মরণবতী

গলার কন্ঠাগুলো উঁচু হয়ে আছে। ঠিক দুঃখ জাগার মত করে জেগে রয়েছে যেন। আমার বলতে ইচ্ছে করেছিল ‘দুখজাগানিয়া।’ তবু চুপ করে রইলাম। কথা শোনার জন্য। মা বলতো আমার নাকি ‘কথা গেলা’র অভ্যাস ছিল। তা ‘ছিল’ আর কোথায়? আজও আছে।
কণিকাদি। কণিকা পাল। আমার কোঁকড়া চুলে তেল মালিশ করে দিত। পিঠ ঘষে দিত। আমার মা তখন দুর্ঘটনায় হাসপাতালে ভর্তি ছিল। বাবা যুদ্ধ করছে হাসপাতাল, সংসারের মাঝে। শৈশব-কৈশোরের সীমারেখায় দাঁড়িয়ে থাকা মেয়ে আমি। কণিকাদির বয়স কত ছিল তা মনে নেই। শুধু মনে আছে চোখদুটো। ঠিক যেন নীল আকাশে ধূসর মেঘের মতো। অতল পথের আহ্বানে কোন এক আশ্চর্য সীমারেখা ছুঁয়ে ফেলেছে। হঠাৎ আসা বন্ধ হয়ে গেল কণিকাদির। কণিকাদির মা মারা গেছে। আমাদের উঠোনের বেল ফুলের গাছটা তখন শুকোতে শুরু করেছে। শুকনো চোখে দুঃখের চাদর জড়িয়ে কণিকাদি আবার আসতে শুরু করল। আমার মা তখনো সম্পূর্ণ সুস্থ হয়নি। মাঝে মাঝে আমার চুলে বিলি কেটে দিত। পালকের মত নরম হাত।
“তুই তারা দেখেছিস?” জিজ্ঞেস করত ।
আমি নিশ্চুপ হয়ে কথা শুনতাম।
“বাবাও বোধহয় চলে যাবে ওখানে।”
এক মরা বিকেলে চার কাঁধে চেপে সত্যিই চলে গেল কণিকাদির বাবা। কণিকাদির হাত ধরে তখন দাঁড়িয়ে রয়েছে দুটো জীবনের প্রতিবিম্ব। ওর ছোট ভাই, বোন। আমি ওকে দেখছি। হঠাৎ দেখি, দুঃখের আলো মাখা বিষাদপ্রতিমার মত দাঁড়িয়ে রয়েছে দিদি। ওর চুল বেয়ে চুঁইয়ে পড়ছে বিষাদের আলো।
তারপর, কনিকাদি পঞ্চায়েত অফিসের সহায়িকা। কয়েক মাস পরে ভাড়াবাড়ি ছেড়ে দেয়। পঞ্চায়েত অফিসের পাশেই একটা ছিটে বেড়ার ঘর তোলে। ভাইবোনেরা স্কুলে যায়। কণিকাদি ভাত বেড়ে দেয়। ‘গরম ভাতে নাকি শিউলি ফুলের গন্ধ থাকে,’ কণিকাদি বলতো। স্কুলের রাস্তায় দেখতাম ওদের ঘর। কণিকাদির তেল চিটচিটে চুল। চকচকে সিঁথি। কপালে ছোট্ট কালো টিপ। ফুলের গন্ধ পেতাম যেন। আমাদের উঠোনের বেলফুল গাছটাও বেশ সজীব তখন।
স্কুল থেকে ফিরছি একদিন। বাড়িতে এসে শুনলাম কণিকাদির বিয়ে। ওর মামা-মামী ঠিক করেছে। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি কালো মেঘ জড়াজড়ি করে পথ আগলে যেন বসে রয়েছে। তখন আমিও কিশোরীবেলায় ঢুকে পড়েছি। কণিকাদির বাড়ি গেলাম। ওর চোখ উথাল-পাথাল। হবু বরকে চেনে না। কয়েক মাস দেখিনি কণিকাদিকে। হঠাৎ একবছর পরে দেখি ওদের ‘ছিটে বেড়ার ঘরে’র দেওয়ালে হাতের দাগ। কেউ পরিষ্কার করেছে। কণিকাদি। সাদা শাড়ি, হাতে একটা থালা। খাবার বেড়ে দিচ্ছে ভাই-বোনেদের। কণিকাদির বর মারা গেছে। পাড়ায় তখন কণিকাদির নাম ‘মরণবতী।’ কণিকাদির জলশূন্য চোখ। হঠাৎ ওর পিঠের দিকে তাকিয়ে মনে হলো অজস্র লোনা জল বয়ে গেছে। যেন আঁকাবাঁকা দাগ।
“আমরা বেশীদিন এখানে থাকতে পারবো না, আমার বরের এইডস হয়েছিল। পাড়ায় কয়েকজন জেনে গেছে। চলে যেতে হবে রে। আমার পঞ্চায়েতের কাজটাও চলে গেছে।” ‘আমি সেদিনও উত্তর দিতে পারিনি। বাড়ি এসে দেখি বেলফুলের গাছটা আধমরা। কণিকাদি চলে গেল তারপর। অনেক দূরের স্কুলে ভর্তি হয়েছিল ওর ভাই-বোনেরা। ওর জীবনে তখন দৈত্যের ছায়া। একটা সংস্থার সঙ্গে যুক্ত হয়। আমি স্কুল যাওয়ার পথে দেখতাম ওই ছিটে বেড়ার ঘরে একটা স্যাঁতস্যাঁতে তালা।
তখন এইডসের কারণ, সচেতনতা, এসব নিয়ে অল্পবিস্তর কাজ শুরু হয়েছে। হঠাৎ শুনি আমাদের ওই ছোট্ট গ্রামের এক প্রান্তে কণিকাদি নিজের উদ্যোগে একটা সংস্থা শুরু করছে। এইডস আক্রান্ত রোগীদের ও তাদের পরিবারের মানুষজনকে সাহায্য করার লক্ষ্যে গড়ে তোলা হয়েছিল সংস্থাটি – আলয়।
“জানিস, এই রোগটা এমনি ছোঁয়াচে নয়, আমরা অযথা কষ্ট পেয়েছি। আর কেউ কষ্ট পাবে না দেখিস!” কণিকাদির চোখে তখন হলুদ আলো।
এই কণিকাদির জীবনেও প্রেম এসেছিল। সত্যিই প্রেম কি? শুনলাম পাড়ার এক দাদার সঙ্গে নাকি বিয়ে হবে কণিকাদির। মাঝে মাঝে আসতো দিদি। আমার চুলে বিলি কেটে দিত। সেই একই নরম হাত? নাকি একটু কঠিন হয়েছে? কণিকাদি আর ওর হবু-বর মিলে একটা দোকান করল। কণিকাদি রোজ হাপুস নয়নে তাকিয়ে থাকতো দোকানটার দিকে। তখনো কে জানতো একটা ধোঁয়ামাখানো দৈত্য এসে গ্রাস করছে কণিকাদিকে! কথাটা জানা গেল বিয়ের কয়েকদিন আগে। কণিকাদিও এইচআইভি পজিটিভ। “মরণবতী! লোক ঠিকই বলে আমায়, তবে আমার ভয় নেই, আমার সন্তান, আমার ‘আলয়’ আছে তো।”
কণিকাদি রাস্তায় দেখা হলেই উলুমঝুলুম বকবক করত। ওর ‘আলয়’-এর আলো নিয়ে মেতে থাকতো। ওর ‘আলয়’ তখন বেশ বড় হয়েছে। ওর বিয়ের কার্ডের অর্ডার দেওয়া হয়ে গিয়েছিলো। সেই অর্ডার বদলে এইডস সচেতনতা অনুষ্ঠানের কার্ড ছাপা হলো। এই সংস্থার কাজ করতে গিয়েই একজন ডাক্তারের সঙ্গে আলাপ হয় কণিকাদির। কণিকাদি শুরু করে চিকিৎসা। সংস্থার নানা কাজে কলকাতায় যেত। ডাক্তার দেখিয়ে একেবারে ফিরত বিকেলে। ক্লান্ত বিকেলে ঠিক শ্বেত-শুভ্র রজনীগন্ধার মত লাগত ওকে। আমি স্তব্ধ হয়ে দেখতাম। এক-একদিন কথা বলতো।
“পৃথিবীর মায়া খুব কষ্টের। খুব বেশি দিন আয়ু নেই হয়তো আমার। একজনকে দত্তক নিয়েছি। এইচআইভি পজিটিভ মেয়ে। তবে অনেকটা সুস্থ এখন। ও আমার ‘আলয়’ সামলাবে বলেছে।” আমি শুধু তাকিয়ে থাকতাম।
কণিকাদি যেদিন মারা যায়, ওর ‘রাজকন্যা’ তখন দুহাতে ‘আলয়’ সামলাচ্ছে। মায়ের স্বপ্নকে মাটির মতো জড়িয়ে ধরেছে। মৃত কণিকাদিকে দেখার সাহস হয়নি আমার। সেদিন ওর সংস্থার পাশ দিয়ে যখন যাচ্ছিলাম, হঠাৎ মনে হল বাড়িটার চারপাশে ডানা গজিয়েছে। সেই ডানায় ভর দিয়ে অজস্র হাসিমুখ উড়ে বেড়াচ্ছে। নীচে একটা প্রদীপ জ্বলছে। চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে উজ্জ্বল আলো।
মরণবতীর আলোকবর্তিকা।
———-
ছবির জন্যে কৃতজ্ঞতাস্বীকারঃ অন্তর্জাল ক্লিপ আর্ট।