নারায়ণ সান্যাল ও কিশোর-কিশোরী সাহিত্য

নারায়ণ সান্যাল ও কিশোর-কিশোরী সাহিত্য

আমার পিতৃদেব, নারায়ণ সান্যাল, নিজেকে বলতেন ‘পল্লবগ্রাহী’। “Jack of all trades, master of…”! একটি নাটকীয় বাও করে বলতেন, “ইতিহাস তার পরীক্ষক।” তাঁর মৃত্যুর ষোল বছর পর যখন আবার ‘শার্লক হেবো’ এবং কিশোর সাহিত্যে নারায়ণ সান্যালের অবদান সম্বন্ধে কিছু লেখার ডাক পড়ল, তখন মনে হল ইতিহাস তাঁকে প্রাপ্য নম্বর দিতে ভোলেনি। কিছু পাঠকের স্মৃতিতে তাঁর ‘হেবো’ এখনও জ্বলজ্বল করছে।

হেবোর সঙ্গে আমার পরিচয় শৈশবের শেষে বা কৈশোরের শুরুতে। অনেক কথাই ভুলে গেছিলাম। নতুন করে পড়ে এবার অন্য আনন্দ পেলাম। অনেক পুরনো স্মৃতি যা এ লেখাগুলির সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে, তা মনে পড়ল। যে সব মানুষ চলে গেছেন স্মৃতির আঙিনায় তাঁদের সঙ্গ পেলাম ক্ষণিকের জন্য হলেও। এই জন্য ভ্রাতৃপ্রতিম ভাস্কর বসুর কাছে আমি কৃতজ্ঞ। কাজে-ভরা অকাজের দৈনন্দিনতায় এই স্মৃতি রোমন্থন এক অমূল্য সম্পদ।

আমাদের বাড়িতে গল্প পড়ে শোনাবার রেওয়াজ ছিল। বাবার মুখে তাদের আমেজ ও ছিল আলাদা। অনেক বড় বড় লেখকের লেখার সঙ্গে পরিচয় তাঁদের বই পড়ার আগেও হয়েছে কানে শুনে। বিশেষ করে মনে পড়ে শরৎচন্দ্রের কথা — ইন্দ্রনাথের উক্তি “ও কিছু নয়, সাপ…!” বাবার পড়ার মধ্য দিয়ে সেই সব নাটকীয় মুহূর্তগুলি, চরিত্রগুলি, আলাদা এক রূপ পেত। মনে পড়ে, রান্নাঘরে বড় পিসিমা রুটি বেলছেন, মা আগুনে তা সেঁকছেন, বাতাসে গরম রুটির গন্ধ, আর পিঁড়িতে বসে বসে বাবা গল্প পড়ে শোনাচ্ছেন। সেই গন্ধ, বাবার গলার স্বর, ও হেবোর কীর্তি কলাপ – সব মিলিয়ে এক দারুণ স্বাদ।

নিজের বাড়িতে লেখাতে নিমগ্ন লেখক

রেলের কামরায় বাঙালি চোর ধরার সেই গল্পটা, বা রসবড়া চুরির এপিসোড জীবন্ত ধরা দিত … (হেবোর এ গল্পগুলি তাঁর ‘কিশোর সমগ্রে’ আছে।) পড়লে মজা পাবেন, নিখাদ হাসি। এই সঙ্গে ছবিগুলিও তাঁরই হাতে আঁকা। আমি আরো জুড়ে দিতে চাই এর পিছনের পারিবারিক ইতিহাসের দু-একটি আঁচড়। কোনো বড় কাজের সময়, যেমন কারো বিয়ে, পৈতে, অন্নপ্রাশন জাতীয় উৎসবে আত্মীয়স্বজনরা আমাদের বাড়িতে বেশ কিছু দিনের জন্য জমা হতেন। এই শুভ উৎসবের বেশিরভাগই আমার জ্যাঠামশাই ডা: দুর্গা দাসের ডিহিরি অন সোনের বাড়িতে হত। অন্তত আমার যেটুকু মনে পড়ে।

শুভকাজের শেষে একটা অনুষ্ঠান হত। খুব সাদাসিধা মঞ্চ, শাড়ি টাঙানো স্টেজ, সেখানে নাটিকা বা পালা গান হত। বিষয় বস্তু — ইতিমধ্যে যা ঘটেছে তাকে রসে ভরে উপস্থাপনা। আমরা ছোটোরা ঘুরে বেড়াতাম গল্পের মালমসলা জোগাড় করতে। তারপর বাবার কানে কানে তা বলা। এরপর তা যেত পরের ধাপের কলাকৌশলীদের কাছে। রঙ চড়িয়ে তারা পালা গান বাঁধতো, সুর দিত এবং কেউ কেউ কার্টুন আঁকত। বাবা সুর দিতেন না, তবে কার্টুন আঁকতেন। তারপর তা পরিবেশিত হত সবার সামনে।

এমনি এক কাজের বাড়িতে ভাঁড়ার ঘরে এক গভীর রাতে এক সম্মানিত আত্মীয় ধরা পড়েছিলেন এক ক্ষুদে স্পাই-এর হাতে। সে কী কাণ্ড! রসবড়া চোরের গল্পটির মূল মশলাটি হয়তো এসেছিল এখান থেকেই। হেবোর সংকলনে আমার সবচেয়ে প্রিয় গল্প — মুকুট চুরির গল্পটি। পণ্ডিত মশাইয়ের চরিত্রটি অনবদ্য।  খানিকটা তুলে দিচ্ছি- 

  • “তফাৎ এই যে মহিষাসুরের টিকি নেই, পণ্ডিতমশায়ের বিজয় কেতন ফ্যানের হাওয়ায় পত পত করে উড়ছে ।….”
  • “বল ছুছুন্দর! তারিণীর হাত থেকে মুকুট নিয়ে কোথায় রেখেছিলি?…” 
  • “বল অকাল কুষ্মাণ্ড, অনরডান, মাথা থেকে মুকুট খুলেছিলি একবারও? অনৃত ভাষণ করলে এক ডাণ্ডায় তোর রাজাগিরি ঠাণ্ডা করে দেব।”…
  • “পরচুলে ছারপোকা ছিল স্যার!” 

হেবোর গোয়েন্দাবাজিতে নোট নেওয়া এবং এক এক করে কেটে দিয়ে সমাধানে আসা (মানে যাকে বলা হয় প্রসেস অফ এলিমিনেশন) ব্যাপারটা ভেবে আজ মজা পাই। বাবা কোন কিছু নিজে পড়ে আনন্দ পেয়েই যে ক্ষান্ত হতেন, তা নয়। সবার সঙ্গে ভাগ না করলে যেন তাঁর সবটা স্বাদ চেটেপুটে পাওয়া হত না। মাঝে মাঝে আমাদের আগাথা ক্রিস্টি বা পেরি মেসন অনুবাদ করে করে পড়ে শোনাতেন এবং এক সময়ে সশব্দে বইটি বন্ধ করে বলতেন, “এবার বার কর কে খুনি।” এই সময়েই এলিবাই, ফোরশ্যাডো এই সব কথা গুলি শুনে ছিলাম ভাসা ভাসা মনে পড়ে। তখনই বাবাকে ঐ হেবোর কায়দায় নোট নেওয়া আর তা কাটাকুটি করতে দেখেছি। যদিও খুনি কে তা বার করা আমার মাথার ওপর দিয়ে চলে যেত, কিন্তু পদ্ধতিটা মনে পড়ে। মাঝে বেশ কিছুদিন বাদ থাকার পর আবার হেবোর উদয় হয় দেব সাহিত্য কুটীরের শারদীয় পূজাবার্ষিকী ‘মনিদীপা’তে, বাংলা ১৩৮১ বা ইংরেজি ১৯৭৪ সালে। এই কাহিনিতে অভিনব পদ্ধতিতে গুপ্তধনের সন্ধান করে হেবো। গল্পের নাম, অনেকটা সেই শার্লক হোমসের বিখ্যাত বইয়ের ধাঁচে – ‘শার্লক হেবো ফিরে এলেন।’

লেখক অর্থাৎ হেবোর কাকার এক বন্ধুর কাছে ছিল পূর্বপুরুষের ডাইরি। তাতেই ছিল এক গুপ্তধনের সংকেত। আরো জানা ছিল যে সেই বন্ধুর ঠাকুর্দা সংকেতের সমাধান করে অন্য একটি ডাইরিতে লিখে রেখেছেন। সেই পুরনো ডাইরি থাকলেও নতুন ডাইরি না পেলে সংকেত সমাধান খুঁজে পাওয়া যাবে না। হেবো প্রমাণ করে দেয় যে বন্ধুর ঠাকুর্দা কোনো নতুন ডাইরি লেখেননি। বরং পুরনো ডাইরিতে বেশ বুদ্ধি করে সংকেত দিয়ে গেছেন।
পুরনো ডাইরি আর নতুন ডাইরি তে হাতের লেখা ছিল এক। কিন্তু সমাধান লুকোনো ছিল বানানের মধ্যে। পূর্বপুরুষ ডাইরি লিখেছিলেন উনবিংশ শতাব্দীতে যখন রেফের পরে দ্বিত্ব বর্জন প্রচলিত নয়। আর বন্ধুর ঠাকুর্দার লেখা ছিল বিংশ শতাব্দীতে – তাঁর মেধাবী উত্তরাধিকারীর জন্য সূত্র ছিল এটুকুই। যেখানে পূর্বপুরুষ লিখেছেন – পূর্ব্ব, সূর্য্য, আশ্চর্য্য, সেখানে একদম শেষের দিকে ঠাকুর্দা লিখেছেন – পূর্ব, সূর্য, আশ্চর্য। এদিকে রটনা হয়ে গেছে অন্য ডাইরির, কাজেই তার খোঁজ না পেলে সমাধান হবে না। কিন্তু ঠাকুর্দার আশা তাঁর উত্তরাধিকারী পূরণ না করতে পারলেও হেবো করে দেয়।

শার্লক হেবো - নারায়ণ সান্যাল অঙ্কিত ছবি
ভুতোদার গল্প - নারায়ণ সান্যাল অঙ্কিত ছবি

তাঁর কিশোর সাহিত্যের ওপর কাজ গুছিয়ে দুটি ভল্যুমে প্রকাশ করেছেন দে’জ প্রকাশনী – ‘কিশোর সমগ্র ও ‘কিশোরী সমগ্র’ – এই বই দুটিতে। হেবো ছাড়া ঐ কিশোর সংকলনে আরেকটি উল্লেখযোগ্য লেখা — ‘ভূতায়ন।’ ভুতোদা চরিত্রটি হেবোর মত শার্প নয়, কিন্তু স্পোর্টসম্যান স্পিরিটে টইটুম্বুর। লেখক লিখছেন,

ভুতোদাকে প্রথম দিন থেকেই আমি চিনতাম। না চিনে উপায় নেই। সে ছিল আমাদের স্কুলের চামপিয়ান প্লেয়ার। এ তল্লাটের সবচেয়ে নাম করা গোল কিপার। …একবার আমাদের ক্লাসে এক কম বয়সী মাস্টার মশাই পড়াতে আসেন। প্রায় ভুতোদারই সমবয়সী। ভুতোদার কি একটা দুষ্কর্মে তিনি চটে উঠে বলেছিলেন, ‘হোয়াটস য়োর নেম? য়ু শ্যাল হ্যাভ টু পে হেভি পেনাল্টি ফর য়্যোর ইনসলেনস।’ ভুতোদা উঠে একগাল হেসে বলেছিল, ‘মাই নেম ইজ পেনাল্টি ইটার, স্যার!’

বাকিটা পড়ে নিন। গল্পটা এখানেই শেষ নয়। 

ভুতোদা ছিল সব খেলায় সেরা। তার বন্দুকে টিপ করে বেলুন ফাটানোর গল্প, মেলায় দোকানিকে কুপোকাত করার কাহিনি না উল্লেখ করেই পারলাম না। দারুণ! গল্পটা বলব না, আপনারা পড়ে নেবেন। কিন্তু এই গল্পটির ভ্রূণ যা বাবার কাছে শুনে ছিলাম সেটা বলি।

গল্পটা বাবার ছেলেবেলার। আমার বড় জ্যাঠামশাই, (হ্যাঁ সেই ডিহিরি অন সোনের ডাক্তার) — তাঁর ছিল অসীম লেগে থাকার ক্ষমতা। বাবা বলতেন ‘টেনাসিটি’। একবার কৃষ্ণনগরের বারো দোলের মেলায় জ্যাঠামশাই গেছেন এক বন্দুক দিয়ে বেলুন ফাটানর স্টলে। কয়েকবার চেষ্টা করে পকেটের সব পয়সা খরচ করে যখন কিছুই জিততে পারেননি তখন দোকানদার তাঁকে তাচ্ছিল্য করে অপমানকর কিছু বলে, যা তাঁর কিশোর মনে বেজায় লাগে।

জেঠু নাকি দাঁত চিপে ছাতের ঘরে দোকানিকে নকল করে আপন মনে বলতেন, “কি খোকা, আরো খেলবে? পয়সা ঠুনঠুন?… দাঁড়া দেখাচ্ছি…!”
পরের সাত দিন জেঠু অনর্গল সকাল- সন্ধ্যা তাক করা অভ্যাস করতে থাকেন চিলেকোঠায় ওঠার সিঁড়িতে জিনিস রেখে। শেষের দিকে নাকি কাচের বোতল-টোতল ও রাখতেন। একেবারে অর্জুনের লক্ষ্যভেদ – আরো হাত পাকাতে। সে নাকি এক আশ্চর্য অধ্যবসায়! দাদার এই ব্যাপারটা তাঁর শিশুমনে দারুণ রেখাপাত করেছিল।

সপ্তাহান্তে জেঠু যখন মেলায় গিয়ে খেলতে শুরু করেন, তা দেখতে নাকি ভিড় জমে যায়। দোকানি পরে হাত জোড় করে বলে… ‘আব আপ রুখিয়ে। বাঙলা করে, যা চাও নিয়ে আমায় উদ্ধার কর।’ তখন আর ‘কি খোকা’ নয় একেবারে — ‘আপনি, আজ্ঞে স্যার!’ (বাকি নাটকটা ভুতোদার গল্পে অনেক রসিয়ে বলা আছে।) জেঠু, বাবার জন্য একটি প্ল্যাস্টিক হাতি জিতে তাঁকে উপহার দেন। প্রথম বিলিতি সেলুলয়েডের খেলনা। সেই অ্যান্টিক খেলনাটি থাকত আমাদের কাচের আলমারিতে সাজানো। টেনাসিটির কথা মনে করাতেই বোধ হয়। 

যাই হোক বাবার গল্পে ভুতোদা বন্ধুদের কথা ভেবে বেছে নিয়েছিল একটা ক্যারম বোর্ড আর নিজের জন্য ডন ব্র্যাডম্যানের সই ছাপা উইলো কাঠের ক্রিকেট ব্যাট। ভুতোদার অনেক কাণ্ড কারখানা আছে, যা নিঃসন্দেহে আজ ও কিশোর মনে সাড়া জাগাবে।

পরিশেষে লেখক বলছেন, “এ হেন ভূদ্দাকে লীডার করব না তো কি ঐ মেনী মুখো পিলে-ডিগ-ডিগ বই-পোকা জিবে গজাকে করব? তোমরাই বল?”

কিশোর সাহিত্যের মস্ত ভূমিকায় তিনি বিদ্যাসাগর থেকে ত্রৈলোক্যনাথ, উপেন্দ্রকিশোর, সুকুমার রায়, ও প্রায় সমসাময়িক লেখক — নারায়ণ গাঙ্গুলি, প্রেমেন্দ্র মিত্র, সত্যজিৎ রায়ের কথা স্মরণ করে লিখছেন, “কে বলে বাংলায় কিশোর সাহিত্য অবহেলিত?” কিশোরী সাহিত্যের ক্ষেত্রে লীলা মজুমদার, আশাপূর্ণা দেবীর কথা মনে রেখেও সেই দৃঢ় স্বর কিন্তু শোনা যায় না।

কিশোরী সাহিত্য প্রসঙ্গে এই বইয়ের ভূমিকাটি অমূল্য। লেখক এখানে কিশোরীদের জন্য কেন লেখা দরকার তার বিশ্লেষণ করেছেন এবং সেই সঙ্গে সমাজ চেতনার যে দিকে আলোকপাত করেছেন তা মর্মন্তুদ। কিশোরীদের মন তৈরী হবার আগেই সংসার তাদের কাছে এক পসরা দাবি নিয়ে এসে দাঁডায়। তিনি তাতে সচেতন। বাঙালি কিশোরীদের জন্য সাহিত্যে এক বিকট শূন্যতা তিনি অনুভব করেছেন। এই নিয়ে আলোচনাটি আমি সুধী পাঠক/পাঠিকাকে পড়তে অনুরোধ করব। এইখানে তিনি ত্রৈলোক্যনাথের অবদান স্বীকার করেছেন এবং আমার নিজের অভিজ্ঞতায় আমি তাতে একমত।

এইখানে বলে নিই ত্রৈলোক্যনাথের ‘কঙ্কাবতী’ পড়ে আমি কিন্তু খুবই আপ্লুত হয়েছিলাম। আমার বয়স তখন বারো। নিপুণ অদৃশ্য যে তরবারিতে শৈশব দ্বিখণ্ডিত হয়েছিল অবাক কিশোরী বেলায় উত্তরণে, আমার ক্ষেত্রে তা ঐ বইটির হাত ধরে। খেতুর জন্য কেঁদেছিলাম, আজও মনে আছে। হয়ত ঐ সময়ে ঐ বইটাই হাতের কাছে পেয়েছিলাম, তাই। অতএব ওটি সার্থক কিশোরী সাহিত্য।

এরপর অন্তত সুচিত্রা ভট্টাচার্য এবং বাণী বসুর কিছু লেখায় আমি কিশোরী মনন নিয়ে কাজের কথা পড়েছি, মনে করতে পারি। আরো ইদানীং কালের কথা বলতে পারি না।

কিশোরীদের জন্য তাঁর কিশোরী সংকলনে দেশ বিদেশের নানান গল্প তিনি ‘হিন্দের বন্দী’ করেছেন এবং সে কথা ফুটনোটে স্বীকার করেছেন। হয়ত সেগুলো ইংরেজিতে পড়া যায় বলে তা আমার ততটা ভাল লাগেনি। নিঃসন্দেহে ইন্টারনেটের আগের যুগে, অনেক বাঙালী কিশোরী পাঠক সে সুযোগ পায়নি। অনেকে বাংলায় পড়ে বেশি রস পেয়েছে। যদিও তাঁর কিশোরী সাহিত্যের গল্পগুলিতে তেমন করে তিনি আমার মন ছুঁতে পারেননি, কিন্তু তাঁর লেখা ‘আম্রপালী’ পেরেছে, কিন্তু তা কি কিশোরী সাহিত্য? ভাবতে হয়।

মনে হয়েছে এই দেখার চশমাটি পুরুষের বলেই অনেকটা অন্য রকম। কিশোরী মনে পৃথিবীর রঙ আলাদা। সেটা লেখক ঠিক ধরতে পারেননি। আবার হয়তো সেটি আমার খামতি, লেখকের নয়। কিশোরীরা পড়ে বলতে পারবে।

তিনি যে কিশোরীদের কথা ভেবেছেন, এই জন্য আমি তাঁর কাছে অপরিসীম কৃতজ্ঞ। এই প্রসঙ্গে তাঁর উক্তি তুলে দিই:

আমার সনির্বন্ধ অনুরোধ: নতুন করে কিশোরী সাহিত্য রচনা কর তোমরা। …[তাদের জন্য] ঐ যারা ইংলিশ মিডিয়াম ইস্কুলে ভর্তি হতে পারেনি। …পার না তোমরা শরদিন্দুর ‘ঝিন্দের বন্দী’র কায়দায় এনিড ব্লাইটেন কে হিন্দের বন্দী করতে? ….আর তোদেরও বলি, দিদিভাইয়ের দল তোরা নিজেরাই কি পারিস না আ্যনি ফ্রাঙ্কের দিনলিপিকে হিন্দের বন্দী করতে? (কিশোরী সমগ্র,পৃষ্ঠা ২০)

তা তো পারেই… তাদের নিজেদের গল্প দিয়েই অর্ঘ্য সাজাতে পারে। কিশোর সমগ্রের প্রথম গল্প, ‘ভাস্করণ স্টেনো’-তে নেতাজি সুভাষচন্দ্রের জীবনী লেখার চেষ্টা করছেন। কথাকোবিদ তাঁর কলমের ক্ষীণশক্তির কথা স্বীকার করছেন এখানে বারবার। এ লেখাটির সারকথা — বিবেক সবার বড়।

মনে হয় এই মূল মন্ত্রটি তিনি উচ্চারণ করতে চেয়েছেন আচার্যের মত আমাদের কিশোরদের কানে। এই একই বীজমন্ত্রের ধুন শুনি তাঁর সাহিত্যের বিভিন্ন বিষয় ধারায় — সত্যকাম, পি কে বাসু সিরিজে বা আরো অনেক বইতে —“আত্মদীপ ভব।” ‘ভাস্করণ স্টেনো’ লেখাটির শেষে তিনি লিখছেন, “এইখানেই মানুষের সঙ্গে যন্ত্রের তফাৎ।” তাই কি?

তাহলে আসুন ‘রবি বলে টু কি’ তে। এটা পাবেন ‘কিশোরী সমগ্রের’ সংকলনে। গল্পটি ২০৫০ সালে একটি বাতিল রোবট কে নিয়ে। জাপান থেকে কিনে এনে এক বাবা তাঁর মেয়েকে উপহার দেন এমন এক রোবট। গল্পটি রোবটের সঙ্গে ছোট মেয়েটির বন্ধুত্ব্রের গল্প। শেষমেশ প্রশ্ন —রোবটের কি প্রাণ আছে? বাকি গল্পটা বলছি না। অপূর্ব সুন্দর কাহিনি। এইখানে আড়ালে দাঁড়িয়ে আমি দেখি বিজ্ঞানী ইঞ্জিনিয়ার সত্তার সঙ্গে কল্পনাবিহারী গল্পকার নারায়ণ সান্যালের দ্বৈরথ সমর। কে জেতে?

অবশেষে কল্পনারই জয় হয়। হয়ত তাঁর হঠাৎ মনে পড়ে যায় আইনস্টাইনের সেই উক্তি : ‘Imagination is greater than knowledge.’ সেই কথাটাই হয়ত শেষ কথা। সেটাই আমাদের ভাববার সময় এখন কিশোর কিশোরীদের কথা মনে রেখে। জ্ঞানের ভারে জর্জরিত না করে ওদের জন্য একটু খেলার সময়… একটু কল্পনার অবসরের কথা।

তথ্যঃ  

নারায়ণ সান্যাল, কিশোরী সমগ্র, দে’জ পাবলিশিং ২০০১

নারায়ণ সান্যাল, কিশোর সমগ্র, দে’জ পাবলিশিং ২০০২

জন্ম ও বড় হওয়া কলকাতায়। এখন ক্যালিফোর্নিয়ার বাসিন্দা। বাঙলা ও ইংরিজি দুই ভাষাতেই লেখার চেষ্টা। বাঙলা ছোট গল্প ও উপন্যাসিকা ‘নবকল্লোল', 'শুকতারা', 'উৎসব', 'শঙ্খ'ও আরও নানা পত্রিকায় প্রকাশিত। বাঙলা বই — ‘আমার বাস কোথা যে’ (২০০৩-দেব সাহিত্য কুটির) ইংরাজী লেখা —Shadow Birds—Story of a Young Girl During the Partition of India (Published 2019 available in Amazon) Glass Bangles — awarded --Katha contest 2003, published in India Currents Magazine শখ — দেশ ভ্রমন, বাগান, শিশু-সঙ্গ, আরো অনেক কিছু। সবচেয়ে আনন্দ —আপন মনে লিখতে। লেখক জীবনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ —পিতৃদেব শ্রী নারায়ণ সান্যালের শেষ বই রূপমঞ্জরীর শেষ অধ্যায় সম্পূর্ণ করা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *