হরিণ-সমস্যা অথবা গ্লুটেন-অ্যালার্জি

হরিণ-সমস্যা অথবা গ্লুটেন-অ্যালার্জি

অফিসের কাজে নিউ ইয়র্ক যেতে হয়েছিল ক’দিনের জন্য। কিন্তু বিদেশ গেলেই কি আর নিস্তার আছে? ওর মধ্যেই খুচুং করে ফোনে মেসেজ – লেখাটা কদ্দূর? কে মেসেজ পাঠিয়েছেন বুঝতেই পারছেন, আমাদের সম্পাদকমশাই ভাস্করদা। আমি উত্তর দিলাম ছোট করে – “ভাস্করদা, আমি নিউ ইয়র্কে। সামনের মঙ্গলবারে ব্যাঙ্গালোরে ফিরেই তোমার লেখাটা পাঠাচ্ছি।” ভাস্করদার উত্তর পেয়ে চমকে গেলাম – “তুমি নিউ ইয়র্কে? আমিও তো নিউ ইয়র্কে। শনিবার ফ্রি আছ নাকি? থাকলে চলো, নিউ জার্সিতে সুজনদার ওখানে হানা দিই।”

পরবর্তী দৃশ্য সুজনদার বাড়ি। বাড়ি না বলে প্রাসাদ বলাই ভালো। বিশেষ করে বেসমেন্টটা। ওই রকম বিশাল সাইজের বেসমেন্ট, সমস্ত দেয়াল জুড়ে বইয়ের আলমারি, হাজার হাজার বই। একটা বিরাট লেখার টেবিল তার এক কোণে। আর মাঝখানে শোভা পাচ্ছে একটা গাবদা সাইজের ট্রেডমিল।

আমি বললাম, “মন এবং শরীরচর্চার এমন আদর্শ ঘরোয়া পরিবেশ আর দ্বিতীয়টি মিলবে না। কিন্তু সুজনদা, আপনার বাড়ির চারদিকটা তো খুবই সুন্দর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঝলমল করছে। সেখানে না হেঁটে এই ট্রেডমিলে হাঁটতে আপনার বোর লাগে না? আর এই ট্রেডমিলটা তো দেখে মনে হচ্ছে বেশ অন্য রকম, আমাদের অফিসের জিমে যেমন ছিল তেমন বিচ্ছিরি না। মানে দামও নিশ্চয় দারুণ হবে।”

সুজনদা বললেন, “হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ। দামটা অবশ্য আমাকে দিতে হয়নি, ওটা আমার জামাইয়ের কাছ থেকে উপহার পেয়েছি। কিন্তু এর পেছনে একটা কারণও আছে। তোমাদের শমীতাদি তো খুব সিরিয়াস, শরীরচর্চার সময় কেউ বিরক্ত করুক, এটা চায় না, কেননা তাতে শরীরের চর্চা হয় না। হয়েছে কী, বাড়ির বাইরে বাগানে যখনই হাঁটতে যাই, কেউ না কেউ চলে আসে আর বকবক করতে থাকে। ফলে হাঁটাহাঁটি আর হয় না।”

ভাস্করদা বলল, “তোমার এই জায়গাটা তো বেশ নিরিবিলি। আসতে গিয়ে দেখলাম একপাশে চাষের ক্ষেত, অন্যদিকে জঙ্গল। এখানে হুটহাট কে চলে আসে?”

-“কেন? একেনবাবু? ওর আসার কি কোনো সময়-অসময় আছে নাকি? এসেই শুরু করবেন বকবকানি।” সুজনদা ঈষৎ ক্ষুব্ধকণ্ঠে বললেন, “একবার শমীতা জামাইয়ের জন্য বেগুনি বানিয়েছিল। আমাদের বাগানেরই বেগুন, তো আমাদের জামাই সেই জার্মান যুবক, বেগুনি খেয়ে এমন প্রশংসা করতে লাগল যে তাকে তো অন্তত আর একটা না দিয়ে পারা যায় না। ও মা, তার জন্য আর এক পিস টেবিলে রাখতেই একেনবাবু সেটা ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে কামড় বসিয়ে দিয়েছেন আর হ্যা হ্যা করতে করতে বলছেন – জার্মান পেটে কি আর এই জিনিস সহ্য হবে? কী অবস্থা ভেবে দ্যাখো তোমরা। সে বেগুনি খাবে বলে বসে রয়েছে, তাকে বেগুনি দেওয়া হয়েছে, অথচ সেই বেগুনি পাত থেকে তুলে নিলেন এই একেন্দ্রনাথ।”

আমি রেগেমেগে বললাম, “ঘাড় ধরে দূর করে দিলেন না কেন?”    

সুজনদা বললেন, “সেটা কি আর করা যায়? তবে লোকটা অসহ্য। বিশেষ করে খাবার দেখলেই ছোঁ মেরে তুলে নেওয়াটা তো তোমার মাইসোর পাক নিয়ে আদিখ্যেতার সমপর্যায়ের। আর শুধু তুলেই নিল না, বেগুনকে কেন কোথাও ব্রিঞ্জল, কোথাও অবারজিন, কোথাও এগপ্ল্যান্ট বলে – সব নিয়ে একটা ভুলভাল থিসিস নামিয়ে দিল হড়হড় করে। বিরক্ত জামাই ক’দিন পরেই তাই এই ট্রেডমিলটা গিফট দিয়ে গেল। যাতে হাঁটাহাঁটি করার সময় কেউ ডিস্টার্ব করতে না পারে। একটা ট্রেডমিলে তো আর দু’জন চাপা যায় না। তাছাড়া, তুমি যেটা বললে, ঠিকই বলছ, এর সামনে যে বড় সাইজের মনিটরটা আছে, ওটা দিব্যি টিভির মতো। হাই রেজোলিউশন, ইন্টারনেট কানেক্টেড। আমি ওতে নিয়মিত বাংলাদেশের টেলিফিল্ম দেখি।”

আমি বললাম, “তাই নাকি? আমিও দেখেছি কয়েকটা। ওরা নাটক বলে। মুশাররফ করিম, চঞ্চল চৌধুরী, নুসরাত ইমরোজ তিশা – এইসব ওদের বড় বড় অভিনেতা-অভিনেত্রী। আমারও ভালো লাগে। আমাদের মতো অখাদ্য নয় ওদের এই নাটক, একটা গল্প থাকে, অভিনয় ভালো, আর বেশ অনেকটা আউটডোর শুটিং থাকে। গ্রামের দৃশ্যে পথঘাট-বাগান-পুকুর-গাছপালা হামেশা দেখা যায়। ঢাকার শহুরে রাস্তা রিকশায় ভর্তি।”

“ঠিক বলেছ,” সুজনদা বললেন, “অভিনেত্রীর তালিকায় আরও দুটো নাম যোগ করে নাও। মেহজাবিন চৌধুরী আর তানজিন তিশা। খুবই সুন্দরী। এদের টেলিফিল্মগুলোও দেখো। এক একটা পঁয়তাল্লিশ মিনিট থেকে এক ঘন্টা মতো। আমি হাঁটতে হাঁটতে নাটকে মশগুল হয়ে যাই। বুঝতেই পারি না, কখন সময় পেরিয়ে গেছে। নাটকও দেখা হয়ে যায় আবার হাঁটাহাঁটিও।”

কিছুক্ষণ পর গল্প হচ্ছিল সুজনদার বাড়ির বাইরের বাগানে একটা গোলটেবিল ঘিরে, চা খেতে খেতে। আমি বললাম, “কিন্তু সুজনদা, এত চেষ্টা করেও তো আমি আপনাকে একটা খুদে টুকরো মাইসোর পাকও খাওয়াতে পারলাম না। যতবার প্রলোভন দেখিয়েছি, আপনি গ্লুটেন অ্যালার্জির নাম করে এড়িয়ে গেছেন। এই জিনিসটা আপনি বুঝলেন কখন যে আপনার গ্লুটেনে অ্যালার্জি আছে? মানে, আমরা তো গ্রামে যা পেতাম তাই খেতাম। কিছুতে অ্যালার্জি থাকলেও বোঝার জো ছিল না। আপনার ছোটবেলা তারও আগে, যদিও শান্তিনিকেতনে থাকতেন। তখন কি ওখানে গ্লুটেন অ্যালার্জি, ল্যাকটোজেন ইনটলারেন্স – এসব নিয়ে লোকের মাথাব্যথা ছিল?”

আমাদের কথাবার্তার মধ্যেই দেখি একজন সিড়িঙ্গে লোক কচকচ করে একটা শশা চিবাতে চিবাতে দুহাতে দুটো নধর শশা দোলাতে দোলাতে আমাদের দিকে এগিয়ে এল। গান গাইতে গাইতে। তার যেমন সুর, তেমনি লিরিক। শুনতে পেলাম গাইছেন – “মৌমাছি ফিরে যাচি মরে লাজে মরে ত্রাসে, অলির কথা শুনে বকুল হাসে।” সুজনদা বলে উঠলেন, “ওই যে, এসে গেছেন!”

ভাস্করদাই আগে উঠে দাঁড়িয়ে ডান হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “একেনবাবু তো? আমি ভাস্কর আর এ হচ্ছে অমিতাভ। আপনার গানের লিরিক শুনে ভীষণ মজা পেয়েছি।”

একেনবাবু লজ্জা লজ্জা ভাব করে বললেন, “কী যে বলেন স্যার! পেছন থেকে আপনাদের দু’জনকে দেখে ভাবছিলাম বাপিবাবু আর প্রমথবাবু। ওদের হাত থেকে বাঁচতে এখানে এলাম তো দেখি ওরাই এখানে আগে থেকে এসে বসে গেছেন, এই ভেবে হতাশ হয়ে গানটা শুরু করেছিলাম। তবে আমার আবার গান, স্যার! রান্নাঘর থেকে খুকুর গুনগুন শুনে আমি কিঞ্চিৎ শেখার চেষ্টা করতাম, এই আর-কি! এই গানটা কোন সিনেমার যেন?”

ভাস্করদা বলল, “আপনি তো একসঙ্গে তিনখানা গান শুনিয়ে দিলেন। তার মধ্যে দু’খানা রবীন্দ্রসঙ্গীত। যাকগে, মৌমাছি ফিরে যাচি’ ফুলের দখিনা, পাখায় বাজায় তার ভিখারির বীণা, কী অদ্ভুত মাধুর্যপূর্ণ না? ভেবে দেখেছেন কখনও?”

একেনবাবু হাসতে হাসতে শশা দোলাতে দোলাতে বললেন, “তা আর ভাবিনি? এই দেখুন আপনার লিরিক শুনে শশাগুলোও কেমন দখিনা হাওয়ায় দুলছে।” পেন্ডুলামের মতো শশা দোলাতে লাগলেন একেনবাবু।

ভাস্করদা বলল, “ফুলের দখিনা কিন্তু দখিনা বাতাস নয়, ফুলের দাক্ষিণ্য। মৌমাছি ফুলের দাক্ষিণ্য যেচে অর্থাৎ যাচ্ঞা করে ফিরছে। কীভাবে? তার পাখায় ভিখারির বীণা বাজিয়ে। ভেবে দেখুন উপমাটা। অলমোস্ট কালিদাস।”

একেনবাবুর হাতের শশার আন্দোলন থেমে গেল। ঈষৎ ভ্রুকুটি করে বললেন, “তাই তো। কী সুন্দর বুঝিয়ে দিলেন জলের মতো। আমাদের বাংলার স্যার অজগরবাবুও একদম হুবহু এই রকমই আমাদের বুঝিয়ে দিতেন – “চুমিয়া যেও তুমি আমার বনভূমি দখিন সাগরের সমীরণ, পুরানো সেই সুরে কে যেন ডাকে দূরে, কোথায় হারিয়ে গেল সোনালি বিকেলগুলো সেই। আচ্ছা তস্করবাবু-”
– ভাস্কর।
– ও স্যরি, তো ভাস্করবাবু, দাক্ষিণ্য মানে তো দয়া, তাই না? আর দক্ষিণ মানে ঐ যে যেদিক থেকে শশাগুলো তুলে নিয়ে এলাম। মানে একটা ডিরেকশন। এ দুটো কী করে দখিনা হয়ে গেল বলুন তো।

ভাস্করদা বলল, “এ সব অমিতাভর লাইন। এই অমিতাভ, বুঝিয়ে দাও তো।”

আমি আমতা আমতা করে বললাম, “ভুল হতে পারে, তবে দক্ষিণ আর দক্ষ সম্ভবত সমার্থক। মানে যার দক্ষতা আছে, সেই দক্ষিণ। এই দক্ষতা অর্জনের জন্যে প্রদেয় দান হচ্ছে দক্ষিণা, তার উপযুক্ত বস্তু দাক্ষিণ্য, এই গানে যা দখিনা। আবার মানুষের ডান হাত যেহেতু বাঁ-হাতের তুলনায় সাধারণভাবে বেশি দক্ষ, তাই ডান হাতকে দক্ষিণ হাত বলা হয়। সমস্ত পুজোই সূর্যের দিকে মুখ করে পুবমুখো হয়ে করা হয়, সে সময় ডান অর্থাৎ দক্ষিণ হাত যেদিকে নির্দেশ করে, সেটাই দক্ষিণ দিক, সে দিক থেকে আগত বাতাস দখিনা বাতাস।”

ভাস্করদা বলল, “ভালো বলেছ। খেয়াল করেছ কি, যে ইংরাজিতে ডেক্সটেরাস মানে দক্ষ, আবার এই ডেক্সটার ল্যাটিনে হচ্ছে ডানদিক। কেমন মিলে যাচ্ছে, না?”

আমি বললাম, “হ্যাঁ। আমাদের কেমিস্ট্রিতে স্টিরিওকেমিস্ট্রি বলে একটা বিষয় আছে, কিছু মলিকুলের মধ্যে দিয়ে প্লেন-পোলারাইজড আলো পাঠালে সেটা ডান বা বাঁদিকে ঘুরে যায়; যেগুলোতে ডানদিকে ঘোরে, তাদের বলে ডেক্সট্রো-রোটেটরি। ইংরাজি ডি-লেখা হয় তাদের নামের আগে। যেমন ডি-গ্লুকোজ, একে আবার বলা হয় ডেক্সট্রোজ।”

একেনবাবু এতক্ষণ চুপ করে ছিলেন। এবার সুযোগ পেয়েই বলে উঠলেন, “আচ্ছা, এ সব আজেবাজে কথাবার্তায় সময় নষ্ট না করে শশার দিকে মনোযোগ দিলে হয় না? সুজনবাবুর এই শশাবাগানটা কিন্তু কাল্টিভেট করার মতোই। সব সময় ওতে শশা ঝোলে। দেখলে আপনার ছিঁড়ে খেতে ইচ্ছে করবেই। আমাকে তো জানেন, আমি ইচ্ছে দমন করা জিনিসটা ঠিক পছন্দ করি না, বিশেষ করে খাওয়ার ব্যাপারে। সত্যজিৎ রায় আমাদের বলে জাননি উটে কাঁটা বেছে খায় কিনা। কিন্তু আমি জানি, আমি গুনে খাই না। শুনেছি, এই বাগানে হরিণের উপদ্রব খুব। হরিণ যখন ঝুলন্ত শশা গপগপ করে খায়, ওরাও নিশ্চয় গুনে খায় না। একদিন সন্ধেবেলা দেখলেন হয়ত বাইশ-তেইশটা শশা ঝুলছে, পরদিন দেখলেন অনেকগুলো হাওয়া। এই অঙ্ক মেলানোও কি কম ঝামেলার? আচ্ছা সুজনবাবু, হরিণের এই শশা খেয়ে যাওয়া সংক্রান্ত অঙ্কগুলোকে কি আপনি মৃগাঙ্ক বলবেন, নাকি শশাঙ্ক?”

নিজের রসিকতায় নিজেই হ্যা হ্যা করে হাসতে হাসতে লাগলেন। দেখে আমাদের পিত্তি জ্বলে গেল। কথা ঘোরানোর জন্য সুজনদাকে আবার জিজ্ঞেস করলাম, “সুজনদা, আমাদের গ্লুটেনে অ্যালার্জি নিয়ে কথা হচ্ছিল।”

সুজনদা কিছু বলার আগেই একেনবাবু আবার বলে উঠলেন, “তাই নাকি স্যার? গ্লুটেন নিয়ে কথা হচ্ছিল বুঝি? বলুন বলুন কী কথা হচ্ছিল। গ্লুকোজের গ্লু আর ব্রিটেনের টেন, আমার কাছে এই হচ্ছে গ্লুটেন। আরে মশাই, অ্যালার্জি-ফ্যালার্জিকে এত পাত্তা দিলে চলে, আপনারাই বলুন। গ্লুটেন কোনো সমস্যাই না, বিশেষ করে আপনি যখন শরীরচর্চার জন্য ওই বিশাল সাইজের জার্মান ট্রেডমিলে চেপে হাঁটতে হাঁটতে রামায়ণ-মহাভারতের সিরিয়ালগুলো দেখেন। ট্রেডমিলের ওটাই তো ট্রেড সিক্রেট, যা খাবেন হজম হয়ে যাবে। গ্লুটেন-ফুটেন সব। ওসব বাদ দিন। তার চেয়ে বরঞ্চ হরিণ…”

 শমীতাদি ভদ্রলোকের দিকে কড়া দৃষ্টিতে তাকাতেই উনি মিইয়ে গিয়ে বললেন, “দেখুন, গ্লুটেনে অ্যালার্জিটা আমি আপনাকে বুঝিয়ে দিতে পারি, তবে হরিণের সমস্যাটা কিন্তু সত্যিকারের। কাল্পনিক নয়। তবে আমি জানি স্যার, সুজনবাবু ইচ্ছা করলেই এ সমস্যার সমাধান করে ফেলতে পারেন। কিন্তু উনি সদাশয় মানুষ, ম্যাডামকে খুব ভয়ও পান। বাঙালি মাত্রেই ভাজাভুজি খেতে পছন্দ করে, করে কিনা বলুন? কিন্তু ম্যাডাম পই-পই করে বলে দিয়েছেন, ভাল করে খাবারটা প্রথমে গ্লুটেন-বর্জিত কিনা, সেটা নিঃসন্দেহ হয়ে তবে খেতে পার, কিন্তু আধখানার বেশি নৈব নৈব চ। আচ্ছা, বলুন তো স্যার, প্রত্যেকটা বেগুনি বা পেঁয়াজির গায়ে কি গ্লুটেন-ফ্রি স্ট্যাম্প মারা পসিবল? বেগুনি কি আপেল? এই যে আপনি, কী যেন নাম আপনার, আপনার কথা আমি সুজনবাবুর কাছে শুনেছি, আপনি যে বইমেলায় মাইসোর পাক এনে হই হই করেন, আপনার ওই পিস পিস করা হলদে-বাদামি জিনিসগুলো দেখে কি বোঝা সম্ভব, ভেতরে কী আছে? গ্লুটেন আছে কি নেই! সুজনবাবু আমাকে বলেছেন, উনি হতাশদৃষ্টিতে একবার ওগুলোর দিকে, একবার ম্যাডামের দিকে তাকিয়ে সাব্যস্ত করেন, উনি খাবেন না।”

মাইসোর পাক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি, চেঁচাচ্ছি
আর একেনবাবুর বইতে সই করছেন বিব্রত সুজনদা

সুজনদা হতাশ হয়ে আমাদের দিকে তাকালেন। শমীতাদি মিটিমিটি হাসছেন। আমি স্মরণ করিয়ে দিলাম, আমাদের কিন্তু অন্য জিনিস নিয়ে কথা হচ্ছিল।

একেনবাবু আধহাত জিভ বের করে বললেন, “এহে, তাইতো স্যার, আপনার মূল্যবান বত্রিশটা সেকেন্ড নষ্ট হয়ে গেল। হ্যাঁ, মনে আছে, হরিণ নিয়ে কথা হচ্ছিল। সে কোন বনের হরিণ ছিল আমার মনে, আমি দেখেছিলেম তার কালো-হরিণ চোখ…”

রাগতে গিয়েও হাসি পেয়ে গেল।

একেনবাবু বলে চললেন, “হরিণ যেগুলো সুজনবাবুর বাগানে ঢোকে, সেগুলো উনি যতই বলুন বনের হরিণ, আসলে কিন্তু তা নয়, এটা আপনারা জানেন তো? আমি রীতিমতো খোঁজ নিয়ে দেখেছি ওগুলো ওঁর দক্ষিণ দিকের প্রতিবেশী জিয়াউল হকের পোষ্য এবং আমার ধারণা সুজনবাবু নিজেও তা জানেন। জিয়াউল হক পাকিস্তানি, বয়সে সুজনবাবুর চেয়ে খানিকটা ছোটই হবেন মনে হয়, তবে বহুদিন ধরে আমেরিকায় আছেন। সুজনবাবুদের এখানে আসার অনেক আগে থেকে। তাঁর ও পাশের বাড়ির মালিক জিয়াউলের বাল্যকালের স্যাঙাৎ, তাঁর নাম জুলফিকার আলি, তিনি বিশাল ভুট্টাক্ষেতের মালিক। ওর কর্নের কাস্টমার কারা জানেন, স্যার? বিখ্যাত কেলগস কোম্পানি। কেলগস কর্নফ্লেক্স খান নিশ্চয় সকালে রোজ। আমার আবার ও বস্তুটা মুখে একেবারেই রোচে না। বাঙালি মুখ, বুঝতেই পারছেন, সকাল হলেই লুচি-আলুর তরকারি, পরোটা-আলুভাজা, রাধাবল্লভী-ছোলার ডাল করতে থাকে। তো সে যাই হোক, আমার কথা ছাড়ুন। জুলফিকার আলি বুঝতেই পারছেন, এত বছর এ দেশে থেকে ভুট্টার ব্যবসা করে প্রচুর কামিয়েছেন, লোকে এখন ওঁকে জুলফিকার আলি ভুট্টা নামেই চেনে। আর সেটাই জিয়াউলের মাথাব্যথার কারণ।”

ভাস্করদা বলল, “কেন? মাথাব্যথার কারণ কেন?”
“আরে, ইয়ে স্যার, মানে লস্করবাবু-”
“ভাস্করবাবু,” আমি সংশোধন করে দিই।

“হ্যাঁ, হ্যাঁ, স্যরি, ভাস্করবাবু,” একেনবাবু বললেন, “বুঝলেন না? হিংসেয়, স্যার। পরশ্রীকাতরতা। পাকিস্তানিরা তো একেবারে ইন্ডিয়ানদের মতই, প্রতিবেশীর ভালো দুচক্ষে দেখতে পারে না। ঐ ভুট্টাক্ষেত তছনছ করার জন্যেই তো উনি হুমদো হুমদো কতগুলো হরিণ পুষেছেন। মাঝরাতে ছেড়ে দেন, হরিণগুলো জুলফিকারের ভুট্টাক্ষেতের নরম কচি কচি ভুট্টা খেয়ে দিনে দিনে ফুলতে ফুলতে হাতির মত তাগড়া হয়।”

সুজনদা মন দিয়ে শুনছেন আর মাঝেমাঝে মুচকি মুচকি হাসছেন। আমি চোখ সরু করে জিজ্ঞেস করলাম, “সত্যি? এ তো ক্রিমিনাল অফেন্স। জুলফিকার আলি জানতে পারলে তো-”

আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে একেনবাবু বললেন, “জানেন বই-কি! আপনার কি ধারণা, এই সহজ সরল জিনিসটা উনি জানবেন না? কিন্তু ওঁর ক্ষেত হচ্ছে গিয়ে মানে যাকে বলে দিগন্তপ্রসারী। এ মুড়ো থেকে ও মুড়ো চোখে দেখা যায় না। একেবারে সেই যেন আজ ধানের ক্ষেতে রৌদ্রছায়ায় ঢেউ খেলে যায় বাতাস কাহার দেশে-র মতো। এ তো আর সুজনবাবুর শখের বেগুন বা শশাবাগান নয়। সামান্য ক’টা হরিণ আর ওই ক্ষেতের কী ক্ষতি করবে? তবে একবার বোধহয় সামান্য ক্ষুব্ধ হয়ে জুলফিকার তাদের একটাকে ধরে জবাই করে নিজের হাতে মশলাপাতি সহযোগে রান্না করে জিয়াউলকে ইনভাইট করে খাইয়েছিলেন। বলেছিলেন, পারফেক্ট হালাল।”

রক্তপাতজনিত হিংসা আমার মোটে পছন্দ না। বিশেষ করে সুজনদার এই নিরিবিলি জায়গাটায় তো এটা একেবারেই মানায় না। শমীতাদিও ভুরু কুঁচকে ওঁর দিকে তাকাতে একেনবাবু আমাদের হাবভাব বুঝে বললেন, “আসলে ভুট্টা খেতে খেতে হরিণগুলোও বোর হয়ে যাচ্ছিল, স্যার। রোজ ব্রেকফাস্টে ভুট্টা, লাঞ্চে ভুট্টা, ডিনারে ভুট্টা কারও পোষায়, আপনিই বলুন স্যার? তাই মুখ বদলাতে ওরা মাঝে মাঝে ঢুকে পড়ে সুজনবাবুর বাগানে। কোনো একটা শখের কিচেন গার্ডেন গ্রুপ থেকে সুজনবাবু টিপস পেয়েছিলেন যে কলার খোসা পচিয়ে তার জল গাছের গোড়ায় দিলে নাকি সেগুলো লকলকিয়ে ওঠে। কী যেন গ্রুপটার নাম, স্যার?”

সুজনদা ছদ্ম-গাম্ভীর্য বজায় রেখে বললেন, “ব্রেথস অভ গ্রিন।”

“হ্যাঁ,” একেনবাবু বললেন, “তো সেই গ্রিনস অফ ডেপথের অ্যাডভাইস অনুযায়ী সুজনবাবু নাকে রুমাল বেঁধে কলার খোসাপচা জল ঢালতে লাগলেন শশার চারার গোড়ায়। আর ওই দুর্গন্ধের তাড়নায় সুজনবাবুর বাগানের ফুলগুলো রঙিন সাজে সেজে উঠল, নধর কচি শশাগুলো দুলতে লাগল ফাল্গুনী হাওয়ায়।”

দোদুল্যমান শশার সিম্পল হারমোনিক মোশনটা একেনবাবু এমন নিখুঁতভাবে দেখালেন যে আমি ভাবলাম প্রফেসর ক্যালকুলাস বুঝি আবার পথ হারিয়েছেন।

একেনবাবু বলে চললেন, “এই যে আপনি বললেন ক্রিমিনাল অফেন্স, কথাটা অবশ্য সত্যি, স্যার। ইন ফ্যাক্ট, একে কৃমি-নাল অফেন্স বললেও ভুল হয় না।” কী বলতে চাইছেন, তা পরিষ্কার করে বুঝিয়ে দিতে দুটোর বানানও বলে দিলেন একেনবাবু। আমি বললাম, “বুঝলাম না কিন্তু।”

একেনবাবু বললেন, “এখুনি বুঝিয়ে বলছি স্যার। এক ছুটির দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে বাগান থেকে ব্রেকফাস্টের শশা আনতে গিয়ে সুজনবাবু বাগানটাই খুঁজে পেলেন না। হতচ্ছাড়া হরিণগুলো সব কটা গাছ মুড়িয়ে খেয়ে গেছে। দক্ষিণের বাগানের জায়গাটা আনফার্নিশড ফ্ল্যাটের মত এক্কেবারে ফ্ল্যাট। ম্যাডাম তো স্যার ব্যাপার-স্যাপার দেখে ভীষণ ম্যাড, মানে রেগে গেলেন। সুজনবাবুকে পাহারায় গাফিলতির জন্যে দোষারোপ তো করলেনই, উপরন্তু নিদান দিলেন, সুজনবাবু যেন তখনই পুলিশে খবর দিয়ে এর বিহিত করার ব্যবস্থা করেন।”

সুজনদা কৌতূহলী চোখে একেনবাবুর দিকে তাকিয়ে আছেন। একেনবাবু গড়গড়িয়ে বলে চললেন, 

“সুজনবাবুর তো দিশেহারা অবস্থা। একবার শান্তিনিকেতন গিয়ে পশ্চিমবঙ্গের পুলিশকে ‘বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি’ না কী-যেন বলে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের প্রসঙ্গ তুলে খুব ধমকেছিলেন, কিন্তু এ তো স্যার আমেরিকার পুলিশ, এরা পলিটিক্যাল সায়েন্স কিচ্ছু বোঝে না। এদের ভয় দেখাতে গেলে উলটো ফল হতে পারে। উপায় না পেয়ে সুজনবাবু বাড়ি ছেড়ে হাঁটতে হাঁটতে কী-করা-যায় ভাবতে ভাবতে কখন যে পারিবারিক বন্ধু কাম ফ্যামিলি ফিজিসিয়ান ডক্টর হাজরার চেম্বারে ঢুকে গেছেন, বুঝতেই পারেননি। উদভ্রান্ত সুজনবাবুকে দেখে ডক্টর হাজরা বললেন, ‘ব্যাপার কী দাশগুপ্ত? নতুন কোনো সমস্যায় পড়েছ মনে হচ্ছে।’ 

‘সুজনবাবু উদাস ভঙ্গিতে বললেন, ‘আর বোলো না। জিয়ার ডিয়ার…’

”জিয়ার্ডিয়ার? কৃমির সমস্যা?’ এইটুকু শুনেই-” একেনবাবু আমাদের বলে চললেন, “সেই যে ডক্টর হাজরা সুজনবাবুকে ডি-ওয়ার্মিঙের কী একটা ভুলভাল পেডিয়াট্রিক ওষুধ দিলেন, সেই খেয়েই তো ওঁর গ্লুটেনে অ্যালার্জি ধরে গেল! ঠিক বলছি না, স্যার? সমস্ত কিছুর মধ্যে এখন গ্লুটেন খুঁজে বেড়ান। নইলে এককালে যাদবপুর ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাস কাঁপিয়ে মিলনদার ক্যান্টিনের ঢপের চপ সাঁটিয়ে এখন সামান্য মাইসোর পাক দেখলে কেউ আঁতকে ওঠে, রুস্তমবাবু?’

                             —————————————————-

সুজনদা ছিলেন আমাদের অভিভাবক। সুজনদার সঙ্গে বইমেলায় মাত্র কয়েকবারই সাক্ষাৎ হয়েছে। মেসেঞ্জারে আর ফোনে কথাবার্তা হয়েছে অনেকবার। অনেক বিষয়ে। ‘অবসর’ পত্রিকার জন্য লেখা দিতে বলেছেন। লেখা হচ্ছে না বললে কারণ জানতে চেয়েছেন, উৎসাহ দিয়েছেন। কয়েকটা প্রচলিত শব্দের বানান আর ব্যুৎপত্তি জিজ্ঞেস করেছেন এই ভেবে যে আমি বোধহয় সেগুলো নির্ভুল জানি। অনেক ব্যাপারে পরামর্শ দিয়েছেন। সুজনদা স্বভাবমিশুক, প্রাণোচ্ছল। তাঁর ব্যক্তিত্ব এমন যে সকলের সঙ্গে সমানভাবে মিশে যেতে পারেন। এবং ফোনে হোক বা সামনাসামনি, সুজনদার গল্প বলার ভঙ্গি এমন মাধুর্যময় যে কোথা দিয়ে সময় চলে যায়, বোঝাই যায় না।

 শেষ কথা হয়েছিল এবার দেশে আসার ঠিক আগে। বলেছিলেন, কলকাতা বইমেলা এলে আমাদের বাড়িতে এসো। বসে বসে আড্ডা দেওয়া যাবে।  সে সুযোগ হ’ল না, তার আগেই সুজনদা চলে গেলেন।

 এখনও চোখ বুজলে সুজনদাকে দেখতে পাই, শুনতে পাই তাঁর কণ্ঠস্বর। ঠিক আগের মতোই সুজনদা – বিন্দুমাত্র অনুযোগ না করে – বলছেন, “দু’জন পাগল মিলে আমরা এই পত্রিকাটা শুরু করেছিলাম, বুঝলে? সুমিতদা আর আমি। তেমন কোনো উদ্দেশ্য ছিল না, এখনও নেই। কিন্তু একে চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যে আমাদের আরও পাগল চাই। তুমি তো মাঝেমধ্যে পাগলামি করতে পছন্দ কর, তাই না?”

 শুনে আমি মাইক্রোসফট ওয়ার্ড ফাইল খুলে বসি। টাইপ করতে থাকি মনে যা আসে…  

বইমেলাতে সুজনদা ও শেখরবাবুর সঙ্গে
সমীর ভট্টাচার্য ও সুজন দাশগুপ্ত, বাংলা ওয়েব ম্যাগাজিনের দুই পথিকৃতের সঙ্গে
আমার ও ভাস্করদার মাঝে সুজনদা
ব্যাঙ্গালোরের বাসিন্দা। পেশায় গবেষক, নেশায় pun-দোষ আছে। আদতে রসায়নের ছাত্র, কিন্তু শখ ইতিহাসের বইপত্তর ঘাঁটাঘাঁটি করা আর ছড়া লেখা। ‘হাফ সেঞ্চুরির পর’ নামে একটা ছড়ার বই আছে। সংস্কৃত ছন্দ, রবি ঠাকুর, ভারতীয় দর্শনে বৈজ্ঞানিক উপাদান – এইসব নিয়ে চর্চার বিশেষ শখ। নিয়মিত লেখেন পরবাস, ম্যাজিক ল্যাম্প, জয়ঢাকের মত ওয়েব ম্যাগাজিনে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *