বুধনি
বিগত কয়েক্ সহস্রাব্দে ভারতীয় নারীদের অবস্থা বহু পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে গেছে। প্রাচীন যুগ থেকে মধ্যযুগে, তাদের অবস্থার অবনতি আর কয়েকজন সমাজসংস্কারকের প্রচেষ্টায় আবার সমমর্যাদার অধিকারে উত্তরণের ইতিহাস বেশ ঘটনাবহুল। আধুনিক ভারতে নারীরা রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, লোকসভার অধ্যক্ষ, বিরোধী দলনেতা, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী, রাজ্যপালসহ বহু গুরুত্বপূর্ণ পদ অলংকৃত করেছেন।
ভারতীয় সংবিধানে বর্ণিত নারীর অধিকারের অন্তর্ভুক্ত মূল বিষয়গুলি হল সাম্য, মর্যাদা, বৈষম্য থেকে স্বাধীনতা। এছাড়াও নারীর অধিকার সংক্রান্ত বহু বিধি প্রযোজ্য।
২০১৮ সালে ভারতের রাষ্ট্রপতি, লোকসভার অধ্যক্ষ, লোকসভার বিরোধী দলনেতা এই তিনটি পদই অলংকৃত করেন মহিলারা। যদিও আজও কিছু কিছু ক্ষেত্রে মহিলারা লিঙ্গবৈষম্য ও অপরাধের শিকার।
আজ এমনই এক নারীর কথা আমি আপনাদের সামনে তুলে ধরব। হয়ত তিনি আজও সকলের কাছেই পরিচিত অথবা অপরিচিত হয়েই আছেন। তবুও আমার চোখে তিনি আজও একজন সাহসিনী ব্যক্তিত্বের অধিকারিণী।
১৯৫৯-এর ৬ই ডিসেম্বর তাঁর হাতেই উদ্বোধন হয়েছিল পাঞ্চেত বাঁধ। কিন্তু আদিবাসী সমাজ তাঁকে ত্যাগ করে। ঝাড়খণ্ডের গ্রামে আজও সেই ক্ষত নিয়ে তিনি বেঁচে আছেন।
দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশনের উদ্যোগে সেদিন পাঞ্চেত বাঁধ উদ্বোধন করেন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু। বাঁধের কাজ শুরু হতেই কাজের সুযোগ পেয়েছিল চারপাশের গ্রামের বেশ কিছু আদিবাসী নারী-পুরুষ। উদ্বোধনের দিন নেহরুকে দেখার জন্য তারাও হাজির ছিল সেখানে। নেহরুর গলায় মালা পরিয়ে স্বাগত জানাবে কে? দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশনের কর্তাদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দায়িত্ব পড়ল রাবণ মাঝি ও পনেরো বছরের সাঁওতাল মেয়ে বুধনির পরিবারের ওপর। সমস্ত গ্রাম নেহরুর প্রতীক্ষায় আনন্দে, উচ্ছ্বাসে আত্মহারা। সেই সঙ্গে বুধনির পরিবারও উচ্ছ্বসিত এক অজানা আনন্দে। কিন্তু তখনও তারা জানত না কী চরম পরিণাম তাদের জন্য অপেক্ষা করছে। গলায় মালা পরিয়ে স্বাগত জানালেন বুধনি। নেহরুও খুশি। নিজে নন, বাঁধ উদ্বোধন করালেন বুধনিকে দিয়ে। সারা পাঞ্চেত হাততালিতে মুখরিত হয়ে উঠল। গর্বে ও অহঙ্কারে মাথা উঁচু হয়ে গেল বুধনির পরিবারের।
কিন্তু সেই ঐতিহাসিক দিনেই চিরতরে পাল্টে গেল বুধনির জীবনপঞ্জিকার ছক। এক লহমায় ভেঙ্গে চুরমার হল সব স্বপ্ন। উদ্বোধনের অনুষ্ঠান শেষে বুধনি বাড়ি ফিরছিল এক অদ্ভুত রঙিন অভিজ্ঞতার রেশ নিয়ে। এ প্রাপ্তি তার কাছে ছিল স্বপ্নাতীত ও আশাতীত। কিন্তু সুখাবেশ ক্ষণস্থায়ী হল। যে মেয়েকে নিয়ে গ্রামবাসীদের গর্ব হওয়ার কথা, বাড়ি ঢোকার আগেই গ্রামের মোড়লরা তাকে পাকড়াও করল।
কিন্তু কেন? কেন তার বিচার হবে? বুধনি কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিল না সে কী অপরাধ করেছে? মোড়লদের ভাষায় তার অপরাধ, সে পরপুরুষের গলায় মালা পরিয়েছে। সে অবিবাহিত। কুসংস্কারের বেড়াজালে আষ্টেপিষ্টে জড়িয়ে থাকা আদিবাসী সমাজের নিয়ম অনুযায়ী কোন অবিবাহিত মেয়ে কোনো অজানা পুরুষের গলায় মালা পরালে ধরে নেওয়া হয় তারা বিয়ে করল। সেই দিক থেকে দেখলে বুধনি হল তখন নেহরুর স্ত্রী। কিন্তু নেহরুতো আর সাঁওতাল নন! তাই বে-জাতে বিয়ে করার অপরাধে একঘরে করে দেওয়া হল বুধনিকে।
বুধনির পরিবারে নেমে এল ঘোর অমাবস্যার কালোছায়া। বুধনিকে সমাজ থেকে বহিষ্কৃত করা হল।
আজও বুধনি সেই ক্ষত নিয়ে বেঁচে আছেন পাঞ্চেতের বুকে। পাঞ্চেতের বাঁধ পেরিয়ে তাঁর বাড়ির পথ সন্ধান করতে গেলে অটোচালক, দোকানদার থেকে শুরু করে আশেপাশের পথচলতি প্রতিবেশীদের সবাইই প্রায় এক কথায় বাড়ির ঠিকানা বলে দিতে পারে। কিন্তু সবাই কেমন যেন কৌতূহলের চোখে তাকিয়ে থাকে প্রশ্নকর্তার দিকে।
গ্রামের প্রায় শেষপ্রান্তে ইটের তৈরি ছোটো অতিসাধারণ একটি একতলা বাড়ি। সেখানেই বুধনি থাকেন।
আজ বুধনিকে কিছু জিজ্ঞেস করলে বুধনি প্রতিবাদী সুরে বলে ওঠে, “সাহেব সুবারা জেনেশুনেই আমাকে পরপুরুষের গলায় মালা পরাতে বলেছিল। তারা কি জানত না যে পরপুরুষের গলায় মালা পরালে বিয়ে হয়ে যায়? কিন্তু নেহরুবাবু সেই সময় শুধু একটাই কথা বারবার বলেছিলেন, ‘বেটি, তোমার জীবনভর চাকরি রইল।’” বলতে বলতে চোখের কোণায় জল চিকচিক করে ওঠে। একটা চাপা কষ্ট ফুটে ওঠে মুখে।
বুধনি এখনও দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশনের কর্মী। আজ তিনি মধুমেহ রোগে আক্রান্ত। এই বয়সেও ঘরের বাইরের সমস্ত কাজ নিজের হাতে করেন। কালের নিয়মে সমাজ হয়তো আজ অনেকটাই বদলেছে। ওদের সমাজেও মেয়েরা স্বাধীন হয়েছে, স্বনির্ভর হয়েছে। মেয়েরাও বহুবিবাহ, বিধবাবিবাহ, এসবে নিজেদের ন্যায্য অধিকার ছিনিয়ে নিয়েছে। একঘরে হয়ে থাকার নিয়ম শিথিল হয়েছে। কিন্তু যে সমাজ তাকে ত্যাগ করেছিল, বিতাড়িত করেছিল কুসংস্কারের বশবর্তী হয়ে, সেখানে বুধনি আর ফিরে যাননি। আত্মীয়স্বজন, পাড়া প্রতিবেশী, উৎসব-আনন্দ-সামাজিকতা, এ সমস্ত কিছু থেকে তিনি নিজেকে ব্রাত্য করে রেখেছেন আজও।
শহুরে মানুষদের কাছ থেকেও নিজেকে স্বেচ্ছায় ব্রাত্যই করে রাখতে চান সমাজচ্যুত বুধনি। আমরা পাঠকরা অবশ্যই বুঝব যে এটা তাঁর আক্ষেপ নয়। এটা তার যন্ত্রণা, অভিমান। তখনকার সমাজের কাছে তাঁর সুপ্ত প্রতিবাদের একটা মাধ্যম।
আজ তাই তিনি আমার চোখে একজন মহীয়সী নারী। যদি কোনোদিন তাঁকে দেখার সুযোগ ও সৌভাগ্য দুটোই হয়, তবে তাঁকে স্যালুট জানিয়ে তাঁর চরণে আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম জানানোর ইচ্ছা রাখি।
সেদিনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি আজ হলে বুধনি হয়ত সংবাদের শিরোনামে থাকতেন। সংবাদ চ্যানেলগুলো ঝাঁপিয়ে পড়ত তাঁর সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য। তাঁকে রাতারাতি সেলিব্রিটির তকমা দিতে উদ্যোগী হয়ে পড়ত। প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ত সমস্ত মিডিয়া। অনেক সহৃদয় ব্যক্তি এগিয়ে আসত হাজারো প্রতিশ্রুতির পসরা সাজিয়ে তাঁদের পরিবারের হিতার্থে। কিন্তু ভাবতেও অবাক লাগে, সেই সময়ে তাঁকে সমাজচ্যুত হতে হয়েছিল।
———-
ছবিঃ রত্না দত্ত
ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস!