সোনার মেয়ে দিব্যাংশী
এই নষ্ট সময়ে যখন মিডিয়াগুলো সস্তা চটুল খবর গেলানোর অসুস্থ প্রতিযোগিতায় মত্ত তখন দুর্ভাগ্যজনক ভাবে ভালো খবরগুলো প্রচারের আলো পায় না। নাহলে এই চৌদ্দ বছরের মেয়েটি যে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে দেশের মুখ উজ্জ্বল করেছে সে অবহেলার শিকার হতে পারত না।
দিব্যাংশী ভৌমিক। এবছর সে তাসখন্দে (taskent) আয়োজিত এশিয়ান ইয়ুথ টেবল টেনিস চ্যাম্পিয়নশিপে অনূর্ধ্ব ১৫ বিভাগে সোনা জিতে নিয়েছে। এত বড় খবরটা দেশের কোন মিডিয়া গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করেনি। সবথেকে বড় কথা, দিব্যাংশী কোয়ার্টার ফাইনাল, সেমিফাইনাল এবং ফাইনাল—তিনটেই চিনা প্রতিযোগীকে হারিয়েছে! যে চিনকে টেবল টেনিসের পাওয়ার হাউস বলা হয়। সেমিফাইনালে ওর প্রতিযোগী ছিল দুর্দান্ত খেলোয়াড় লিউ ঝিলিং। ওই ম্যাচটা ছিল ওর অ্যাসিড টেস্ট। সাংঘাতিক লড়াই করে ও চিনা মেয়েটিকে ৪-৩ গেমের থ্রিলারে ছিটকে দিয়ে ফাইনালে ওঠে। এক্ষেত্রে ভারতের বিদেশী কোচ মাসিমো কস্তানতিনি-র অবদান অনস্বীকার্য। চিনা খেলোয়াড়দের বিরুদ্ধে খেলার স্ট্র্যাটেজি উনিই বাৎলে দিয়েছিলেন। ফাইনালে ওর বিপক্ষে ছিল চিনেরই ঝু কিহুই। ফাইনালেও আগাগোড়া চাপে রেখে ও ৪-২ (১৩-১১, ১১-৮, ৮-১১, ১২-১০, ৯-১১, ১১-৮) গেমে ম্যাচ জিতে নিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় ও সোনা জিতে নিয়ে দেশের পতাকাকে উঁচুতে তুলে ধরে দিব্যাংশী।


গত বছরেও আলজিয়ার্সে অনূর্ধ্ব ১৭-তে ও সোনা জিতেছিল। ২০২৩ সালে রূপো জিতেছিল নোভা গোর্সিয়া-তে, অনূর্ধ্ব ১৫ ওয়ার্ল্ড ইউথ চ্যাম্পিয়নশিপে।
২০১৮ সালে দিব্যাংশী টেবল টেনিস খেলা শুরু করে। তার দু বছর বাদেই কোভিড প্যান্ডেমিক এসে পড়ায় খেলায় ব্যাঘাত ঘটে। ওর বাবা রাহুল ভৌমিক ওর খেলার প্রতি আগ্রহ দেখে তখন বাড়িতেই একটা টেবল কিনে আনেন, তাতে দিব্যাংশী ওর বোন আর ওর বাবার সঙ্গে প্রতিদিন চার পাঁচ ঘণ্টা ধরে প্র্যাকটিস করত। কিন্তু যে জাতীয় প্রতিযোগিতায় ও প্রথম অংশ নেয় তাতে শুরুর দিকেই হেরে যায়। ওর বাবা ওর খেলার ভুলত্রুটির দিকগুলো চিহ্নিত করতে সচেষ্ট হন। ওঁকে বলা হয় যে এখনো ওকে তিন চার বছর কঠোর পরিশ্রম করে যেতে হবে, তারপর হয়ত ও জাতীয় পর্যায়ে উঠতে পারবে। উনি ওর কোচকে জিজ্ঞেস করেন যে কিভাবে, কোন পথে গেলে ও উন্নতি করতে পারবে। কোচের উত্তর ছিল, এ দীর্ঘমেয়াদী ব্যাপার, তাড়াহুড়োয় কিছু হবে না।

কোচের এই উত্তর উনি বিনাবাক্যে মেনে না নিয়ে ব্যাপারটাকে নিজের হাতে তুলে নেন। উনি একটা পাওয়ার পং ওমেগা রোবট বাড়িতে নিয়ে এলেন যাতে মেয়ের খেলার উন্নতি হয়। চিনা খেলোয়াড়দের যে ব্যাপারটা উনি লক্ষ করেছিলেন, তা হলো ওদের বল কন্ট্রোল।
সুতরাং উনি সিদ্ধান্ত নিলেন দিব্যাংশীর যেখানে যেখানে দুর্বলতা আছে, রোবটটাকে সেইভাবে প্রোগ্রামিং করিয়ে সেই সেই জায়গাগুলি সংশোধন করাবেন। রোবটটাকে উনি হাই স্পিন, হাই লুপ সেটিং-এ প্রোগ্রামিং করিয়ে সেইভাবে রোবটের সাহায্যে দিব্যাংশী কঠোর মাল্টিবল প্র্যাক্টিস করেছিল যতক্ষণ না সেই বিশেষ স্ট্রোকটি নিখুঁত হয়। ফল মিলল হাতে-নাতে। তার পরের বছরেই ২০২১ সালে ও জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হয়।
অবশ্য ও একজন নয়, তিন তিনজন ফুল-টাইম কোচের সাহায্য পেয়েছে যাঁরা খেলাটির এক একটি দৃষ্টিকোণের দিক থেকে বিশেষজ্ঞ। এর পরেও উনি মেয়েকে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে বারবার বিদেশে পাঠিয়েছেন যাতে তার খেলার উন্নতি আরও ত্বরান্বিত হতে পারে।
২০২২-২৩ সালে যখন উনি বিদেশে ছ’টা আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে মেয়েকে খেলতে পাঠান তখন ওঁকে লাখ লাখ টাকা খরচ করতে হয়েছিল। টেবল টেনিস ব্যাট, বল, রাবার, জুতো ইত্যাদি বেশ দামি, এছাড়াও যাতায়াত, থাকা, খাওয়ার খরচ সব মিলিয়ে আমাদের দেশে প্রথম দিকটায়, যতক্ষণ না সে জাতীয় পর্যায়ের নজর কাড়তে পারছে ততক্ষণ পর্যন্ত প্রচুর খরচ করে যেতে হয়। ২০২৪-এর শেষের দিকে দিব্যাংশী দানি স্পোর্টস ফাউন্ডেশনের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়, যারা ওর এবং আরও কয়েকজন সম্ভাবনাময় খেলোয়াড়ের আর্থিক দায়ভার সহ সার্বিক দায়িত্ব নিয়েছে।
দিব্যাংশী মূলতঃ কোর্টের কাছে দাঁড়িয়ে ব্যাকহ্যান্ড ডিফেন্সিভ খেলা খেলে। হাঁকপাঁক করে না, ধৈর্য ধরে ডিফেন্স করে যায়, লুজ বল পেলে কিন্তু স্ম্যাশ করতে দ্বিধা করে না। ডিফেন্সিভ খেলার সুবিধের জন্য ও ব্যাকহ্যান্ডে বড় পিম্পল-যুক্ত রাবার ব্যবহার করে। এই রাবারে খেললে বলের সঙ্গে ব্যাটের ঘর্ষণ হয় যৎসামান্য, এতে বিপক্ষের পাঠানো স্পিন এই রাবারে পড়ে নির্বিষ হয়ে যায়, অনেক সময় উল্টে বিপক্ষের টেবলেই স্পিনটা ঘুরে (রিভার্স) যায়।
ওর খেলার প্রধান অস্ত্র হলো অত্যন্ত বুদ্ধিদীপ্ত প্লেসমেন্ট। ওর আচমকা ও একেবারেই অপ্রত্যাশিত প্লেসিংগুলো বিপক্ষ খেলোয়াড়কে দিশাহারা করে তোলে এবং এই দুর্দান্ত প্লেসিং-এর সাহায্যেই ও একটার পর একটা কঠিন ম্যাচ জিতে নেয়। তাসখন্দে আয়োজিত টুর্নামেন্টে সোনা জিতে দিব্যাংশী আগামী নভেম্বরে রোমানিয়ায় ওয়ার্ল্ড ইউথ টেবল টেনিস খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছে।
আমাদের সোনার মেয়েটি পরপর তিন তিনটে চিনা প্রতিযোগীকে হারিয়ে যখন এশিয়ান চ্যাম্পিয়ন হতে পেরেছে তখন বিশ্বচ্যাম্পিয়নই বা হতে পারবে না কেন? সো লেটস কিপ আওয়ার ফিংগার্স ক্রসড।