সাম্প্রতিক বাংলা কবিতায় বহুমুখী লিরিকপ্রবাহঃ মীরা মুখোপাধ্যায় ও গোলাম রসুলের কবিতা

সাম্প্রতিক বাংলা কবিতায় বহুমুখী লিরিকপ্রবাহঃ মীরা মুখোপাধ্যায় ও গোলাম রসুলের কবিতা

লিরিক্স (lyrics) কথাটা শুনলেই আমাদের মনে ভাসে গানের কথা – কিন্তু লিরিক কবিতা কাকে বলে? কথাটির উৎস গান থেকেই, লিরিক কবিতা বলতে আগে বোঝানো হত সেই পদ্য যাতে সুর দেওয়া যায় বা যা গান হিসেবে গাওয়া যায়। সেই ট্র্যাডিশন চলছে সাফোর [১] সময় থেকেই যখন উনি লাইয়ার (lyre, বীণা জাতীয় বাদ্যযন্ত্র) বাজিয়ে ওনার কবিতা গান হিসেবে গাইতেন। লিরিক কবিতার বর্তমান মানে অবশ্য গানের লিরিক্স থেকে সরে গেছে – এটাতে এখন বোঝানো হয় একটা ছোট কবিতা যাতে কোনো এক জনের ব্যক্তিগত অনুভূতির প্রকাশ পেয়েছে [২] – এই কোনো একজনটা অনেক সময়েই কবি নিজেই কিন্তু সব সময় তা নাও হতে পারে। আধুনিক লিরিক কবিতা মানে ধ্বনিসমৃদ্ধ ভাষায় একটানা আবেগ ঢেলে দেওয়া নয়, অনেক বেশি সূক্ষ্ম ও রহস্যময় এরা – পড়লে গান হিসেবে গাইবার কথা মাথাতেও আসবে না। অনেক সময়ই একটা ঘটনা দিয়ে শুরু হয় লিরিক কবিতা, বা কোনো ঘটনার ইঙ্গিত সাজিয়ে বা কবিতায় একটা বিশেষ ছবি এঁকে লিরিক কবিতা চলে, কিন্তু বর্ণনামূলক (narrative) কবিতার মত এতে পরপর ঘটনা ঘটতে থাকে না।

উদাহরণ স্বরূপ বলতে পারি, সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের “মেজাজ” একটি অসাধারণ বর্ণনামূলক কবিতা যা আবার নাটকীয়তায় ভরা, আবার অন্যদিকে ঘটনা ঘটতে থাকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের “কেউ কথা রাখেনি” কবিতায় কিন্তু এই কবিতা একবার পড়লেই বোঝা যায় এ কবিতা বাংলা লিরিক কবিতার এক অমূল্য সম্পদ। 

সাম্প্রতিক বাংলা কবিতায় উত্তর-আধুনিক, বর্ণনামূলক এবং নাটকীয় কবিতার পাশাপাশি লিরিক কবিতার বহুমুখী ধারা অব্যাহত। এই নিবন্ধে আমি দু’জন প্রতিষ্ঠিত কবির কয়েকটা কবিতা নিয়ে আলোচনা করব – সব কটা কবিতাই প্রকাশ পেয়েছে গত দু’তিন বছরের মধ্যে।

মীরা মুখোপাধ্যায়ের কবিতা

মীরা মুখোপাধ্যায় একজন আদ্যোপান্ত লিরিক কবি, ইংরেজিতে যাকে বলে “dyed in the wool” – চলুক উত্তর-আধুনিক কবিতার তোলপাড়, ঝড় আনুন স্বদেশ সেন বা বারীন ঘোষাল, তিনি লিখে যাচ্ছেন সুললিত ভাষায় তাঁর গভীর অনুভূতির কথা – ভালোবাসা আর আবেগ, বুক ভেঙে পড়া যন্ত্রণা আর অশান্তি, ব্যক্তিগত লস, এবং পাশাপাশি আনন্দ এবং নিরাশার কথা। মনে পড়ে যায় ২০২০তে নোবেল প্রাইজ পাওয়া আমেরিকান কবি লুঈজ গ্লুকের কথা (Louise Glück) – আমেরিকান কবিতার সমস্ত তোলপাড় – গিন্সবার্গ এবং কেরুয়াকের বিট কবিতা, নিউইয়র্ক স্কুলের উত্তর আধুনিক নিজস্ব ধারা, ভাষাকবিতার (language poetry) ঝড়  – সব কিছুর মধ্যেও [৩] লুঈজ গ্লুক লিখে চলেছেন অসামান্য সব লিরিক কবিতা [৪]। একমনে, একটুও না সরে নিজের বিশিষ্ট নৈপুণ্য থেকে। তেমনই মীরা মুখোপাধ্যায়ের একনিষ্ঠ ধ্যান।

ব্যক্তিগত লসের কথা বলছিলাম তাই শুনুন কয়েকটা লাইন “মার্গারেট রাধিকা গোমেজ” থেকে

বাইশ বছর ধরে শুয়ে আছো
ঠান্ডা, কালো পাথরের পাশে,

তোমার জন্মসাল মুছে গেছে, মৃত্যুর তারিখ

রাধিকা গোমেজ!
তোমাদের ধর্মে কোনো পুনর্জন্ম নেই
তাই তোমাকে ছোঁয়ার জন্য
এপিটাফে ক্লান্ত ঠোঁট রাখি
এ কবিতার আবেদন গভীর, অত্যন্ত ব্যক্তিগত, পড়ামাত্র পাঠককে ছুঁয়ে যায় করুণ বেহালাছড়ে।

আবার দেখুন এই কবিতাটি “বিবাহদ্বীপের গল্প” – এতে কবি সরাসরি জড়িয়ে নেই ঘটনার সঙ্গে, প্রায় বর্ণনামূলক, কিন্তু পড়ামাত্রই এর লিরিক আবেদন ছুঁয়ে যায় –

চাঁদের আলোর জন্য জেগে আছে অলৌকিক দ্বীপ
চাঁদ উঠলেই বিবাহ মুহূর্ত শুরু হবে…
লাল কাঁকড়ার দল নেমে গেছে জল সরে গেলে
বালির উপরে শুধু পড়ে আছে শামুকের খোলা…

সমুদ্র যেখানে এসে থমকেছে
সেখানে আলো ও জলে মাখামাখি কয়েকটি ছায়া

আজ রাতে চাঁদ উঠবে অনেক দেরিতে,
বিবাহমুহূর্ত অপেক্ষায় জেগে আছে
চাঁদের আলোর জন্য পৃথিবীর অলৌকিক দ্বীপে

মীরা মুখোপাধ্যায়ের লিরিক কবিতায় ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত সরাসরি আসে, “আশ্চর্য এগারো মিনিট” কবিতায় এইভাবে সৃষ্টির সুরে যেন –

আজ্ঞাচক্র থেকে সেই অমোঘ বার্তাটি
পিছলে এলে অকালবর্ষণ শুরু হয়।
যেখানে আলো ও ছায়া মাখামাখি,
মালহার বাজাচ্ছেন আমজাদ আলী
সৃষ্টি দাঁড়িয়ে একটু তফাতে

তুলনায় “গর্জ উইন্ড” হয়ে দাঁড়ায় “দুরদুর বক্ষের স্পন্দন, আশা নিরাশার ক্রন্দন, কারা ভেঙে দেবে বিশ্বাস” [৫]

আমরা হাঁটছিলাম,
শীর্ণ, ক্লিষ্ট ভাঙাচোরা কজন মানুষ
তীর্থযাত্রীরই মতো
যারা জানে তারা আর ফিরবে না।
দুটি খাড়া পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে পথ।
ফেলে আসা পাথরের উপত্যকা বেয়ে
শুকনো ঝাপটা আসছে বাতাসের,
বাতাস না বলে তাকে ল্যাসো বললে ঠিক হয়।
আমরা হাঁটছিলাম, এ ওকে আঁকড়ে ধরে
এই গিরিখাতটুকু পেরোলে কী দুধ ও মধুর দেশ !
আমরা হাঁটছিলাম
সুতীব্র ল্যাসোর টান অগ্রাহ্য করেও
বিবিক্ত কজন,তীর্থযাত্রীরই মতো বিষণ্ণ মানুষ

এ কবিতা পড়ে যে আমার সলিল চৌধুরীর গানের কথা মনে পড়ল, সেটাই বোধহয় মীরা মুখোপাধ্যায়ের লিরিক কবিতার সবচেয়ে বড় আবেদন।

