অনন্যা
“ডায়েরি করবেন? আপনি? কার বিরুদ্ধে?” অবাক হয়ে সামনের বৃদ্ধা মহিলার দিকে তাকালেন অফিসার।
“বলছি। কিন্তু তার আগে একটু বসতে চাই। বেশিক্ষণ দাঁড়াতে পারি না।” বলতে বলতে অনুমতির অপেক্ষা না করেই পাশের চেয়ারে বসে পড়লেন মহিলাটি। পাশের অল্প বয়েসি মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বললেন, “তুইও বোস। সময় তো লাগবে।”
লজ্জা পেলেন অফিসার। বয়স্কা মহিলা। আগেই বসতে বলা উচিত ছিল। “সরি। হ্যাঁ হ্যাঁ। বসুন। বলুন।”
“রুপম সাহার নামে ডায়েরি করতে চাই। নিয়ম কানুন কিছু জানি না। যদি বলে দেন…” অকপট স্বীকারোক্তি বৃদ্ধার।
“ওহ! নিশ্চয়ই। কিন্তু কী ব্যাপারে ডায়েরি সেটা জানা দরকার।”
“বধূ নির্যাতন।”
“ওহ! তাই বলুন। অমূল্য বাবু, ডায়েরির খাতাটা একবার নিয়ে আসবেন তো এদিকে।”
বৃদ্ধার ব্যক্তিত্বে কিছুটা বেসামাল হলেও তৎক্ষণাৎ নিজেকে সামলে হাঁক পাড়েন অফিসার ইন চার্জ। তারপর প্রশ্ন করেন, “রুপম সাহা কে?”
“ওর স্বামী।” পাশের নতমুখী মেয়েটির দিকে আঙুল দেখান বৃদ্ধা।
“ও। আচ্ছা।”
খাতা এসে গিয়েছিল। সামনে মেলে ধরে প্রশ্ন শুরু করেন অফিসার…
“আপনার নাম?”
“শিবানী সাহা।” তড়িঘড়ি জবাব দেন বৃদ্ধা।
মুখ তুলে তাকিয়ে একটু হাসেন অফিসার। তারপর বলেন, “আপনি নন, মা। স্বামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ তো। ডায়েরিটা ওনাকেই করতে হবে। এটাই নিয়ম।”
স্থির চোখে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকেন বৃদ্ধা। তারপর বলেন, “শুনলি তো। এবার তাহলে তুই বল। সব বলিস। কিছু বাদ দিস না যেন।”
জলভরা চোখ তুলে তাকায় মেয়েটি। অস্ফুটে শুধু একটা ভয়ার্ত আওয়াজই কানে যায় অফিসারের। “মা!”
“ভয় কী? আমি তো আছি। বল। একেবারে প্রথম দিন থেকে আজ অব্দি…” শিরা বের করা শীর্ন হাতখানা মেয়ের গায়ে রেখে সাহস জোগান বৃদ্ধা।
“কতদিন বিয়ে হয়েছে আপনার?”
“দেড় বছর।”
“হুম। অত্যাচার শুরু হয়েছে কবে থেকে?”
“বিয়ের প্রথম রাত থেকেই।”
“সম্বন্ধ করে বিয়ে?”
“হ্যাঁ। কত আশা নিয়ে বিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু…” নিষেধ ভুলে আবার কথা বলে ওঠেন বৃদ্ধা।
“হুম। অত্যাচারের কারণ কী?”
“কারণ তো অতি সহজ।” যেন অফিসারের অজ্ঞতায় নিতান্ত বিরক্ত হয়েই মুখ খোলেন বৃদ্ধা। “কারণ টাকা! পণ!”
“পণের জন্য অত্যাচার?”
“তাছাড়া আবার কী? একটা দিন শান্তি দিল না মেয়েটাকে! অথচ কম পেয়েছে? টাকাপয়সা, গয়নাগাঁটি, আসবাবপত্র – সব। তবু লোভ যায় না!” রীতিমত হাঁপাতে থাকেন বৃদ্ধা।
“আপনি নন। ওনাকে বলতে দিন।”
এবার একটু বিরক্ত হয়েই কড়া স্বরে নিষেধ করেন অফিসার।
“তার মানে পণের জন্য রুপম সাহা আপনার ওপর জুলুম করতেন। তাই তো?”
উত্তর দিতে গিয়েও একবার পাশের দিকে তাকায় মেয়েটি। বৃদ্ধার নিস্কম্প দৃষ্টিতে কী দেখেন কে জানে! ঘাড় হেলিয়ে সায় দেন।
“মারধর?”
“সেও বাকি রাখেনি। দেখা না, দেখা। তোর আঁচল সরিয়ে দেখা।” বলতে বলতে এক ঝটকায় শাড়ীর আঁচল টান মেরে সরিয়ে দেন বৃদ্ধা।
“না না, দরকার নেই। ওসব প্রয়োজন হলে কোর্টে…”
বাধা দেবার আগেই অফিসারের চোখের সামনে অনাবৃত হয় মেয়েটির দুই বাহুর কিছুটা অংশ। শিউরে ওঠেন অফিসার। কালো গভীর কালসিটে শুধু বাহুতে নয়, গলায়, ঘাড়ে। এমনকি গালেও রক্তমাখা আঁচড়ের দাগ! উফফ! নিজের অজান্তেই চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে। স্কাউন্ড্রেল!
“এতদিন কী করছিলেন? শুধু পড়ে পড়ে মার খেলেন?”
“বলেছিলাম তো। মেয়ে কথা শুনলে তো! আজও তো একরকম জোর করেই…”
“ওনাকে বলতে দিন, প্লিজ।”
চুপ করে যান বৃদ্ধা। কলম চলতে থাকে অফিসারের। সেই একই বস্তা পচা পুরোনো ঘটনা। একই লাঞ্ছনা আর অত্যাচারের পুনরাবৃত্তি । বদলায় শুধু পাত্র-পাত্রী আর অবস্থান।
“এখানে একটা সই করে দিন।”
মেয়েটির দিকে কলম এগিয়ে দেন অফিসার। আবার চোখ ফিরিয়ে পাশে বসা বৃদ্ধার দিকে তাকায় মেয়েটি।
“সই কর।” নিষ্কম্প শোনায় বৃদ্ধার কণ্ঠস্বর।
“ঠিক আছে। আপনারা আসুন। দেখছি কী করা যায়।”
“কখন দেখবেন? আমার মেয়েটা আর পারছে না। একটু তাড়াতাড়ি ব্যবস্থা নিন।” অনুনয় ঝরে পড়ে বৃদ্ধার গলায়।
“চিন্তা করবেন না। আজই, এক্ষুনি অ্যাকশান নেব। আপনারা বাড়ি চলে যান। মেয়েকে এখন শ্বশুরবাড়ি পাঠাবেন না। আপনার কাছেই রাখুন।”
উঠে দাঁড়ালেন মহিলা। “ও আমার কাছেই থাকবে।”
“আর একটা কথা। আপনার মত সাহসিনী মহিলা আমি খুব কম দেখেছি। ঘরে ঘরে এরকম মা থাকলে সমাজটা বদলে যেত।”
ম্লান হাসলেন বৃদ্ধা। তারপর বললেন, “ও আমার মেয়ে নয়। তার থেকেও বেশি। আমার পুত্রবধূ।”
———-
বিঃ দ্রঃ
ঘটনাটি আমার চোখে দেখা। বৃদ্ধা মহিলাকে আমি জেঠিমা বলে ডাকতাম। ছেলের বিরুদ্ধে থানায় গিয়ে অভিযোগ করার জন্য ওঁর পরিবার ওঁকে বয়কট করেছিল। স্বামীর পেনশনটুকু সম্বল করে ভাড়া বাড়িতে বাকি জীবনটা মাথা উঁচু করে কাটিয়েছেন। পুত্রবধূর সঙ্গে সারা জীবন সদ্ভাব বজায় ছিল।
ছবির জন্যে কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ অন্তর্জাল ক্লিপ আর্ট।