আধুনিক কবির ধর্ম ও সমকালের দর্পণ

আধুনিক কবির ধর্ম ও সমকালের দর্পণ

 

ঘরভর্তি লোকজনের সামনে আধুনিক যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত পড়লেন রবীন্দ্রনাথের কবিতা–‘নিমন্ত্রণ’। তারপর মৃদু হেসে বললেন: ”এটা একটা চতুর্থ শ্রেণির কবিতা!” পিনপতন স্তব্ধতা।

বেশ কিছুক্ষণ পর কবিতা সিংহ রাগত স্বরে কবিকে বললেন যে, তিনি কেন এমন একটি বিস্ময়কর কথা বললেন! সুধীন্দ্রনাথ আবার মৃদু হেসে বললেন: ”এমন চতুর্থ শ্রেণির কবিতা কি আর একটিও লিখিত হয়েছে?” এই অপূর্ব ব্যাজস্তুতিটির পর অবশেষে কবিতা সিংহের মুখেও হাসি ফুটল।

এই স্মৃতিচারণটি অনেকদিন আগে করেছিলেন কবিতা সিংহ।

আধুনিক যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত

মাঝে মাঝে কেউ কেউ একটা প্রশ্ন তোলেন যে, সাহিত্য ‘তারপর’ কত এগিয়ে গেছে, সেই খোঁজ ‘এখন’ নিতে হবে! ঠিকই। ‘সাহিত্য পাঠ’ বিষয়টাই ধারাবাহিকতা দাবি করে। কিন্তু, মুশকিল হচ্ছে, ওই ‘তারপর’ আর ‘এখন’ এই দুটি শব্দ নিয়ে। রবীন্দ্রনাথ-উত্তর বাংলা সাহিত্য, একেবারে তুমুল বর্তমান অবধি যার বিস্তার, যদি চর্চিত হয় এবং হওয়া উচিতও, তার মানে কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ‘ব্রাত্য’ হয়ে যান না এবং একথাও ঠিক কথা নয় যে, রবীন্দ্রনাথে ‘বিভোরতা’ নিতান্ত অনর্থক হয়ে যায়। শুধু রবীন্দ্রনাথই বা কেন, তাঁর আগের সৃষ্ট বাংলা সাহিত্যসম্ভারও সমান গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বসাহিত্যের ক্ষেত্রেও একই ‘সত্য’ উল্লেখ্য। ওয়ার্ডসওয়ার্থ, কিটস, শেলি, বায়রন কি আজ আর কেউ পড়বেন না? কিংবা, এলিয়ট, বোদল্যের, কাম্যু, সার্ত্র আজ তাহলে অপাঠ্য? এমন ভাবনা কেবল ‘দুঃস্বপ্নেই’ ভাবা সম্ভব! সাহিত্যে ‘অতীত’ বলে কিছু হয় না; বিশেষত সাহিত্যে এমন কিছু ‘মহীরুহ’ আছেন, যাঁরা সবসময়ই ‘বর্তমান’। কারণ, তাঁরা ‘শাশ্বত’। বিভূতিভূষণ বা জীবনানন্দের ক্ষেত্রে কি ভাবতে পারা যাবে যে, তাঁদের ‘সৃষ্টির আয়ু’ আর ‘কিছুকাল’? এমন ভাবনা ভাবতে পারার জন্যেও ‘প্রতিভা’ লাগে!

কিন্তু, একথা ঠিক যে, সুধীন্দ্রনাথের ‘মুগ্ধতা’র মধ্যে শিক্ষণীয় বার্তা আছে। শঙ্খ ঘোষের মতো আধুনিক কালের শ্রেষ্ঠতম কবিও যাঁকে ‘হৃদয়ে’ রেখেছিলেন, তিনি—রবীন্দ্রনাথ। পঞ্চাশ, একশো, দুশো বছর–এমন কালখণ্ডের হিসেবে নয়, সৃষ্টির ভেতর থেকে যে ‘আলো’ নির্গত হয় তা-ই তার ‘অমরত্ব’-কে চিহ্নিত করে। ‘কবি’ শব্দটির আকছার ব্যবহার আজকাল দেখা যায় মূলত ‘কবি’ কাকে বলে সে সম্পর্কে সম্যক ও স্বচ্ছ ধারণার অভাবে। বস্তুত, কবি আর বাউলের মধ্যে মিল যেমন আছে তেমনই আছে অমিলও। কবি ও বাউল দুজনেরই মাটি ও ঘাসের সঙ্গে, গাছ, প্রান্তর, নদী, আকাশ এসবের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক। সখ্য। এগুলি মিল। আর অমিলটা হ’ল, বাউল ঘরছাড়া হয় এসবের টানে। সর্ব বাঁধনমুক্ত। কিন্তু, কবি ঘর থেকে বাইরে আসেন, বাইরে থেকে আবার ফিরে তার ঘরটিকে ‘সাজান’। কী দিয়ে? কিছু গন্ধ দিয়ে, আলো দিয়ে, ছায়া দিয়ে, বাতাস দিয়ে! সেসব অলীক হয়েও অলীক নয়! কবি আসলে ঘরে আছেন, থাকেন না কি বাইরে তা বোঝা খুব সহজ নয়। তিনি বাঁধনে থেকেও বাঁধনমুক্ত! এ তো যেমন তেমন, যার তার কাজ নয়!

গালিবের মৃত্যুদিনে চলে যান কবি আল মাহমুদ

১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯। গালিবের মৃত্যুদিনে চলে যান কবি—মীর আব্দুস শুকুর আল মাহমুদ; যিনি আল মাহমুদ নামেই খ্যাত। তাঁর কবিতা অনাঘ্রাত পুষ্পের সুবাস বয়ে আনে। গভীরতম অনুভূতির সঙ্গে প্রজ্ঞামিশ্রিত ও সত্যাশ্রয়ী জীবনদর্শন ‘কবিতা’ নামক যে শিল্পের জন্ম দেয়, যা সৌন্দর্যের অভিজ্ঞানে আলোকিত হয়ে মানুষ কীভাবে তার সৃষ্টির মধ্যেই লগ্ন হয়ে থাকা শ্রেষ্ঠত্বের অন্বেষায় জীবন-পরিক্রমা করবে তার প্রক্রিয়া বর্ণনা করে—আল মাহমুদ সেই বিরল কাব্যশিল্প সৃষ্টির ধারায় অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রতিনিধি। কবির অমরত্বের এ হ’ল প্রথম শর্ত। দ্বিতীয় শর্ত হ’ল, কাব্যভাষায় স্বাতন্ত্র্যের নির্মাণ, যেক্ষেত্রেও আল মাহমুদ সসম্মানে উত্তীর্ণ। শব্দচয়নও যে কতটা শৈল্পিক হতে পারে, তার প্রমাণেও তিনি রেখেছেন একক কৃতিত্বের স্বাক্ষর। ‘কালের কলস’, ‘লোক লোকান্তর’, ‘সোনালি কাবিন’, ‘মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো’, ‘অদৃষ্টবাদীদের রান্নাবান্না’, ‘বখতিয়ারের ঘোড়া’ ইত্যাদি তাঁর ধ্রুপদী কাব্যগ্রন্থ।

তাঁর অসামান্য কলম গদ্যেও রেখেছে স্বাতন্ত্র্যে উজ্জ্বল শিল্পসুষমার ছাপ। যেমন, ‘কাবিলের বোন’, ‘পানকৌড়ির রক্ত’, ‘সৌরভের কাছে পরাজিত’, ‘যেভাবে বেড়ে উঠি’, ‘দিনযাপন’ ইত্যাদি।

”আত্মবিক্রয়ের স্বর্ণ কোনও কালে সঞ্চয় করিনি!”  আল মাহমুদ লিখিত আরেকটি অনন্য পংক্তি।
”যা আমার সবার হেলাফেলা যাচ্ছে ছড়াছড়ি।” বস্তুত, রবীন্দ্রনাথের এই গীতিদ্যোতনায় ‘কবি’ শব্দটিকে যদি দেখতে হয় তাহলে তা রীতিমতো ভাবিত করার মতো। বস্তুত, ‘কবি’ পরিচয়টি আজ অযথা বহু ব্যবহারে জীর্ণ ও দীর্ণ হওয়া ‘বড় বেদনার মতো’ বাজে! ‘কবি’ বলতে যদি আপন হৃদয়ে কাব্যমঞ্জুষায় পূর্ণ পুরাকালের ধ্যানস্থ ঋষিকল্পটি প্রতিভাত হয়ে না-ও ওঠে, অন্তত প্রবল গৃহী রবীন্দ্রনাথের যাপনশৈলীটি মানসমুকুরে উদ্ভাসিত হতে কোনও অসুবিধা থাকার কথা নয়। কিংবা, ধরা যাক নজরুলের কথা; যিনি ‘রূপ’ ও ‘রুপার’ মধ্যে পার্থক্য চিহ্নিত করে কবিকে বলেছিলেন–‘রূপের উপাসক’। আল মাহমুদও কিন্তু পরোক্ষে সেই কথাটিই বললেন। যদিও ‘সোনালী কাবিন’-এর দয়িতার উদ্দেশে কবির বলা কথা, কিন্তু কবির হৃদয়ের গভীর উচ্চারণকে তো ‘সঙ্কুচিত’ করা যায় না। প্রশ্ন উঠবে, কবি কি আলো ও বাতাস খেয়ে বেঁচে থাকবেন? কবি ‘আলো’ ও ‘বাতাস’-এর ‘স্তব’ লিখলেও সেসব যে ‘দেহের খাদ্য’ নয় তা তো সকলেই জানে। কিন্তু, পাশাপাশি এ-ও সত্য যে, ‘আত্মবিক্রয়ের স্বর্ণ’ সঞ্চয়ের পথে ধাবিত হয়ে কবি ‘আলো ও বাতাসের স্তব’-কে কলুষিত করবেন না। তিনি হবেন ‘সত্য উচ্চারক’। দয়িতাকে কুসুমিত, মহার্ঘ ‘প্রেম’ দিতে চান ঠিকই, কিন্তু ‘আত্মবিক্রীত’ না হয়ে–কবির এই ঘোষণাটির মধ্যে রয়েছে আসলে পৃথিবীর সব ‘যথার্থ কবি’র অন্তরাত্মার ছবি। শুধু ‘দয়িতা’র ক্ষেত্রেই নয়, বরং সবখানেই তার স্বাক্ষর ছড়িয়ে থাকার কথা। সেই অর্থে দেখলে এই কবিত্ব একটি প্রতীকী নির্মাণ।

দৃশ্যমান বাস্তবতা আজকের কবিদের কিন্তু অন্যভাবে চেনাচ্ছে। অনুমিত হয়, দিনে দিনে ‘কবির নিভৃতি’ কিংবা ‘নিভৃতচারী কবি’ শব্দবন্ধগুলি বোধহয় লুপ্ত হয়ে যাবে! কবি কি কবিতা লেখেন পাঠকের জন্য? তিনি তো লেখেন আসলে ‘নিজের জন্যে’! পাঠক ‘সৌভাগ্যক্রমে’ পড়ে মাত্র! কবির কাউকে ‘জানান দেওয়া’র প্রয়োজন হয় না। তিনি ভিড়ে মিশতে চান না, বরং ভিড় থেকে পালাতে পছন্দ করেন। কিন্তু, এখন চলছে সবই উল্টো পুরাণ। কবিরা ‘মঞ্চ’ পছন্দ করছেন। যেকোনও মঞ্চ। বিজ্ঞাপন ভালবাসছেন; নিজেরই প্রদত্ত বিজ্ঞাপন। প্রবল ও সোচ্চার সেই বিজ্ঞাপন। ভিড়ে, শব্দের জঙ্গলে, আলোর বন্যায় কবিরা নিজেকে খুঁজে পাচ্ছেন। অথচ, সেই পাওয়া আসলে নিজেকে হারিয়ে ফেলা! গভীর নির্জনতা কবিদের যেন আর প্রিয় অনুষঙ্গ নয়! জীবনানন্দ, শঙ্খ ঘোষ, আল মাহমুদ প্রমুখ বিরল আজকের কবিদের চর্যায়। কালের ধ্বনি শুনতে পাওয়া যাচ্ছে! বর্তমান ও অনাগত ভবিষ্যৎ যেন বারবারই বলছে–কবিতার জন্য ‘সুখের সময়’ নয়!

আজকের কবিরা ‘নগরবিলাসী’! এবং, ‘বিত্তবিলাসীও’! নাগরিক জৌলুস আর বৈভবদাস্যে দীর্ণ কৃত্রিম জীবনের পাঁক থেকে কি ‘কবিতা’ হয়? তাঁরা কি আজ এমনভাবে বলতে পারবেন: ”ঘাসে ঘাসে পা ফেলেছি বনের পথে যেতে, ফুলের গন্ধে চমক লেগে উঠেছে মন মেতে?” কবিতা হোক, অথবা গদ্য, সমস্ত লেখালেখির মর্মমূলে আছে একটা সংযোগের নিরুচ্চার ধ্বনি-প্রতিধ্বনি। লেখকের ‘আত্মকথন’ কেবল লেখকেরই নয়, তাকে হয়ে উঠতে হয় পাঠকেরও ‘আত্মকথন’। এটাই সংযোগ। সামাজিক নানা আবর্ত যদি লেখায় প্রবাহিত না হয় তাহলে তা পাঠককে টানবে কীভাবে? ”আমি সেইদিন হব শান্ত…”–নজরুলের এই লাইনটি সম্ভবত সমস্ত লেখকদের লেখকসত্তার চর্যাকে ব্যক্ত করে। যে ‘বিচলন’ একজন লেখককে ‘শান্ত’ থাকতে দেয় না তা আজ ক্রমশ বিরল হয়ে উঠেছে! তাঁরা ‘শান্ত’ আছেন, কিন্তু ‘বিচলিত’ হওয়া ব্যতীত! তাঁদের সমূহ লেখালেখি তাই ‘মানবিক স্বর ও সুর’ হয়ে উঠতে ব্যর্থ! আজ গদ্যে ও কবিতায় তাই অশুভ দুর্দিনের লক্ষণ প্রকট! ঘরে বসে বসে কেবল যে সাংবাদিকতাই হয় না তা নয়, কবিতাও হয় না এবং গদ্যও হয় না। ‘ঘাসে ঘাসে পা’ ফেলতে হয়, মানুষের সঙ্গে হেঁটে যেতে হয়!

প্রথাগত ধারার বাইরে গিয়ে পর্দায় স্বতন্ত্র চলচ্চিত্রভাষা নির্মাণে সফল হয়েছিলেন পরিচালক বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত। তাঁর প্রয়াণের পর আকাশবাণী কলকাতার সংগ্রহশালা থেকে রেডিওতে একটি সাক্ষাৎকার পুনরায় সম্প্রচারিত হয়েছিল। দুটি পর্বে তাঁর সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক অধ্যাপক চিন্ময় গুহ। মৃদুভাষী কবি ও চলচ্চিত্রনির্মাতা বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, শৈশব থেকে বেড়ে ওঠা জীবনের সূত্র ধরে কীভাবে তাঁর জীবনবোধ গড়ে উঠল এবং কবিতা ও পরে চলচ্চিত্রের প্রতি তিনি আকৃষ্ট হলেন সেসব কথা ব্যক্ত করেছিলেন। সংক্ষেপে সেই আলাপনের কিছু টুকরো নির্যাস তুলে ধরা যায়। তাঁর মা শিখিয়েছিলেন কীভাবে ‘উদার’ হতে হয়। কখনও ‘আমি’ বা ‘আমার’ নয়, ‘সমষ্টির মধ্যে নিজেকে লীন করা’ বা ‘আমি সকলের মধ্যে একজন’ এই চেতনা লাভ করেন।

স্বতন্ত্র চলচ্চিত্রভাষা নির্মাণে সফল হয়েছিলেন পরিচালক বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত

লণ্ঠনের আলোয় পড়তে বসতেন। কাছেই জমে থাকা গাঢ় অন্ধকারে তাঁর চেতনা ও উপলব্ধির প্রথম বিস্তার–যেন ‘অনেকটা বুঝতে পারা’! ‘চোখ বন্ধ করে’ শোনার মধ্য দিয়ে যে ছবি গভীরভাবে দেখা যায় তার ‘গুরুত্ব’ও তাঁর মা-ই তাঁকে শিখিয়েছিলেন। তাঁকে ‘পথের পাঁচালী’ দেখতে পাঠিয়েছিলেন বাবা। বাড়িতে উপন্যাস ও কবিতার বই খুব পড়তেন। এসব তাঁর ‘মনোভূমি’কে গড়ে তুলেছিল। বাস্তবতার ভেতরে যে অন্তঃসলিলা হয়ে থাকে অন্যতর এক বাস্তবের সুর, যা কল্পিত অথচ অবাস্তব নয়, তার নির্মাণ তিনি চলচ্চিত্রে করেছেন মূলত ‘কবিতা’র প্রেরণা থেকেই। বস্তুত, কবিতা আর চলচ্চিত্রকে তিনি কখনও আলাদা করতে পারেননি। মানুষকে দেখতে, তাকে অনুভব করতে পছন্দ করতেন। এই ‘দেখা’র সূত্রেই তাঁর মনে হয়েছিল যে, যাদের আমরা ‘সাধারণ মানুষ’ ভাবি তাদের মধ্যেও কত যে ‘অসাধারণত্ব’ থাকে তার খোঁজ আমরা রাখি না! জীবনে অনেকের কাছ থেকে অনেক ‘দুঃখ’ও পেয়েছিলেন, কিন্তু সেসব তাঁকে স্তব্ধ, নিশ্চল করতে পারেনি এবং এটাই ‘জীবনের মূলমন্ত্র’ হওয়া উচিত বলে তাঁর মনে হয়েছিল। ‘জীবনের প্রতি বিশ্বাস’ই ছিল তাঁর পাথেয়। চলচ্চিত্রে ‘ইমেজ’-কে তিনি খুব গুরুত্ব দিয়েছেন, যা আমাদেরই জীবনের সঙ্গে, জীবনচর্যায় নানারূপে মিশে থাকে। তাঁর এমনই নানা কথা, চিন্তা, বোধ, অনুভূতি, চেতনার অভিব্যক্তি উদ্ভাসিত হয়েছিল সাক্ষাৎকারটিতে, যেখানে ফুটে উঠেছে মিতভাষী, অন্তর্মুখী, সংবেদনশীল ও মানুষের প্রতি দায়বদ্ধ একটি মানুষের ছবি! কবি ও চলচ্চিত্রকার হিসেবে অবিচ্ছেদ্য সত্তার অধিকারী বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের ‘অন্তর্জগতের উন্মোচন’ই ছিল অপূর্ব সেই আলাপচারিতাটি থেকে বিশেষ প্রাপ্তি !

কঠিন-কঠোর বাস্তব সবসময়ই ছিল। অপরূপ প্রকৃতিও আদিকাল থেকে অপার রূপসৌন্দর্যের উপচার নিয়ে মূর্ত ছিল। চোখের সামনে শুধু নয়, মানুষের চেতনায়, অনুভবে ও মননে। বলা হয়, এখন বাস্তবটা নাকি আরও কঠিন ও কঠোর হয়েছে। ফলে, প্রকৃতির প্রতি মুগ্ধ হওয়ার অবসর, তাকে নিয়ে রোমান্টিকতায়, গাঢ় অনুভবে লীন হওয়া এসবের আর সময় কোথায়! গড়পড়তা মানুষের এই চিন্তার বিন্যাসে ফাঁক ও দীনতা কোথায় সেটা ঠিকঠাক বুঝতে না-পারলে চিরকালের এক শ্রেষ্ঠ প্রকৃতিপ্রেমিক, রোমান্টিক কবিকে সম্পূর্ণরূপে বোঝাও সম্ভব নয়! বস্তুত, তিনি তাঁর সময়েও বড্ড একাই ছিলেন! তাঁর মতো মানুষদের সেটাই বোধহয় অনিবার্য ললাটলিখন! তিনি উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ। তাঁকে নিয়ে চিন্ময় গুহর একটি অসাধারণ বিশ্লেষণসমৃদ্ধ, দীপ্তিময় প্রবন্ধের কথা এখানে উল্লেখযোগ্য। ‘ওয়ার্ডসওয়ার্থ : নগ্ন, নির্জন পথচারী’। প্রবন্ধটি ‘পরম্পরা’ থেকে প্রকাশিত তাঁর ‘বিন্দু থেকে বিন্দুতে’ বইয়ে সংকলিত হয়েছে। ৯৭ থেকে ১০৫ পৃষ্ঠায় সম্পূর্ণ প্রবন্ধটির এক জায়গায় তিনি লিখছেন : ”…শুরুতেই তিনি এই নতুন কবিতাকে ‘পরীক্ষামূলক’ বলে দাবি করেছেন। সেখানে তিনি নম্র অথচ স্পষ্ট ভাষায় লিখেছিলেন, কবি সাধারণ মানুষের জীবনের কথা সাধারণ মানুষের দৈনন্দিনের ভাষায় লিখবে। কবিতা যে শুধু কবির জন্য নয়, কবিও যে মানুষের জন্য, ইংরেজিতে এই ঘোষণার সম্মান ঐতিহাসিকভাবে ওয়ার্ডসওয়ার্থের প্রাপ্য। সাধারণ মানুষ থেকে কবির বিচ্ছিন্নতার বিরুদ্ধে এই রায়। কোলরিজ পরে এ-বিষয়ে ওয়ার্ডসওয়ার্থের সাফল্য নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করলেও এই মূলনীতির সত্যতাকে অস্বীকার করবে কে?” পৃষ্ঠা : ১০২। মোট নয় পৃষ্ঠার একটি প্রবন্ধ। একথা সত্যি যে, কোনও লেখাই সম্পূর্ণ, পূর্বাপর না-পড়লে উল্লিখিত ছিন্ন অংশটিকে বোঝা সম্ভব নয়। তবুও আরেকটি উজ্জ্বল বাক্য উদ্ধৃত করার লোভ সম্বরণ করতে পারছি না। “আত্মোপলব্ধি ও আত্মজিজ্ঞাসা তাঁকে করেছে সকলের চেয়ে আলাদা। তাঁর কবিতার গোধূলি শুধু রং-রেখা নয়, সেখানে লেগে থাকে মরালশুভ্র এক দার্শনিক আভা।” পৃষ্ঠা: ৯৭। এই প্রজ্ঞাদীপিত, স্বাদু প্রবন্ধটি বিশেষত আজকের কবিদের জন্য অবশ্য পাঠ্য, যা হয়তো তাঁদের অনুসৃত কাব্যচর্চার অভিমুখ বদলে দিতে পারে!

সাধারণত ধরে নেওয়া হয় যে, একজন কবি নিজেকে একটি স্বরচিত গুহায় বন্দি করে রাখেন–সেখান থেকে বাইরের জগৎ-কে তিনি দেখেন। কবিতা আসলে কবির নিজেকে দেখার একটি দর্পণ–যেখানে ফুটে ওঠা বিপন্নতা, আর্তি, ক্ষোভ ইত্যাদি শব্দের শরীরে প্রকাশিত হয়। কবিতার উৎসমুখে লগ্ন হয়ে থাকা এই চেনা ছকটি ভীষণই আত্মকেন্দ্রিক ও আদতে কবিতাবিরোধী; বৃহত্তর সমাজ কিংবা বহির্বিশ্বের সাথে এমন ভাবনার সম্পর্ক শূন্য বা অন্তর্হিত। এই ধরণের ভাবনা উৎসারিত কবিতা পাঠককে রোমাঞ্চিত বা আন্দোলিত করে না। কবি যখন নেমে আসেন মাটির পৃথিবীতে, তাঁর নিজের কথা নয় মানুষের কথা বলতে, তখনই সেই কথাশিল্প, কবিতা যার নাম, মানুষকে চঞ্চল করে তোলে–যে চঞ্চলতায় মিশে থাকে আনন্দ, রোমাঞ্চ, উদ্দীপনা ও প্রেরণার উপাদান।

নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী ছিলেন এই গোত্রের কবি, যিনি একটি কবিতাও কেবল তাঁর নিজের কথা বলার জন্য লিখেছিলেন কি না সন্দেহ। মানুষ ও সমাজের প্রতি গভীর মমত্ববোধ ও দায়বদ্ধতা থাকলেই কেবল নিজের ক্ষুদ্র গণ্ডিটিকে কেউ এভাবে অতিক্রম করে যেতে পারে–রবীন্দ্রনাথ যেমন লিখেছিলেন, ”আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়া, বুকের মাঝে বিশ্বলোকের পাবি সাড়া!” তিনি এই সাড়া পেয়েছিলেন। আর, পেয়েছিলেন বলেই তাঁর কলম থেকে উৎসারিত কবিতা হয়ে উঠেছিল মানুষ তথা সমাজের দর্পণ–যে দর্পণ শুধু বর্তমানের ছবি দেখায় না, উত্তরণের দিশায় অঙ্কিত সুন্দর ভবিষ্যতের ছবিও নির্মাণ করে বা করার সাহস ও প্রত্যয় যোগায়; আর এই মহামহিম কাজটি করতে গিয়ে তিনি পাঠককে শব্দের জটিল ও দুর্ভেদ্য অরণ্যে পথ হারিয়ে ফেলতে দিতে চাননি, বরং নিতান্তই সহজ ও আটপৌরে শব্দ নির্বাচনের শৈল্পিক দক্ষতায় তিনি কুয়াশায় ঢাকা পথের রেখাটিকে কবিতার পাঠকদের কাছে আরও স্পষ্ট করেছেন, আরও কাছে এনে দিয়েছেন!

নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী ছিলেন এই গোত্রের কবি, যিনি একটি কবিতাও কেবল তাঁর নিজের কথা বলার জন্য লিখেছিলেন কি না সন্দেহ।

 

বস্তুত, কবিতার আঙ্গিক ও প্রকরণ, রসবিচার ইত্যাদি নিয়ে চর্চা, আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক হয়। আধুনিকতা, উত্তর-আধুনিকতা প্রভৃতি প্রসঙ্গ উঠে আসে। চর্যাপদ, বৈষ্ণব পদাবলী হয়ে বর্তমান কবিতার যে দীর্ঘ যাত্রাপথ, তার বহু বাঁক, নানা অবয়ব, রূপ ও রঙের বর্ণচ্ছটা। জীবন যেমন ক্রমাগত অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে করতে এগিয়ে চলে, শিল্প ও সাহিত্যও তেমনি তার নান্দনিক চেতনাকে ভাঙা-গড়ার মধ্য দিয়ে ক্রমশ উন্নততর করে সম্মুখে অগ্রসর হতে থাকে। কবিতাও তার ব্যতিক্রম নয়। কবি তাঁর নিজের অনুভবই ব্যক্ত করবেন, কিন্তু তাঁর আত্মগত উচ্চারণকে পাঠক নিজেরই অন্তরাত্মার প্রতিধ্বনি ভাববে এবং উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠবে, কোনও এক গন্তব্যে পৌঁছনোর হদিস পেয়ে রোমাঞ্চিতও হয়ে উঠবে। এভাবেই একটি কবিতার জন্ম সার্থক হয়। হতাশা, স্বপ্নভঙ্গ ও গ্লানির শেষকথাটিও বলা দরকার, যেভাবে কবি ‘রাত্রির গভীর বৃন্ত থেকে’ ‘ফুটন্ত সকাল’ ছিঁড়ে আনার কথা বলেছিলেন। কবিতার নরম শরীরে অকারণ জটিল ও দুর্বোধ্য ভাষার পোশাক পরিয়ে পাঠকদের কবিতা সম্পর্কেই ভীতসন্ত্রস্ত করে তোলার যে প্রয়াস চলছে, তা অনাগত ভবিষ্যতে কবিতার মতো এক মহত্তর শিল্পের পক্ষে মোটেই শুভঙ্কর নয়।

বাংলা ভাষার চির- 'পদাতিক'

প্রসঙ্গত আরেক কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়-এর কথাও বলা যাক। মাটির গন্ধমাখা মানুষের মিছিলে চির-পদাতিক এই কবি বাংলা কবিতাকে কল্পনাবিলাসের সুউচ্চ মিনার থেকে নামিয়ে যেভাবে নিরেট বাস্তবতার অভিমুখী করেছিলেন তা এক দৃষ্টান্ত। সহজ কথা নাকি সহজে বলা যায় না! কবিতার মতো একটি সাহিত্যকর্মে তা নাকি আরও বেজায় কঠিন! কিন্তু, সুভাষ মুখোপাধ্যায় তথাকথিত এই ‘কঠিন’ কাজটিকে ‘সহজ’ করতে পেরেছিলেন অবলীলায়। এর কারণ, ‘সহজ কথাটা’ আগে নিজের কাছেই ‘সহজ’ হওয়া দরকার। কী বলতে চান–তা হয়তো নিজেরই কাছে ‘স্বচ্ছ’ নয় বলেই এই অবস্থা! সুভাষ মুখোপাধ্যায় ছিলেন তাঁর জীবনচর্যা ও সৃষ্টিশীলতা দুটিতেই নিতান্ত ‘সহজ’। আর তাই তাঁর কবিতাও সম্ভবত সকলের কাছেই হৃদয়গ্রাহী–এই মূল্যায়নকে ‘সরল’ বলার উপায় নেই। কবি যে নিছক ‘নিজের ভিতরেই’ বাস করেন না, তারও যে রীতিমতো একটি সামাজিক সত্তা আছে, সমাজের সঙ্গে যার নিবিড় যোগসূত্রতা জরুরি, তিনি তাঁর যাপিত জীবনে এই ‘সত্য’ প্রমাণ করেছিলেন। সম্ভবত ‘এই কারণটিও’ তাঁর ‘সহজিয়া’ কবিসত্তার ভিত্তিভূমি।

২০২৩-এর ২ এপ্রিল সংখ্যার পাক্ষিক ‘দেশ’ পত্রিকায় নির্মাল্য মুখোপাধ্যায়-এর একটি প্ৰবন্ধ প্রকাশিত হয়। ‘অপরাজেয় বাংলা কবিতা’। অত্যন্ত সুলিখিত ও সুখপাঠ্য একটি প্রবন্ধ। প্রবন্ধের শেষ অনুচ্ছেদের একটি অংশ উদ্ধৃত করি: ”কেবল কবিতা রচনাতেই কবির দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না, সমগ্র জীবন ধরে ওই লোভের কুমিরগুলিকে এড়িয়ে কবিতা এক অন্য নিরবচ্ছিন্ন যাপন দাবি করে কবির কাছে।” কবি শঙ্খ ঘোষের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্ৰবন্ধ–‘দেখার দৃষ্টি’, যা তিনি সঙ্গত কারণেই স্মরণ করেছেন; কবিদের কাছেও যা হয়ে ওঠা উচিত ‘আলোকবর্তিকা’র মতো। বস্তুত, উত্তরাধিকারের শ্লাঘা তখনই ‘অধিকার’ হয়ে ওঠে, যখন ‘উত্তরাধিকার’ বস্তুটি যথার্থ পথে প্রবাহিত হয়। নইলে তা অনধিকারচর্চার ভ্রান্তিবিলাস মাত্র!

সব ছবিগুলিই অন্তর্জাল থেকে সংগৃহীত
লেখক মুর্শিদাবাদের একটি উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে বাংলার শিক্ষক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *