মহিষাসুরের রাজ্যে বর্ষবরণ

মহিষাসুরের রাজ্যে বর্ষবরণ

(১)

ডিসেম্বরে টানা ক’দিন ছুটি থাকায় সেই ছুটি কি মিস করা যায়? বাউন্ডুলে মনটা তাই ওই সময়ে ছটফটিয়ে বেরিয়ে পড়ে ঘর ছেড়ে। এবারে আমাদের গন্তব্য মাইসোর। এখানকার আবহাওয়া অতি মনোরম, ১৫ ডিগ্রি থেকে ৩৫ ডিগ্রির মধ্যে তাপমাত্রা ওঠানামা করে। আভিজাত্যপূর্ণ ও সাবেকি এই শহর সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৭৭০ মিটার উঁচুতে অবস্থিত। এই শহরকে কেউ বলেন ‘বাগিচার শহর,’ আবার কেউ বলেন ‘চন্দনের শহর।’ শহরটি যেন আজও অতীত রাজাদের রাজ্য। রাজত্ব গেলেও রাজারাজড়াদের বৈভব আজও এই শহরটির অন্যতম আকর্ষণ। যদিও আগে দু’বার গিয়েছি, তবে এখন ছোটবোন ওখানে থাকায় আলাদা আকর্ষণ। তাছাড়া ওর কাছে অনেক নতুন তথ্য পেয়েছি যা আগে জানতাম না। তাই দেখাও হয়নি। এবারে সব দেখব। 

তেইশে ডিসেম্বর রাতে খেয়েদেয়ে সোজা কলকাতা এয়ারপোর্ট যাবার তোড়জোড় শুরু। কারণ খুব ভোরে ফ্লাইট। ব্যাপারটা বলেই ফেলি। আসলে বিকেল সাড়ে পাঁচটার টিকিট কাটতে গিয়ে ভোর সাড়ে পাঁচটার টিকিট কেটে বসে আছি! তাই এগিয়ে থাকা। চব্বিশে ডিসেম্বর রাত সোয়া তিনটেয়  আমার কলকাতার বাসা থেকে বেরিয়ে এয়ারপোর্ট গিয়ে জানতে পারি সাড়ে পাঁচটার ফ্লাইট ছটায় ছাড়বে। অবশেষে ছটা ষোলো মিনিটে ফ্লাইট ছাড়ল। ভেবেছিলাম আকাশ থেকে দেখব সূর্যোদয়। দেখব তরুণ তপনকে, দেখব উদীয়মান সূর্যকে। হল না। একটু উঁচুতে উঠতেই ঝকমক করে জানালা দিয়ে রোদ এসে পড়ল। চোখ বুজে ঘুমোনোর বৃথা চেষ্টা। এই আধোঘুম, আধোজাগরণেই আড়াই ঘন্টা পার। পৌঁছে গেলাম ব্যাঙ্গালোর। এবার মাইসোরের বাস ধরতে ফ্লাইবাসের কাউন্টারে দাঁড়াতেই ওরা বাসে উঠে পড়তে বলল। উঠে টিকিট কাটা যাবে। ভোলভো বাস, আরাম করে বসলাম। উঠতেই দু’জনকে দু’বোতল মিনারেল ওয়াটার দিয়ে গেল। আগে কখনও ভোলভো বাসে চাপিনি। শরীরটাকে ঢেলে দিলাম চেয়ারে, জানলা দিয়ে বাইরের শোভা দেখতে দেখতে চললাম। রাস্তার দু’ধারে সুন্দর বাগান বেশ অনেকটা রাস্তা জুড়ে। মোটে নয়টি যাত্রী নিয়ে ওই বিশাল বাস চলল। বাসে যাবার ফলে রাস্তার শোভা দেখতে পাচ্ছিলাম সুন্দর। কোথাও ছোট ছোট টিলা পথের ধারে। আর পথের দু’ধারে কাশফুলেরা সেজেগুজে হাওয়ার দোলায় দোল খাচ্ছে, ঠিক পুজোর আগে আমাদের বাংলায় যেমনটি দেখি। বুঝলাম, ডিসেম্বরে কলকাতায় যখন ঠান্ডা কর্ণাটকের আবহাওয়া তখন শরতের মত। তাই ওদিকে তখন কাশফুলের বাহার। 

কিছুদূর যাবার পর দেখলাম মেট্রোরেল স্টেশন, সেখানে ট্রেন চলছে। মাঝরাস্তায় বাস একবার দাঁড় করিয়েছিল লাঞ্চ করার জন্য। কেউ কেউ নামল, আমরা নামিনি। পথে যেতে দু’বার কাবেরী নদীকে পার হলাম। এরপর প্রায় মাইসোরের কাছাকাছি শ্রীরঙ্গপটনম, কাবেরী ও কপিলা নদীর সঙ্গমস্থল, পার হলাম। 

বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছালে বোনপো আমাদের সেখান থেকে নিয়ে গেল বাড়িতে। ভাত খেয়ে একটু বিশ্রাম নিতেই ভগ্নিপতি এসে গেল। ইতিমধ্যে ভাগিনেয় ফেসবুকে পোস্ট দেখে ইলেকট্রনিক সিটি থেকে এসে হাজির হল বিকালের দিকে। মামিকে সে বড়ই ভালোবাসে। বেশ জমজমাট আড্ডা শুরু হল। এরই মাঝে ভগ্নিপতি নিজে হাতে রান্না করবে বলে রেজালার মাংস নিয়ে এসে হাজির। সন্ধেবেলায় রান্নার তোড়জোড় লেগে গেল, রেজালা তৈরি হল। তাড়াতাড়ি ডিনার সেরে আমরা রওনা দিলাম ‘সেন্ট ফিলোমেনাস ক্যাথিড্রাল’এর উদ্দেশ্যে। সেদিন চব্বিশে ডিসেম্বর, ক্রিসমাস ইভ, বড়দিনের আগের রাত।   

রাত তখন সাড়ে এগারোটা বেজে গেছে। পথঘাট ফাঁকা, জনশূন্যই বলা চলে। চার্চের কাছে পৌঁছে দেখি, চার্চের গেটের বাইরে কিছু দোকান তখনও খোলা। গির্জা আলো দিয়ে সাজানো, ঝলমল করছে। এমন দিনে আর এমন মুহূর্তে কোনোদিন কোনো গির্জায় যাবার অভিজ্ঞতা আগে হয়নি। বাইরে থেকে শোনা যাচ্ছে ক্রিসমাস ক্যারল। উৎসবের পরিবেশ। পৌঁছাবার পরই বারোবার ঢং ঢং শব্দ করে গির্জার ঘড়ি বেজে উঠল। রাত বারোটা বাজল। আমরা ভিতরে গেলাম। ভিড়ে ভিড়। প্রচুর মানুষ বেঞ্চে বসে। যাঁরা বসতে পাননি, তাঁরা দাঁড়িয়ে আছেন। মাটিতেও অনেকে বসেছেন। আমরাও ভিড় ঠেলে এগোতে লাগলাম যতটা সম্ভব। ঢোকার পর দেখলাম পোপ পোশাক পরিবর্তন করলেন। শান্তির বাণী শুনতে বেশ  লাগছিল। এমন পবিত্র পরিবেশে সময় কাটাতে বড় ভাল লাগে, শান্তি আসে মনে। আর খুব ভাল লাগল দেখে গির্জার ভেতরে মাদার মেরির মূর্তিটিকে শাড়ি পরানো। এমনটি সচরাচর চোখে পড়ে না। গির্জার ভেতরের দেয়ালে সুন্দর সুন্দর গ্লাস পেইন্টিং। কাচের ওপর আঁকা ছবিতে যিশুর জীবনের এক একটি মুহূর্ত। তাঁর জন্ম, লাস্ট সাপার, ক্রুশবিদ্ধ হওয়া প্রভৃতি। গির্জার মূল প্রবেশদ্বারটি বিশাল কাঠের তৈরি, তাতে খুব সুন্দর কারুকার্য করা। বেশ কিছুক্ষন ওখানে সময় কাটিয়ে বেরিয়ে এলাম। একপাশে সবাই মোমবাতি জ্বালাচ্ছিল, আমরাও জ্বালালাম। চারিদিকে সান্টাক্লজের টুপি পরে অনেকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমরা একজনের কাছ থেকে টুপি চেয়ে প’রে ছবি তুললাম।

এই গির্জাটি সেন্ট ফিলোমেনার নামে, যিনি ছিলেন একজন লাতিন ক্যাথলিক সন্ত বা সন্ন্যাসিনী। চোদ্দ বছর বয়সে চতুর্থ শতকে অর্থাৎ আনুমানিক ১৬০০ বছর আগে তাঁকে হত্যা করা হয়। মৃত্যুর পর তাঁর দেহটি সমাধি দেওয়া হয়। পরে সেই সমাধি থেকে তার অবশেষ ও যে পাত্রে তাঁর শুকিয়ে যাওয়া রক্ত ছিল, সেসব ভারতবর্ষে নিয়ে আসা হয়। এই গির্জার বেসমেন্টে তা রাখা আছে। সে এক বিরাট গল্প। 

১৮৪৩ খ্রিস্টাব্দে এই গির্জা নির্মিত হয়। গির্জা নির্মাণের জন্য মহারাজ মুম্মাদি কৃষ্ণরাজ ওয়াদেয়ার জমি দান করেন। প্রথমে ছোট মাপের, মূলত কাঠের তৈরি ছিল এই গির্জা। ১৯২৬ সালে মাইসোরের মহারাজ নলবড়ি কৃষ্ণরাজ ওয়াদেয়ারের অনুমতিতে প্রচুর অর্থ ব্যয় করে নতুন গির্জা নির্মাণ শুরু হয়। 

ফিরলাম রাত দুটোয়। শুতে শুতে আড়াইটে। পরদিন সকালেই আবার নাগেরহোলের জঙ্গলে যাওয়া, কতটুকুই বা ঘুমোবো।

(২)  

সারাদিনের প্রোগ্রাম, কিন্তু আগেরদিন অত রাতে শুয়ে  ভোরবেলা আর কেউ উঠতে পারলাম না, বেরোতে এগারোটা বেজে গেল। গন্তব্য নাগেরহোলে টাইগার রিজার্ভ ফরেস্ট। মাইসোর শহর থেকে প্রায় আশি কিলোমিটার পথ। ‘নাগেরহোলে’ অর্থ স্নেক রিভার। নাগ মানে সাপ এবং হোলে অর্থাৎ ছোট নদী। যে নদী নাগেরহোলের মধ্য দিয়ে বয়ে গেছে সেটি সাপের মত আঁকাবাঁকা। এটি ‘রাজীব গান্ধী ন্যাশনাল পার্ক’ নামেও পরিচিত। মাইসোরের পূর্বতন শাসক রাজাদের রাজত্বে এটা ছিল মৃগয়াস্থল। বর্তমানে পার্কটি টাইগার রিজার্ভ হিসেবে ঘোষিত।

পৌঁছালাম বেলা প্রায় দেড়টা। সাফারি নিইনি। নিজেদের গাড়িতেই জঙ্গলের পথে পার হবার সময় যা দেখা যায় তাই দেখব। কিছু না কিছু জন্তু-জানোয়ার নাকি সবসময়ই দেখা যায়, কারণ এই পার্কে প্রচুর জন্তু-জানোয়ার আছে।

গাড়ির জন্য টিকিট কেটে ভিতরে ঢুকলাম। জঙ্গল প্রথমে খুব একটা ঘন নয়, রাস্তার দু’পাশ ফাঁকা ফাঁকা, কিন্তু ভেতরে যে ঘন জঙ্গল তা দূর থেকে দেখেও বোঝা যাচ্ছে। আমার অনুসন্ধানী চোখ জঙ্গলের গভীরে ঢুকতে চায়। হঠাৎ জঙ্গলের আড়ালে কালো কালো দেখে ভাবলাম বাইসন। ভগ্নিপতি গাড়ি চালাচ্ছিল, পাশে আমি। বাইসন মনে হলেও নিশ্চিত না হয়ে কাউকে কিছু বললাম না। তারপর এগিয়ে আসতে দেখি হাতি! সবাই হইহই করে উঠল, ছবি তোলা হল। পাশাপাশি তিনটি, তার মধ্যে একটা পর্বতপ্রমাণ দেহ নিয়ে এগিয়ে আসছিল। পিছনে হয়তো আরও ছিল। হাতি সাধারণত দলবদ্ধ হয়ে থাকে। এরা বোধহয় জল খেতে যাচ্ছিল। এখানে অনেক নদী আছে, জন্তু-জানোয়াররা সেখানে জল খেতে যায়। খুব ইচ্ছা হচ্ছিল দাঁড়িয়ে দেখি। 

কিছুদূর যেতে দফায় দফায় হরিণ, বুনো শুয়োর, নানা প্রজাতির বাঁদর দেখতে পেলাম। বড় আশা, যদি একটা বাঘ বা চিতা দেখতে পাই। গাছের ফাঁক দিয়ে জন্তু-জানোয়ার দেখা খুব সহজসাধ্য নয়, তার জন্য কপাল লাগে। কতরকমের গাছ জঙ্গলে। প্রধান গাছ রোজউড, সেগুন, চন্দন, সিলভার ওক।  ছোট ঝোপঝাড় তো আছেই। প্রচুর বাঁশঝাড়। তারই ফাঁকে ফাঁকে কয়েকবার ঝাঁকে ঝাঁকে বিভিন্ন প্রজাতির হরিণ দেখা দিল। একবার একটা বুনো শুয়োর মাথা নিচু করে ছুটে বেরিয়ে এল ভেতর থেকে, আবার ঢুকেও গেল। এই জঙ্গলে বাঘ, চিতা, হায়না, কিছু ভালুক প্রভৃতি হিংস্র জন্তু রয়েছে। বাইসনও এখানে প্রচুর। রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির বানর, বেজি, শেয়াল ইত্যাদি। নানাবিধ পাখি রয়েছে এই পার্কে। রয়েছে শকুন, ঈগল, কাঠঠোকরা, ময়ূর, পায়রা নানারকম। পাখিদের মিষ্টিমধুর কলকাকলিতে মুখর হলেও দেখা দেয়নি তারা। জঙ্গলের আলোছায়া পথ পেরিয়ে যেতে এমনিই বেশ ভাল লাগছিল আর পাখির ডাক আমাদের যাত্রাপথকে আরও উপভোগ্য করে তুলছিল। এ পথে যাবার সময় কোনোরকম গান চালানো বা যান্ত্রিক আওয়াজ নিষিদ্ধ। গাড়ীর হর্নও বাজাবার অনুমতি নেই। একটু জন্তু-জানোয়ার দেখতে পাবার আশায় ভগ্নিপতিকে বললাম আস্তে আস্তে গাড়ি চালাতে, কিন্তু উপায় নেই। ৩০ থেকে ৪০ কিলোমিটার বেগে গাড়ি চলবে, একঘণ্টার মধ্যে জঙ্গলের মধ্যের রাস্তা পার করতে হবে। নাহলে এক হাজার টাকা ফাইন। 

এখানে রয়েছে নানারকমের বিষাক্ত সাপ, পাইথন, বিভিন্ন প্রজাতির পোকামাকড়। ষাট রকম  প্রজাতির কেবল পিঁপড়েই নাকি রয়েছে এখানে! তারমধ্যে একধরণের পিঁপড়ে আছে যেগুলি এক মিটার উচ্চতা পর্যন্ত লাফ দিতে পারে। আমাদের অবশ্য দেখা হয়নি। এখানকার প্রচুর মূল্যবান গাছ যেমন চন্দন, সেগুন প্রভৃতি চুরি করে কেটে ফেলা হচ্ছে বর্তমানে। প্রচুর পরিমাণে হাতি মেরে ফেলা হচ্ছে তাদের মূল্যবান দাঁতের লোভে। আমরা মনুষ্যজাতি বড় লোভী। প্রকৃতিকেও আমরা ছাড়ি না, সেদিকেও লোভের হাত বাড়াই।

না, ওই হাতি ছাড়া বড় কোন জন্তুজানোয়ার আর আমাদের কপালে দেখা হল না, জঙ্গল পেরিয়ে গেলাম। বেশ বেলা হয়ে গেল, তখন খিদেয় পেট চুঁইচুঁই কিন্তু কোথাও খাবার পাওয়া যাচ্ছে না। অত বেলায় খাবারের দোকানের সব খাবার শেষ। শেষে একটা জায়গায় রুটি ও ডিমের কারি পেলাম। দারুণ নরম রুটি, খেয়ে বেশ তৃপ্তি হল। এবার ফেরার পালা। ওই জঙ্গলের রাস্তা দিয়েই ফিরতে হবে, মনে আশা যদি কিছু দেখা যায় ফিরতি পথে। কিন্তু না, বিফল মনোরথ হয়ে ফেরার সময় জঙ্গলের শেষের দিকে ময়ূর দেখলাম রাস্তা পার হচ্ছে আপন মনে। মনটা ভরে গেল। এছাড়া জঙ্গলের ভিতরেও বেশ কয়েকটা ময়ূর দেখলাম।

(৩)

পরদিন ভগ্নিপতির অফিসে কাজের চাপ এবং বোনপোর পরীক্ষা শেষ না হওয়ায় বেরনো হল না। সকালটা ঘরেই কাটল। বিকেল চারটে নাগাদ অটো নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম বোন, আমি আর আমার স্বামী। ওখানে দেখলাম আইন-শৃঙ্খলা বেশ কড়া। অটোচালক ড্রেস ছাড়া চালাচ্ছিল, দূর থেকে পুলিশ দেখে ড্রেসটা গায়ে চাপাবার চেষ্টা করল কিন্তু ট্রাফিক পুলিশ এসে তাকে ধরে ফেলল! উপযুক্ত ড্রেস গায়ে না থাকায় দাঁড় করিয়ে ফাইন নিল। বেচারা! আমরা কাবেরীতে গেলাম, টুকটাক গিফট আইটেম আর ধূপ কিনলাম। এরপর আমরা গেলাম আরসু রোড মার্কেটে। শাড়ি দেখছিলাম, পছন্দ আর বাজেট মেলাতে পারছিলাম না বরাবরের মতই। তবু বোনের আর আমার দুটো শাড়ি কিনে ফেললাম। তারপর ধোসা-পয়েন্ট থেকে দুর্দান্ত ধোসা খেয়ে বাড়ি ফিরলাম। 

পরদিন বোনের সঙ্গে গল্পগুজবে কাটল। সন্ধেয় ভগ্নিপতি এলে আমাদের গন্তব্য চামুন্ডেশ্বরী মন্দির। একটু দেরি হয়ে গেল। গিয়ে পৌঁছলাম রাত সাড়ে আটটায়। পাহাড়ের ওপর  চামুন্ডি হিলসে তখন বেশ ঠান্ডা। মাইসোরে তখন পাখা চলছে তাই বুঝিনি, গরম কাপড় রাখিনি সঙ্গে। ঠান্ডায় গা শিরশির করছিল, কোনোরকমে শাড়ির আঁচল গায়ে জড়িয়ে ঠান্ডা নিবারণের বৃথা চেষ্টা।

মাইসোর শহরের দক্ষিণে ১০৯৫ মিটার উঁচু এই চামুন্ডি পাহাড়। এখানেই পাহাড়ের ওপর রাজপরিবারের কুলদেবী চামুন্ডেশ্বরী মন্দির। এই মন্দিরে রয়েছে দু’হাজার বছরের প্রাচীন মূর্তি। কথায় বলে এই পাহাড়েই দেবী দুর্গা অসুর বধ করেছিলেন। এখানে দেবী দুর্গার সঙ্গে লড়াইয়ে একে একে প্রবল প্রতাপ শুম্ভ-নিশুম্ভ, রক্তবীজ, চন্ড-মুন্ড প্রভৃতি অসুরেরা সকলে দেবীর হাতে নিহত হয়। সবশেষে মহিষাসুর। চন্ড-মুন্ড এই দুই ভাইয়ের সঙ্গে ভীষণ যুদ্ধ করেছিলেন দেবী এই পাহাড়ে আর তাতেই এই পাহাড়ের নাম হয় চামুন্ডি পাহাড়। মাইসোর শহরটির আদতে নাম ছিল মহিষাপুরা যা নাকি মহিষাসুরের নাম থেকে এসেছে। অতীতে মহিষাসুরের সাম্রাজ্য ছিল এখানে। চামুন্ডেশ্বরী দেবী অসুরদের নিধন করে এখানকার অধিবাসীদের রক্ষা করেন। ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত এই রাজ্য পরিচিত ছিল মহীশূর হিসাবেই, পরে নাম পাল্টে নতুন নামকরণ হয় কর্ণাটক।

এই চামুন্ডি পাহাড়ের শিখরে চামুন্ডেশ্বরী মন্দিরে পদব্রজে পৌঁছাতে হলে চড়তে হবে ১০০৮টি সিঁড়ির ধাপ। আমরা পাহাড় ঘুরে গাড়িতে যাবার পথ ধরেই গেছি, অত সিঁড়ি ওঠার ক্ষমতা নেই। পথে পড়ল একখন্ড কালো পাথর কুঁদে তৈরি ২৫ ফুট দীর্ঘ ও ১৬ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট বিশাল নন্দীমূর্তি। পাথরখণ্ডটি অন্য কোথাও থেকে আনতে হয়নি, ওটা ওখানেই ছিল। শিল্পীর অসাধারণ দক্ষতায় তৈরি এই অপূর্ব সুন্দর কালো পাথরের মূর্তি রাজা ডোড্ডা দেবরাজ ওয়াদেয়ার ১৬৬৪ সালে তৈরি করান। মূর্তিটি নিজস্ব মহিমা নিয়ে সদর্পে বসে আছে যেন বীর্যের প্রতীক হয়ে। মন্দিরের সামনে বিশাল মহিষাসুরের মূর্তি। মূর্তিটি বেশ রংচঙে কিন্তু যুদ্ধের বেশে ভয়ংকর দর্শন। এক হাতে তরবারি, অন্য হাতে বিশাল কেউটে সাপ। চামুন্ডি পাহাড়ের প্রধান আকর্ষণ কিন্তু মহিষাসুরের মূর্তি নয়, 

চামুন্ডেশ্বরী মন্দিরই এখানকার প্রধান দ্রষ্টব্য। মহিষাসুরের মূর্তি অবধি গাড়ি যাবে, সেখান থেকে খানিকটা হেঁটে মন্দিরে যেতে হবে। দেবী চামুন্ডেশ্বরী (মা কালী) এই মন্দিরের অধিষ্ঠিতা দেবী। চামুন্ডেশ্বরীর নাম অনুসারে এই পাহাড়ের নাম। আগে এই পাহাড়ের নাম ছিল মহাবালাছালা। গাড়িতে ওপরে ওঠার সময় ওপর থেকে আলো ঝলমলে মাইসোর শহর দেখে চোখ যেন ঝলসে যাচ্ছিল।

দেরি হয়ে যাওয়ায় চিন্তায় ছিলাম মন্দির বন্ধ হয়ে যাবে কিনা। কিন্তু আমরা খুব ভালো সময়ে পৌঁছেছি, আর দেরি হলে বন্ধ হয়ে যেত মন্দির। তখন ফাঁকা, টিকিট কাটাও বন্ধ হয়ে গেছে। অল্প কয়েকজনই ছিল তখন মন্দিরে। আমরা প্রবেশ করতেই দেখি ঠাকুরের জন্য ভোগ আসছে বাজনা-বাদ্যি করে। ঠাকুরকে ভোগ দেওয়া হল। আমরা অপেক্ষারত। ভোগ দেওয়া হয়ে গেলে আমরা ঠাকুর দর্শন করতে পেলাম, ভোগপ্রসাদও পেলাম, সঙ্গে ঠাকুরের সিঁদুর আর ছ’গাছা সবুজ কাঁচের চুড়িও পেলাম। বোনও পেল, ওখানে যে ক’জন মহিলা ছিল প্রত্যেকেই পেল। আমরা বিবাহিতারা যেমন পবিত্র মনে করে শাঁখা-পলা পরি, তেমনি সবুজ এদের পবিত্র রং, তাই সবুজ চুড়ি। মন্দিরে যাবার পথে দেখি বিশাল শৃঙ্গবিশিষ্ট ষাঁড় দাঁড়িয়ে আছে, যেন নন্দী এসে দাঁড়িয়েছে। প্রসাদ নিয়ে মন্দির প্রদক্ষিণ করলাম।  দক্ষিণের মন্দিরগুলির বিশেষত্ব গোপুরম। এই গোপুরমেরও বিশেষত্ব আছে, এটি দেহের বিভিন্ন অংশকে উপস্থাপন করে। এর বাইরের দেয়ালে নানারকম সূক্ষ্ম কারুকাজ, বিভিন্ন উচ্চতায় নানারকম ভঙ্গিমায় অনেক সুন্দর সুন্দর মূর্তি মন্দিরের সৌন্দর্য বাড়িয়ে তুলেছে। মন্দিরের পিছনদিকে উঁচু উঁচু ধাপে সিঁড়ি করা আছে মন্দিরপ্রাঙ্গণের বাইরে। সেখানে উঠলে আলো ঝলমলে মাইসোর শহর দেখতে ভারী ভালো লাগে। ঠান্ডা শিরশিরে হাওয়ায় দাঁড়িয়ে দেখতে দেখতে মনে হয় আলোগুলো যেন দুলছে। 

ফেরার পথে আমরা পাহাড়ের ওপরে যেখানে টেলিস্কোপ রয়েছে দাঁড়ালাম টেলিস্কোপ দিয়ে মাইসোর প্যালেস ও আলো ঝলমলে শহর দেখব বলে। কিন্তু তখন টেলিস্কোপ বন্ধ হয়ে গেছে, তাই খালি চোখেই দেখলাম। চোখ জুড়িয়ে গেল। ঝলমলে প্যালেস দেখে দূর থেকে মনে হয় সোনার তৈরি। সারা শহর আলোয় উদ্ভাসিত। মন ভরা খুশি নিয়ে মনে মনে দেবী দুর্গা ও মহিষাসুরের যুদ্ধ চিন্তা করে সেইস্থান দেখার আনন্দ নিয়ে ঘরে ফিরলাম। 

(৪)

পরদিন সকাল থেকেই প্রোগ্রাম, ভোর সাড়ে পাঁচটা নাগাদ বেরোলাম মাইসোর প্যালেসের উদ্দেশ্যে। প্যালেসের বাইরের বাঁধানো চাতালে পায়রার দানা খাওয়া দেখতে। বোনের কাছে শুনে অনেকদিন থেকেই সে অপরূপ দৃশ্য দেখার সাধ। ওখানকার বাসিন্দারাও সবাই জানে না এই ব্যাপারটা। বোনপো ভোরবেলা ঘুরতে ঘুরতে একদিন দেখে এই অসাধারণ দৃশ্য, তারপর মাকে নিয়ে যায় একদিন দেখাতে। এ কোনো স্থাপত্য নয় যে গেলাম আর দেখে এলাম। ভোরবেলা ওই সময়েই গেলে তবেই দেখা যাবে এমন বিরল দৃশ্য। 

কোনো এক এনজিও থেকে রোজ ভোরবেলায় বস্তা বস্তা দানা আনা হয় পায়রাদের খাওয়ানোর জন্য, আর ওরা সেটা বিলক্ষণ জানেও। কিন্তু কী শৃঙ্খলা ওদের মধ্যে। চারদিক থেকে পায়রা উড়ে উড়ে আসতে থাকে, জড়ো হয় বিভিন্ন গাছে, সামনের গম্বুজের মাথায় কিন্তু নামে না। অপেক্ষা করে দানা ছড়ানোর। দানা ছড়ানো শুরু হলে ঝাঁকে ঝাঁকে তারা আকাশে পাক খেতে থাকে। সে এক দেখার মত দৃশ্য। সব দানা ছড়ানো হলে, মানুষজন দানার পাশ থেকে সরে গেলে তবেই ওরা নামে। ততক্ষণ আকাশে পাক খেতে থাকে। আকাশ ততক্ষণ কালো পায়রার ভিড়ে গিজগিজ করে।

এনজিওর মাধ্যমে অনেকে দানা দেয়। সেদিন ওখানকার কোনও গণেশ জুয়েলারি দানা দিয়েছিল। তাই এনজিওর তরফ থেকে দানা দিয়ে গণেশ জুয়েলারির নাম লেখা হলো। তেমনি কারও জন্মদিনেও এনজিওর কাছে দানা পাঠালে তারা রাজবাড়ির বড় চাতালে দানা ছড়িয়ে যার জন্মদিন তার নামে হ্যাপি বার্থডে লিখে দেয় দানা দিয়ে। ঝাঁকে ঝাঁকে পায়রা নেমে সেসব দানা খেয়ে যায় রোজ। জীবনে এমন দৃশ্য দেখিনি কখনও, মনটা ভরে গেল। 

সেখান থেকে আমরা গেলাম কুকরাহোলি লেক। লেকের পাশ দিয়ে রাস্তা। নানারকম গাছ, ভোরবেলায় সেখানে প্রচুর মানুষ প্রাতঃভ্রমণ করতে যায়। মনোরম পরিবেশ, কোথাও বড় বড় বটগাছ, অশ্বত্থগাছ চারিদিক থেকে ঝুরি নামিয়েছে। এছাড়াও নাম না জানা বড় বড় গাছ। এখানে নতুন একটা গাছ দেখলাম, নাম ‘উচেকাই।’ উজ্জ্বল কমলা রঙের খুব সুন্দর ফুল। কুঁড়িটা যখন পরিণত হয়, ঠিক ফুল ফোটার আগের অবস্থায়, তখন কুঁড়িটা টিপলে জল পড়ে। উচে মানে ওদের ভাষায় হিসি, কাই মানে সবজি।

বিকালে ভগ্নিপতি নিয়ে গেল রঙ্গনাথিত্তু বার্ড স্যাংচুয়ারি। জানি না বিকেল বলে কিনা, গাছে পাখিদের ডাক শুনছিলাম নানারকম কিন্তু তাদের দেখতে পাচ্ছিলাম না। কাবেরি নদীর ব্যাকওয়াটারের পাড়ে বড় বড় গাছে প্রচুর সাদা বক দেখলাম, যেন গাছে গাছে সাদা ফুল ফুটে আছে। একটা গাছে আবার ভর্তি কালো পাখি, ওই বক জাতীয়ই। রেকর্ড অনুযায়ী প্রায় ২২১ প্রজাতির পাখি এখানে আসে প্রতিবছর। পাখি দেখতে না পেলেও নানারকম গাছ, অর্জুন গাছ, আম গাছ, প্রচুর বাঁশ ঝাড়, বহু প্রাচীন গাছ বিভিন্ন আকৃতির ডালপালা মেলে রয়েছে। রয়েছে বিভিন্ন ফুলের গাছ, বাহারি গাছ। চারপাশ দিয়ে বাঁধানো সুন্দর রাস্তা। কতরকমের সবুজ সে বাগানে। বাঁশঝাড়গুলোও নানারকম আকৃতি নিয়ে সৌন্দর্য সৃষ্টি করেছে। পাখিদের কলতান শোনা যাচ্ছিল। সুপ্রাচীন একটি আমগাছ রয়েছে, বিশাল মোটা তার গুঁড়ি। তা থেকেই বোঝা যায় তার প্রাচীনত্ব। এটাকে বোটানিক্যাল গার্ডেনই বলা যায়। রয়েছে কয়েকটি ওয়াচ টাওয়ার। 

কাবেরি নদীতে নাকি অনেক কুমির আছে, তবে আমরা একটাই দেখেছি। মাছও আছে প্রচুর। নদীতে লঞ্চ চলছিল। লঞ্চে করে ঘুরতে গেলে হয়তো সেখান থেকে পাখি ও কুমির আরও দেখতে পেতাম। নদীর জলে অস্তগামী সূর্যের ছায়া পড়েছে। জলের মৃদু কম্পনের তালে সূর্যও দুলছিল ইতস্তত। উপভোগ করলাম তার যাবার পথের প্রতিটি মুহূর্ত গাছের ফাঁক দিয়ে ও নদীর জলে।  

(৫)

পরের দিন অর্থাৎ জানুয়ারির পয়লা তারিখে আমাদের ফেরা। ভোর সাড়ে পাঁচটায় বেরোতে হবে কলকাতার উদ্দেশ্যে। স্যুটকেস গুছিয়ে রাখলাম। তারপর শ্যাম্পু করে স্নান করে নিলাম। কলকাতায় তখনও খুব ঠান্ডা শুনলাম। অন্তত ক’দিনের জন্য নিশ্চিন্ত, তারপর যদি ঠান্ডা কমে যায়। এবার গেলাম চন্দ্রমৌলি শিবমন্দিরের উদ্দেশ্যে। বোনের বাড়ির কাছেই, হাঁটা পথ। মাঝে শিবের মূর্তি, বাঁ হাতে পার্বতী, ডান হাতে গণেশ। খুব ভালো লাগল। স্নান করে শুদ্ধ কাপড় পরে পরিবারের সবার নামে অর্চনা করলাম বিশেষ করে। তাছাড়া মা, ভাই, বোন, আত্মীয়-পরিজন, প্রিয়জন সকলের জন্য প্রার্থনা করলাম। এই মন্দিরে নাকি ভারতবর্ষের যত শিব মূর্তি আছে, প্রত্যেকটির একটি করে রেপ্লিকা বানানো আছে।

এরপর গেলাম বিষ্ণু মন্দিরে। সেখানে ঠাকুরকে ভোগ দেওয়া শুরু হল। ঠাকুরের সামনে পর্দা দিয়ে ঢাকা হল। ঢাক ও সানাই বাজতে লাগল। তারপর দু’জন পুরোহিত প্রতিটি দরজায় চাল ও জল দিতে দিতে মন্দির প্রদক্ষিণ করতে লাগল। তাদের সঙ্গে ঢাক ও সানাই বাজাতে বাজাতে বাজনদাররাও ঘুরতে লাগল। এছাড়া মন্দিরের ভেতর সুইচ বোর্ডে সুইচ টিপলেও ঢাক ও সানাইয়ের রেকর্ড বাজতে থাকে। ভোগের পর ঠাকুরের সামনে পর্দা সরিয়ে দেওয়া হল। আরতি হল। ছবি তোলা নিষেধ তাই দু’চোখ দিয়ে দেখলাম সেই মূর্তি। কালো মুখ, সোনালি হাত, পরনে নীল ধুতি, বেশ জমকালো মূর্তি। সামনে থেকে দেখলাম, মন ভরে গেল। আরতির প্রদীপের তাপ নিয়ে মনে মনে প্রার্থনা করে বেরিয়ে এলাম।

বাড়ি ফিরে তাড়াতাড়ি খাওয়া দাওয়া সেরে মাইসোর প্যালেসের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। বর্ষবরণের উৎসব দেখতে যাওয়া। বের হতে হতে বেশ রাত হয়ে গেল। নিউ ইয়ার্স ইভের সন্ধ্যা থেকেই সেখানে প্রোগ্রাম চলছে। খুব সুন্দর প্রোগ্রাম হয়। আমরা পৌঁছালাম তখন রাত সাড়ে এগারোটা। অকথ্য ভিড়, গেটে সিকিউরিটি চেক করে ছাড়া হচ্ছে বলে ভিড় যেন এগোচ্ছেই না। চারপাশ থেকে চাপ। চেষ্টা করছি সবাই এক জায়গায় থাকার, ছিটকে গেলে মুশকিল। দুলছি ভিড়ের চাপে, এদিকে সময় হয়ে আসছে, ঘড়িতে বারোটা বাজল বলে। সবাই অস্থির হয়ে পড়ছে। খানিক বাদে চেকিং বন্ধ করে ছেড়ে দিল। হুড়মুড়িয়ে সব ভেতরে ঢুকল। চারিদিকে আলোর মেলা, একদিকে ফ্লাওয়ার শো, তবে সেখানকার আলো নিভিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাও আশপাশের আলোয় ভালোই দেখা গেল। ফুল দিয়ে তৈরি হাতির দল, বেশ বড় একটা মসজিদ। বেশিরভাগ সাদা ফুল দিয়ে, মাঝে মাঝে লাল ফুল দিয়ে নকশা করা। নৌকা, কাঠবেড়ালি, জিরাফ, জেব্রা – সব ফুলের। অনবদ্য।

ওদিকে প্যালেসের সামনে স্টেজে গান-বাজনা চলছে। সেখানে সামনে বসবার ব্যবস্থা করা। চেয়ার পাতা যদিও বসার জায়গা নেই। আমরা প্যালেসের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। কত ইতিহাস লেখা আছে এই প্রাসাদের গায়ে। পুলিশের ব্যান্ড বাজছিল। কিছু পরে স্ক্রিনে কাউন্টডাউন শুরু হয়ে গেল ২৮, ২৭, ২৬…১০, ৯, ৮…৩, ২, ১… বারোটা বাজল। সমবেত জনতা হৈ হৈ করে উঠল আর প্যালেস, গেট, সর্বত্র একসঙ্গে ঝপ করে সমস্ত আলো জ্বলে উঠল। আমরা দু’চোখ ভরে দেখলাম মাইসোর প্যালেস। চারিদিকে আলোর রোশনাই, আলো ঝলমলে চারিপাশ। আহা, অপূর্ব অপূর্ব অপূর্ব। যেদিকে চোখ যায় শুধু ঝলমলে আলোর ঝলকানি। উল্টোদিকের গেটে শুরু হয়ে গেল বাজি ফাটানো। আকাশ জুড়ে নানারকম নানারঙের বাজি ছুটতে লাগল। মনপ্রাণ ভরে দেখলাম সে দৃশ্য। যদিও প্রতি রবিবার সন্ধ্যা সাতটায় এরকম একসঙ্গে প্যালেসের সব আলো জ্বালানো হয়, তবু দেখিনি কখনও আগে। আর এই বর্ষশেষের দিনটিতে নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে একদিকে আলোর রোশনাই, আরেকদিকে বাজির বাহার, এমন তো আর অন্যদিনে হয় না। দেখে আশ মেটে না যেন। কিন্তু ফিরতে হয়। পরদিন ভোরবেলায় বাস, এয়ারপোর্ট যেতে প্রায় সাড়ে চার থেকে পাঁচ ঘন্টা লাগে। দুপুর বারোটায় ফ্লাইট। প্যালেস থেকে বোনের বাড়ি ফেরার পথে দেখলাম বাইকের তাণ্ডব। এমনই নাকি হয় প্রতিবছর। সব অল্পবয়সী ছেলেরা এমন বেহেডের মতো বাইক চালাচ্ছে, মনে হচ্ছে এই বুঝি অ্যাক্সিডেন্ট হল। একেকটায় আবার তিন-চারজন করে চেপেছে, মুখে নানারকম আওয়াজ, দু’টো হাত দু’দিকে প্রসারিত করে দিয়ে শুরু হল তাদের ফার্স্ট জানুয়ারি সেলিব্রেশন, বর্ষবরণ। জানি না কোথায় যাবে, তবে শহর জুড়ে বাইকের তাণ্ডবলীলা শুরু হয়ে গেল। সেদিন পুলিশও তাকায় না ওদিকে। 

বাড়ির কাছাকাছি এসে আর একটা জিনিস বড় নজর কাড়ল। বোনের অ্যাপার্টমেন্টের সামনে এক লিকারের দোকান, সেখানের ভিড় দেখার মত। উপচে পড়ছে। বুঝি এই একদিনেই মালিক তার সারাবছরের মুনাফা তুলে নিলেন। 

পরদিন ভোর সাড়ে-পাঁচটায় বোন, ভগ্নীপতি, বোনপো সকলে মিলে বাসস্ট্যান্ডে ছাড়তে এল। বাসে উঠলাম। ওদের চোখ ছলছল, আমাদেরও। ছলছল চোখে যতক্ষণ বাস না ছাড়ল ওরা অপেক্ষায় রইল। নিজের জায়গায় ফিরে এলাম। ঘোরা-বেড়ানো সবই ভালো লাগে, তবে দশদিনের বেশি নয়। মন আনচান করে ঘরের টানে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *