আর এক ধরনের বাস্তবতা
ছেলেবেলাতেই পিতৃবিয়োগ হয়েছিল অঁদ্রে জিদের। বাবার অভাব বালকটির পক্ষে মানিয়ে নেওয়া বেশ কঠিন হয়ে পড়েছিল। কিন্তু বালকরা তো দুঃখে কাতর হয়ে থাকতে পারে না একটানা। জীবনরহস্য নিত্য নতুন দিক খুলে দেয় তাদের চারপাশে। জিদ্ অবশ্য ওই সময় অতিরিক্ত একটা আশ্রয়ও খুঁজে পেয়েছিল মনে মনে। তার মনে হয়েছিল, বাবা সত্যি সত্যি মারা যাননি। তাঁকে চোখে দেখা যায় না দিনের বেলায় ; কিন্তু রাত হলেই তিনি আসেন, চুপি চুপি। ‘আমি ঘুমিয়ে পড়লেই তিনি চলে আসেন আমার মায়ের কাছে।’ তাঁর এই আসা-যাওয়ার ব্যাপারটি ঘটে গোপনে, সবার চোখের আড়ালে। খটখটে দিনের আলোয় শুধু একটু খটকা লাগত ছেলেটির। কই, কোথাও তো চিহ্ন নেই বাবার!
বিচিত্র এই রহস্য শেষ পর্যন্ত রহস্যই থেকে গিয়েছিল জিদের কাছে। দিনের বেলায় তাঁর কোনও অস্তিত্ব নেই, অথচ রাত একটু গভীর হলে টের পাওয়া যায় তিনি আছেন। সবার চোখের আড়ালে যান মায়ের কাছে। রহস্য উদ্ঘাটনের জন্যে ছেলেটি অবশ্য কখনও মায়ের কাছে যায়নি। কী লাভ গিয়ে? প্রশ্ন করলেই মায়ের সেই বাঁধা উত্তরটি শোনা যাবেঃ “বড় হও, আর একটু বড় হলে সব জানতে পারবে।”
জিদ তাঁর অসামান্য আত্মকথা ‘ইফ ইট ডাই’ গ্রন্থে ওপরের ঘটনাটির কথা লিখেছেন। জানিয়েছেন, একেবারে শৈশবেই এমন একটি ধারণা তাঁকে কেমন যেন আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল।
পরের পর এমন কত ঘটনাই না ঘটত তখন! সেবার এক সকালেই ছোট ছেলেটি টের পেয়ে গিয়েছিল রাতের বেলায় তাদের বাড়িতে বল নাচের আসর বসবে। কিন্তু এই ‘বল’ ব্যাপারটা কী, সে সম্পর্কে শিশুটির কোনও ধারণাই ছিল না। বাড়িঘর সাজানো হচ্ছিল সকাল থেকে। বাড়ির কাজের লোকেরা ছুটোছুটি করে বেড়াচ্ছিল সমানে। চলাফেরার পথে নিজেদের মধ্যে তাদের কত কথা, কত পরামর্শ। কিন্তু আসল ঘটনাটি ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে গিয়েছিল ছোট ছেলেটির কাছে।
রাতে নির্দিষ্ট সময়ে নিজের ঘরে শুয়ে পড়তে হয়েছিল ছেলেটিকে। কিন্তু ঘুম আসছিল না কিছুতেই। কী হচ্ছে এখন দোতলায়? কথার ছোটখাটো টুকরো, হাসির শব্দ ভেসে আসছিল চারতলার ছোট ঘরটিতে।
কৌতূহল আর চেপে রাখতে না পেরে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়েছিল ছেলেটি। তারপর পায়ে পায়ে নেমে এসেছিল তিনতলায়। এখানে কেউ নেই। সিঁড়ির রেলিংয়ের ফাঁক দিয়ে দোতলার খানিকটা অংশ দেখা যাচ্ছিল। ওখানে ঝলমলে পোশাকে চেনা-অচেনা কতজন! ওরা গল্প করছে, হাসছে, কেউ বা হাতের ছোট্ট পাখা ঘুরিয়ে হাওয়া খাচ্ছে। চারদিকে বেশ একটা উৎসবের মেজাজ।
চোখের পলক না ফেলে সব কিছু দেখছিল ছোট ছেলেটি। মনে হচ্ছিল, এ এক অন্য জগৎ। সব কিছু এখানে অন্য রকমের সত্যি। সব কিছুই এখানে বুঝি একটু রহস্যমাখানো। অন্য সময় এই জগৎটাকে দেখা যায় না। তার কারণ–ছোট ছেলেরা ঘুমোতে যাওয়ার পরেই এই সব কাণ্ড ঘটে থাকে।
বাড়ির কাজের লোক ভিকটরকেও চিনতে পারেনি ছেলেটি। চিনবেই বা কেমন করে? ওর পরনে এখন নি-ব্রিচেস আর সাদা স্টকিংস। ও দাঁড়িয়ে ছিল ড্রয়িংরুমের খোলা দরজার সামনে।
কিছুক্ষণ অবাক চোখে সবকিছু দেখার পরে ছেলেটি হঠাৎ ধরা পড়ে গিয়েছিল ওর নার্স মারির কাছে। এবার ওকে নির্ঘাত ধরে নিয়ে যাবে ঘুম পাড়াবার জন্যে। কিন্তু না, মারি ছেলেটির হাত ধরে সিঁড়ির আরও কয়েক ধাপ নীচে নেমে গিয়েছিল। সিঁড়ির ওই বাঁক থেকে নীচের সব কিছু পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল। বাজনা বাজছিল, সেই বাজনার তালে তালে অনেকে নাচছিল। সবার পোশাকই কী সুন্দর! এক সময় বাজনা থামল, সেই সঙ্গে থেমে গেল নাচও। তারপরেই শুরু হয়েছিল উঁচু গলার হাসি ও কথা। সেই সময় এক সুন্দরী মহিলার চোখে চোখ পড়ে গিয়েছিল ছোট ছেলেটির। মহিলা অমনি তরতর করে সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠে এসে ছোট ছেলেটিকে বুকে জড়িয়ে ধরে আদর করে চুমু খেল। কে ইনি? চিনতে না পেরে ছেলেটি অবাক চোখে তাকাতেই হেসে উঠেছিলেন মহিলা। ইনি আসলে ছেলেটির মায়ের বন্ধু। এই তো সকালেই কথা হয়েছিল, কিন্তু এখন চেনা যাচ্ছে না ওঁর রেশমের ঝলমলে পোশাক আর রিবনের জন্যে। নাকি ইনি অন্য কেউ?
ঘোর কাটছিল না ছেলেটির।এমন রাতে সব কিছুই কি পালটে যায়? দিনের বেলার চেনা মানুষগুলো ঝলমলে পোশাকে কেমন যেন অচেনা হয়ে উঠেছে! হঠাৎই যেন উৎসব শুরু হয়ে গিয়েছে।
রাত আর একটু বাড়ার পরে নার্স ছোট ছেলেটিকে নিয়ে এসে শুইয়ে দিয়েছিল বিছানায়। কিন্তু ঘুম ছুটে গিয়েছিল ছেলেটির। মাথার মধ্যে অদ্ভুত সব ভাবনা। ওই বয়সেই গভীর এক চিন্তা ছড়িয়ে পড়েছিল তার মাথায়। বারবার মনে হচ্ছিল—বাস্তব আছে, আবার স্বপ্নও আছে। তবে সেখানেই সবকিছুর শেষ নয়; পাশাপাশি ‘আর একধরনের বাস্তবতাও’ আছে।
ঝাপসা ওই ধারণাটি ছোট ছেলেটির মাথায় কেমন যেন গেঁথে গিয়েছিল। চোখে যা দেখা যায় তাকেই তো বাস্তব বলে। প্রতিদিনের জগতে এই বাস্তবতাকে দেখা যায়। কিন্তু এর বাইরেও নিশ্চয়ই আরও কিছু আছে—আর এক ধরনের বাস্তবতা।
কয়েক বছর বাদে, বাবা মারা যাওয়ার পরে সেই আর এক ধরনের বাস্তবতার ঘোরে পড়েছিল ছেলেটি। তার বাবা মারা গিয়েছে সত্যি, দিনের বেলায় তাকে কখনও দেখা যায় না; কিন্তু রাতের বেলায় ছেলে ঘুমিয়ে পড়লে অদৃশ্য সেই বাবা চুপি চুপি ফিরে আসে মায়ের কাছে। আবার চলে যায় দিনের আলো ফোটার আগেই।
জিদ্ বলেছেন, এই ‘আর এক ধরনের বাস্তবতার’ সঙ্গে পরি বা দত্যি-দানো-ডাইনির গল্পের কোনও সম্পর্ক নেই। হফ্ম্যান বা হান্স অ্যান্ডারসনের গল্পের সঙ্গেও এর কোনও মিল খুঁজে পাওয়া যাবে না। অনুভবের জগতের এই বাস্তবতার সঙ্গে খানিকটা বুঝি অস্বচ্ছতাও মিশে আছে। এটিকে তাই বুঝি ব্যাখ্যা করে বোঝানো অসম্ভব। তবে কোনওমতেই এই অবস্থাকে অস্বীকার করা যায় না।
আত্মকথায় নিজের শৈশব ও কৈশোরের বিচিত্র সেই অভিজ্ঞতার কথা লেখার পরে জিদ্ তাঁর সাহিত্যজীবনের গভীর এক সত্যের কথা জানিয়েছেন। লিখেছেনঃ “সেদিনের ওই দুটি অভিজ্ঞতার রেশ আজও আমি কাটিয়ে উঠতে পারিনি। সেদিনের সেই ছোট্ট ছেলেটির মতো আজও মনে হয়—জগৎ সত্যি, স্বপ্নও সত্যি; তবে আরও সত্যি বুঝি ‘আর এক ধরনের বাস্তবতা।’”
জিদের আত্মকথা ‘ইফ ইট ডাই’-এর প্রথম প্রকাশ ১৯২৪ সালে। লেখকের বয়স তখন পঞ্চান্ন। বইটিতে শুধু তাঁর শৈশব, কৈশোর নয়, প্রথম যৌবনের নানা কথাও উঠে এসেছে অকপটে। কোনরকম রাখঢাকের মধ্যে না গিয়ে তিনি তাঁর সমকামিতার কথা জানিয়েছেন সবিস্তারে। জানিয়েছেন আরব-বালকদের নিয়ে তাঁর অ্যাডভেঞ্চারের কাহিনি। তাঁর জার্নালে তিনি নিজের পরিচয় দিয়েছেন ‘পেডারাস্ট্স’ বলে। বলেছেন, ‘সোডোমাইট’রা তো বয়স্ক সঙ্গী বাছাই করে, কিন্তু তিনি শুধুই বালকপ্রেমী।
জিদের সঙ্গে বিশিষ্ট লেখক অসকার ওয়াইল্ডের প্রথম পরিচয় প্যারিসে। পরে তাঁদের দেখা আলজিয়ার্সে। ওয়াইল্ডও ছিলেন সমকামী। দুই বন্ধু রাতের অন্ধকারে বেরিয়ে পড়তেন বালকসঙ্গীর সন্ধানে। সে এক রোমাঞ্চকর কাহিনি। আরব দেশের এক বালকের সঙ্গে জিদ্ তাঁর প্রেমের বৃত্তান্ত জানিয়েছেন খোলামেলা ভাষায়।
জিদের লেখা পড়ে উদ্দীপ্ত হতেন ফরাসি দেশের তরুণ লেখকরা। তাঁর গুণগ্রাহীদের তালিকায় ছিলেন আলবেয়ার কামু ও জঁ পল সার্তের মতো প্রতিভাবান লেখকরা। জিদের সত্যসন্ধানী নতুন কণ্ঠস্বর ছড়িয়ে পড়েছিল দেশের নানা প্রান্তে। ভক্তের সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছিল, কিন্তু স্বীকারোক্তির ঢঙে লেখা তাঁর এই অস্বাভাবিক বালকপ্রীতির কথা অনেকেই মেনে নিতে পারেননি। এক তুতো বোনকে বিয়ে করেছিলেন জিদ, কিন্তু নামেই বিয়ে; সহজ-স্বাভাবিক দাম্পত্যজীবনের কোনও জায়গা ছিল না সেখানে। বেশিদিন থাকেনওনি একসঙ্গে।
আত্মকথা ও জার্নালে জিদ্ তাঁর ব্যক্তিজীবন ও সাহিত্যজীবনকে পাশাপাশি জায়গা দিয়েছেন। গোঁড়া প্রোটেস্টাণ্ট পরিবারে তাঁর জন্ম। কৈশোরে বাইবেল ছিল তাঁর সর্বক্ষণের সঙ্গী। কিন্তু ধর্মীয় অনুশাসন থেকে তিনি নিজেকে মুক্ত রেখেছিলেন। তাঁর জীবনচর্যা ও লেখালেখিতে গোপনীয়তার কোনও স্থান ছিল না। সর্বত্রই তিনি অকপট। তাঁর গদ্য পরিচ্ছন্ন, সহজ, কখনও বা তির্যক। আলো-আঁধারে মেশানো প্রগাঢ় এক অনুভবের কথাও তিনি জানিয়েছেন তাঁর মতো করে। জীবদ্দশাতেই ধ্রুপদী অর্থে মহান এক স্টাইলিস্ট হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন জিদ্।
জিদের উপন্যাসেও তাঁর জার্নালের ছায়া পড়েছে। প্রথম পুরুষে লেখা এই জার্নালের নিবিড় উচ্চারণে নাটকীয় সংঘাতও তৈরি হয়েছে বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে। জিদ অজস্র চিঠিও লিখেছেন সারা জীবন ধরে। তাঁর জীবনীকার এলান শেরিডন বলেছেন, জার্নালই জিদের রচনার প্রধান প্রকাশভঙ্গিকে ধরে রেখেছে। এই জার্নাল থেকেই উঠে এসেছে তাঁর প্রথম উপন্যাস। জার্নাল লিখতে শুরু করেছিলেন আঠারো-উনিশ বছর বয়সে এবং তা ছেদহীন ভাবে চলেছিল দীর্ঘ জীবনের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত। জিদের জার্নাল যখন প্রথম জনসমক্ষে উঠে আসে তখনই সেটির পৃষ্ঠাসংখ্যা তেরোশো অতিক্রম করে গিয়েছিল।
পরিণত বয়সে এক সমালোচক জিদকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “আপনার যদি একটিমাত্র বই বেঁচে থাকে—কোনটি বাঁচলে আপনি সব চাইতে বেশি খুশি হবেন?” সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিয়েছিলেন জিদঃ “আমার জার্নাল।”
উনিশ শতকে ফ্রান্সের সাহিত্যধারায় যে বাধানিষেধ, নিয়ন্ত্রণ ও পরস্পরবিরোধিতার পাঁচিল গড়ে উঠেছিল ধীরে ধীরে, জিদ ছিলেন তার প্রবল বিরোধী। দ্বিধাহীন কণ্ঠে, কখনও কিছুটা আবেগ-মথিত হয়ে, তাঁর চিন্তাভাবনা ও হৃদয়ের কথা জানিয়েছেন খোলামেলা ভঙ্গিতে। এই ভঙ্গিটি ছিল একান্তভাবে তাঁরই। সেই সঙ্গে ছিল স্বপ্ন, বাস্তব ও আরও এক ধরনের বাস্তবতার কথা। শেষের ওই বাস্তবতার সূত্রপাত হয় তাঁর শৈশব এবং কৈশোরে। এই ‘আর এক ধরনের বাস্তবতা’ সারা জীবনই তাঁর কাছে গভীর এক সত্য হয়ে উঠেছিল। নানা ভাবে নিজেকে প্রকাশ করার ব্যাপারে এই বাস্তবতা জিদকে সাহায্য করেছিল অনেকখানি।