অচেনাকে চেনা – কার্তিকস্বামী মন্দির
ভ্রমণকাহিনি লেখা হয় সাধারণত একটা রাজ্যের বেশ কয়েকটা বিখ্যাত জায়গাকে একসূত্রে গেঁথে নিয়ে যাতে ভ্রমণপিপাসু মানুষের অর্থ আর সময়ের মেলবন্ধনে সুবিধা হয়। আমার অভিপ্রায় তা নয়। আমি খণ্ডে বিশ্বাসী, নিবিড়তা আর নির্জনতায় আগ্রহী। সেই ভাবনা থেকেই আজ আমি আপনাদের নিয়ে যাব গাঢ়োয়াল হিমালয়ের এক নির্জন প্রান্তে, ‘কার্তিকস্বামী’ মন্দিরে। আমাদের বাৎসরিক ভ্রমণগুলির একটা বৈশিষ্ট্য, প্রচলিত জায়গাগুলির সাথে একটি অচেনা বা কম চেনা জায়গা ভ্রমণ করে আসা। বছর তিনেক আগে যখন উত্তরাখণ্ড ভ্রমণের উদ্দেশ্যে পরিকল্পনা শুরু করি তখন সেই তালিকায় রাখলাম গাঢ়োয়াল হিমালয়ের কার্তিকস্বামী মন্দির।
দুর্গাপুজোর নবমীর দিন, ‘উপাসনা’ এক্সপ্রেসে আমরা যাত্রা শুরু করি হরিদ্বারের উদ্দেশে। রাস্তায় ঘণ্টা দুয়েক লেট করে পরের দিন হরিদ্বার স্টেশনে পৌঁছলাম সন্ধ্যায়। হোটেলে পৌঁছতে পৌঁছতে ঘাটের সন্ধারতি প্রায় শেষের পথে। তাই হোটেলের বারান্দা থেকে আরতির শেষ অংশটুকু দেখেই সন্তুষ্ট রইলাম। তারপর বাকি সন্ধেটা সামনের জলপ্রবাহ দেখে, লস্যি খেয়ে, ক্রিস্টাল কিনে কাটিয়ে দিলাম। পরেরদিন সকাল সকাল পুরি তরকারি দিয়ে প্রাতরাশ সেরে আমরা যাত্রা শুরু করলাম কনকচৌড়ি গ্রামের উদ্দেশে। রাস্তায় রামঝুলা, লক্ষ্মণঝুলা, রুদ্রপ্রয়াগ, দেখে সন্ধের আবছা অন্ধকারের মধ্যে পৌঁছলাম কনকচৌড়ি গ্রামে। যাত্রাপথ দুশ’ কিলোমিটারের ওপর। হরিদ্বার থেকে একশ বাষট্টি কিলোমিটার রুদ্রপ্রয়াগ, সেখান থেকে চল্লিশ কিলোমিটার কনকচৌড়ি। সেখানে পৌঁছনোর আগেই অন্ধকার হয়ে যাওয়ার জন্যে জায়গাটার সম্বন্ধে কোন আন্দাজই করতে পারলাম না। অমন একটি গ্রামে, হোটলের অপ্রতুলতার ফলে একটি অতি সাধারণ মানের হোটেলে রাতটা আশ্রয় নিলাম। সেই রাতেই ঘরে এসে উপস্থিত হলেন একজন স্থানীয় লোক যিনি গাইড হিসাবে কাল আমাদের নিয়ে যেতে চান কার্তিকস্বামী মন্দিরে। টাকা-পয়সার রফা হয়ে গেলে আমাদের রাত তিনটের সময় প্রস্তুত হয়ে থাকতে বলে তিনি চলে গেলেন।
আমরা রাত তিনটের মধ্যে উঠে প্রস্তুত হলাম। বাইরে বেশ ঠান্ডা, তাই আপাদমস্তক গরম জামাকাপড়ে মুড়েছি। সঙ্গে ক্যামেরা আর টর্চ ছাড়া কিছুই নেওয়ার নেই। যেখানে আগের দিন গাড়ি থেকে নেমেছিলাম সেখানে পৌঁছে দেখি বেশ অনেক লোক জড়ো হয়েছে, যদিও অন্ধকারে কারোর মুখ দেখা যাচ্ছিল না। কথাবার্তা শুনে বুঝলাম তারাও আমাদের মতই ভ্রমণার্থী। মিনিট দশেকের মধ্যে যাত্রা শুরু হল। দশ বারোটা লোক পিছু একজন পথপ্রদর্শক বা গাইড। তখন চারিদিকে শেষরাতের জমাট অন্ধকার। গাইডের হাতের আলোয় সরু পথের দু’পাশে ঘন জঙ্গলের আভাস। দু-একটা আলোর ঝলক পড়াতে বুঝতে পারছি পথের একদিকে উচ্চতায় আর একদিকে খাদের গভীরে বৃক্ষগুলো দাঁড়িয়ে আছে। আমরা অমন অন্ধকারে কিছুটা ভয়ে কিছুটা ভাবনায় পরস্পরকে স্পর্শ করে চলতে থাকলাম।
মনে অজানা পথে চলার ভয়; একটু অসতর্ক হলেই এক প্রান্তের গভীর খাদে পড়ে যাবার ভয়। তিন কিলোমিটার পথ ট্রেক করতে হবে। বেশ কিছুটা চলার পরে আমার চোখে পড়ল মাথার ওপরে অজস্র তারকা খচিত এক অনাবৃত আকাশ। তার মধ্যে দেবীপক্ষের একাদশীর এক ফালি চাঁদ লাজুক মুখে স্তিমিত আলো ছড়াচ্ছে। আমি অন্ধকার ভুলে গেলাম, অরণ্য ভুলে গেলাম, পরিবার গাইড সব ভুলে গেলাম। ওই একফালি চাঁদের হাত ধরে আমি হেঁটে চললাম কার্তিকস্বামীর পানে। কতক্ষণ চলেছি জানি না যখন চেতনা ফিরল দেখলাম আমি দাঁড়িয়ে আছি একটা চওড়া চত্বরে। আমার সামনে মাত্র একজন আর পিছনে বাকি সবাই। বুঝলাম আমি অনেকটা আগে চলে এসেছি ওই সরু পথ ধরে। মোবাইলে সময় দেখলাম পাঁচটা দশ।
চারিদিকের অন্ধকার তখন অনেকটা ফিকে হয়ে এসেছে। আগে যা ছিল নিকষ কালো এখন তার ওপর একটা পাতলা সরের আস্তরণ পড়েছে। আধো অন্ধকারে চোখে পড়ছে যেন একটা পাহাড়ের মাথার ওপর দাঁড়িয়ে আছি। মাথাটা একট মস্ত গোল টেবিলের মতো। একটু দূরে একটা ছোট মন্দিরের অবয়ব চোখে পড়ছে। শনশন করে ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে। চারিদিকে এক অদ্ভুত রহস্যময় সৌন্দর্য। জ্যাকেটের হুডটা আরো একটু টেনে দিলাম। একাদশীর ক্ষীণ চাঁদ অনেকটা পশ্চিমে নেমে গেছে। একটু পরেই এসে পড়ল বাকি ট্যুরিস্টের দল। এবার অপেক্ষা সূর্যোদয়ের। এখান থেকে সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তের দৃশ্য অপূর্ব। আমরা কার্তিকস্বামী মন্দিরের পাশ দিয়ে এগিয়ে গেলাম অপ্রশস্ত জায়গার পশ্চিমে, একেবারে শেষের দিকে। সামনে গভীর খাদ। গাইডের নির্দেশ অনুযায়ী ক্যামেরা সেট করে সামনের দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম। এই চত্বরটার সামনের তিনদিক খোলা। তাকিয়ে থাকতে থাকতে যখন বেশ ক্লান্ত লাগছে, হঠাৎই সামনে তিনশো ষাট ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে পরপর দাঁড়িয়ে থাকা কেদারনাথ, চৌখাম্বা, নীলকান্ত, দ্রোণাগিরি, নন্দাঘুন্টি, ত্রিশূল, নন্দাদেবী, মেরু, আর সুমেরু পর্বতের মাথার ওপর সূর্যের প্রথম রোদের কিরণ পড়ে এক রাজকীয় শোভা তৈরি হল। সে যে কী অপূর্ব স্বর্গীয় দৃশ্য! কোথাও হলুদ কোথাও লাল কোথাও কমলা রঙের ছড়াছড়ি। চারিদিকে তখন শুধু ক্যামেরার শাটার পড়ার শব্দ। আলো বাড়তে লাগল আর আমি গাঢ়োয়াল হিমালয়ের এই আশ্চর্যভূমির অনন্য সৌন্দর্যে ডুবে যেতে লাগলাম।
একমাত্র ঈশ্বরই পারেন এমন স্বর্গীয় দৃশ্য রচনা করতে। আমার পায়ের নিচে তখন বিশাল বিশাল তুলোর মতো মেঘের পাল। হঠাৎ হঠাৎ মনে হয় আমি মাটিতে নয় মেঘের ওপর দাঁড়িয়ে আছি। চটকা ভাঙল গাইডের ডাকে। এবার মন্দিরে যাওয়ার পালা। মন্দিরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। বাইরে একটি তৈরি মূর্তি থাকলেও ভেতরে রয়েছে পাথরের ওপর প্রাকৃতিক ভাবে খোদাই করা বিগ্রহ। আমরা পুজো দিলাম নারকেল আর নকুলদানা দিয়ে। দক্ষিণ ভারত, শ্রীলঙ্কা, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়াতে মুরুগানস্বামী বা কার্তিকের পুজো প্রচলিত থাকলেও এদেশে কার্তিকের মন্দির খুব কমই দেখেছি। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে তিন হাজার পঞ্চাশ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত এই মন্দিরটার একটা পৌরাণিক কাহিনি আছে যেটা গাইডের কাছে শোনা গেল। গল্পটি এই রকম।
শিব পার্বতীর সংসারে একবার দ্বন্দ্ব তৈরি হয় কার্তিক আর গণেশের মধ্যে কে আগে পুজো করবে এই নিয়ে। শিব এই সমস্যার সমাধান করার জন্য দু’জনকেই একই কাজ দেন। দু’জনকেই বলেন পৃথিবী পরিক্রমা করে আসতে। যে আগে আসবে সে আগে পুজো করবে। কার্তিক বেরিয়ে পড়েন পৃথিবী পরিক্রমায়। গণেশ বুদ্ধিমান। সে শিবকে একবার প্রদক্ষিণ করে বলে তুমিই আমার পৃথিবী। শিব যুক্তিতে সন্তুষ্ট হয়ে গণেশকে পুজো করার অনুমতি দেন। কার্তিক পরিক্রমা সেরে ফিরে এসে সব শোনেন। এরপর অভিমানী কার্তিক তার শরীরের মাংস শিবকে আর অস্থিপঞ্জর পার্বতীকে দান করেন। পার্বতী সেই অস্থিপঞ্জর গাঢ়োয়ালের এই নির্জনভূমিতে রেখে যান। তার ওপরেই গড়ে ওঠে যুদ্ধ আর বিজয়ের দেবতা কার্তিকস্বামীর এই ছোট্ট মন্দির। বছরে দুবার এখানে কলস উৎসব হয়।
এবার আমাদের নিচে নামার পালা। অন্ধকারে যে পথ মধ্যরাতে অতিক্রম করেছিলাম সেই পথ এখন সকালের নরম আলোতে ঝলমল করছে। চারিদিকে পাখির নানারকম ডাকে মনে পড়ল এখানে আসার আগে পড়ে এসেছিলাম এই রডোডেনড্রনের জঙ্গলে অজস্র পাখির বাস। তার মধ্যে গোল্ডেন ঈগল, ব্ল্যাক ঈগল, স্টেপি ঈগল, বিয়ার্ডেড ভালচার, হিমালয়ান মোনাল ফেসেন্ট উল্লেখযোগ্য। তার বেশ কিছু গাইড আমাদের দেখাল। তবে ছবি তেমন নিতে পারিনি। প্রকৃতির শোভা দেখতে দেখতে নেমে এলাম নিচে। এবার এখান থেকে ঝোলা গোটানোর পালা।
5 Comments