আনন্দমেলার দিনগুলি

আনন্দমেলার দিনগুলি

নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী

সাতের দশকের মাঝামাঝি সময়ে মাসিক আনন্দমেলা প্রকাশের তোড়জোড় হয়। একদম শুরুর দিকে সম্পাদনার দায়িত্ব বর্তেছিল রমাপদ চৌধুরীর ওপর। তিনি ছিলেন আনন্দবাজার রবিবাসরীয় দফতরের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, আনন্দবাজার পূজাসংখ্যা বার করার দায়িত্বও ছিল তাঁর ওপর। পুরো সময়ের একজন সম্পাদক পেলে মাসিকটির প্রতি সুবিচার করা হয়—কর্তৃপক্ষের সঙ্গে এমন কিছু আলোচনায় বসার পরে তিনি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর কথা তুলেছিলেন। নীরেনদা তখন দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকার সহকারী সম্পাদক। সম্পাদকীয় লেখেন, পাশাপাশি পুস্তক-পরিচয় বিভাগটিও দেখে থাকেন। কর্তৃপক্ষের প্রস্তাবে সম্মত হয়ে তিনি মাসিক আনন্দমেলা প্রকাশের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। ফল খুব ভালো হয়েছিল, মাসিক আনন্দমেলা সর্বক্ষণের জন্য একজন যোগ্য সম্পাদক পেয়েছিল। দৈনিকে সম্পাদকীয় লেখার কাজ থেকে তিনি রেহাই পেলেন, কিন্তু পুস্তক-পরিচয় বিভাগটি কিছুদিন তাঁর কাঁধেই থেকে গিয়েছিল।

দৈনিক পত্রিকায় প্রতি সপ্তাহে একটি পাতা বরাদ্দ ছিল আনন্দমেলার জন্যে। একদা সাপ্তাহিক আনন্দমেলার খুব সুনাম ছিল। পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন ‘মৌমাছি’ ছদ্মনামের আড়ালে বিমল ঘোষ। তিনি পেতেন প্রায় বিজ্ঞাপনহীন পুরো একটি পাতা। মৌমাছির চিঠি বার হত প্রতি সপ্তাহে, শুধু তাই নয়, শিশু ও কিশোর পাঠকদের একত্রিত করে তিনি ‘মণিমেলা’ নামের একটি সংগঠনও তৈরি করেছিলেন। যুগান্তরেও সাপ্তাহিক ছোটোদের পাতাকে কেন্দ্র করে এমন একটি সংগঠন গড়ে উঠেছিল। সেটির নাম ‘সব পেয়েছির আসর।’ পরিচালনায় ছিলেন ‘স্বপনবুড়ো।’ ছদ্মনামের আড়ালের মানুষটি ছিলেন অখিল নিয়োগী।

কিছুকাল দৈনিকের পাতায় সাপ্তাহিক আনন্দমেলার দায়িত্বে ছিলেন কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়। ওঁর আমলেই সাপ্তাহিক আনন্দমেলার পাতায় দুটি ধারাবাহিক লিখেছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়। এই সাপ্তাহিকের পাতাতেই মনে হয় তারাপদ রায়ের ডোডো-তাতাইয়ের আবির্ভাব। সাপ্তাহিকের একটি পাতা বরাদ্দ আনন্দমেলার জন্য, কিন্তু বিজ্ঞাপনের বোঝা ওই পাতার অনেকটাই খেয়ে নিত। অথচ ছোটোদের লেখার চাহিদা ছিল যথেষ্টই। সম্ভবত সেই চাহিদার কথা ভেবেই মাসিক আনন্দমেলা প্রকাশের পরিকল্পনা। মাসিক আনন্দমেলা পত্রিকা হিসেবে বার হল, কিন্তু দৈনিকের সাপ্তাহিক আনন্দমেলা যেমন চলছিল, তেমনি চলতে লাগল। শক্তির পরে এক সময় দায়িত্বভার এসে পড়েছিল পার্থ বসুর ওপর।

মাসিক আনন্দমেলার প্রথম প্রকাশ ১৯৭৫ সালের এপ্রিল মাসে (বৈশাখ ১৩৮২)। প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন সত্যজিৎ রায়। যাকে বলে সাড়ম্বরে প্রকাশ, তেমন প্রকাশনাই হয়েছিল পত্রিকাটির। রূপে-গুণে মাসিক পত্রিকাটি নজর কেড়েছিল অনেকেরই। পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে অবশ্য দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকার সম্পাদক অশোককুমার সরকারের নাম ছিল। এই ব্যবস্থা ছিল কিছুকাল, তারপর থেকে সম্পাদক হিসেবে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর নাম ছাপা হতে থাকে।

আনন্দমেলা পত্রিকা – প্রথম বর্ষ, প্রথম সংখ্যা

একেবারে প্রথম দিকে পত্রিকার সম্পাদক সহকারী হিসেবে মাত্র একজনকে পেয়েছিলেন। প্রবীণ ওই মানুষটির নাম যোগব্রত গুপ্ত। উনি প্রধানত প্রুফ রিডিংয়ের কাজটি দেখতেন। এর পরে আমি কর্মসূত্রে আনন্দমেলার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলাম। কী ভাবে সেই কথায় আসছি এবার। একটু আগের কথা বলে নেওয়া দরকার।

১৯৬৫ সালে আনন্দবাজার পত্রিকা গোষ্ঠী ‘‘জার্নালিস্টস’ অ্যাপ্রেনটিস স্কিম’’ চালু করে। শিক্ষানবিশী সাংবাদিক চেয়ে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছিল দৈনিক পত্রিকায়। সেই বিজ্ঞাপনের জবাবে যারা আবেদন করেছিল, দু-দফা পরীক্ষা দেওয়ার পরে তাদের ভেতর থেকে সাতজনকে নিয়োগপত্র দেওয়া হয়েছিল; সেই সাতজনের একজন আমি। শিক্ষানবিশি পর্ব শেষ হওয়ার পরে দৈনিক আনন্দবাজারে সহ সম্পাদক হিসেবে যোগ দিই। এক বছর বাদে আমাকে বদলি করে দেওয়া হয় সংস্থার ইংরেজি দৈনিক হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ডে। মাসিক আনন্দমেলার প্রকাশলগ্নে আনন্দবাজার সংস্থায় আমার দশ-বারো বছর চাকরি হয়ে গিয়েছে। একদিন করিডরে নীরেনদার সঙ্গে দেখা হতেই উনি বললেন, ‘তুমি আনন্দমেলার জন্যে একটা  গল্প দাও তো?’

উত্তরে আমতা-আমতা করে বলেছিলাম, ‘কিন্তু আমি তো কখনো ছোটোদের জন্যে লিখিনি।’

সম্পাদক এবার একটু ধমকেই বললেন, ‘লেখোনি তো কী হয়েছে? লেখো। সামনের মাসেই গল্পটা চাই।’

ছোটোদের জন্যে লেখার কথা ভাবিনি কখনো। অথচ পড়েছি বিস্তর। বাংলা শিশু সাহিত্যের সম্পদ তো বিস্ময়কর। কোনও বাঙালি গল্পপড়ুয়া কি ওই সব এড়িয়ে বড়ো হয়ে উঠতে পারে? পারে না। ছোটোদের অসংখ্য লেখা পড়েছি। পড়ে মুগ্ধ হয়েছি। আশ্চর্য ওই জগতে কত দিনরাত কেটে গেছে আমার। কিন্তু একটু বড়ো হওয়ার পরে আমার ঘোরাফেরা শুরু হয়েছিল শুধুই বড়োদের দুনিয়ায়।

প্রথম যৌবনে ছিলাম লিটল ম্যাগাজিনের লেখক। গল্প-আন্দোলন নিয়েও মেতে ছিলাম কিছুকাল। দেশ, আনন্দবাজারে গল্প লেখার শুরু ১৯৭০ সাল থেকে। ১৯৭৪ সালে আনন্দবাজার পূজাসংখ্যায় উপন্যাস। এমন মানসিক কাঠামোয় হঠাৎ ছোটোদের জন্য গল্প লিখব কেমন করে?

লেখকের ছোটোদের গল্প – ‘নিমগাছের কাক’

এক মাস নয়, দু’মাস বাদে ছোটোদের জন্যে আমার প্রথম গল্পটি লিখে ফেললাম। গল্পের নাম ‘ভাগ্যিস ইনু ছিল।’ এটি মাসিক আনন্দমেলায় ছাপা হয়েছিল ১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসে। শুরু হল আমার ছোটোদের জন্যে গল্প লেখা। সেই বছরেই আনন্দমেলা পূজাসংখ্যায় লিখলাম ‘নিমগাছের কাক।’ লেখাদুটি পাঠকদের ভালো লেগেছিল। ওই সময়ই নীরেনদার কাছ থেকে একটি প্রস্তাব পেলাম। বললেন, ‘তুমি আনন্দমেলায় জয়েন করো না–। করবে?’ অভাবনীয় প্রস্তাব। খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলেছিলাম, ‘আমাকে কি আমার দফতর থেকে ছাড়বে?’ নীরেনদা আশ্বাস দেওয়ার ভঙ্গিতে বলেছিলেন, ‘সে আমি ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে কথা বলে নেব, তুমি রাজি তো?’ বললাম, ‘আমাকে দু-একটা দিন সময় দিন, আমি জানাচ্ছি আপনাকে।’

ভাবনা শুরু হয়ে গিয়েছিল আমার। একটি প্রথম শ্রেণির ইংরেজি দৈনিক ছেড়ে ছোটোদের একটি পত্রিকায় যোগ দেওয়া কি ঠিক হবে? দৈনিকে আমার গোটাদুয়েক প্রমোশনও হয়ে গিয়েছে। আমি প্রধান সহ-সম্পাদক। রাতের শিফ্‌টে নাইট এডিটর। পরদিনের কাগজ বার করার দায়িত্ব নাইট এডিটরের। কিছুটা ঝক্কি-ঝামেলা থাকে, তবে কাজটা চ্যালেঞ্জিংও।

ওই প্রস্তাব নিয়ে চিন্তাভাবনা চলছিলই। পাল্লা কখনো এদিকে ঝোলে, কখনো ওদিকে। ষাট বছর বয়সে চাকরিজীবন থেকে অবসর নিয়েছি, কিন্তু কখনো চাকরিতে উন্নতি করা নিয়ে বিন্দুমাত্র মাথা ঘামাইনি। কাজকর্মে ফাঁকি দেওয়ার কথাও ভাবিনি, তবে নিজের লেখালেখির জন্যে উদ্বেগহীন বাড়তি সময় চেয়েছি সব সময়। পদমর্যাদার দিক থেকে মাঝামাঝি জায়গায় আটকে থাকলেই এটা সম্ভব। দৈনিক কাগজে দু-সপ্তাহ ডে ডিউটি, এক সপ্তাহ নাইট। মর্নিং ডিউটি চমৎকার, গোটা দিনটা পাওয়া যায়। সন্ধের ডিউটি ভালোই, কিন্তু বন্ধুরা সন্ধেয় আড্ডা মারছে কফি হাউসে, আর আমি চাকরি করছি! এটা মেনে নেওয়াটা খুবই কষ্টের। একটা সপ্তাহ রাতে চাকরি করলে, পরের সপ্তাহে রাতে শুলেও সময়মতো ঘুম আসতে কয়েকটা দিন লেগে যায়। বিস্তর ভাবাভাবির পরে লেখা ও আড্ডা মারার বাড়তি সময় বার করার স্বার্থেই আনন্দমেলায় যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। নীরেনদাকে সে-কথা জানাতে উনি কর্তৃপক্ষের মত করালেন। কিন্তু আমাকে সরাতে গেলে আমাদের দফতরে কিছু রদবদল প্রয়োজন, যা করতে একটু সময় লাগবে। নীরেনদা বললেন, ‘তুমি এক কাজ করো, যত দিন না বদলির ব্যাপারটা পাকা হয়, তত দিন তুমি আনন্দমেলায় অবসর সময়ে একটু কাজ করে যাও।’

ভালো প্রস্তাব, যেখানে কাজ করব, সেখানকার কাজকর্ম একটু আগে থেকে বুঝে নেওয়া ভালো। নীরেনদার ঠিক পাশেই একটা সেক্রেটারিয়েট টেবিলে আমার বসার জায়গা হল। উলটোদিকের একটা টেবিলে যোগব্রতবাবু। অত্যন্ত সজ্জন মানুষ, উনি আগে শিক্ষকতা করতেন, ইংরেজি একটি গ্রামার বইয়ের লেখকও।

দৈনিক পত্রিকার সঙ্গে মাসিক পত্রিকার অনেক তফাত, সে পত্রিকা আবার ছোটোদের হলে তফাতের মাত্রা অনেক বেড়ে যায়। ডাকে ছোটোদের, বড়োদের অনেক লেখা আসত; তবে পত্রিকার বেশির ভাগ লেখাই ছিল আমন্ত্রিত। বেশ লাগছিল কাজ করতে। কমিক্সের টিনটিন তখন বাঙালি পাঠকদের কাছে একেবারেই অপরিচিত, সর্বভারতীয় স্তরেও খুব একটা পরিচিতি ছিল না। অভীক সরকার ব্রাসেলসে টিনটিনের স্রষ্টা হার্জের স্টুডিও ঘুরে এসে জানালেন, টিনটিনের বাংলা স্বত্ব কেনা হয়েছে, এবার থেকে টিনটিনের কমিক্স বার হবে আনন্দমেলায়। টিনটিনের কমিক্স সম্পর্কে কোনও ধারণাই ছিল না আমাদের। সম্পাদক বললেন, ‘তুমি অভীকবাবুকে ইন্টারভিউ করে ব্যাপারটা জেনে নাও তো, সাক্ষাৎকারটি আমরা আনন্দমেলায় ছাপব।’ গেলাম। হার্জের স্টুডিওর খুঁটিনাটি জেনে এবং টিনটিনের কয়েকটি বই নিয়ে ফিরে এলাম। টিনটিনের বইগুলো উলটেপালটে দারুণ লাগল। পরের সংখ্যার আনন্দমেলায় অভীকবাবুর জবানিতে বেরিয়ে গেল টিনটিন ও হার্জের স্টুডিও বৃত্তান্ত। টিনটিনের অনুবাদ করতেন নীরেনদা, আমিও বেশ কিছু করেছি। অনুবাদ করতাম রোভার্সের রয়েরও। টিনটিনের প্রিয় কুকুর স্নোয়ির বাংলা নামটা দিয়েছিলেন সম্পাদক—কুট্টুস। ‘হেনরি’ নামেরও একটি কমিক্স চালু হয়েছিল আনন্দমেলায়। অঘটন ঘটাতে পটু ছিল গোলগাল চেহারার হেনরি। সম্পাদক বললেন, এর একটা বাংলা নাম দিয়ে দাও তো। আমি নাম দিলাম—গাবলু। ধারাবাহিক উপন্যাস, গল্প, কবিতা, ছড়া, ভ্রমণকাহিনি, ছোটোদের ‘তোমাদের পাতা’ ইত্যাদি নিয়ে উত্তরোত্তর আকর্ষণীয় হয়ে উঠছিল আনন্দমেলা। আমি স্বনামে লিখতে শুরু করলাম ধারাবাহিক কিশোর ক্লাসিকস। বিশ্বখ্যাত ধ্রুপদী রচনার সংক্ষেপিত অনুবাদ, পরে যা ‘বারোটি কিশোর ক্লাসিক’ নামে আনন্দ পাবলিশার্স থেকে বই হিসেবে বেরিয়েছে। সম্পাদনার বাইরে ছদ্মনামে এবং নামহীন কিছু লেখালেখিও করতে হত আনন্দমেলায়।

ছোটোদের লেখাপত্তরের সঙ্গে একটু একটু করে জড়িয়ে যাচ্ছিলাম। ১৯৭৬ সালে আনন্দমেলায় দুটি গল্প লিখেছিলাম। সাধারণ সংখ্যায় ‘শানুর কথা,’ পুজোয় ‘ঝুমুর।’ পরের বছর গোড়াতেই ডাক পেলাম পুজোসংখ্যা আনন্দমেলায় উপন্যাস লেখার জন্য। ওদিকে কিছুটা দেরিতে হলেও হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড থেকে আমার মুক্তি পাওয়ার প্রক্রিয়া এগিয়ে গিয়েছিল অনেকখানি। দুজনকে প্রমোশন দেওয়া হল, একজন এলেন নতুন চিফ সাব-এডিটর পদে। তারপরেই আমার ছুটি হয়ে গেল দৈনিক থেকে। পাকাপাকি ভাবে চলে এলাম আনন্দমেলায়। ওই বছরেই শারদীয় আনন্দমেলায় ছাপা হল আমার প্রথম ছোটোদের উপন্যাস ‘সোনার বিস্কুট।’ উপন্যাসটির কপালে বেশ খানিকটা প্রশংসা জুটেছিল। পরের বছর আনন্দ পাবলিশার্স থেকে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় সোনার বিস্কুট। ছোটোদের জগতের সঙ্গে আমার সম্পর্ক নিবিড় হয়ে উঠছিল ধীরে ধীরে।

লেখকের সমাদৃত ছোটোদের উপন্যাস – ‘সোনার বিস্কুট’

আনন্দমেলার সম্পাদক হিসেবে যোগ্য মানুষ ছিলেন নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। উদ্ভাবনী ক্ষমতা ছিল, রসবোধ ছিল। ছোটোদের আনন্দ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের সর্বাঙ্গীণ বিকাশের দিকেও নজর দিয়েছিলেন। বানান এবং শুদ্ধ বাক্যগঠনের দিকে নজর ছিল অতিমাত্রায়। আনন্দমেলা স্টাফের সংখ্যা বাড়তে বাড়তে জনা-আটদশ হয়েছিল। প্রত্যেককেই সতর্ক থাকতে হত নির্ভুল সংখ্যা বার করার ব্যাপারে। সেই সময় আনন্দমেলায় রেওয়াজই ছিল—লেখা যত প্রতিষ্ঠিত লেখকেরই হোক না কেন, সেই লেখা আদ্যোপান্ত পড়ার পরেই প্রেসে পাঠাতে হবে। লেখকের অনবধানে কোথাও কোনও ছাড় বা অসঙ্গতি চোখে পড়লে সংশ্লিষ্ট লেখকের সঙ্গে কথা বলে তা ঠিক করে নিতে হত। আনন্দমেলার সেরা আকর্ষণ ছিল সত্যজিৎ রায়ের উপন্যাস। সেবার ওঁর উপন্যাসটি দফতরে আসামাত্র সম্পাদক আমাকে দিলেন। সত্যজিতের হাতে-লেখা কপি। সাদা কাগজে কালো কালিতে লিখতেন। ঝকঝকে পাণ্ডুলিপি, কোথাও কোনও কাটাকুটি নেই। শুনেছি লেখা হয়ে গেলে পুরোটাই উনি নিজের হাতে কপি করতেন। সত্যজিৎ ‘দেশ’ পত্রিকায় ফেলুদা লিখতেন, আনন্দমেলায় শঙ্কুকাহিনি।

সত্যজিতের লেখা হাতে এলে না পড়ে থাকা যায় না, পড়লাম, মুগ্ধ হলাম এবং প্রেসে পাঠিয়ে দিলাম। এর দু-একদিন পরেই অফিসের কী একটা কাজে যেন আমাকে সত্যজিতের বাড়িতে যেতে হয়েছিল। বিশপ লেফরয় রোডের সেই বিশাল ফ্ল্যাট। বইপত্তরে ঠাসা মস্ত ঘরে জীবন্ত কিংবদন্তির সামনে বসে কাজের কথা সেরে ফেলার পরে বলেছিলাম, ‘আপনার এবারের আনন্দমেলার উপন্যাসটি পড়ে ফেলেছি, অসাধারণ লেগেছে।’ তাই শুনে জলদগম্ভীর কণ্ঠের অধিকারী কঠিন ব্যক্তিত্বের আবরণে মোড়া ওই মানুষটি বলে উঠেছিলেন, ‘অ্যাঁ! এর মধ্যেই পড়ে ফেলেছ!’ জার্মানির পটভূমিতে লেখা কয়েকটি জাঁদরেল চরিত্রের কাণ্ডকারখানার উল্লেখ করে বললাম, ‘ওই জায়গাগুলো দারুণ লেগেছে!’ বিশালদেহী মানুষটি এবার ছেলেমানুষি খুশিতে বলে উঠেছিলেন, ‘এই ব্যাপারে কেউ আমাকে হারাতে পারবে না।’ মুগ্ধ পাঠকের কাছে একজন বড়ো লেখকও কতখানি খোলামেলা হতে পারেন—এই ঘটনাটি তার একটি প্রমাণ। শুনেছি, উপন্যাস লেখা শেষ হয়ে গেলে সত্যজিৎ প্রথমে সেটি স্ত্রী ও ছেলের কাছে পড়ে শোনাতেন, পত্রিক-দফতরে পাঠাতেন তার পরে। সেবার ঘটনাচক্রে ওই উপন্যাসের তৃতীয় পাঠক হয়ে গিয়েছিলাম আমি, এবং পাঠকের প্রতিক্রিয়াও জানিয়েছিলাম উপন্যাস ছাপা হওয়ার আগে।

সম্পাদক আনন্দমেলার সঙ্গে বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত মানুষদের জড়িয়ে নিয়েছিলেন লেখালেখির সূত্রে। নেতাজি রিসার্চ ব্যুরোর কর্ণধার ডাঃ শিশিরকুমার বসু ‘বসুবাড়ি’র কথা লিখলেন আনন্দমেলায় ধারাবাহিক ভাবে। বিশিষ্ট কবি শঙ্খ ঘোষ বাংলা বানান ও ভাষার শুদ্ধ ব্যবহার নিয়ে ‘কুন্তক’ ছদ্মনামে গল্পাকারে একটি ধারাবাহিক লিখতেন। বিভিন্ন স্কুলের পঠনপাঠন নিয়েও কিছুকাল একটি ধারাবাহিক রচনা বেরিয়েছিল। বিভিন্ন জন এই লেখাটি লিখতেন। দশম শ্রেণির ফার্স্ট বয়ের সাক্ষাৎকারও বার হত। একবার এক অত্যুৎসাহী মহিলা ক্লাসের সেকেন্ড বয়ের সাক্ষাৎকার নিয়ে তাকেই ফার্স্ট বয় বলে চালিয়ে দিয়েছিলেন। ধরা পড়ার পরে জবাবদিহি চাইলে তিনি বলেছিলেন, ‘কী করব, সেদিন ফার্স্ট বয় ক্লাসে আসেনি।’ এ অনেকটা সেই গল্পের মতো। পাঁচকড়িকে ধরে আনার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। প্রহরী পাঁচকড়িকে না পেয়ে তিনকড়ি আর দুকড়িকে ধরে এনেছিল। নির্ভুল পত্রিকা বার করার প্রাণপণ চেষ্টা করা সত্ত্বেও মাঝেমাঝে ছাপাখানার ভূত ঢুকে পড়ত লেখার মধ্যে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাকাবাবু চরিত্রটির গোঁফ আছে, একবার ধারাবাহিকের ইলাস্ট্রেশনে তার গোঁফ বাদ পড়ে গিয়েছিল। গোঁফ না থাকার কথা জানিয়ে পাঠকদের বেশ কিছু চিঠি এসেছিল দফতরে। পরের সংখ্যায় একজোড়া গোঁফের ছবি ছাপা হয়েছিল । নীচে ক্যাপশন—এই হচ্ছে কাকাবাবুর হারানো গোঁফ। এটি নিঃসন্দেহে সম্পাদকের চমৎকার রসবোধের ছবি। পত্রিকায় ছাপার ভুল ছিল ধরতে গেলে থাকতই না। আনন্দমেলার ইলাস্ট্রেশন ছিল বেশ উঁচু মানের, আঁকতেন মুখ্যত আনন্দবাজারের আর্টিস্টরাই। বাইরের শিল্পীদের মধ্যে বেশি কাজ করতেন সুধীর মৈত্র, সমীর সরকার, মুম্বাইবাসী অলক ধর এবং ছোটোদের বিখ্যাত ছবি-আঁকিয়ে বিমল দাস। প্রধানত সম্পাদকের উদ্যোগেই বিমল দাস আনন্দমেলার স্টাফ হিসেবে যোগ দেন পরবর্তীকালে। মানুষটি শুধুমাত্র ভালো ছবিই আঁকতেন না, অত্যন্ত সুরসিক ছিলেন। ওঁকে পেয়ে দফতর জমজমাট হয়ে উঠেছিল।

ছবি থেকে হারিয়ে যাওয়া ‘কাকাবাবুর’ গোঁপ!

শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘সদাশিব’ কাহিনির চিত্ররূপ আনন্দমেলায় ধারাবাহিক ভাবে বার হত। অসাধারণ সব ছবি আঁকতেন বিমলবাবু। চিত্রকাহিনির চিত্রনাট্য লিখতেন বিখাত চিত্রপরিচালক তরুণ মজুমদার। যেমন ছবি, তেমন চিত্রনাট্য। চিত্রকাহিনির বেশ ভালো একটি হোমওয়ার্ক করা হয়েছিল আগেই। আনন্দবাজার সংস্থা-কর্তৃপক্ষের ইচ্ছায় বিমলবাবুকে সঙ্গে নিয়ে সম্পাদক মুম্বাই ও পুনের বিস্তীর্ণ এলাকা, পাহাড় ও জাদুঘর ঘুরে এসেছিলেন। ভ্রমণের একটাই উদ্দেশ্য ছিল যাতে শিবাজির বিচরণভূমি, সেই আমলের পোশাক-পরিচ্ছদ, অস্ত্রশস্ত্র ইত্যাদি স্টাডি করার সুযোগ পান শিল্পী। খাতাভর্তি স্কেচ নিয়ে কাজে হাত দেওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন বিমলবাবু। দুর্ধর্ষ কাজ হয়েছিল। যেমন ছবি, তেমন লেখা। কিন্তু কেন যে এটি গ্রন্থাকারে বার হল না—আজও বিস্ময় আমার কাছে।

একটু একটু করে আনন্দমেলার সঙ্গে বেশ জড়িয়ে পড়েছিলাম। সম্পাদনার কাজ তো ছিলই, ছদ্মনামে ও স্বনামে বেশ কিছু লেখাপত্তর লিখেছি পত্রিকার পাতায়। এ ছাড়া গল্প, উপন্যাস তো ছিলই। সাম্প্রতিক কালের রোমাঞ্চকর অ্যাডভেঞ্চার-কাহিনি কালাহানের ‘অ্যাড্রিফ্‌ট’-এর সংক্ষেপিত অনুবাদ করেছিলাম, সেটি ‘মহাসাগরের ছোট্ট ভেলায় ৭৬ দিন’ নামে ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয়েছিল আনন্দমেলায়। রোমহর্ষক সত্যকাহিনির গুণে পাঠকপ্রিয় হয়ে উঠেছিল ধারাবাহিকটি।

এই ভাবেই দিন কাটছিল আমার, কিন্তু একটা সময় বিশেষ কোনও কারণে মনে হয়েছিল– আর নয়, এবার আনন্দমেলা ছেড়ে অন্য কোনও দফতরে চলে যাওয়াই ভালো। এমন মনে হওয়াটা একদিনের নয়, একটু একটু করে বেশ কিছুদিন ধরেই মনে হচ্ছিল। শেষে সিদ্ধান্তই নিয়ে ফেললাম। সিদ্ধান্তের কথা একদিন বলেও ফেললাম সম্পাদককে। উনি থেকে যাওয়ার কথা বললেন। কিন্তু আমাকে অনড় দেখে বললেন, ‘আমি তোমাকে ডেকে এনেছি, এখন তোমার ট্রান্সফারের কথা কী করে বলব বলো তো?’

বললাম, ‘তা ঠিক। ঠিক আছে, আমিই তাহলে জানাচ্ছি।’

বদলি চেয়ে একটি চিঠি পাঠালাম কর্তৃপক্ষের কাছে। একটি কপি দিয়ে দিলাম নীরেনদাকে।

পরদিনই ডাক এলো কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দেখা করার জন্য। প্রশ্নের উত্তরে যা বলার সবই বললাম। সব কিছু শোনার পরে কর্তৃপক্ষ জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি কোথায় যেতে চান?’

বললাম, ‘আমার কোনও চয়েস নেই, যেখানে পাঠাবেন, সেখানেই কাজ করব’।

সহৃদয়তার সঙ্গে কর্তৃপক্ষ জবাব দিলেন, ‘ঠিক আছে, শিগ্‌গিরই আপনার ট্রান্সফারের ব্যবস্থা করা হবে।’

কিন্তু এই দফতরে আসার সময় যে সমস্যায় পড়েছিলাম, এবারও সেই সমস্যায় পড়তে হয়েছিল। এখানে পাকাপাকি ভাবে আসতে সময় লেগেছিল প্রায় বছরদেড়েক, এবারও প্রায় সেই সময়। ইতিমধ্যে মাস-ছয়েকের মধ্যে আর একটি ঘটনা ঘটে গিয়েছিল। নীরেনদা আনন্দমেলার চাকরি ছেড়ে বাংলা একাডেমিতে জয়েন করলেন। আমি এই দফতরে আরও কিছুকাল থাকার পরে বদলি হলাম ‘প্রবাসী আনন্দবাজার’-এ। তখন সেলফোন, ইন্টারনেট যুগ আসতে অনেক দেরি। ইলেকট্রনিক মিডিয়ার এই দাপটের ছবি সেদিন সাধারণ মানুষের কল্পনায় ছিল না। ত্রিবেণী টিসু পেপারে ছাপা ঝকঝকে ট্যাবলয়েড প্রবাসী আনন্দবাজারের যথেষ্ট চাহিদা ছিল বিদেশের বাঙালিদের কাছে। প্রবাসীর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সুকুমার বন্দ্যোপাধায় চাকরিজীবনে আমার চাইতে একটু সিনিয়র, বয়সে বছর-তিনেকের বড়ো। আনন্দবাজারে মাত্র দু-তিনজনের সঙ্গে আমার তুই-তোকারির সম্পর্ক ছিল, এই সুকুমার তাদের মধ্যে একজন। অসম্ভব হাসিখুশি মানুষ। অফিসে কর্মজীবনের শেষের বারোটি বছর এই প্রবাসী দফতরে আনন্দের সঙ্গে কেটে গিয়েছিল আমার। নিজের লেখালেখি করার জন্যে যে উদ্বেগহীন সময়ের আকাঙ্ক্ষা ছিল, সেটি পেয়েছিলাম এই প্রবাসীতে আসার পরে। না হলে বোধ হয় আনন্দবাজারের রবিবাসরীয় দফতরে চার-চারটি ধারাবাহিক উপন্যাস অল্প সময়ের ব্যবধানে লিখতে পারতাম না। এই সময়ই ‘সাপ্তাহিক বর্তমান’ পত্রিকায় দুটি ধারাবাহিক উপন্যাসও লিখেছিলাম। তখন এই পত্রিকার লেখকদের অন্য পত্রিকায় লেখার ব্যাপারে কোনও বিধিনিষেধ ছিল না। কর্মজীবনের শেষের দিকে প্রবাসী আনন্দবাজারের ভারপ্রাপ্ত হয়েছিলাম।

আনন্দমেলা ছাড়ার পরে দু-তিন বছর আনন্দমেলায় গল্প লিখেছিলাম। তারপর ছোটোদের লেখা ধরতে গেলে ছেড়েই দিয়েছিলাম। ছোটোদের লেখায় আবার ফিরে আসি বছর-দশেক বাদে। এটা সত্যি কথা, সেদিন নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী আনন্দমেলায় না লেখালে আমার হয়তো ছোটোদের জন্য লিখতে বসাই হয়ে উঠত না।

—– 

ছবিঃ লেখকের সংগৃহীত। 

প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও ছোটগল্পকার। কর্মজীবনে আনন্দবাজার পত্রিকার গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বহু বছর। এখন পুরো সময়টাই লেখালেখির কাজ করছেন। গত চল্লিশ বছরে উনি বহু গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ ও গোয়েন্দাকাহিনী লিখেছেন। এযুগের যুবক সম্প্রদায়ের অনেকেই বড় হয়েছেন ওঁর লেখা ছোটদের বই পড়ে।

Related Articles

1 Comment

Avarage Rating:
  • 0 / 10
  • রাজীব কুমার ঘোষ , January 16, 2022 @ 6:36 pm

    কুট্টুসের নামকরণ জানতাম কিন্তু গাবলু নামের কাহিনি জানতাম না। সদাশিব এবং রোভার্সের রয় বই হয়ে বেরোল না এটা দুর্ভাগ্যের।
    সাত বিলিতি হেরে গেল যখন পড়ি তখন বোধহয় ক্লাস এইট। ছাপ ফেলেছিল।
    চুঁচুড়ার গল্পকার প্রয়াত প্রশান্ত মালের সঙ্গে আড্ডায় আপনার কথা উঠেছিল একদিন।

    ভালো থাকুন সুস্থ থাকুন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *