“জঙ্গলে জ্যান্ত পাথর” – একটি মুগ্ধপাঠ

“জঙ্গলে জ্যান্ত পাথর” – একটি মুগ্ধপাঠ

বইঃ জঙ্গলে জ্যান্ত পাথর
লেখকঃ ত্রিদিবকুমার চট্যোপাধ্যায়
প্রকাশকঃ পত্রভারতী

সেই প্রভাবতী দেবী সরস্বতী, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে হেমেন্দ্রকুমার, স্বপনকুমার হয়ে সুনীল-শীর্ষেন্দু। বাংলাসাহিত্যে অ্যাডভেঞ্চার বা কিশোর থ্রিলার গল্পের উজ্জ্বল উপস্থিতি দশকের পর দশক ধরে। এই ট্রাডিশনেই এক সুপরিচিত নাম জগুমামা ও টুকলু জুটি। তাঁদের আরেকটি সার্থক অভিযান নিয়েই এই রিভিউ। ব্যোমকেশ, ফেলুদা, কাকাবাবু, পরবর্তী এই বছরগুলিতে বাংলাসাহিত্যের অ্যাডভেঞ্চার জগতে ক্রমশ বেড়ে ওঠা শূন্যতাকে পূর্ণ করতে যে কয়েকটি হাতে গোনা চরিত্র তাদের নিজস্বতা নিয়ে উঠে এসেছে এবং পাঠকমনে জায়গা করে নিয়েছে, তাদের মধ্যে জগুমামা ও টুকলুর গল্পগুলি অন্যতম।

বর্তমানে আলোচ্য জঙ্গলে জ্যান্ত পাথর বইটিতে দুটি অভিযানের গল্প আছে। জগুমামার অভিযানের নাম ‘জঙ্গলে ভয় ছিল।’ এখানে জগুমামা, টুকলু, সোমলতা, আর অনন্তবাবু, এই চার সিরিজ চরিত্র (অর্থাৎ জগুমামার আগের গল্পগুলিতে যাঁরা বারবার ফিরে এসেছেন) উপস্থিত হয়েছেন উত্তরবঙ্গের ডুয়ার্সে। তিতির রায় বর্মন নামের এক ভদ্রমহিলার বাবা নিরুদ্দেশ। তাঁর সন্ধানে জগুমামার এই জঙ্গল-অভিযান। কিন্তু শুধুমাত্র কিশোরপাঠ্য অ্যাডভেঞ্চারের স্বাদই নয়, এই অভিযানের সঙ্গে সাবটেক্সট হিসাবে যুক্ত হয়েছে উত্তরের রাজনৈতিক একটি গোষ্ঠীর রেফারেন্সও। সাবটেক্সট অর্থে এখানে মূল অ্যাডভেঞ্চারের সঙ্গে সমান্তরালভাবে যে রাজনৈতিক পটভূমিকার কাহিনি বহমান সেটিরই উল্লেখ করা হচ্ছে।

তিতিরের বাবা বিজ্ঞানী আনন্দ রায় বর্মন, যিনি জীবজগতের উপর বিদ্যুতের প্রভাব নিয়ে গবেষণা করছিলেন। তাঁকে হঠাৎ কি সত্যিকারেরই কিছু তথাকথিত জঙ্গি বন্দি করল? ঠিক কী নিয়ে রিসার্চ করছিলেন আনন্দবাবু? জগুমামা প্রাণ বাজি রেখে ছোটেন জঙ্গলে যেখানে একটা সাংঘাতিক দুর্ঘটনা ঘটে। রাতের আঁধারে কিছু অদ্ভুত প্রাণী আক্রমণ করে তাঁদের, যাদের ছায়াশরীর থেকে বেরোয় আশ্চর্য্য ভয়াল গন্ধ। কী হলো এরপর? কীভাবে জগুমামা আর তাঁর সঙ্গীরা সন্ধান পাবেন তিতিরের বাবার? গোটা ঘটনার সাথে কি যোগ আছে বায়োলজিক্যাল ওয়ারের? জানতে হলে পড়তেই হবে “জঙ্গলে ভয় ছিল।”

জগুমামার দ্বিতীয় অভিযানের নাম “জ্যান্ত পাথর! তারপর…।” এ গল্পের প্লট দেশে নয়। রাশিয়ায়! দিপালী ও তার স্বামী ফিওডরের পরিবারে ঘটে যাওয়া এক দুর্ঘটনার তদন্তে যান জগুমামা। জগুমামার শিক্ষক সত্যপ্রিয়বাবুর ডাকে সাড়া দিয়ে, তাঁর মেয়ে কুকুরের কামড়ে গুরুতর আহত ফিওডরের বাবার মস্তিষ্কবিভ্রাট ও মৃত্যুর সঠিক ব্যাখ্যার খোঁজে বিপদের মুখে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ফিওডরের ডাচা বা খামারবাড়িতে রয়েছে একটি বিশেষ তালাবন্ধ কিউরিও রুম, যার মধ্যে আটকে আছে কয়েকশত বছরের ইতিহাস। এই গল্পটির বিশেষত্ব হলো গল্পটিতে অ্যাডভেঞ্চার জড়িয়ে গেছে ইতিহাসের সঙ্গে। রাশিয়ান এই সম্ভ্রান্ত পরিবার কীভাবে যুক্ত ভারতীয় নিজামদের সঙ্গে?

ইংরেজিতে doppelgänger বলে একটি শব্দ আছে যার আপাত অর্থ হতে পারে এক ব্যক্তির বিশেষ ধরনের যমজ যার এই পৃথিবীতে অস্তিত্ব আছে, কিন্তু সে জৈবিকভাবে সেই ব্যক্তির সাথে যুক্ত নয়। এর অতিপ্রাকৃ্ত ব্যাখ্যাও পাওয়া যায়। সেই doppelgänger মোটিফটি এই গল্পটিতে কাজে লাগানো হয়েছে। ফিওডর, যাকে জগুমামার সঙ্গী অনন্ত সরখেল একাধিকবার দেখেন এবং সন্দেহভাজন বলেই মনে করেন, সে কি সত্যিই ফিওডর? না অন্য কেউ? কীভাবে হলো ফিওডরের বাবার মৃত্যু? তাঁদের কুকুরটির গলায় কি সত্যিই এক জীবন্ত পাথর আটকে ছিল? পাথর কি জীবন্ত হয়? নাকি এও বিজ্ঞানের অশেষ ভাণ্ডারের কোন অজানিত রহস্য? জানতে, পাঠককে বইটির শেষ পাতা পর্যন্ত উল্টোতে বাধ্য করবে গল্পটি।

জগুমামার গল্পের এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো অ্যাডভেঞ্চারের সঙ্গে বিজ্ঞানের কোনো না কোনো আশ্চর্য্য তথ্য লুকিয়ে থাকে অঙ্গাঙ্গীভাবে। এটাই আজকের যুগের ভাষায় বলা যায় জগুমামার মূল আকর্ষণ! একই সঙ্গে অ্যাডভেঞ্চার ও কল্পবিজ্ঞানের কিছুটা মিশেল গল্পগুলিকে অনবদ্য করে তুলেছে। বর্তমান সংকলনের দুটি গল্প, দুটি ভিন্নতর প্রেক্ষাপটকে তুলে ধরে যা অ্যাডভেঞ্চার ধারার (genre) সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছে সামাজিক, রাজনৈতিক, ঐতিহাসিক, এবং সর্বোপরি বৈজ্ঞানিক এমন কিছু বিষয়, যা যেকোনো বয়সী পাঠকমনকে আকৃষ্ট করবে এই আশা রাখা যায়।

পরিশেষে আসা যাক ছাপা ও প্রচ্ছদ প্রসঙ্গে। প্রদীপ্ত মুখার্জির করা সামনের ঝকঝকে ইলাস্ট্রেশনটি চোখ টানে। প্রথম গল্পে জঙ্গলের মধ্যেকার একটি বিশেষ দৃশ্যের রূপায়ন রয়েছে। ব্যাকগ্রাউণ্ডে গাঢ় নীলাভ কালোয় দেখা যায় স্বয়ং জগুমামার সিল্যুয়েট। পিছনের ইলাস্ট্রেশনটিতে চার সিরিজ-চরিত্রের উপস্থিতিই লক্ষ্য করা যায় আর সেটাও দ্বিতীয় গল্পটির প্রেক্ষিতে। দুটি ছবিই অর্থবহ আর আকর্ষণীয়। পাতা ও ছাপা উচ্চমানের।

শেষ করার আগে একটিই কথা বলব – বর্তমানের অবক্ষয়ী সময়ে দাঁড়িয়ে জগুমামার মত নায়কোচিত চরিত্রের প্রয়োজনীয়তা সবসময়ই অনুভব করা যায়, যাঁরা মানুষের বিপদে তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসেন অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করেই। যদিও যাঁরা সমাজের নানা বিষয়ের তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করেন, তাঁদের মতে এই উত্তরাধুনিক, উত্তর-বিশ্বায়নের যুগে ‘হিরো’ বা নায়কদের ভূমিকা অনেকদিনই শেষ হয়ে গেছে। তবুও যতদিন সাহিত্যের এই আদর্শ চরিত্রগুলি থাকবেন তাঁরা নিঃসন্দেহে উদ্দীপিত করবেন পরবর্তী জেনারেশনকে। ততদিন পর্যন্ত পাঠকরা নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন।

 

ইংরেজী সাহিত্যের অধ্যাপিকা। কল্প-গল্পের লেখালেখি করছেন বেশ কয়েক বছর ধরে। লেখা প্রকাশিত হয়েছে “ম্যাজিক ল্যাম্প,” “জয়ঢাক,” ইত্যাদি ওয়েবজিনে। এছাড়াও থ্রিলার প্রকাশিত নভোরজ শারদ সংখ্যা, ভূতান্বেষী শারদ সংখ্যা, নবকল্লোল পত্রিকায়। লেখা প্রকাশিত “রহস্যের ৬ অধ্যায়” (অরণ্যমন প্রকাশন), “আতঙ্কের অমানিশা” (তুহিনা প্রকাশনী), “ভয়ঙ্কর বিশ” (পালক পাবলিশার্স), “হরর টাইম” (অরণ্যমন প্রকাশন), ইত্যাদি সংকলনে। শপিজেনে প্রকাশিত প্রেমের নভেলা “যক্ষের গান।”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *