাত দিয়ে দেখেন সে এক কান্ড। পেনের কালি লিক করে ভরে গেছে পাঞ্জাবির পকেট। অথচ শব্দগুলো না লিখে রাখলে যে শান্তি নেই! গিয়ে হাজির হলেন পথের পাশের কলমের দোকানে। অথচ সেখানেও বিপত্তি। কলম কিনে পাঞ্জাবি হাতড়ে দেখলেন পকেট গড়ের মাঠ। কিন্তু তাতে কী? দোকানদার কিছু মনে করতেন না। করবেন কী করে? তাঁর বিক্রিত কলম যে সঠিক হাতের ছোঁয়ায় তার জড়জন্ম সার্থক করে জীবন পেতে চলেছে, তা কি তিনি জানতেন না?
কলমের অভাব হলেও কাগজের অভাব হত না তাঁর। মনের ভিতর শব্দের ছটফটানি টের পেলেই পকেট থেকে বেরিয়ে আসত সিগারেটের কাগজ। একবার নাকি নচিকেতা ঘোষের সঙ্গে গোলবাড়ির কষা মাংস খেতে খেতে এমনভাবেই লিখে ফেলেছিলেন, ‘আমার গানের স্বরলিপি লেখা রবে।’
একবার বাসে উঠেছেন দেশপ্রিয় পার্ক থেকে, গন্তব্য নিজের বাড়ি রামগড়। যথারীতি সে বাস চলতে চলতে প্রকান্ড ট্র্যাফিক জ্যামে দেহ রাখল। দাঁড়াল তো দাঁড়াল, চলার আর নাম নেই। একসময় বিরক্ত হয়ে তিনি আপনমনে বলে উঠলেন, “কতদূর, আর কতদূর।” শব্দ বেরিয়েছিল শব্দের মতো আনমনে। কিন্তু শিল্পীমনে তখন শব্দের পিছনে বসতে শুরু করেছে আরও কত শব্দ। প্রসব যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকা কবিকে মুক্তি দিয়েছিল একখানা সিগারেটের কাগজ। সৃষ্টি হয়ে গেছিল মরুতীর্থ হিংলাজ ছবির সেই কালজয়ী গান, ‘পথের ক্লান্তি ভুলে স্নেহ ভরা কোলে তব, মা গো বল কবে শীতল হব। কতদূর আর কতদূর, বল মা।’
এই সিগারেটই কি অবশেষে যবনিকা টেনেছিল তাঁর শিল্পী জীবনে? ভবানীপুরে এক শিল্পী সম্মেলনে স্টেজে উঠে গৌরীপ্রসন্ন বিষণ্ণ মুখে বলেছিলেন, “আপনারা সবাই ভালো আছেন? আমি ভালো নেই। আমার ক্যান্সার হয়েছে।” দশটি বছর লড়াই করেছিলেন সে দানবীয় শত্রুর সঙ্গে। চেন্নাইতে চিকিৎসা করাতে গিয়েছিলেন। তবু শেষরক্ষা হয়নি। শিল্পীর জীবনে এক অভিমান ছিল। নিজেই বলেছিলেন, গীতিকাররা কখনো পুরস্কার পায় না। একটা গানের সৃষ্টির পিছনে তাঁদের অবদান হয়তো কম নয়। অথচ তাঁদের কি মনে রাখে কেউ? যে ঘটনা দিয়ে এ লেখা শুরু করেছিলাম, সেখানেও তাঁর এ কথারই অনুরণন। তবু আমার মনে হয়, বব ডিলনকে সাহিত্যে নোবেল পেতে দেখে নিশ্চয়ই পৃথিবীর পরিবর্তনের আলোকরেখা একটু হলেও তাঁর মুখে হাসি ফুটিয়েছে সবার অলক্ষ্যে।
তথ্যসূত্র:
মজুমদার, তরুণ (2021)। সিনেমাপাড়া দিয়ে। কলকাতা: দে’জ পাবলিশিং।
https://www.tbsnews.net/splash/how-song-coffee-house-was-born-427162
চিত্রঋণ: অন্তর্জাল