চিত্রতারকা কবরী: স্মৃতিটুকু থাক
সে কত কাল আগের কথা। ক্লাস থ্রিতে পড়ি। নিতান্ত সুবোধ, ভোলাভালা বালক বলতে যা বোঝায়, আমি ছিলাম আসলে তখন তাই-ই। এরপরও কেন জানি সব স্পষ্ট মনে পড়ে…।
আমাদের পাশের মহল্লা, ‘লক্ষ্মীপুর।’ সে মহল্লার বিশাল চৌরাস্তার মাথায় গণিচাচার দোতলা বাড়ি। মুর্শিদাবাদের চর, আষাঢ়িয়াদহ নামের একটা জায়গা থেকে জ্ঞাতিগুষ্ঠি সমেত উঠে এসে চাচা এ শহরে থিতু হয়েছিলেন। রাজশাহী কোর্টে মোক্তারি করতেন। সেই পরিচয়টাই বরাবর বড় হয়ে থাকল আমাদের মাথায় আর তাই বোধহয় নিজেদের মধ্যে মোক্তার চাচা বলেই তাঁকে ডাকাডাকি করতাম। মোক্তার থেকে উকিল পদে পদোন্নতি পাবার পরেও অভ্যাসবশে সে ডাক আর বদলাতে পারিনি আমরা। বাবা-মার ভীষণ ঘনিষ্ঠ মানুষ ছিলেন এই গণিচাচা। সকাল কিম্বা সন্ধ্যার দিকে নিয়ম বেঁধে আমাদের বাড়িতে আসতেন। খুব সাহিত্যমনা ও জাঁহাবাজ আড্ডাবাজ মানুষ ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, কলকাতা… কোনো বিষয়েই তাঁর অভিজ্ঞতার কমতি ছিল না। রসালো বুলির গুলিতে একটুতেই সবাই ধরাশায়ী হতো। হাসি-মস্করার ঢেউ বয়ে যেত একটার পর একটা। আর আমরা ছোটোরা আশপাশে বসে বা দাঁড়িয়ে এ রসালাপের ভাগীদার হতাম। হয়তো গায়ের রঙ আর চেহারার কারণেই হবে, আমাকে সামনে পেলেই চাচা বলতেন, তুমি দেখতে কিন্তু পুরোই বিদেশি, সাহেবদের ছেলে হিসেবে খুব সহজেই চালানো যাবে… মনে হয় সেই ভুল ভাবনা থেকেই আমাকে প্রিন্স বলে ডাকতেন। তো, ঠিক সে সময় নিজের চাকরির মধ্যেই বাবা কষ্টেসৃষ্টে তাঁর স্বপ্নের গ্রাজুয়েশন শেষ করলেন। খুশিতে গদগদ হয়ে গণিচাচা চকচকে ছোট্ট গোল্ড মেডেল বানিয়েই শুধু আনলেন না, হলের বক্সে সিনেমা দেখানোর ঘোষণাও দিয়ে বসলেন।
সিনেমা তখন ছিল মানুষের বিনোদনের ডাকসাইটে মাধ্যম। সিনেমা হলে যাওয়ার অনেক আগে থেকেই মনটা উড়ুউড়ু করা শুরু করত। ঘুম-টুমও চলে যাওয়ার মত অবস্থা হতো সবার। যাই হোক, অবশেষে সেই কাঙ্খিত দিনটি এসে পড়ল। ইভনিং শো’তে বাবা-মা, গণিচাচার সাথে কপাল গুণে আমিও চান্স পেয়ে গেলাম।
অলকা সিনেমা হল যা আদতে ছিল রাজা প্রমথনাথ টাউন হল। আহা, সেই আনন্দধামের ভিতরে আলোআঁধারির কী অপূর্ব খেলা! রহস্যে মোড়া টানটান পরিবেশ! বক্সে এই আমার প্রথম আগমন। কেমন যেন একটা কেতাদুরস্ত ভাব নিজের মধ্যে লতিয়ে উঠছে। সামনের বিশাল পর্দা, গিজগিজে দর্শকের সার, ঢং ঢং করে বাজা মৃদু ঘণ্টা মনকে আরও উচাটন করে তুলছে।
ছবির নাম ময়নামতি। দেশসেরা রাজ্জাক-কবরী জুটির সুপার, ডুপার হিট সিনেমা। শুনেছি, একটা হলে রিলিজ হলে, মাসের পর মাস ধরে এটি চলত। একেবারে ছোট্ট বাচ্চা ছেলে আমি, কিন্তু গল্প, গান, অভিনয়ের জাদুতে সবকিছুই মনের দেয়ালে গেঁথে যেতে লাগল। শুধু আমিই নই, মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গেছি আমরা সবাই। কী আশ্চর্য, রূপালি পর্দার মেয়েটির আনন্দে হেসে উঠছে হল ভর্তি মানুষ, আবার তার দুঃখে কেঁদে চোখ ভাসাতেও সময় লাগছে না। এ যেন সবার ঘরের মেয়ে, একান্ত আপনজন!
চিত্রনায়িকা কবরীর সাথে সেই আমার প্রথম পরিচয়। মিষ্টি একটা মুখ, তার সাথে আবার চোখমুখে দুষ্টু হাসির ঝিলিক। দুমদাম করে ছোটাছুটি, দস্যিপনা। কথায় চাবুক, স্বভাবে পুরোদস্তুর বাঙালিয়ানা। একনজরেই মনে ধরে যায়। দেশের কোটি মানুষের সাথে সিনেমার ‘মিষ্টি মেয়ে’টি আমারও মন জয় করে নিল। এরপর বছরের পর বছর ধরে মেয়েটির টানে হলে ছুটে যেতে হতো। আসলে না গিয়ে উপায় থাকত না। ‘আগুন্তুক,’ ‘নীল আকাশের নীচে,’ ‘ক-খ-গ-ঘ-ঙ,’ ‘দর্পচূর্ণ,’ ‘আগুন,’ ‘বেঈমান,’ ‘সাত ভাই চম্পা,’ ‘অরুণ বরুণ কিরণমালা,’ ‘স্মৃতিটুকু থাক,’ ‘রংবাজ,’ ‘গুন্ডা,’ ‘সুজনসখী,’ ‘দেবদাস,’ ‘সারেং বৌ’ — মিছিলের মতো হয়ে যাবে সে সব লিখতে গেলে।
১৯৬৪ তে পরিচালক সুভাষ দত্তের ‘সুতরাং’ দিয়ে কবরীর যাত্রা শুরু। নতুন এ শিল্পীর বয়স তখন মাত্র তেরো বছর। তাতে কী! এমন কোমল, কচি বয়সেই বাজিমাৎ করে বসলেন কিশোরী কবরী। জনপ্রিয়তার পাশাপাশি সিনেমাটি ফ্রাংকফুটের আন্তর্জাতিক ছবিমেলা থেকে দ্বিতীয় সেরা ছবির সম্মান বয়ে আনল। স্বাধীনতার পরপর ভারত-বাংলাদেশের যৌথ প্রযোজনার ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ও তাঁর শিল্পীজীবনে নতুন একটা মাত্রা যোগ করে। পরিচালক ছিলেন ঋত্বিক ঘটক।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ তখন শুরু হয়েছে। সম্ভবত ময়নামতি ছবিটি দেখার ঠিক পরের বছরের ঘটনা। পুরো দেশ তখন পাকিস্থানি হানাদারদের হাতে অবরুদ্ধ। মানুষ আতংকে ঘেরা রুদ্ধশ্বাস এক একটা দিন কাটাচ্ছে। বর্বর পাক বাহিনীর হাতে রোজ অসংখ্য নিরীহ মানুষ মারা পড়ছে। লাখ লাখ মানুষ জীবন বাঁচাতে ঘর ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যাচ্ছে। চার চারজন সন্তানকে নিয়ে অনিশ্চিত এমন জীবন বেছে নেবার সাহস আমার অভিভাবকদের হয়নি। তাই দেশের মধ্যেই একবার শহর থেকে গ্রাম, আবার গ্রাম থেকে শহরে লুকিয়ে বেরাতে লাগলাম আমরা। খুব অসহায়, দুর্বিষহ দিনকাল। প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর আশংকা। সুযোগ পেলে, লুকিয়ে বিবিসি, আকাশবাণী শুনি সবাই। স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র তখনো চালু হয়নি।
বোধহয় মে মাসের কোনো এক সকাল হবে। কলকাতার সংবাদ পরিক্রমা অনুষ্ঠানে হঠাৎ এই প্রিয় শিল্পীর চেনা গলা ভেসে আসলো। অনুষ্ঠানস্থল কলকাতায় খোলা বাংলাদেশ সরকারের নতুন হাই কমিশন অফিস। মিডিয়ার সামনে দাঁড়িয়ে সুহাসিনী কবরী সেদিন হাসছিলেন না, কেঁদে কেঁদে বলছিলেন, কীভাবে বাবা-মা, আত্মীয় স্বজন, সকলকে ছেড়ে এক কাপড়ে দেশ ছেড়ে চলে আসতে বাধ্য হয়েছেন। দেশের ভিতরে আটকে পড়া আমাদের মত মানুষদের ভয়ানক দুর্দশা, নির্বিচার হত্যা, লুণ্ঠন, ইত্যাদি প্রসঙ্গ তুলে ভারতবাসী সমেত পুরো বিশ্ববাসীর সাহায্য কামনা করছিলেন। এসব কথা শুনতে শুনতে আমাদের চোখও জলে ভিজে উঠছে। নিয়তি মানুষকে কোথায় নিয়ে যায়… ঘরের মেয়েটি কী করে যেন অনেক দূরে ছিটকে পড়েছে! পরের মাসগুলিতে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত সৃষ্টি করতে কবরী বিভিন্ন সভা-সমিতিতে বক্তৃতা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করে বেরিয়েছেন। কলকাতায় সম্ভব না হলেও, মুম্বাইয়ের একটি সিনেমার প্রধান চরিত্রে অভিনয় করার সুযোগ পেয়েছেন। আই, এস, জোহর পরিচালিত এ সিনেমার নাম ছিল, ‘জয় বাংলাদেশ।’ অভিনয়ের পারিশ্রমিক হিসেবে পাওয়া কুড়ি হাজার টাকার অর্ধেকটাই মুক্তিযুদ্ধের তহবিলে দান করতে দেরি করেননি। এরকম অনেক ছোটবড় সব কাজ মিলিয়ে অভিনেত্রী কবরী সাদামাটা থেকে অন্যতর উচ্চতার একজন মানুষ হয়ে উঠেছিলেন।
চট্টগ্রামের মেয়ে মিনা পাল ওরফে সারাহ বেগম। ‘মিষ্টি মেয়ে’ কবরী নামেই বাংলাদেশের সিনেমা জগতে পরিচিতি পেয়েছিলেন। একাত্তর বছরের নাতিদীর্ঘ জীবনের আটান্নটি বছর কেটেছে এই রুপালি ঘরানায়। শতাধিক সিনেমার নায়িকা হিসেবে দর্শককুলের মন জয় করেছেন বারবার। জনপ্রিয়তার কারণে খুব সহজেই হয়ে উঠেছেন দেশের প্রধান তারকা, সেলুলয়েডের রানি। সুভাষ দত্তের পাশাপাশি জহীর রায়হান, নারায়ণ ঘোষ মিতা, কাজী জহীর, খান আতা, দিলীপ বিশ্বাস, আজিজুর রহমানরা ছিলেন তাঁর ছবির নির্মাতা। একটানা এই জাঁদরেল পরিচালকদের সাথে কাজ করেছেন। কুড়িয়েছেন সুনাম, যশ, স্বীকৃতি সবই। একটা সময়ে ক্যামেরার সামনে থেকে পিছনে চলে এসেছেন। অভিনয় ছেড়ে ছবি পরিচালনা, প্রযোজনায় হাত দিয়েছেন। এরপর রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে ২০০৮ সালে জাতীয় সংসদ সদস্যও নির্বাচিত হয়েছেন। মিডিয়া ও সামাজিক পরিচিতির কারণে বহু মানুষের সাথে মিশেছেন। জনপ্রিয়তার কারণে সব মহলে ছিল তাঁর অবাধ যাতায়াত। অনেক সেবাধর্মী সংগঠনের সাথে ছিলেন জড়িত। ২০১৭ সালে কবরীর লেখা ‘স্মৃতিটুকু থাক’ নামে আত্মজীবনীমূলক বই প্রকাশিত হয় যা শিল্পীর ব্যক্তিগত ও সংশ্লিষ্ট সময়কালের একটি অমূল্য দলিল হয়ে আছে। বইটি তাঁরই একটি বিখ্যাত ছবির নামে নামকরণ করা হয়। জীবন অপরাহ্ণে নতুন আরেকটি ছবির নির্মাণ কাজে হাত দিয়েছিলেন। একঝাঁক নতুন মুখ ছিল আলোছায়ার এ পথের যাত্রী। কিন্তু বলা নেই, কওয়া নেই, হঠাৎ করেই সবকিছু থেমে গেল। অনেক স্বপ্ন, অনেক শিল্পভাবনা, চলমান কাজ অসম্পূর্ণ রেখেই খ্যাতিমান দেশবরেণ্য এই শিল্পী চলে গেলেন না-ফেরার দেশে। ঘাতক ছিল সেই মারণ ব্যাধি, করোনা। আক্রান্ত হওয়ার মাত্র তেরো দিনের মাথায় সব চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে গত ১৭ এপ্রিল রাতে কবরী নামের জ্বলজ্বলে, ঝলমলে তারাটি ঝরে পড়ল ঢাকার চিত্রাঙ্গনের আকাশ থেকে৷ একান্ত অসময়ে নিরুদ্দেশের দেশে পাড়ি জমালেন।
কিছুদিন আগে বাংলাদেশের সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক, ‘প্রথম আলো’ পত্রিকার জন্য দেয়া এক দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে কবরী তাঁর জীবনের নানান অভিজ্ঞতা, ভাবনা মন খুলে বলেছিলেন। আর এটাই ছিল তাঁর সহজাত স্বভাব। রাখঢাক করে কথা বলতে পারতেন না। সেদিন এক পর্যায়ে বলেছিলেন, ‘মানুষের জীবনে অনেকগুলো দরজা থাকে। তার মধ্যে মৃত্যু হল শেষ দরজা। মৃত্যুর কথা মনে হলে আমার চোখ জলে ভরে যায়। সবাইকে ছেড়ে চিরকালের জন্য চলে যেতে হবে ভাবলেই আমার ভয় লাগে।’ অথচ জাগতিক নিয়মে সেটাই ঘটে গেল! আজ এ বাংলার গুণী শিল্পীটি আর নেই। তাঁর চোখে জল আসার প্রশ্নই আসে না। এখন আমাদের চোখ জলে ভরে যায় এক অদ্ভুত শূন্যতায়, কররীহীনতায়।
দু’তরফের দিক থেকে পাঁচ পাঁচজন পুত্রসন্তানের জননী ছিলেন কবরী। প্রতিষ্ঠিত হয়ে ওরা যে যার মত আলাদাই থাকত। নিজে থাকতেন ঢাকার অভিজাত গুলশান এলাকার একাকি অ্যাপার্টমেন্টে আর বাসার কাজের মানুষ বাদ দিলে, থাকতেন একদম একলাই। সারাক্ষণ কত মানুষ চারপাশ ঘিরে রাখত, কত জায়গায় জানাশোনা, কত আলোর ঝলকানি, তবু শেষবেলায় ছিলেন একেবারে নিঃসঙ্গ। ব্যক্তিগত আনন্দ-বেদনা সম্পর্কে কবরী বলেছিলেন, ‘ছায়াছবির জীবনে আমি অনেক আনন্দ পেয়েছি, জীবনকে উপভোগ করেছি। আনন্দ পেয়েছি বলেই তো এতদিন কাজ করেছি। তাছাড়া আনন্দ না পেলে, কষ্ট বুঝব কীভাবে?’
কবরী আমাদের শুধু কাঁদিয়েই যাননি, সঙ্গে করে নিয়ে গেছেন একান্ত ব্যক্তিগত একটি দুঃখবোধও। ওই সাক্ষাৎকারে তিনি আরও বলেছিলেন, ‘আমার একটা দুঃখ রয়ে গেল। জীবনে আমি একজন ভালো বন্ধু পেলাম না। সঙ্গ দেওয়ার মত একজন ভালো মানুষ আমি পাইনি, যাকে বলতে পারি, এসো, এক কাপ চা খাই। একটু সুখদুঃখের গল্প করি। এটাই হয়তো মানুষের জীবন।’
কী আশ্চর্য, একজন মানুষের সদাহাসি মুখের আড়ালে এত কান্না জমা থাকে, জানা ছিল না! নাকি খ্যাতির অলিন্দে দাঁড়িয়ে থাকা তারকা হয়ে ওঠা মানুষের পিছনের কাব্যটি এমনই হয়?
1 Comment