অপরূপা প্যারিস

অপরূপা প্যারিস

আমাদের গন্তব্য ফ্রান্সের রাজধানী সুন্দরী প্যারিস বা ‘পারি’। ফরাসি বিপ্লবের জন্মভূমি প্যারিস। নেপোলিয়ন বোনাপার্টের প্রিয় শহর প্যারিস। শিল্প, সংস্কৃতি, বাণিজ্য, বিজ্ঞান, ফ্যাশন, চিত্রকলা, ভাস্কর্য, সাহিত্য ও কবিতার শহর প্যারিস। পাবলো পিকাসো, মোদিগ্লিয়ানী, হেনরি মাটিস, ভিনসেন্ট ভ্যান গঘ, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, জেমস জয়েস, বেকার মিলার, ভিক্টর হুগো, এলেন গিন্সবার্গ, সালভাদর দালি, লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির শহর প্যারিস। সুন্দরী মোনালিসার স্নিগ্ধ হাসির শহর প্যারিস। তেমনি কুখ্যাত গিলোটিনের শহর প্যারিস।

কক্স এন্ড কিংস-এর সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে ২০১৪ সালের ২৪ শে মে শুরু হয়েছে আমাদের ইউরোপের কয়েকটি দেশের কিছু উল্লেখযোগ্য ঐতিহাসিক স্থান, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং অবিস্মরণীয় সৃষ্টি ও স্থাপত্য দর্শনের জন্য ১৮ দিনের ভ্রমণ। লন্ডন থেকে রোম অবধি আমাদের সঙ্গে আছেন ট্যুর গাইড মিস্টার এডউইন।

২৬ শে মে সন্ধ্যেবেলা লন্ডন থেকে বিলাসবহুল জাহাজ ‘স্টেনালাইন’-এ চেপে আমরা রওনা দিলাম হল্যান্ডের উদ্দেশ্যে। জাহাজে চেপে বারো ঘন্টার সমুদ্র যাত্রা — নতুন অভিজ্ঞতার জন্য আমরা সবাই মুখিয়ে আছি । বারো ঘন্টায় নর্থ সি অতিক্রম করে স্টেনালাইন আমাদের সকাল সকাল পৌঁছে দেবে হল্যান্ডে। জাহাজের ভেতরের আরামদায়ক কেবিন, শপিং মল, ক্যাসিনো, বার, রেস্তোরা ও পূর্ণিমার আলোয় আলোকিত নর্থ সির উত্তাল ঢেউ দেখতে দেখতে পরদিন ২৭ শে মে পৌছে গেলাম হল্যান্ডে। এক রাত জাহাজে কাটানোর স্মৃতি কোনোদিন ভুলবার নয়।
জাহাজে ব্রেকফাস্ট সেরে হুক অফ হল্যান্ডে নেমেই দেখি, মিস্টার এডউইন দাঁড়িয়ে আছেন আমাদের জন্য। বাস ছুটল আমস্টারডামের উদ্দেশে। আমস্টারডামের মাদুরাদাম, ক্যানাল ক্রুজ, Dam Square, Royal Palace দেখে ইন্ডিয়ান রেস্তোরায় লাঞ্চ সেরে বাস এবার ব্রাসেলসের পথে । আমস্টারডাম থেকে ব্রাসেলস হয়ে সড়ক পথে প্যারিসের দূরত্ব ৫১৬ কিলোমিটার। সারাদিনের বাস জার্নি ও ঘোরাঘুরির ধকলে সবাই ক্লান্ত। তাই প্যারিস থেকে ২০৪ কিলোমিটার দূরে ফ্রান্সের ছোট্ট শহর লিল (Lille)-তে আমাদের রাত্রিবাস।

পরদিন ২৮শে মে ফরাসি লোফ ও ক্রসান্ট, সসেজ, হ্যাম, ডিম, দুধ-কর্নফ্লেক্স, ফল এবং কফি দিয়ে ব্রেকফাস্টের পর বাস ছুটল প্যারিসের পথে। ধুলোহীন চমৎকার ঝকঝকে রাস্তা। রাস্তায় গাড়ির হর্নের আওয়াজ নেই । রাস্তার ধারে সবুজের প্রাচীর। ফ্রান্সে এখন বসন্ত কাল। গাছে গাছে রঙিন কচি পাতার ঝালর। রাস্তার সৌন্দর্য দেখতে দেখতে কখন যে আমরা স্বপ্নের শহর প্যারিসে পৌঁছে গেছি, বুঝতেই পারিনি। বাসের সাউন্ড সিস্টেমে মিস্টার এডউইন আজকের দিনের প্রোগ্রাম আমাদের জানিয়ে দিলেন :-
লাঞ্চের পর বাস আমাদের নামিয়ে দেবে সিয়েন নদীর ধারে কিছুটা সময় হাঁটাহাঁটির জন্য, সন্ধ্যায় সিয়েন নদীর বুকে কাঁচে মোড়া নৌকোয় River Cruise, তারপর আলোর মালায় উজ্জ্বল ‘an evening in Paris’ দর্শন । ডিনারের পরে রাত দশটায় যেতে হবে বিখ্যাত ক্যাবারে শো (Lido Show) দেখতে, সঙ্গে থাকবে কমপ্লিমেন্টারি দু’পেগ ফ্রেঞ্চ শ্যাম্পেন।

প্যারিসের জনবহুল রাস্তা
সিয়েন নদীতে নৌকাবিহার

সূর্য তখন হেলে পড়েছে। বাস আমাদের নামিয়ে দিল সিয়েন নদীর ধারে। বাতাসে সামান্য শীত শীত ভাব। খুবই মনোরম আবহাওয়া। নদীর ধার দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মনে হল সত্যি যেন স্বর্গে পৌঁছে গেছি। রাস্তার ধারে অজস্র মার্বেল পাথরের ভাস্কর্য ও ফুলের সমারো। কী অপূর্ব তার নান্দনিক রূপ! চোখ জুড়িয়ে যায়। ফ্রান্সের মানুষের সৌন্দর্যবোধে মন ভরে ওঠে। প্রতিটি ভাস্কর্যের কী সুন্দর সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ!

কাচের মতো স্বচ্ছ সিয়েন নদীর জল। ওপর থেকে পরিষ্কার দেখা যায় জলের ভেতর মাছেদের আনাগোনা । নদীর উপর অনেকগুলো সেতু। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ চোখে পড়ল একটি সেতুর লোহার রেলিঙের গ্রিলে সহস্রাধিক তালা ঝুলছে। তালার ভারে লোহার গ্রিল বেঁকে গেছে, যে কোনো সময় ভেঙে পড়বে নদীর জলে। এডউইন হাসতে হাসতে বললেন, “বিয়ের পর প্যারিসের নব দম্পতিরা নতুন তালা-চাবি নিয়ে এই ব্রিজে এসে হাজির হয়। তাদের দাম্পত্য জীবন চিরস্থায়ী হোক, এই কামনায় সেতুর গ্রিলে তালা মেরে চাবি ছুঁড়ে ফেলে নদীর জলে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় কী, সেই যুবক বা যুবতি কিছু মাস পর আবার অন্য আরেকজনের হাত ধরে নতুন তালা-চাবি নিয়ে হাজির সেতুর উপর। মনে মনে সেই একই প্রার্থনা। “হেসে উঠলেন এডউইন। পরে হাসি থামিয়ে বললেন, “কিছুদিন পরপর সরকার গ্যাসকাটার দিয়ে তালাগুলো কেটে স্ক্র্যাপ হিসেবে বিক্রি করে দেয়। সামান্য হলেও কিছু রেভিনিউ আসে সরকারের ভাঁড়ারে।”

এরপর আমরা চলে এলাম শজেলিজে (Champ Elysees)-তে। দৃষ্টিনন্দন এই চওড়া রাস্তার দু’ধারে বিশ্ববিখ্যাত সব ফ্যাশন হাউসের উজ্জ্বল উপস্থিতি । দেশি বিদেশি ফ্যাশন ম্যাগাজিনের পাতায় যে সব ফ্যাশন ব্র্যান্ডের নাম পড়েছি, আজ প্যারিসের রাস্তায় চাক্ষুষ দেখছি তাদের বিলাসবহুল শো রুম। অবিস্মরণীয় সেই মুহূর্তগুলো । রাস্তায় হেঁটে হেঁটে কাচের জানলার ভেতর দিয়ে চোখ চলে যায় ভেতরের সামগ্রীর উপর। কিন্তু পকেটে গোনাগুন্তি সামান্য ইউরো নিয়ে আমাদের কারোরই ভেতরে প্রবেশ করার দুঃসাহস হল না ।
মরমর সন্ধ্যায় শুরু হলো কাচে ঢাকা নৌকোয় চেপে সিয়েন নদীর উপর এক ঘণ্টার Boat Cruise । একটার পর একটা ব্রিজের নিচ দিয়ে এগিয়ে চলছে নৌকো। সঙ্গে ইংরেজিতে ধারাভাষ্য। নদীর দু’পাড়ের অগুন্তি ভাস্কর্য ও মনুমেন্টের ঐতিহাসিক বিবরণ।

সন্ধ্যা ঘন হয়ে এল । প্যারিসের রাজপথ ও শহরের আনাচে-কানাচে সর্বত্র জ্বলে উঠছে আলো। আমাদের চোখে ধরা পড়ছে আলোর রোশনাইয়ে উজ্জ্বল প্যারিসের এক অন্য মোহময়ী রূপ। এই সেই শহর যেখানের রাস্তায় ১৮৬০ সালে সর্বপ্রথম জ্বলে উঠেছিল গ্যাস লাইট। তাই প্যারিসকে বলা হয় City of Lights. বাসে বসে এডউইনের ধারাভাষ্য শুনতে শুনতে আমরা দেখছি আলো ঝলমল ‘An Evening in Paris’. মনে রাখবার মতো প্যারিসের সেই মোহময়ী রূপ ও সৌন্দর্য, যা ভাষায় প্রকাশ করা সত্যিই কষ্টকর ।

Illumination Tour কাটছাঁট করে আমরা সবাই চলে এলাম হোটেলে। ফ্রেশ হয়ে ইন্ডিয়ান রেস্তোরায় ডিনার শেষে ফিরতে হবে আবার হোটেলে। Lido Show দেখতে হোটেল থেকে আমাদের বাস ছেড়ে যাবে রাত দশটায়। তার আগেই আমাদের ক্যাবারে শোয়ের নিয়ম অনুযায়ী উপযুক্ত পোশাক পরিচ্ছদ পরে প্রস্তুত থাকতে হবে। প্রায় দু’বছর আগেও স্যুট ছাড়া ক্যাবারে শোয়ে প্রবেশাধিকার ছিল না। পরবর্তী কালে সমস্ত ট্যুর কোম্পানিগুলো এই ব্যাপারে কথা বলেন ক্যাবারে হাউসগুলোর সঙ্গে। এখন পুরুষ দর্শকরা ফুল স্লীভ শার্ট, পায়ে মোজা সহ জুতো পরে প্রবেশ করতে পারবেন। স্লিভলেস জামা বা ব্লাউজ পরে মহিলাদের প্রবেশ নিষেধ।

আইফেল টাওয়ারের ওপর থেকে সিয়েন নদী
Lido Show-এর ক্যাবারে

ক্যাবারে কালচারের জন্মভূমি ফ্রান্সের প্যারিস । ১৮৮১ সালে কবি, সাহিত্যিক, ভাস্কর ও শিল্পীদের সান্ধ্য আড্ডায় নিছক মজার মেজাজে শুরু হয় ক্যাবারে। তারপর ধীরে ধীরে ক্যাবারে ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। এককালে মূলা রুজ ছিল প্যারিসের কেতা-দুরস্ত এক নম্বর ক্যাবারে। ইদানিং Lido Show মূলা রুজকে টেক্কা দিয়ে এক নম্বর জায়গায় উঠে এসেছে। আমাদের প্যাকেজের মধ্যেই ধরা আছে Lido Show এর টিকেটের দাম।

Lido Show-এর ক্যাবারে চালু হয়েছে ১৯৪৬ সালে। আসন সংখ্যা ১১৫০ জনের। আমরা যখন পৌঁছুলাম, হল কানায় কানায় পরিপূর্ণ। এডউইনের তৎপরতায় মুল মঞ্চের বাঁ দিকে দশ ফিট দূরত্বে আমাদের গ্রুপের বসার ব্যবস্থা হল । এক একটি টেবিলে চার জনের বসার ব্যবস্থা। মূল মঞ্চের এত কাছে আমাদের বসার ব্যবস্থা হওয়ায় আমরা বেজায় খুশি। টেবিলে চলে এল দু’পেগ ফরাসি শ্যাম্পেন এবং শ্যাম্পেনের বদলে একগ্লাস ফলের রস।

পুরো হলে আলোর রোশনাই। ছাদের নিচে পুরো হল জুড়ে বৈদ্যুতিন সিস্টেমে তৈরি ভাসমান স্টেজে গান গাইতে গাইতে মুখ্য গায়িকার আগমন এবং অনুষ্ঠানের সূচনা। এরপর ঘূর্ণায়মান মূল মঞ্চে একেক সময় হাজির বিস্ময়কর সব সেট ও বিকিনি-পরিহিতা অপূর্ব সুন্দরী নর্তকীদের নৃত্য। একসময় মূল মঞ্চে নিচ থেকে উপরে উঠে এল সুইমিং পুল। শুরু হল ওয়াটার ব্যালে। আমরা স্টেজের খুব কাছে, জলের ফোঁটা ছিটকে আসছে আমাদের জামা কাপড়ের উপর। এরপর স্টেজে নিচ থেকে উঠে এল বরফে ঢাকা স্কেটিং রিংক। শুরু হল ব্যালে। জোড়ায় জোড়ায় পুরুষ মহিলা ডান্সারদের জুতোর হিলের আঘাতে বরফের ছোট্ট ছোট্ট কুঁচি ছিটকে পড়ছে আমাদের টেবিলের উপর।  প্রোগ্রামের বেশির ভাগ সময় জুড়েই গান আর ব্যালে। স্টেজে কাঠের ঘোড়া এল , হাতি এল, জ্যান্ত ভল্লুক এল । সঙ্গে মুখ্য গায়িকার সুরের মূর্ছনা আর ডান্সারদের নয়নাভিরাম সাজসজ্জা ও অপূর্ব নৃত্যশৈলী । প্রোগ্রামের অন্তিম দৃশ্য মনে রাখবার মতো। পাতাল থেকে মঞ্চের উপর ভেসে উঠল কম্বোডিয়ার আঙ্কোরভাট মন্দির। মন্দির গাত্রে প্রায় পঞ্চাশটি নৃত্য ভঙ্গিমার ভাস্কর্য, যেমন খাজুরাহোর মন্দির গাত্রে দেখা যায় । রিভলভিং স্টেজে মন্দিরটি চক্রাকারে ঘুরছে। মিউজিক শুরু হল । ভাস্কর্যগুলো জীবন্ত হয়ে নেমে এল মঞ্চের উপর। পুরুষ ও মহিলা মিলে প্রায় পঞ্চাশজন ডান্সার সংগীতের তালে তালে মাতিয়ে তুলল পুরো মঞ্চটাকে। মেক-আপ, কস্টিউম ও সেট যে এত নিখুঁতভাবে পাথর খোদাই ও প্রাচীনত্বের রূপ ফুটিয়ে তুলতে পারে, চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কষ্টকর।

বাসের জানলা দিয়ে যুবতীরাতের প্যারিসের অন্য রূপ দেখতে দেখতে ফিরে এলাম হোটেলে। স্মৃতি ও চোখের পাতায় রয়ে গেল অপরূপা প্যারিসের লাস্যময়ী রূপ।
২৯ শে মে সকাল সকাল বেরিয়ে পড়লাম এডউইনের সঙ্গে। আমাদের প্রথম গন্তব্য ল্যুভর মিউজিয়াম (Louvre Museum)। এডউইন বললেন, ল্যুভর মিউজিয়াম ভালোভাবে দেখতে একজন মানুষের কমপক্ষে পনেরো দিন সময় দরকার। আমাদের জন্য বরাদ্দ মাত্র দু’ঘন্টা সময়। এর মধ্যেই আমরা আমাদের পছন্দ মতো গ্যালারিগুলো দেখতে পারি। মিউজিয়ামের গেটে এডউইন হাতে ধরিয়ে দিলেন ভেতরে প্রবেশের টিকেট। আমরা সবাই ঠিক করলাম, শুধুমাত্র আর্ট গ্যালারিই আমরা দেখবো।
ল্যুভর মিউজিয়াম পৃথিবীতে ‘Most Visited Museum’ হিসেবে স্বীকৃত। এর আয়তন ৭৮২৯১০ স্কোয়ার ফিট। ফরাসি রাজাদের প্রধান রাজপ্রাসাদ ‘Louvre Palace’ এ ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে এটির সূচনা হয়। এখানে ৩৮০০০০ দর্শনীয় বস্তু রাখা আছে এবং শুধু ছবিই রাখা আছে ৩৫০০০ এর কিছু বেশি।

 

ল্যুভরের মোনালিসা
ল্যুভরের গ্লাস পিরামিড

মিউজিয়ামের প্রবেশ দ্বারের সামনে বিশ্ববিখ্যাত গ্লাস পিরামিড দেখে ভেতরে প্রবেশ করলাম। আর্ট গ্যালারির ভেতর কানায় কানায় ভিড়। এখানেই দেখলাম লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির অরিজিনাল মোনালিসার অয়েল পেইন্টিং। দু’ধারের দেওয়ালে অপূর্ব সুন্দর অসংখ্য পেইন্টিংস । ক্যামেরার ক্লিকে বন্দি হলো প্রচুর ছবি । গ্যালারির ভেতরে ক্যামেরা নিয়ে প্রবেশে আপত্তি নেই, কিন্তু ক্যামেরায় ফ্ল্যাশ ব্যবহার কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ। দু’ঘন্টা সময় ফুরিয়ে এল। মোনালিসার অরিজিনাল তৈলচিত্র দেখে মনে অপার তৃপ্তি। বেরিয়ে এলাম ল্যুভর মিউজিয়াম থেকে।

পরের দ্রষ্টব্য আইফেল টাওয়ার।  ১০৬৩ ফিট উঁচু রট আয়রন ল্যাটিস দিয়ে তৈরি এক বিশাল রাজকীয় মনুমেন্ট। এর নির্মাণ কার্য শুরু হয় ১৮৮৭ সালে এবং জনসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয়  ১৮৮৯ সালে। গুস্তাভে আইফেল নামে এক ইঞ্জিনিয়ারের কোম্পানি এটি তৈরি করেন। তাঁর নাম থেকেই এটির নাম আইফেল টাওয়ার। মোটামুটি মূল স্ট্রাকচারের ওজন ৭৩০০ টন। এছাড়া লিফ্ট, ভেতরের দোকানপাট, বাথরুম, কফি শপ ও এন্টেনা নিয়ে মোট ওজন প্রায় ১০১০০ টন। আইফেল টাওয়ারকে প্যারিসের লোকজন আদর করে ডাকে ‘La Dame  de  far’ অর্থাৎ  আয়রন লেডি।
ওপরে উঠবার টিকেট কেটে লিফটে করে থার্ড লেভেল অবধি উঠলাম। অৰ্থাৎ ভূপৃষ্ঠ থেকে আমরা ৯০৬ ফিট উপরে উঠেছি। এখান থেকে পরিষ্কার দেখা যায় সিয়েন নদী, নদীর বুকে একাধিক ব্রিজ, প্যারিস শহর, প্যারিসের সর্বোচ্চ বিল্ডিং ৫৯ তলার মন্টপারনেস টাওয়ার (Montparnasse Tower)।

থার্ড লেভেল থেকে লক্ষ্য করলাম, প্যারিসের প্রচুর বাড়ির উপরের ছাদের রং কালো। পরে এডউইন বললেন যে ফরাসি গভর্মেন্ট যে যে বাড়ির মালিক , সরকারি নিয়ম অনুযায়ী সেই সব বাড়ির ছাদের রং হবে কালো। মোদ্দা ব্যাপার, সরকারি বাড়ি ও প্রাইভেট বাড়ি সহজে আইডেনটিফাই করবার একটি সহজ উপায়

গুস্তাভে আইফে্লের নামে আইফেল টাওয়ার
রাতের আলোয় ঝলমলে

লাঞ্চের পর আমাদেরকে নিয়ে যাওয়া হল প্লেস ডি লা কনকর্ড (Place de La Concorde)এ। ১৯ একর জমি নিয়ে এটিই প্যারিসের বৃহত্তম পাবলিক স্কোয়ার । এখানেই রাজা ষোড়শ লুই (king Louis XVI) কে ২১শে জানুয়ারি ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে গিলোটিনে হত্যা করা হয়েছিল।

 

এর পরের দ্রষ্টব্য প্যারিসের দ্বিতীয় বিখ্যাত মনুমেন্ট আর্ক ডি ট্রায়ামফ (Arc de Triomphe)। সিয়েন নদীর ধারে অবস্থিত এই মনুমেন্টটির উচ্চতা ৫০ মিটার, চওড়ায় ৪৫ মিটার। দেখতে এটি অনেকটাই আমাদের দেশের গেট অফ ইন্ডিয়ার মতো। ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়নের সময় নির্মিত হয়েছিল এই প্রবেশদ্বারটি। ফরাসি বিপ্লব ও নেপোলিয়নের যুদ্ধে যে সৈনিকরা প্রাণ দিয়েছিলেন, তাঁদের নাম খোদাই করা আছে মনুমেন্টটির ভেতর ও বাইরের গাত্রে। প্যারিসের স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর ফরাসি সৈন্য মার্চ পাস্ট করেছিল এই প্রবেশ পথ দিয়ে। প্রতি বছর ১৪ই জুলাই বাস্তিল দুর্গ পতনের সেই ঐতিসাহিক ঘটনাকে স্মরণে রেখে এখানে উদযাপিত হয় মিলিটারি প্যারেড।

মনুমেন্ট আর্ক ডি ট্রায়ামফ (Arc de Triomphe)

এবার আমরা এলাম নোতরদাম ক্যাথিড্রালের সামনে। তখনো নোতরদাম গির্জা অক্ষত, অভিশপ্ত অগ্নিকাণ্ডের আগে আমরা প্যারিস ভ্রমণে গিয়েছিলাম। ঐতিহাসিক গির্জাটির নাম Notre Dame de Paris, ফরাসিরা ভালোবেসে বলে ‘Our Lady of Paris’. এই ক্যাথিড্রালে প্যারিসের আর্চবিশপের পবিত্র সিংহাসন। বিশাল বিশাল রাজকীয় জানলা, বড়ো বড়ো পিতলের ঘন্টা, কাঠের উপর অকল্পনীয় কারুকার্য, মা মেরির কোলে প্রভু যীশুর স্ট্যাচু। এখানে পা রাখলেই মনে পড়ে যায় ভিক্টর হুগোর অমর সৃষ্টি ‘হাঞ্চব্যাক অফ নোতরদাম’। ১৫ই এপ্রিল 2019 সালে কোলকাতায় বসে টিভিতে দেখলাম Notre Dame de Paris আগুনে জ্বলছে। চোখ জলে ভরে গিয়েছিল। চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল ক্যাথিড্রালের রাজকীয় সৌন্দর্য ও মা মেরির কোলে প্রভু যীশুর মূর্তি।

৩০০ বছরের ঐতিহ্যশালী পারফিউম প্রস্তুতকারী সংস্থা ‘Fragonard’ দর্শনের পর সন্ধ্যার মুখে বাস দাঁড়িয়ে পড়ল গারনিয়ের্স অপেরা (Garnier’s Opera)-র সামনে। মোট ১৯৭৯ আসন নিয়ে এটিই পৃথিবীর বৃহত্তম অপেরা হাউস। যেমন দৃষ্টিনন্দন এর স্থাপত্য, তেমনি সুন্দর এর রক্ষণাবেক্ষণ, তাকিয়ে থাকবার মত।  অপেরার বদলে আজকাল এখানে সাধারণতঃ ব্যালে অনুষ্ঠিত হয়।

গারনিয়ের্স অপেরা প্যারিসের Place de l’ Opera নামক একটি জায়গায় অবস্থিত, যার চতুর্দিকে অগুন্তি দোকানপাট। অনেকটা কলকাতার লিন্ডসে স্ট্রিটের মতো জমজমাট মার্কেট প্লেস। ভাষার ব্যবধান সত্বেও হাত ও আঙুলের মুদ্রা দেখিয়ে দামাদামির পর এখানেই ৫০ ইউরো দিয়ে মেয়ের জন্য একটি চামড়ার ব্যাগ কিনলাম। নিঃসন্দেহে ব্যাগটি দেখতে বড়োই চমৎকার।

ফিরে এলাম হোটেলে। ফ্রেশ হয়ে ইন্ডিয়ান রেস্তোরায় ডিনারে যেতে হবে। সময়াভাবে ভার্সাই প্যালেস আমাদের অদেখা রয়ে গেল।আজই প্যারিসে আমাদের শেষ রাত। বড়ো মায়াময় সে রাত। আগামীকাল ইউরোপের সুপারফাস্ট TGV Train ধরে আমরা চলে যাবো সুইজারল্যান্ডের জেনিভায়।                          

ভালো থেকো প্যারিস। যুগ যুগ ধরে ভালোলাগা ও ভালোবাসার শহর হয়ে ভালো থেকো।

তথ্য ঋণ স্বীকার :-- Internet/Google ছবি :- Lido Show ছবিটি Cox & Kings এর Brochure থেকে সংগৃহীত। বাকি সমস্ত ছবি লেখকের ক্যামেরায় তোলা।
কোচবিহার জেলার এক প্রত্যন্ত গ্রামে জন্ম, শৈশব ও কৈশোরের দিনগুলোয় গ্রামীণ জীবন ও সংস্কার, লৌকিকতা ও সমাজের ঘাত-প্রতিঘাত দেখেছেন খুব কাছ থেকে। ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়াশুনো, রাষ্ট্রীয় ব্যাংকে কর্মজীবন শুরু এবং চিফ ম্যানেজার হিসেবে অবসর গ্রহণ। কর্মজীবনে বিভিন্ন দায়িত্ব পালনের জন্য বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করেছেন। নিজের চোখে দেখা গ্রাম্য জীবন, গ্রামীণ লৌকিকতা ও সমাজের চাপা-পড়া মানুষদের কথা উঠে আসে লেখায়। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। "মহাপৃথিবী" তাঁর প্রকাশিত গল্প সংকলন। তবে সবকিছুর পরেও নিজেকে পাঠক হিসেবে ভাবতেই বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করেন।

1 Comment

Avarage Rating:
  • 0 / 10
  • Rabindranath Das , April 20, 2022 @ 10:35 am

    মনতোষ রায়বর্মন ততটা ভালো ,ঠিক ততটাই ভালো ওনার বিভিন্ন লেখাগুলো। ইউরোপ ভ্রমণে ওনার একজন সঙ্গী হয়ে নিজেকে ভাগ্যবান বলে মনে করি। বিভিন্ন ধরনের লেখায় ওনার আরও শ্রীবৃদ্ধি হোক এই কামনা করি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *