একেন্দ্রনাথ সেন
সুজনদা প্রয়াত হবার পর বেশ কিছুদিন কেটে গেছে। এখন আর তাঁকে সেভাবে মনে রাখেনি। কালের নিয়মই তাই।
সুজনদা নিয়ে বলার আগে ‘একেনবাবু’ নিয়ে কিছু বলার প্রয়োজন। বইয়ে যেভাবে একেনবাবুর পরিচিতি আছে, ওয়েব সিরিজের প্রভাব নেই এতে।
একেন্দ্রনাথ সেন
কিপটে আর বোকাসোকা চেহারার একেনবাবু যে গোয়েন্দা এটা ভাবাই মুশকিল। ফেলুদা, কিরীটী বা ব্যোমকেশের মত স্মার্ট নন। তিনি আবার কলকাতা পুলিশ থেকে অ্যামেরিকায় ট্রেনিং নিতে গিয়ে, ওখানেও গোয়েন্দাগিরি করে টু পাইস কামান। গল্পগুলোতে ম্যানহাটানের নিখুঁত বর্ণনা পড়ে মুগ্ধ হবেন যে কেউ।
পূর্ব পরিচিতির সূত্রে একেনবাবু থাকেন প্রমথ এবং বাপির সাথে। প্রমথ Chemistry নিয়ে গবেষণা করে আর বাপি নিউ ইয়র্কের কলেজে ফিজিক্স পড়ায়। দু’জনেই যোগ্য ব্যাচেলর কিন্তু বিয়ে করার জন্য কোনো চাড় নেই। বাপী বাবু লিখে রাখেন একেনবাবুর কীর্তিকলাপ।
একেনবাবু বিবাহিত কিন্তু “পরিবার” কলকাতায় থাকেন। কবে কোলকাতা থেকে অ্যামেরিকা নিয়ে আসবেন – এই প্রশ্নের উত্তরে একেনবাবু ভদ্রলোকের এক কথার মত বলেন – “নেক্সট্ ইয়ার!” যদিও সেই নেক্সট ইয়ার কবে আসবে – ভগা ন জানন্তি।
একেন গিন্নি রাঁধেন ভালো – তবু যেতে পারেন না নিউ ইয়র্কে। যদিও খাদ্যপ্রীতি নেই একেনবাবুর।
সৌন্দর্যের পরীক্ষায় একেনবাবুকে পাশ করাতে গেলে প্রচুর গ্রেস মার্ক্স দিতে হবে। বেঁটে, টিংটিঙে চোয়াড়ে টাইপের চেহারা। চুলগুলো উসকোখুসকো, খাড়া খাড়া। জামাকাপড়গুলোর কোনোটার সঙ্গে কোনোটার সামঞ্জস্য নেই। একমাত্র যা মিল, সেটা হল সবক’টাই কোঁচকানো আর নোংরা। সবকিছু মিলে নিদারুণ আনইম্প্রেসিভ চেহারা। তার ওপর অফুরন্ত বাজে বকেন, আর লোকদের উলটোপালটা প্রশ্ন করে নানান সমস্যার সৃষ্টি করেন। এরকম একটি লোকের সঙ্গে কেন বাপী আর প্রমথ থাকে তা নিয়ে মাঝেমাঝেই নিজেদের মধ্যে গবেষণা করে।
গবেষণাটা অবশ্য মজা করার জন্যেই, কারণ, এই একবছরেই একেনবাবুর সত্যিকারের মূল্যটা ওরা বেশ বুঝে গেছে। এরকম একজন ক্ষুরধার ডিটেকটিভ সারা নিউ ইয়র্ক শহরে আর একজনও আছেন কি না সন্দেহ।
তবে গোয়েন্দাগিরি করতে একেনবাবু নিউ ইয়র্কে আসেননি। এসেছেন নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটিতে ক্রিমিনোলজির ওপর রিসার্চ করতে। যাই হোক – একেন বাবু সকলকেই ‘স্যার’ বা ‘ম্যাডাম’ বলেন আর ‘আপনি’ ছাড়া কথা বলেন না। ম্যানহ্যাটানের মুনস্টোন মিস্ট্রির রহস্যভেদ করতে সাহায্য করায় – নিউ ইয়র্ক পুলিশের ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টসাহেব একেনবাবুকে পছন্দ করেন। রিসার্চেই বেশির ভাগ সময় চলে যায় – তবে কেউ কেস নিয়ে এলে তাদের ফিরিয়ে দিতে পারেন না।
বাপিবাবু এই কেসগুলো নিয়ে পত্র-পত্রিকায় লেখেন বলে শুনেছেন একেনবাবু। কয়েকটা বইও নাকি ছাপিয়েছেন। প্রমথবাবুর ধারণা সেগুলোর একটা কপিও বিক্রি হয় নি। কথাটা সত্যি কিনা জানা নাই, তবে বাপিবাবুর এত পরিশ্রম নষ্ট হচ্ছে ভাবতে খারাপ লাগে তো বটেই। এ নিয়ে বাপিবাবু অবশ্য কোনো আলোচনা করতে চান না।
এবার একেনবাবু কলকাতায় এসেছেন, কিন্তু আমার ফোন আর তুলছেন না। গতবার বইমেলায় অল্পক্ষণের জন্য বইমেলায় এসেছিলেন একেনবাবু। তখন, ওনার পয়সায় মেনকা সিনেমার কাছে – মিলনী কাফেতে মোগলাই পরোটা খেতে চেয়েছিলাম, নিদেন পক্ষে একেন গিন্নির হাতে কুচো নিমকি। এটাই হয়তো কারণ ফোন না তোলার কারণ।
তবে, বাপিবাবুর বিরুদ্ধে মানহানির মোকদ্দমা করবেন একেনবাবু। বাপিবাবু নাকি ইচ্ছেমত একেনবাবু কী ভাবছেন চিন্তা করছেন সেগুলো বইয়ে ঢুকিয়েছেন।
======
এই বইটার ষষ্ঠ খণ্ড প্রকাশ করছে – ‘দ্য কাফে টেবল’, কোলকাতা বইমেলা ২০২৩এ।
“ওরাও কেস খাবে – বলেছেন”, একেন বাবু। খণ্ডগুলো যে শেষ, সেটা প্রমথ আর একেনবাবু বিশ্বাস করেন না। কেসাকেসির মধ্যে আমি নেই। তাই জানিয়ে রাখলাম। (একেনবাবু আমায় ফাঁসালে – আমি কিন্তু আপনার পয়সায় মোগলাই খাবো)। ও! একটা কথা বলা হয় নি – একেন গিন্নি উবাচ, একেনবাবু ‘ঘোড়ার ডিমে’র রিসার্চ করেন। নিজের কানে শোনা।
জবাবে সুজনদাকে লিখেছিলাম- ‘একেনবাবুর দুটো ওয়েব সিরিজ দেখেছি। সিনেমা দেখা হয়নি, শারীরিক সমস্যার জন্য। অনির্বাণবাবু চমৎকার অভিনেতা, কিন্তু বইয়ের একেনবাবুর সাথে একেবারেই মিল নেই। হতে পারে চিত্রনাট্যকার এটা চাননি। তাই পাঠক হিসেবে হতাশ।’
এক পাঠক লিখেছেন, ‘অনির্বাণবাবুর একেনবাবু পর্দায় আসার আগে অন্য রেফারেন্স পয়েন্ট ছিল না, সবার কাছে এটাই এখন benchmark হয়ে গেছে! Producer যদি বুক authentic কোনও look দিয়ে নতুন একেনবাবু আনেন, দেখুন কেমন backlash হয়!’ আমরা এরকম আগেও দেখেছি।
‘দ্য কাফে টেবিলে’র প্রথম একেনবাবু প্রকাশের পর যে চুক্তিপত্র হয় তা হয়েছিল আমার বাড়িতেই। তারপরে এক চিঠিতে সুজনদাকে জানিয়েছিলাম আমার সকৃতজ্ঞ মুগ্ধতার কথা। পাঠকদের সুবিধার্থে সেটাই তুলে দিলাম।
শ্রদ্ধেয় সুজনদা,
আজ যখন আপনি, ‘আসি রামকৃষ্ণ!’ বললেন – তখন কেন যেন আমার চোখে জল চলে এসেছিল।
আমার খুব কাছের লোক ছিলেন, প্রয়াত সমীর সান্যাল এবং প্রয়াত জোৎস্নাময় দাশগুপ্ত। এঁদেরই জন্য, আমার মত এক শিক্ষাদীক্ষাহীন লোক, দুটো পেটের ভাত যোগাড় করতে পেরেছিল, ওষুধ বেচে। আপনার নিরহংকার পাণ্ডিত্য, সাধারণ চালচলনে আমি মুগ্ধ।
প্রণাম, আমি কাউকে চট করে করি না, তবু মনে হলো আপনাকে প্রণাম করা উচিত। শুনেছি, প্রণাম করলে তাঁদের ভালো গুণগুলো নাকি চলে আসে প্রণামকারীর কাছে। আপনি হচ্ছেন সেই লোক, যিনি একটা রিংয়ের পর ফোন তুললে যে আনন্দ হয়, সেই আনন্দ দিতে সক্ষম। আমি ভালো করেই জানি, আপনার বই ছাপানোর জন্য, এই বাংলায়- অনেক বড় এবং নামী প্রকাশক মুখিয়ে ছিলেন। তবু, আমাকে না চিনেই – সাক্ষাৎ না দেখে, শুধু মাত্র অবসর ওয়েবজিনের একজন ক্ষুদ্র এবং সামান্য কলমচির অনুরোধমত, আপনি – দ্য কাফে টেবলকে বই প্রকাশের অনুমতি দেন।
তারপর এলো, সেই মাহেন্দ্রক্ষণ- সেই তেসরা ডিসেম্বর ২০১৬, বেলা তিনটে। আপনি চুক্তিপত্রে দ্বিধাহীন ভাবে সই করলেন, অভিষেক আর অরিজিৎদের সাথে। অজানা, অচেনা – আমাদের তিনজনকে আপনি বিশ্বাস করে, কৃতজ্ঞতা পাশে বেঁধে নিলেন। অভিষেক আর অরিজিৎকে দেখেছি- কি ভাবে প্রাণপণ খেটেছে আপনার বই নিয়ে।
যদিও ওরা ওদের সব বইয়ের ক্ষেত্রেই তাদের খাটনি উজাড় করে দিয়েছে। তাই, আপনাকে টিম কাফে টেবলের একজন হিসেবে পেয়ে, তারা যখন উৎফুল্ল- আমার আনন্দ বাঁধনছাড়া হয়ে পড়েছে।
আপনি আবার মার্কিনমুলুক চলে যাবেন, রেখে গেলেন আমার মত অজস্র গুণমুগ্ধ।
আমার বইতে যখন আমার অটোগ্রাফ চাইলেন, তখন একেনবাবুর মত লিখে দিলাম- কি যে বলেন স্যার, আপনাকে অটোগ্রাফ দেবো আমি?
ভালো থাকবেন স্যার। আবার সাত মাস পর দেখা হবে, ততদিন এই আনন্দকে ছোটবেলার লজেঞ্চুসের মত চুষেচুষে খাবো, যতক্ষণ না ফের দেখা হচ্ছে।
বৌদিকে আমার প্রণাম দেবেন।
ভবদীয়
রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য সান্যাল
যাই হোক এর বেশি লিখতে পারলাম না। অভিনেতা বিকাশ রায়ের পুত্র সুমিত রায়ের আর সুজনদার বিশাল ভাণ্ডারের কি হবে জানি না। আশাকরি সুজনদা যাঁদের হাতে দায়িত্ব দিয়েছেন তাঁরা বাঁচিয়ে রাখবেন এটিকে।
1 Comment