গোলাম রসুলের কবিতা

লিরিক কবি ব্যক্তিগত জীবনে থাকতে চান, ভালোবাসা-আবেগ, জয় পরাজয়, মৃত্যু বিচ্ছেদ, আশা নিরাশার ক্রন্দন নিয়ে একান্তে লিখতে চান কিন্তু কবিও সমাজে বাস করেন। ভেঙে পড়া ক্ষয়িষ্ণু সমাজ, তার অন্যায় অবিচার, অসম্মান অমর্যাদা নিয়ে কবির ওপর আছড়ে পড়ে। একেই হাক গুটম্যান (Huck Gutman) বলেছেন “The Plight of the Modern Lyric Poet” [৬] (আধুনিক লিরিক কবির ভাবজগতের সঙ্কট)। গুটম্যান আলোচনা করেছেন বিংশ শতাব্দীর দু’ সময়ের দু’জন বড় মাত্রার লিরিক কবির মানসিক দ্বন্দ্বকে নিয়ে – দু’জনেই নোবেল প্রাইজ পেয়েছেন – সোভিয়েত ইউনিয়নের বরিস পাস্তেরনাক এবং উত্তর আয়ারল্যান্ডের সীমাস হিনি (Seamus Heaney)। আমি সেই টানাপোড়েন দেখতে পাই গোলাম রসুলের মধ্যে যখন তিনি দেখেন পক্ষপাত আর অসাম্য –

বুনো কুয়াশায় ঝিঁঝিঁর ডাক
আঁধারে লুকিয়ে যায় লবণ
জাহাজের তলায় জমানো জলের মতো আমাদের সেই ভিটেটুকু
ঢেউয়ের ঘরে ঘরে ডিঙিটি ভিক্ষা করে
দূরে ধনী হয়ে বসে আছে রাজার পাহাড়

পাশাপাশি কিন্তু তিনি আবার তাঁর ব্যক্তিজীবনের গভীর অনুভূতির কথা লেখেন “নামহীন আমি” কবিতায় –

নামহীন আমি
আমাকে খোঁজার জন্য অনেক পাখিদের উড়িয়ে দিয়েছি
শীতের রুক্ষতায় যখন পরিযায়ী পাখিরা উড়ে আসতো তখন তাদের কাছে
আমি জানতে চাইতাম আমার জীবনের কথা
আমার একাকীত্ব নক্ষত্র অবধি চলে যায়
ফিরে আসে সোনালি ধ্বংস হয়ে

লিরিক কবির অনুভূতির এই দৃষ্টিকোণ যুগে যুগে ফিরে আসে – Emily Dickinson এর কথা মনে বাজতে থাকে [৭] –
I’m Nobody! Who are you?
Are you – Nobody – too?

গোলাম রসুলের কবিতা নিয়ে আলোচনায় তৈমুর খান বলেছেন [৮] “মেটাফোরিক কাব্যভাষায় গোপন মর্মের আলোড়ন বহুক্ষণ বাজতে থাকে। কোথাও কোথাও বিশ্বসংসার বিচিত্র উল্লাসে স্পন্দিত হয়। একাকীত্ব নেই। নির্বাসন নেই। শূন্যতারও স্বর আছে, কল্পনা আছে বোঝা যায়।“

আমি একদম একমত এই বিশ্লেষণের সঙ্গে এবং তা আবারও প্রকাশ পায় “নৌ অভিযান” কবিতায়

সন্ধ্যায় শীতের চাঁদ মনে করিয়ে দিলো আমাদের সেই নৌ অভিযানের কথা
আর প্রথম থেকে এই অবধি আমরা কিভাবে ভাসছি

দুঃখকে লুকিয়ে রাখার জন্য তুমি যে পাহাড় দেখিয়ে দিয়েছিলে
আমি সেভাবেই আছি
সামান্য একটা গোড়ালির মতো

এখন রাতের তারারা আমাদের নিয়ে যাবে সেই বিশ্বাসের দিকে
আবার ফিরিয়ে দেবে স্বপ্নের মধ্যে
ঠিক যেভাবে আমরা খুঁজে পেয়েছিলাম জীবন

আমরা অদৃশ্য হয়ে যাবো সেই সব ভালোবাসাগুলোর মতো
যেগুলো বানিয়েছিলাম উপাদানহীন

একটা দিন
ছোট্ট একটি মৃত্যু অন্তহীন

খোলা আকাশ আর পাহাড়
জলে ঘেরা অট্টালিকা

আবার সেই “দুরদুর বক্ষের স্পন্দন, আশা নিরাশার ক্রন্দন, কারা ভেঙে দেবে বিশ্বাস” – লিরিক কবিতার শীর্ষচূড়া, উর্ধ্ববিন্দু। গোলাম রসুল টেকনিকের দিক থেকে চমকপ্রদ এবং অন্বয় বা সিনট্যাক্স-এর দিক থেকে রকমারি তাঁর কৃতিত্ব। সব মিলিয়ে শব্দ তরঙ্গের দোলা উৎসারিত হয় তাঁর লেখায়। আমার কাছে তার চেয়েও বড় কথা হল, ইনি একজন বিরল কবি যিনি একই সঙ্গে আমাদের ধীশক্তিকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেন এবং আমাদের হৃদয়কে আপন করে নেন।

উপসংহারে বলি, এই নিবন্ধে আমি সাম্প্রতিক বাংলা কবিতায় লিরিক প্রবাহের ধারা যে অব্যাহত রয়েছে তা দেখাতে গিয়ে দু’জন প্রতিষ্ঠিত কবির কবিতা নিয়ে আলোচনা করেছি। বাংলা কবিতার বেশির ভাগ আলোচনাতেই দেখি “দশকের কবি” বা “দশকের কবিতার” ওপর প্রাধান্য দেওয়া হয়। আশা করছি আমার এই নিবন্ধটি বিষয়ভিত্তিক আলোচনার আরো অনেক পথ খুলে দেবে।

উল্লেখসূত্র:

১) Poems of Sappho, Dover Thrift Edition, Translated by John Maxwell Edmonds (2018). উৎপল কুমার বসু সাফোর কিছু কবিতার অসামান্য অনুবাদ করেছেন বাংলায়, এগুলি পাওয়া যাবে ওনার কবিতা সংগ্রহের দ্বিতীয় খণ্ডে (দে’জ পাবলিশিং, ২০১৭)

২) An Introduction to Poetry, X. J. Kennedy and Dana Gioria, 13th Edition, Longman (2010).

৩) Postmodern American Poetry, edited by Paul Hoover, 2nd Edition, Norton (2013).

৪) Louise Glück, Poems 1962-2012, Farrar, Strauss, and Giroux (2013)

৫) “এইবার স্বপ্নের বন্ধন খুললাম”, কথা ও সুর সলিল চৌধুরী। হৈমন্তী শুক্লার কন্ঠে গানটি শোনা যাবে এইখানেঃ https://www.youtube.com/watch?v=2wuwQlgZJE0

৬) Poetry and Social Injustice: An unpublished essay by Huck Gutman originally submitted to The Statesman, Kolkata, India
https://www.uvm.edu/~sgutman/The_Plight_of_the_Modern_Lyric_Poet.html

৭) Emily Dickinson, Poems, Castle Books (2006)

৮) “গোলাম রসুলের আবির্ভাব”, তৈমুর খান, https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=3082121508684074&id=100006587656476

অমিত চক্রবর্তীর জন্ম সোনারপুর অঞ্চলের কোদালিয়া গ্রামে। ছাত্রাবস্থায় অনেক লেখা এবং ছাপানো কলকাতার নানান পত্রপত্রিকায়। পড়াশোনার সূত্রে আমেরিকা আসা ১৯৮২। এখন ক্যানসাস স্টেট ইউনিভারসিটি তে পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক ও প্রাক্তন কলেজ অফ আর্টস অ্যান্ড সায়েন্সের ডিন (২০১৬-২০২২) । প্রকাশিত কবিতার বই চারটি – "অতসীর সংসারে এক সন্ধ্যাবেলা" (২০২১), "জলকে ছুঁয়ো না এখানে" (২০২২), "ভালো আছি স্তোত্র" (২০২৩), এবং “ভুলটা ছিল উপপাদ্যে, প্রমাণেতে নয়” (ই-বুক ২০২৩)। দু'টি পত্রিকার সম্পাদক - উত্তর আমেরিকার নিউ জার্সি অঞ্চলের পত্রিকা "অভিব্যক্তি" (সহ-সম্পাদক) এবং "উজ্জ্বল এক ঝাঁক পায়রা" অনলাইন কবিতা পত্রিকা।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *