লাইব্রেরি অফ কংগ্রেস, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র

লাইব্রেরি অফ কংগ্রেস, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র

“The history of the world is the biography of great men.”
[লাইব্রেরির দেয়াল থেকে]

ওয়াশিংটন ডি.সি. (Washington DC) শহরে অবস্থিত লাইব্রেরি অফ কংগ্রেস (Library of Congress) আমেরিকার প্রাচীনতম সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ও সম্ভবত বিশ্বের বৃহত্তম গ্রন্থাগার, যা ২০০৯ সালে আমেরিকা সফরের সময় আমার দেখবার বিরল সুযোগ হয়। যদিও তারপর অনেক বছর কেটে গেছে, তবুও মনে হ’ল এই মহান প্রতিষ্ঠানের কিছু স্মৃতি নিয়ে লেখা যেতেই পারে।

প্রবেশপথ

১৮০০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি জন অ্যাডামস (John Adams) ফিলাডেলফিয়া (Philadelphia) থেকে ওয়াশিংটনে (Washington) রাজধানী স্থানান্তর করেন। সেই সময় একটা আইন পাস হয় যেখানে মার্কিন কংগ্রেসের (US Congress) জন্য একটা গ্রন্থাগারের প্রয়োজনীয়তার কথা বলা ছিল। শুরুতে ক্যাপিটল হিল (Capitol Hill) চত্বরে একটা ছোট গ্রন্থাগার তৈরি করা হয়। তবে বার দুয়েক অগ্নিকাণ্ডে সংগ্রহের বিশাল অংশ পুড়ে যায়। ১৮৬৫ সালে ক্যাপিটলের উল্টো দিকে নতুন ভবনে এই গ্রন্থাগারকে স্থানান্তরিত করা হয়।

 

লাইব্রেরি অফ কংগ্রেসের মিশন হ’ল কংগ্রেস বিধায়কদের সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে সহায়তা করা, আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়াগুলোকে অবহিত করা, জাতীয় কপিরাইট (copyright) ব্যবস্থার তত্ত্বাবধান, আমেরিকা তথা বিশ্বের ইতিহাস সংরক্ষণ এবং নথিভুক্তিকরণ। এখানে বেশ কিছু মূল্যবান ও বিরল নথিপত্র দেখেছি – যেমন বিশ্বের প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ বিখ্যাত গুটেনবার্গ বাইবেল (Gutenberg Bible), আমেরিকার সংবিধান (Constitution of America), আমেরিকান এবং বিশ্ব ইতিহাসের নানান পাণ্ডুলিপি ইত্যাদি।

লম্বা বইয়ের তাক

থমাস জেফারসন ভবনে (Thomas Jefferson Building) আমি অনেকটা সময় কাটাই। তৎকালীন লাইব্রেরিয়ান আমাকে সেই সংগ্রহশালা ঘুরে দেখান, এর ইতিহাস বর্ণনা করেন। এই জেফারসন ভবনটি কংগ্রেস ভবনের প্রথম পৃথক লাইব্রেরি এবং এটাই হল লাইব্রেরি অফ কংগ্রেসের প্রধান ভবন। ১৮৭১ সালে তৎকালীন কংগ্রেসের লাইব্রেরিয়ান আইনসওয়ার্থ র‍্যান্ড স্পফোর্ড (Ainsworth Rand Spofford) এর প্রস্তাব করেন, ১৮৮৬ সালে তা অনুমোদিত হয় এবং ১৮৯৭ সালে এর কাজ সম্পন্ন হয়। পরে এটির নামকরণ করা হয় লাইব্রেরির প্রধান প্রতিষ্ঠাতা জেফারসন-এর নামে। ১৮৫১ সালে অগ্নিকাণ্ডের পর লাইব্রেরি অফ কংগ্রেস পুনরুদ্ধারের সময় অবসরপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি জেফারসন তাঁর সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত পুস্তকসংগ্রহ এখানে দিয়ে দেন। এই সংগ্রহে নানারকম বিষয়ের বই রয়েছে যা সাধারণত আইনসভার গ্রন্থাগারে থাকে না। জেফারসন বিশ্বাস করতেন যে দেশের আইনসভার গ্রন্থাগারের জন্য সবরকম বিষয়ই গুরুত্বপূর্ণ।

গ্রন্থাগার ভবনটা এক ঐতিহ্যবাহী জাতীয় স্মৃতিস্তম্ভ এবং বলা হয় যে এটা বিশ্বের “বৃহত্তম, ব্যয়বহুল এবং নিরাপদ” লাইব্রেরি ভবন । অত্যাধুনিক কাঠামোয় তৈরী এবং পাশাপাশি একটি শিল্প মন্দিরও, যেটা “Temple of Arts” ব’লে খ্যাত । এর ভেতরে অসাধারণ সব ভাস্কর্য রয়েছে। আরো রয়েছে সোনায় মোড়ানো এক অপূর্ব সুন্দর গম্বুজ।। গম্বুজের উচ্চতা ১৯৫ ফুট এবং ২৩-ক্যারেট সোনার পাত দিয়ে মোড়ানো। মাঝখানের হলঘরে (Central Hall) মার্বেল, গ্র্যানাইট ও ব্রোঞ্জের স্তম্ভ রয়েছে। খিলানগুলো গ্রীক ও রোমান দেবতাদের ভাস্কর্য এবং মূর্তিতে উজ্জ্বল। দ্বিতীয় তলার বারান্দাটি ঘুরে দেখলাম যেখানে বিশিষ্ট মহাপুরুষদের আবক্ষ মূর্তি রয়েছে।

গ্রন্থাগারের অভ্যন্তর- চিত্র ১
গ্রন্থাগারের অভ্যন্তর- চিত্র ২
মিনার্ভার মোজাইক (Mosaic of Minerva)

এই ভবনটার এক আকর্ষণীয় দিক সম্বন্ধে আরও কিছু জেনেছিলাম।

২০০০ সালের আগে, জেফারসন ভবনে বিশেষভাবে নির্মিত এক বইয়ের সুড়ঙ্গের (Book Tunnel) মাধ্যমে ক্যাপিটল ভবনের সঙ্গে সংযুক্ত ছিল। এতে এক বৈদ্যুতিক “বই পরিবহন যন্ত্র” ছিল যা প্রতি মিনিটে ৬০০ ফুট বেগে এই দুই ভবনের মধ্যে বই আনা-নেওয়া করতে পারত। 

সেই সময়ের নিরিখে এটা বেশ উন্নত ও আধুনিক প্রযুক্তি বলা যায়।

 

 

আরেকটা আকর্ষণীয় জিনিস দেখেছিলাম, দেওয়ালে রয়েছে বিখ্যাত রোটান্ডা ঘড়ি (Rotunda Clock), ব্রোঞ্জের তৈরি, কর্তৃত্বের এক রোমান প্রতীক ।

রোটান্ডা ঘড়ি (Rotunda Clock)

এই সফরটা আমার কাছে ছিল অত্যন্ত শিক্ষণীয়, বিশেষত নথি সংরক্ষণ, প্রদর্শন, ডিজিটাইজেশন এবং পুনরুদ্ধার সংক্রান্ত বিষয়ে অনেক কিছুই জেনেছি। নলেজ ক্লাসিফিকেশন-এর (knowledge classification) জন্য যে পদ্ধতি ওখানে ব্যবহৃত হয় সেটা পরবর্তীকালে আমায় অনেক সাহায্য করেছে। সেই সময় আধুনিকতম প্রযুক্তির গ্রন্থাগারে ব্যবহার নিয়ে জেনেছি। উল্লেখযোগ্য যে এখানকার অনেক বই সেই সময়েই সম্পূর্ণভাবে ডিজিটাইজড (digitized) এবং সেগুলো সুন্দরভাবে মেশিন-রিডেবল (machine-readable) অবস্থায় দেখেছিলাম। গ্রন্থাগারটা এক কথায় বলা যায় state-of-the-art। বিশ্বের গ্রন্থাগারগুলোর ওপর লাইব্রেরি অফ কংগ্রেসের যে বিশাল প্রভাব রয়েছে তা অনস্বীকার্য।

লাইব্রেরি অফ কংগ্রেস যে আমেরিকার কত বড় ঐতিহ্য, তা এই বর্ণনাতেই স্পষ্ট:

“America is justly proud of this gorgeous and palatial monument to its National sympathy and appreciation of Literature, Science, and Art. It has been designed and executed entirely by American art and American labour and is a fitting tribute for the great thoughts of generations past, present, and to be.” (সূত্র: গাইডবুক)

ছবি:  লেখকের নিজের ক্যামেরায় তোলা

সারা জীবন কলকাতায় বাস। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম.এ. এবং যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লাইব্রেরি সায়েন্স-এ ডিগ্রি অর্জন করে তিন দশকেরও বেশি সময় ধ’রে একটি স্বনামধন্য তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থায় কর্মরত থেকে ইনফর্মেশন রিসোর্স সেন্টার-এর (IRC) প্রধান হিসেবে কর্মজীবন শেষ করেন। পেশার অংশ হিসেবে বেশ কিছু বিষয়-সংক্রান্ত দেশি-বিদেশি সম্মেলনে তাঁর একাধিক নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। ভালো লাগে ছবি আঁকা, বাগান করা, গান শোনা, বই পড়া এবং, অবশ্যই ঘুরে বেড়ানো। ভারতের নানা প্রদেশে এবং বিদেশে অনেক জায়গায় ভ্রমণ করে সম্প্রতি একটি ভ্রমণ-ব্লগ শুরু করেছেন – santraveldiaries.blogspot.com

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *