কাছে যবে ছিল: সদ্য প্রয়াত বিশিষ্ট সঙ্গীতশিল্পী কৃষ্ণকুমার কুন্নথ ওরফে কে কে র উদ্দেশে শ্রদ্ধাঞ্জলি
নব্বই সালের মাঝামাঝি। কিশোর-তরুণদের মুখে মুখে তখন বাগধারার মত ঘুরছে একটা শব্দগুচ্ছ, “ইয়ে দিল মাঙ্গে মোর!” ছেলেমেয়েরা মায়ের কাছে মাংসের ঝোল চাইবার সময়ও বলছে, আবার প্রিয়জন তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে যেতে চাইলেও জানাচ্ছে, “একটু থাকো না, ইয়ে দিল মাঙ্গে মোর!”
সারা ভারত কাঁপাচ্ছে পেপসির বিজ্ঞাপন – পেপসি পিয়াসীরা তো বটেই – চিরকাল যারা থামস আপ প্রেমী, তাদের ঠোঁটেও গুণগুণ করছে পেপসির বিজ্ঞাপনের জিঙ্গলস!
সত্যি বলতে কী, বিজ্ঞাপনের ছোটো ছোটো গানগুলোকে যে জিঙ্গলস বলে, সেটা সেই যুগে একেবারেই জানা ছিল না আমার। তবে বিজ্ঞাপনের গান লোকের মুখে মুখে ফিরত সেই রেডিওর যুগ থেকেই। তারপর টেলিভিশন আসার পর দেখা আর শোনা একসঙ্গে – কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সেই গানগুলো যে কারা গাইছেন তার খোঁজ আমরা অনেকেই রাখতাম না। তাই পেপসির জিঙ্গলের গায়কও রয়ে গেলেন আমার অজানাই।
এই নব্বই এর যুগেরই আর একটি ঘটনা। সময়টা ১৯৯৬ সালের শেষের দিক। সদ্য ফিরেছি সিমলা মানালি ভ্রমণ সেরে অক্টোবর মাসে। নভেম্বরে সিনেমা হলে দেখতে গেছি সদ্য রিলিজ করা গুলজারের ছবি, ‘মাচিস।’ দুর্দান্ত গল্প, এক ঝাঁক নতুন তরুণ মুখ -সঙ্গে উপরি পাওনা সদ্য ফেলে আসা অপরূপা মানালি, মণিকরণের নয়ন ভোলানো দৃৃশ্য সেই ছবিতে। মুগ্ধ হয়ে দেখে যাচ্ছি কখনো বরফের মধ্যে, কখনো পাইনের জঙ্গলে আবার কখনো অপরূপা বিয়াসের পাশ দিয়ে যেতে যেতে একদল ঘরছাড়া তরতাজা যুবক গাইছে, “ছোড় আয়ে হাম ও গলিয়াঁ,” ইন্টারল্যুডে অপূর্ব শিস। গুগল -ইউটিউবের যুগ সেটা নয়, তাই ইচ্ছে হলেই যে গায়কদের নাম জানতে পারব সে উপায় ছিল না। সিনেমায় অবশ্যই গায়ক গায়িকার নাম থাকত, কিন্তু পরিচিত নাম ছাড়া বাকি সবই যেতাম ভুলে, ছবিতে লতা মঙ্গেশকরেরও একটা গান ছিল নায়িকা টাব্বুর লিপে, “পানি পানি রে”, বেশ হিট করেছিল সেটাও। কিন্তু ‘মাচিসে’র কথা মনে পড়লেই একটাই গান বুকের মধ্যে থেকে উঠে আসে, “ছোড় আয়ে হাম ও গলিয়াঁ!”
এরপর ১৯৯৯ সাল। কলকাতায় তখন চলছে, ‘হাম দিল দে চুকে সনম!’ এক শনিবারের দুপুরে ছ’ বছরের ছেলেকে ডাক্তারের কাছে যাচ্ছি এই ভুজুং ভাজুং দিয়ে দক্ষিণ কলকাতার নবীনা সিনেমা হলে গেছি সেই সিনেমা দেখতে।
ছায়াছবিতে পুরুষ কণ্ঠের এক বিরহের গানের আর্তিতে সব দর্শকের হৃৃদয় খান খান। মনে হচ্ছিল সমস্ত চরাচর জুড়ে প্রিয়া বিচ্ছেদের সর্বহারা আকুতির সুর আছড়ে পড়ছে উত্তাল ঢেউএর মতো।
“লুঠ গ্যায়ে হাম লুঠ গ্যায়ে তেরি প্যার মে….”
তখনও জানতাম না এই গানের গায়ক কে? এই রেঞ্জে গান গাইতে পারেন কোন প্রতিভাধর?
নয়ের দশকের গোড়া থেকে শুরু করে উত্থান ঘটেছিল এক বিরল সঙ্গীতশিল্পীর…তিনি হলেন কৃষ্ণকুমার কুন্নথ ওরফে কে কে। ঘাটের নেয়ে হয়ে যখন সোনার তরীটি বেয়ে এসেছিলেন তিনি, তখন জানতে পারিনি, আজ সেই তরণী অনেক দূরে শান্তির পারাবারে ভাসমান।
মনে হয় কেন একটু বেশি চিনিনি তাঁকে?
একটু খোঁজ করেই অবশ্য জানতে পারি এটাই ছিল তাঁর জীবনদর্শন, সেলিব্রিটি হতে চাননি কোনোদিনই। ক্যামেরাকে ছিল বড্ড ভয়। লোকে যদি চিনে ফেলে তাহলে স্বাভাবিক চলাফেরায় শুরু হবে মারাত্মক অসুবিধা, এই ভয়েই নিজেকে রাখতেন গোপনে।
ফিরে যাই কেকের কেরিয়ারের গোড়ার দিকের গাওয়া গান যা নিয়ে এই লেখা শুরু করেছিলাম: জিঙ্গলস!
একটি সাক্ষাৎকারে কে কে বলেছেন, “প্রথম জিঙ্গলটি এক মিনিটের পেয়েছিলাম। খুব ভালো ছিল গানটা। কিন্তু সময় ওই, মাত্র এক মিনিট। তার মধ্যেই গানে ইমোশন আনতে হবে, ক্রিসেন্ডো অর্থাৎ চড়ায় সুর তুলে গানে একটা চমক তোলা, সেটাও করতে হবে। পুরো প্যাকেজ নামাতে হবে এক মিনিটে। তবেই ক্লায়েন্ট খুসি, প্রোডাক্টও বিক্রি হবে হইহই করে! আর আমার কাছে চ্যালেঞ্জ যে ওই এক মিনিটে আমি যে কেমন গাইতে পারি সেটা দুনিয়াকে জানান দিয়ে যেতে হবে।”
‘মাচিস’ সিনেমার সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন বিশাল ভরদ্বাজ, কে কের বিজ্ঞাপন জগতের বন্ধু। ফিল্মে প্রথম কাজ।
‘হাম দিল দে চুকে সনম’ এই কে কের প্রথম সোলো গান। এক বুকফাটা বিরহের গানকে ঘিরে হৃদয়ের গভীরে কান্না জমাট বেঁধেছে আপামর ভারতবাসীর। আজ বুঝতে পারি সুরকার ইসমাইলের হীরে চেনার ক্ষমতা ছিল।
কলেজ ছেড়ে বেরিয়ে এসেছি তখন।
ইন্ডিপপে ঝড় তুলেছে পল আর ইয়ারো। সব কলেজ ফেস্টেই সেই সব গান উত্তাল। ভাই বোন ননদ দেওরদের মুখে মুখে সেই সব গান।
এরপর কানে এসেছে “খুদা জানে”…এই একটি গান যা কে কে র ঝুলিতে এনে দিয়েছিল পুরস্কার, অথচ গায়ক সেই পুরস্কার নিতে যাননি নিজে।
কোনটা ছেড়ে কোনটা বলি। অলভিদা, ইয়ে টাইম টু ডিস্কো র মত গানে উত্তাল যখন রেডিওর এফ এম, টেলিভিশন, রিয়ালিটি শো, আসল গায়ক তখন প্রচারের আলোর থেকে অনেক দূরে আনন্দে কাটাচ্ছেন তাঁর ব্যক্তিগত পারিবারিক জীবন।
সব শিল্পীকেই যেখানে রিয়ালিটি শো এর জাজ বা অ্যাঙ্কার হিসেবে কোনো না কোনো সময় দেখা যায়, সেখানে সারা জীবনে কেকে মাত্র একটি রিয়ালিটি শো তে এসেছিলেন জাজ হয়ে। কিন্তু তারপর থেকে আর কোনদিন নয়। রিয়ালিটি শোর এই মারাত্মক মাপের কম্পিটিশন তাঁর ঘোর অপছন্দ ছিল।
স্টেজ ছিল কেকের সবচেয়ে প্রিয় জায়গা। যে মানুষ ক্যামেরার সামনে, মিডিয়ার সামনে ভয়ে জড়সড়, সেই মানুষই স্টেজ কাঁপিয়ে বেড়াতেন।
চলেও গেলেন শেষবারের মত স্টেজে হাজার হাজার মানুষের মন গান করার ঠিক পরই।
মৃৃত্যুর পর কে কে র চেহারা এখন আমজনতার পরিচিত। এখন আমরা সবাই জানি কী কী গান গেয়েছিলেন কৃষ্ণকুমার কবে কোন অভিনেতার লিপে। অবশ্য নিজেকে আমজনতার সামনে আনা, যশের প্রচার এসব কিছুতেই এই শিল্পীর আগ্রহ ছিল না। তাঁর কণ্ঠস্বর লোকের মনে দাগ কাটছে, লোকে গুণগুণ করছে তাঁর সুর, এটাি তাঁকে পরম প্রশান্তি এনে দিত।
তাই দূরে চলে গেলেও কে কে গান চিরকাল রয়ে যাবে মনে, যেমন ছিল তাঁকে না জেনে, না চিনে।
গুলজার বোধহয় এমন মানুষের কথা ভেবেই লিখেছিলেন, “নাম গুম জায়েগা, চেহরা ইয়ে বদল জায়ে গা, মেরি আওয়াজ হো পহচান হ্যায়, গর ইয়াদ রহে!”
ছবির জন্যে কৃতজ্ঞতাস্বীকার: অন্তর্জাল।
1 Comment