ঠাকুরবাড়ির দুর্গাপূজা

ঠাকুরবাড়ির দুর্গাপূজা

ঠাকুরবাড়ি। সে তো কেবলমাত্র একটি জমিদারবাড়ি বা বনেদিবাড়ি নয়। এই বাড়ির প্রতিটি ধুলো-বালি-ইঁট-কাঠ-পাথর-মাটিতে মিশে আছে প্রতিভা, কীর্তি আর সাফল্যের ঝলমলে ইতিহাস। উনিশ শতকের নবজাগরণে যে বাড়ির ভূমিকা অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই।
এই ঠাকুরবাড়ির অন্যতম কৃতী পুরুষ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর। নিষ্ঠাবান বৈষ্ণব এই মানুষটি নিজের হাতে প্রতিদিন গৃহদেবতা লক্ষ্মীজনার্দনশিলার পুজো-হোম-তর্পণ-জপ করতেন। বাড়ির পূজারী ব্রাহ্মণ নিযুক্ত ছিলেন শুধুমাত্র ভোগদান আর আরতির জন্য। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির জগদ্ধাত্রী ও সরস্বতী প্রতিমার খ্যাতি ছিল যথেষ্টই। ব্রাহ্মসমাজের প্রতিষ্ঠাতা ভারতপথিক রামমোহন-প্রচারিত একেশ্বরবাদে আকৃষ্ট হয়েও তাঁর পরিবারে প্রচলিত লক্ষ্মী-জনার্দন, দুর্গা, জগদ্ধাত্রী, সরস্বতীর পূজা কখনও বন্ধ করেননি। বরং পূজা হোম তর্পণ পিতৃমাতৃশ্রাদ্ধ ইত্যাদির জন্য পৃথক পুরোহিত নিয়োগ করেছিলেন। তাঁর পরিবারে বেতনভোগী ব্রাহ্মণ-পুরোহিত ছিলেন আঠারো জন।
এই পরিবারের আদি ইতিহাস অতি বিচিত্র। জোড়াসাঁকো ঠাকুর পরিবারের আদি নিবাস ছিল বাংলাদেশের যশোর জেলায়। তাঁদের পদবী ছিল কুশারী। যশোর থেকে কলকাতায় এসেছিলেন পঞ্চানন কুশারী। সমাজে কুশারীরা ছিলেন ব্রাহ্মণ। কাজেই যশোর থেকে কলকাতায় এসে ব্রাহ্মণ পঞ্চানন কুশারী সুতানুটি অঞ্চলের গঙ্গার ঘাটে ব্যবসায়ীদের পূজার্চনার কাজ শুরু করলেন। লোকমুখে তাঁর পরিচয় হয় ‘ঠাকুরমশাই’। তাঁর আদি পদবী কুশারী ক্রমশ হারিয়ে গিয়ে তাঁর নাম হয় ‘পঞ্চানন ঠাকুর’। ক্রমশ এই ‘ঠাকুর’ পদবী বহাল থাকে।
পঞ্চাননের দুই নাতি। নীলমণি এবং দর্পনারায়ণ। বিষয়সম্পত্তির বিবাদে নীলমণি ঠাকুর একদিন গৃহত্যাগ করেন। বংশের কুলদেবতা শালগ্রাম শিলা আর লক্ষ্মীর বিগ্রহ নিয়ে তিনি চলে আসেন মেছুয়াবাজারে। এটিই আজকের জোড়াসাঁকো। নীলমণি ঠাকুর জোড়াসাঁকোয় এই ঠাকুরপরিবারে আরম্ভ করলেন দুর্গাপূজা। যে পূজার আড়ম্বরের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল লোকমুখে। আর সেই পুজো রাজকীয় আকার ধারণ করে নীলমণি ঠাকুরের নাতি প্রিন্স দ্বারকানাথের সময়।
বিশাল বাড়ির প্রকান্ড ঠাকুরদালান। উল্টোরথের দিন ঠাকুরবাড়ির প্রতিমা গড়ার মাটি আসত গঙ্গার পাড় থেকে। অর্ধচন্দ্রাকৃতি একচালার মূর্তি আর সেই প্রতিমার মুখের আদল তৈরি হত দ্বারকানাথের স্ত্রী দিগম্বরী দেবীর মুখের আদলে। পুজোর ক’দিন দেবীমূর্তিকে দু’বেলা পরানো হত বেনারসি, দামি তসর কিংবা গরদ। সোনার মুকুট থেকে কোমরে সোনার চন্দ্রহার– প্রতিমার সমস্ত গয়নাই সোনার।

ঠাকুরবাড়ির প্রতিবেশি শিবকৃষ্ণ দাঁয়ের বাড়িতে প্রতিমার গায়ে থাকত বহুমূল্যের স্বর্ণ অলংকার। তখন কথিত ছিল, মা দুর্গা কৈলাস থেকে মর্ত্যে এসে জোড়াসাঁকোর দাঁ-বাড়িতে গয়না পরেন, ভোজন করেন কুমোরটুলির অভয়চরণ মিত্রের বাড়িতে আর রাত জেগে নাচ দেখেন শোভাবাজারে রাজা নবকৃষ্ণের বাড়ির মজলিসে। প্রতি বছর দ্বারকানাথের বাড়ির সামনে দিয়ে গা-ভর্তি সোনার গয়না পরে দাঁ-বাড়ির প্রতিমা যেত বিসর্জনে। যদিও সেই সব গয়না ভাসানের আগেই খুলে নেওয়া হত। দ্বারকানাথ এর যোগ্য জবাব দেবেন ঠিক করলেন। কার-টেগোর কোম্পানির মালিক প্যারিস থেকে নিয়ে এলেন বহুমূল্য ফরাসি গয়না। তারপর? দশমীর দিন সেই সব গয়না সমেত প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হল। একেই বলে আভিজাত্য।

দ্বারকানাথ ঠাকুর

জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির দুর্গাপূজার ভোগে দু’বেলাই অন্ন থেকে মিষ্টান্ন সব মিলিয়ে একান্ন রকম পদ। সঙ্গে বিভিন্ন ফল আর ডাবের জল। দর্শনার্থীরা এই প্রসাদের ভাগ পেতেন।
পুজোর তিনমাস আগে থেকেই জুতোর মাপ নিতে আসতেন চিনাম্যান, কাপড়ের পুঁটুলি নিয়ে হাজির হতেন দরজি, ছেলেদের জন্য তৈরি করতে দেওয়া হত চাপকান, জরি দেওয়া টুপি আর রেশমি রুমাল। আতরওয়ালা এসে প্রত্যেকের জন্য দিয়ে যেত এক শিশি করে আতর। তাঁতিনীর পসরায় অন্তঃপুরিকাদের জন্য নীলাম্বরী, গঙ্গাযমুনা, ঢাকাই, বেনারসির সম্ভার। পুজোর ক’দিন মেয়েরা দিনে পরতেন সোনার গয়না, রাতের সাজে থাকত জড়োয়া। খোঁপায় দেওয়ার সোনা বা রূপোর ফুল উপহার পেতেন প্রত্যেকে। আত্মীয়স্বজন, ভৃত্য, কর্মচারী প্রত্যকের জন্য বরাদ্দ ছিল নতুন জামাকাপড়, উপহার আর পার্বণী।
বিজয়া সম্মিলনীতে উন্মুক্ত ঠাকুরদালানে বসত জলসা। আতর আর গোলাপজলের গন্ধে মাতোয়ারা চারদিক। সেকালের মান্যগণ্য ওস্তাদের গানে, আমোদপ্রমোদ আর সমারোহে মোহিত হতেন আমন্ত্রিত অতিথিরা। এর সঙ্গে থাকত রাজসিক খাওয়াদাওয়ার আয়োজন।
তখন সমাজের বিশিষ্টজনেরা আমন্ত্রিত হতেন এই উৎসবে। আমন্ত্রণ পত্রের নিচে স্বাক্ষর থাকত দ্বারকানাথের পিতা রামমণি ঠাকুরের নাম।
১৮৩৮ সাল। বারো বছরের বালক দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরবাড়ির দুর্গাপূজার আমন্ত্রণ জানাতে গেলেন রামমোহন রায়ের কাছে।

দেবেন্দ্রনাথ লিখছেন, “আমাদের বাটীতে দুর্গাপূজা উপলক্ষে আমি একবার রাজাকে নিমন্ত্রণ করিতে গিয়াছিলাম। আমি আমার পিতামহের প্রতিনিধি স্বরূপ হইয়া গিয়াছিলাম। চলিত প্রণালী অনুসারে আমি রাজাকে বলিলাম, ‘রামমণি ঠাকুরের বাড়িতে আপনার দুর্গোৎসবের নিমন্ত্রণ।’
রাজা ব্যগ্রভাবে উত্তর করিলেন, ‘আমাকে পূজায় নিমন্ত্রণ?’

প্রতিমাপূজায় অবিশ্বাসী, পৌত্তলিকতা বিরোধী এবং সমালোচক রাজা রামমোহন রায়ের এই বিস্ময় পরবর্তীকালে উপলব্ধি করেছেন দেবেন্দ্রনাথ। রামমোহনের অনুগামী হয়ে তিনিও সংকল্প করেছেন, “কোন প্রতিমাকে পূজা করিব না, কোন প্রতিমাকে প্রণাম করিব না, কোন পৌত্তলিক পূজায় নিমন্ত্রণ গ্রহণ করিব না।”

দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর
রাজা রাম_মোহন_রায়
রাজা রামমোহন রায়

দেবেন্দ্রনাথ ভাইদের নিয়ে একটি পৌত্তলিকতা বিরোধী দল তৈরি করলেন। তাঁদের সঙ্গে প্রতিজ্ঞা করলেন, “পূজার সময়ে আমরা পূজার দালানে খই যাইব না। যদি কেহ যাই, তবে প্রতিমাকে প্রণাম করিব না। তখন সন্ধ্যাকালে আরতির সময় আমার পিতা দালানে যাইতেন। সুতরাং তাঁহার ভয়ে আমাদেরও তখন সেখানে যাইতে হইত। কিন্তু প্রণামের সময় যখন সকলে ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করিত, আমরা তখন দাঁড়াইয়া থাকিতাম। আমরা প্রণাম করিলাম কিনা, কেহই দেখিতে পাইত না।”

১৮৩৯ সালের ৬ অক্টোবর। একুশে আশ্বিন। জোড়াসাঁকো বাড়িতে আয়োজন চলছে দুর্গাপূজার। বাইশ বছরের যুবক দেবেন্দ্রনাথ এসব থেকে বিচ্ছিন্ন, নিস্পৃহ, নিরাসক্ত। বাড়ির অন্য প্রান্তে একটি ছোট্ট ঘরে তিনি বসে আছেন অল্প কয়েকজন ঘনিষ্ঠ আত্মীয় বন্ধুবান্ধব নিয়ে। সেখানে নিজে তিনি ব্যাখ্যা করছেন কঠোপনিষদের শ্লোক। সেইদিন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ‘তত্ত্ববোধিনী সভা।’
ধীরে ধীরে বাড়ির পৌত্তলিক অনুষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ ছিন্ন করেন দেবেন্দ্রনাথ। প্রতি বছর দুর্গাপূজার সময় তিনি থাকতেন কলকাতার বাইরে। ছোটভাই নগেন্দ্রনাথ যখন দীর্ঘ বিলেত প্রবাসের পরে স্বদেশে ফিরেছেন, তাঁর উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হতে লাগল দুর্গাপূজা। বিচ্ছিন্ন হয়ে রইলেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ। নগেন্দ্রনাথ তাঁকে বলেছিলেন, “দুর্গোৎসব আমাদের সমাজবন্ধন, বন্ধু-মিলন ও সকলের সঙ্গে সদ্ভাব স্থাপনের একটি উৎকৃষ্ট ও প্রশস্ত উপায়। ইহার উপরে হস্তক্ষেপ করা উচিত হয় না। করিলে সকলের মনে আঘাত লাগিবে।”
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গেও বাংলাদেশের এই উৎসবের কোনও প্রত্যক্ষ যোগাযোগ গড়ে ওঠেনি। তবুও যোগ না থাকলেও উৎসবের আনন্দ তাঁর মনকে স্পর্শ করেছে।

শিলাইদহতে ঠিক পুজোর আগেই জমিদারি কুঠিবাড়ির জানালায় বসে রবীন্দ্রনাথ দেখছেন দুটি একটি করে নৌকা ঘাটে এসে লাগছে। তার থেকে নামছেন প্রবাসীরা। তাদের সঙ্গে বাক্স প্যাঁটরা পোঁটলা পুঁটলি বোঝাই নানান উপহার।
১৮৯৪ সালের ৫ অক্টোবর ভাইঝি ইন্দিরা দেবী চৌধুরাণীকে কলকাতা থেকে এক চিঠিতে লিখছেন,

শিলাইদহতে নদীঘাট

“ঘরে ঘরে সমস্ত দেশের লোকের মনে যখন একটা আনন্দের হিল্লোল প্রবাহিত হচ্ছে তখন তাদের সঙ্গে সামাজিক বিচ্ছেদ থাকা সত্ত্বেও সে আনন্দ মনকে স্পর্শ করে…। … সমস্ত বাংলাদেশের লোক যাকে উপলক্ষ করে আনন্দে ভক্তিতে প্লাবিত হয়ে উঠেছে, তাকে আমি মাটির পুতুল বলে যদি দেখি তবে তাতে কেবল আমারই ভাবের অভাব প্রকাশ পায়।”       

ঋণঃ

দুর্গাপূজা- তিন পুরুষের চোখেঃ পূর্ণানন্দ চট্টোপাধ্যায়– “রবীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথ”_ আনন্দ পাবলিশার্স – পৃষ্ঠা ২০৮
• আত্মজীবনীঃ মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর
• অনুপূর্বা রায়— জয়ঢাক ওয়েবজিন, ২০১৬
প্রাণীবিদ্যায় স্নাতকোত্তর, ফ্রেশ ওয়াটার ইকোলোজিতে গবেষণা করে ডক্টরেট পেয়েছেন। কর্মসূত্রে আজকাল, আবার যুগান্তর, খবর ৩৬৫ ও অন্যান্য অনেক পত্রপত্রিকার নিয়মিত ফিচার ও কভারস্টোরি লিখে থাকেন। গল্প লেখা তাঁর প্যাশন| প্রথম সারির পত্রিকাগুলিতে নিয়মিত লেখিকা। দুটি গল্প সংকলন, গবেষণাঋদ্ধ বই, ফিচার সংকলন প্রকাশিত হয়েছে। আকাশবাণী কলকাতার বাংলা অনুষ্ঠানের উপস্থাপিকা, দূরদর্শনের ভয়েস ওভার আর্টিস্ট। বিভিন্ন রেডিও চ্যানেলে নিয়মিত বাংলাসাহিত্যের বিখ্যাত ছোটগল্প-পাঠের অনুষ্ঠান, অডিও প্রজেক্ট করে থাকেন। প্রকাশিত সিডি "জগতে তুমি রাজা"। এছাড়াও ইউটিউবে তাঁর "এবং রবীন্দ্রনাথ" নামে ধারাবাহিক গবেষণামূলক সব অনুষ্ঠানের লিংক পাওয়া যায়।

10 Comments

Avarage Rating:
  • 0 / 10
  • অনিন্দিতা বসু , October 15, 2021 @ 7:11 pm

    খুব ভাল লাগল লেখাটি।

  • Debolina mukherjee , October 16, 2021 @ 3:50 am

    Khub bhalo laglo💖💖

  • উমা ব্যানার্জী , October 16, 2021 @ 4:13 am

    অনবদ্য। এ লেখার মন্তব্য লেখার মতো শিক্ষা,দক্ষতা কোনটাই আমার নেই।
    তবে আরও এরকম অজানা তথ্য জানবার জন্য অপেক্ষায় র‌‌ইলাম।

  • Ishani , October 16, 2021 @ 6:40 am

    ভালো লাগল।

  • Kakoli Chatterjee , October 16, 2021 @ 12:56 pm

    খুব ভালো লাগলো পড়ে…

  • যুগান্তর মিত্র , October 16, 2021 @ 6:46 pm

    ভীষণ ভালো লেখা। কত অজানা দিক জানা হল। ধন্যবাদ শ্যামলী।

  • Purbasa , October 17, 2021 @ 2:36 pm

    Koto notun kichhu janlam.. mone holo khub taratari shesh hoye gelo lekhata.. aro chai..

  • Pushpita Samajdar , October 17, 2021 @ 3:54 pm

    ঋদ্ধ হলাম লেখা টি পড়ে। কিছু জানা তথ্যের সঙ্গে অনেক অজানা তথ্য ও জানতে পারলাম।

  • Krishna Roy , October 18, 2021 @ 3:49 am

    খুব ভালো লাগলো শ্যামলী লেখাটা… তথ্যমূলক, সহজ সরল

  • ইলা বেরা , October 19, 2021 @ 2:14 am

    ভালো কাটল বেশ কিছুটা সময় কিছু ভালো পড়ে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *