ওপেনহাইমার, পারমাণবিক বোমা, ও পৃথিবীর ভবিষ্যৎ

ওপেনহাইমার, পারমাণবিক বোমা, ও পৃথিবীর ভবিষ্যৎ

সুজনদার (দাশগুপ্ত) স্মৃতির উদ্দেশে 

হলিউডের পরিচালক ক্রিস্টোফার নোলানের “ওপেনহাইমার” ছবিটি মুক্তি পাওয়ার পর চারিদিকে শোরগোল পড়ে গেছে। মার্কিন প্রেস তো প্রশংসায় পঞ্চমুখ! দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ষাট বছর পর, পারমাণবিক বোমা আবিষ্কারের রোমান্টিকতা আর তৎকালীন রাজনীতির চতুর টানাপোড়েন ছবিটার কেন্দ্রীয় বিষয়। সিনেমার পর্দায় দেখতে পেলাম সেই সব মানুষদের যাঁরা গত শতাব্দীতে বৈজ্ঞানিক চিন্তা-জগতে এনেছিলেন বিপ্লবের ঢেউ। এই চলচ্চিত্রের বিষয়টি আজও প্রাসঙ্গিক, কারণ বৈজ্ঞানিক গবেষণার নৈতিকতা নিয়ে সনাতন প্রশ্নগুলো ইদানীং আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। কিন্তু ছবিতে দেখতে পাইনি হিরোশিমা আর নাগাসাকিতে ধ্বংস এবং মৃত্যুর রূপ। দেখানো হয়নি ব্যাঙের ছাতা আকারের বিধ্বংসী মেঘ (mushroom cloud) – পারমাণবিক বোমাবর্ষণের ফলস্বরূপ যে করাল মেঘ জাপানের দুটো শহরকে সম্পূর্ণ গ্রাস করেছিল। সেই সংহারক মেঘ আজ স্মরণ করিয়ে দিলে হয়তো টনক নড়ত কিছু দরদী নেতার, যাঁদের কয়েকজন এখনও অবশিষ্ট আছেন। আজকের মানুষও দেখতে পেত শুধু একটি পারমাবিক অস্ত্রের কী নিদারুণ কালান্তক ক্ষমতা। সেই রকম পারমাণবিক বোমা অধুনা অনেক দেশে বহু সংখ্যায় রয়েছে।

নাগাসাকির আকাশে পারমাণবিক মেঘ

আজ তাই সে যুগের বিজ্ঞানীরা, যাঁরা ওই মারাত্মক অস্ত্র তৈরির নেশায় মেতেছিলেন, তাঁদের মানসিকতা ফিরে দেখার সময় হয়েছে। হিরোশিমা এবং নাগাসাকির অভিজ্ঞতার পর কি তাঁরা মানসিকভাবে বিধ্বস্ত হননি? পরবর্তীকালে অস্ত্রগুলোর ভবিষ্যৎ নিয়ে কি তাঁরা একেবারেই চিন্তা করেননি? তাঁদের মানসিক অভিজ্ঞতা মূল্যায়ন করার ক্ষমতা আমাদের আছে কি? এই আলোচনা করতে শুরু করতে হয় প্রথম থেকে।

ম্যানহাটন প্রজেক্ট

আজ থেকে ৮১ বছর আগে, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ তখন পুরদমে চলছে, মার্কিন রাষ্ট্রপতি ফ্র্যাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্টের আমন্ত্রণে এক তরুণ পদার্থবিদ এগিয়ে এলেন একটি গোপন গবেষণাকেন্দ্র গড়ে তুলতে। সেটা ১৯৪২ সালে। ইনিই জে. রবার্ট ওপেনহাইমার। গবেষণাগার স্থাপনের জন্যে জায়গা বাছা হল লস অ্যালামোস, নিউ মেক্সিকো। গবেষণার গূঢ় উদ্দেশ্য বিশ্বের প্রথম পারমাণবিক বা অ্যাটম বোম্ব তৈরি করা। প্রকল্পটির কোড নাম – ম্যানহাটন প্রজেক্ট।

প্রজেক্ট সফল করতে দেশের অধিকাংশ নামী বিজ্ঞানীদের সাহায্য নিলেন ওপেনহাইমার। তাঁর নেতৃত্বে তিন বছরেরও কম সময় লাগল কাজ সফল হতে। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হ্যারি ট্রুম্যানের নির্দেশে, ১৯৪৫ সালে, দুটি পারমাণবিক বোমা ফেলা হল জাপানের জোড়া শহর হিরোশিমা এবং নাগাসাকিতে। প্রাণ হারাল লক্ষ লক্ষ অসহায় মানুষ। পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ থেকে প্রাণে বেঁচে, টোগে সানকিচি তাঁর “হিরোশিমার কবিতায়” (Poem of Hiroshima) লিখলেন:

সূর্য ওঠে
নিঃশব্দ চরণে
নিঃশব্দেই অস্ত যায় যুদ্ধক্ষেত্রে
আর মানুষ হারাল
নিজের সত্তা
হৃৎপিণ্ড খুবলে খাওয়ার উৎসবে
(অনুবাদঃ লেখক) 

ম্যানহ্যাটন প্রজেক্টের নায়ক – ওপেনহাইমার

প্রযুক্তির সফল ব্যবহারের জন্য দেশে বিদেশে ছড়িয়ে পড়ল ওপেনহাইমারের খ্যাতি – জনপ্রিয় হলেন “পারমাণবিক বোমার জনক” হিসেবে। ওঁর অনুপ্রেরণায়, সদ্য আবিষ্কৃত নিউক্লিয়ার বিভাজন (nuclear fission) তত্ত্ব বোমা বানানোর কাজে লাগিয়েছিলেন বিজ্ঞানীরা। ম্যানহাটন প্রোজেক্ট-এর সাফল্য কেবল ওই দুটি ব্যাপারে সীমাবদ্ধ রয়ে গেল। বিশ্ব জানল পারমাণবিক বোমার মারক শক্তির কথা। এই সর্বনাশা প্রযুক্তি সৃষ্টি করার মূলে নিজের ভূমিকা নিয়ে অপরাধবোধে ভুগতে লাগলেন ওপেনহাইমার। বাকি জীবনটা উৎসর্গ করলেন পারমাণবিক শক্তি নিরস্ত্রীকরণের কাজে – সোচ্চার হলেন এই প্রযুক্তির প্রসারের বিরুদ্ধে গোটা বিশ্বে জনমত গড়ে তুলতে।

ক্রিস্টোফার নোলানের “ওপেনহাইমার”

পরিচালক ক্রিস্টোফার নোলানের “ওপেনহাইমার” ছবিটা দুটি প্রধান আখ্যানের সমন্বয়ে তৈরি। প্রথমটি ঘটেছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। ছবির প্রথমাংশে রয়েছে জেনারেল লেসলি গ্রোভসের তত্ত্বাবধানে নিউ মেক্সিকোর লস আলামোস গবেষণাগার পত্তনের কাহিনী। নানা বাধা বিঘ্ন অতিক্রম করে, ওপেনহাইমারের নেতৃত্বে, এক দল বিজ্ঞানী অসাধ্য সাধন করলেন (পাদটীকা দেখুন)। তৈরি করলেন বিশ্বের প্রথম পারমাণবিক বোমা। দ্বিতীয়াংশের ঘটনাকাল এক দশক পরে। এই আখ্যানের কেন্দ্র ওপেনহাইমারের দুঃখজনক পতন কাহিনি। ওঁর জাতীয়-নিরাপত্তা বিষয়ক ‘সিকিউরিটি ক্লিয়ারেন্স’ অন্যায় ভাবে নাকচ করা হল। পারমাণবিক বোমার চেয়ে বেশি শক্তিশালী, গণবিধ্বংসী হাইড্রোজেন বোমা তৈরির বিরোধিতা করেছেন বলে ওপেনহাইমার এই অনুমোদন হারালেন। সেই সময়ে পারমাণবিক শক্তি কমিশনে অগ্রণীর ভূমিকায় ছিলেন ধূর্ত রাজনীতিবিদ লুইস স্ট্রস। এঁরই চক্রান্তের শিকার হলেন ওপেনহাইমার।

অ্যাটম বোমা নিক্ষেপের পর হিরোশিমা

তুরুপের তাস

কর্মজীবনের প্রথমে, বিজ্ঞানী মহলে ওপেনহাইমার ছিলেন এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। তাঁর গবেষণার মূল বিষয় ছিল মহাকাশ রহস্যের তাত্ত্বিক অনুসন্ধান। ম্যানহাটন প্রোজেক্টের হাল ধরার পর পারমাণবিক বোমা তৈরির ব্যাপারে মন দিয়েছিলেন তিনি। ওপেনহাইমার বিশ্বাস করতেন, যুদ্ধে নাৎসি জার্মানিকে পরাজিত করা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রর একটি নৈতিক দায়িত্ব। তাছাড়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধর অবসানে হয়তো অনাবশ্যক মৃত্যুও থামবে। মনে করেছিলেন পারমাণবিক বিস্ফোরণ যুদ্ধজয়ের তুরুপের তাস। অ্যাটম বোম যেখানে ফেলা হবে, ধ্বংস হবে সে দেশে। অর্থাৎ তৎক্ষণাৎ আত্মসমর্পণ ছাড়া কোনও উপায় থাকবে না। এতে শেষ পর্যন্ত লোকক্ষয় কম হবে, আর সম্ভব হবে যুদ্ধরত মার্কিন সেনাবাহিনীকে তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরিয়ে আনা। কিন্তু সেই সঙ্গেই ওপেনহাইমার বুঝেছিলেন পারমাণবিক বিস্ফোরণ কী ভয়ঙ্কর রূপ নিতে পারে!

ওপেনহাইমারের পতন

ওপেনহাইমারের পতনের কারণ বুঝতে হলে আর একজনের কথা বলা দরকার – হাঙ্গেরি থেকে আসা আমেরিকান তাত্ত্বিক পদার্থবিদ, এডওয়ার্ড টেলার। ম্যানহাটন প্রোজেক্টে টেলার-এর একটা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব ছিল – পারমাণবিক বোমার অন্তর্মুখি বিস্ফোরণ (implosion) পদ্ধতির বিস্তারিত নকশা করা। টেলার ছিলেন উঁচু মানের পদার্থবিদ। ম্যানহাটন প্রকল্প শেষ হবার পর তাঁর উদ্যোগেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হাইড্রোজেন বোমা বানানোর কাজে হাত দিয়েছিল (আধুনিক হাইড্রোজেন বোমা প্রযুক্তির ভিত্তি হল টেলার-উলাম ডিজাইন)। এই বোমার ব্যাপারে ওপেনহাইমারের সঙ্গে টেলারের মতবিরোধ নোলানের ছবিতে নাটকীয় ভাবে দেখানো হয়েছে। টেলার ছিলেন হাইড্রোজেন বোমা তৈরির সমর্থক, আর ওপেনহাইমার বিরোধী। টেলার ভাবতেন সোভিয়েত ইউনিয়নকে এই মারাত্বক অস্ত্র তৈরি থেকে বিরত করতে হলে আমেরিকার হাইড্রোজেন বোমা বানানো ছাড়া আর কোনও পথ নেই। অন্যদিকে হাইড্রোজেন বোমার ধ্বংসাত্মক শক্তির নিয়ন্ত্রণহীন প্রয়োগের সম্ভাবনায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলেন ওপেনহাইমার। তাই বিকল্প হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে প্রচলিত অস্ত্র তৈরির দিকে মনোযোগ দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন।

মতবিরোধ তুঙ্গে উঠল ১৯৫৪ সালে। ওপেনহাইমারের বিরুদ্ধে ওঁর সিকিউরিটি ক্লিয়ারেন্সের শুনানিতে সাক্ষ্য দিলেন টেলার। অতীতে ওপেনহাইমারের সঙ্গে যে কমিউনিস্টদের যোগাযোগ ছিল তা উনি ভালো চোখে দেখেননি। জবানীতে বললেন, ‘হাইড্রোজেন বোমার নির্মাণ প্রকল্প নিরাপদ রাখতে হলে ওপেনহাইমারের উপস্থিতি কাম্য নয়।’ মোক্ষম চাল চেলেছিলেন টেলার। রিপাবলিকান সেনেটার ম্যাককার্থির যুগে কমিউনিস্ট আখ্যা ছিল অত্যন্ত বিপজ্জনক। চক্রান্ত থেকে বেরোনোর রাস্তা ওপেনহাইমার পেলেন না। উনিশ দিন গোপন শুনানির পর যে শীর্ষস্থানীয় সরকারি বিজ্ঞানী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পারমাণবিক বোমা তৈরি করায় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তিনিই সোভিয়েত-এর গুপ্তচর হিসেবে অভিযুক্ত হলেন। আমেরিকার হিরো হয়ে দাঁড়ালেন আমেরিকার শত্রু। কেড়ে নেওয়া হল ওপেনহাইমারের সিকিউরিটি ক্লিয়ারেন্স। সেই সঙ্গে লুপ্ত হল তাঁর সরকারি-বিজ্ঞানী পদ। অবহেলায় আর ভগ্ন হৃদয় নিয়ে কাটল তাঁর অবশিষ্ট জীবন।

হাইড্রোজেন বোমা

দুর্ভাগ্যবশত, মার্কিন কর্মকর্তারা ওপেনহাইমারের কোন সতর্কবানীই কানে তোলেননি। পারমাণবিক অস্ত্রের বিধ্বংসী রূপ দেখেও শুরু হল আন্তর্জাতিক অস্ত্র প্রতিযোগিতা। পারমাণবিক প্রযুক্তি নিয়ন্ত্রণে ওপেনহাইমারের আন্তর্জাতিক সহযোগিতার আহ্বানও উপেক্ষা করা হল পুরোপুরি। তৈরি হল প্রথম হাইড্রোজেন বোমা।

১৯৫২ সালের নভেম্বরে মাসে হাইড্রোজেন বোমার বিস্ফোরণ ঘটাল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। স্থান মার্শাল দ্বীপপুঞ্জ। সোভিয়েত ইউনিয়ন বোমা ফাটাল তার এক বছর পরে, ১৯৫৩ সালের আগস্ট মাসে। এই দুটি বিস্ফোরণের সঙ্গে সঙ্গে শুরু হল শীতল সংগ্রাম (cold war) – পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতার এক নতুন অধ্যায়। আর চালু হল পারমাণবিক যুদ্ধের ক্রমন্বয় হুমকি, যা আজও থামেনি।

এখানে আর একটা কথা বলি। হাইড্রোজেন বোমায় যে প্রক্রিয়াটি কাজে লাগানো হয়েছিল, তার নাম নিউক্লিয়ার ফিউশন (nuclear fusion)। এই মৌল-এর দুটো আইসোটোপকে (ডিউটেরিয়াম ও ট্রিটিয়াম) এক সঙ্গে গলিয়ে যোগ করলে (fuse) পাওয়া যায় হাইড্রোজেন বোমার প্রচণ্ড শক্তি । আইসোটোপ এবং হাইড্রোজেন বোমার কথায় পরে আসছি।

ভুল শোধরানোর পালা

সময়ের সঙ্গে নতুন প্রজন্মের মাতামত পাল্টায়। ওপেনহাইমারের মৃত্যুর প্রায় পঞ্চাশ বছর পর, ২০১৪ সালে, ওঁর শুনানির সমস্ত প্রতিলিপি ডিক্লাসিফাই (গোপনীয়তার চুক্তি সরিয়ে নেওয়া) করল প্রেসিডেন্ট ওবামার প্রশাসন। দেখা গেল হাইড্রোজেন বোমা প্রকল্পে ওঁর বিরোধিতার কারণ কেবলই প্রযুক্তিগত এবং সামরিক, সোভিয়েতদের প্রতি সহানুভূতিশীলতার জন্য নয়। ২০২৩ সালে, ওপেনহাইমারের সিকিউরিটি ক্লিয়ারেন্স প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত একটা “ত্রুটিপূর্ণ প্রক্রিয়া” আখ্যা দিল বাইডেন প্রশাসন। এনার্জি সেক্রেটারি, জেনিফার এম. গ্রানহোম, একটি বিজ্ঞপ্তিতে জানালেন, ১৯৫৩ সালে পারমাণবিক শক্তি কমিশনের যে সিদ্ধান্তের ফলে ওপেনহাইমার সিকিউরিটি ক্লিয়ারেন্স হারিয়েছিলেন, সেই প্রক্রিয়ায় কমিশন নিজস্ব নিয়মই ভঙ্গ করেছিল। ফলে ডঃ ওপেনহাইমার হয়েছিলেন পক্ষপাতিত্ব এবং অন্যায়ের শিকার। শুনানির প্রতিলিপিগুলো পরীক্ষা করলেই তাঁর দেশপ্রেম ও আনুগত্য সংশয়হীনভাবে প্রমাণিত হয়।

অবশেষে, মৃত্যুর প্রায় ষাট বছর পরে, জে. রবার্ট ওপেনহাইমার মিথ্যে অভিযোগ থেকে রেহাই পেলেন। মরণোত্তর তাঁর সিকিউরিটি ক্লিয়ারেন্স পুনর্স্থাপন করল মার্কিন সরকার আর বিজয়ী হলেন সেই সব ঐতিহাসিক, যাঁরা এতদিন এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন।

ভগবদগীতা

যুদ্ধের পর নানান ভাষণে, ওপেনহাইমার বহুবার পারমাণবিক অস্ত্রের বিপদ সম্পর্কে সকলকে সতর্ক করেছেন। তাঁর নিরস্ত্রীকরণের আবেদন সেই সময় সচেতনতা বাড়াতে সাহায্য করেছিল। ১৯৬৫ সালে একটি টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে ভগবদগীতার কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের দৃশ্য তিনি বর্ণনা করেছিলেন। অর্জুনকে মহাযুদ্ধে যোগ দিতে কৃষ্ণ অনুপ্রাণিত করছেনঃ ‘কর্ম সাধন হল ক্ষত্রিয়র ধর্ম।’ তারপর নিজের বিশ্ব-রূপ প্রকাশ করে কৃষ্ণ বললেন, “এখন আমিই মৃত্যু, জগত ধ্বংসকারী।” পরীক্ষামূলক প্রথম পারমাণবিক অস্ত্র বিস্ফোরণ – ট্রিনিটি টেস্ট-এর (হিরোশিমা-নাগাসাকি ধ্বংসের আগে এই বিস্ফোরণ নিউ মেক্সিকোর মরুভূমির ওপর পরীক্ষামূলক ভাবে ঘটানো হয়েছিল) বিধ্বংসী রূপ নিজের চোখে দেখে কৃষ্ণ-উবাচই মনে পড়েছিল তাঁর। আরও বলেছিলেন, “I suppose we all thought that one way or another।” অর্থাৎ, জগতসংহারী ঈশ্বরের আসনে নিজেদের (নিজে এবং সতীর্থদের) বসিয়ে ধ্বংসের উল্লাসে মেতেছিলেন তাঁরা।

নিরস্ত্রীকরণ চুক্তি

ট্রিনিটি পরীক্ষার পর এবং হিরোশিমা আর নাগাসাকিতে বোমাবর্ষণের আগে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছিল। ঘটনাটা ঐতিহাসিক হলেও এর গুরুত্ব সেই সময় পুরোপুরি বোঝা যায়নি।

রাষ্ট্রপতি হওয়ার এক মাসের মধ্যে, পারমাণবিক অস্ত্র বিষায়ক পরামর্শ সরকারকে দেওয়ার উদ্দেশ্যে হ্যারি ট্রুম্যান একটি কমিটি গঠন করেছিলেন। ‘অন্তর্বর্তী কমিটি’ নামের এই পরিষদের উদ্যোগে, ১৯৪৫ সালের ৩১ মে, একটি আলোচনা সভা আয়োজিত হয়েছিল। অধিবেশনের গোপন নথি ডিক্লাসিফাই করার পর জানা গেল অধিবেশনে অংশগ্রহণকারী ওপেনহাইমার এবং অন্যান্য বিজ্ঞানী ও নেতারা, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরের কিছু কিছু ঘটনা বা পরিস্থিতির পূর্বাভাস পেয়েছিলেন। বহু বছর কেটে যাবার পরে দেখা গেল কিছু ঘটনা ওঁদের ভবিষ্যদবাণীর সঙ্গে কাকতালীয় ভাবে মিলে গেছে। আবার কিছু আদপেই মেলেনি।

সভার আরম্ভে, যুদ্ধ সচিব হেনরি এল. স্টিমসন বিজ্ঞানীদের বলেছিলেন, ‘পারমাণবিক অস্ত্র যুদ্ধের প্রয়োজনে তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু ম্যানহাটন প্রকল্পের কার্যকারিতা যুদ্ধের প্রয়োজনের থেকে অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। যদি বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়, তবে এই প্রযুক্তি নিয়ন্ত্রণে আনা প্রয়োজনীয়।’

অধিবেশনের লিখিত নথি থেকে জানা যায়, আলোচনার বিষয় ছিল পারমাণবিক শক্তির যুদ্ধকালীন নিয়ন্ত্রণ, জনসাধারণের জ্ঞাতার্থে ঘোষণার কাঠামোর খসড়া, আইন প্রণয়ন এবং যুদ্ধোত্তর সংগঠন সম্পর্কীত সুপারিশ, ইত্যাদি। সোভিয়েত ইউনিয়নের পারমাণবিক কর্মসূচী সম্বন্ধে উদ্বিগ্নতা প্রকাশ করে কমিটি সুপারিশ করেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে অস্ত্র প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকতে হবে। সদস্যরা একমত হয়ে পরামর্শ দিয়েছিলেন, নানান ধরনের পারমাণবিক অস্ত্র, যেমন ইউরেনিয়াম, প্লুটোনিয়াম, এবং থার্মোনিউক্লিয়ার বোমা, তৈরি করতে হবে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে পারমাণবিক অস্ত্রের বিভিন্ন উপকরণের উৎপাদন চালিয়ে যেতে হবে। পারমাণবিক গবেষণাও বহাল থাকা দরকার, তবে তা যুদ্ধকালীন তৎপরতায় চালানোর দরকার নেই। অন্যান্য গবেষণার রীতি অনুযায়ী চালালেই হবে। পারমাণবিক অস্ত্রের আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণের সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনার পর সিদ্ধান্ত হয়েছিল, কোনও সর্বজনীন চুক্তি কার্যকর করা সহজ হবে না।

এই পরিষদের একটি বিশেষ সুপারিশ, জাপানে পারমাণবিক বোমা ফেলা হোক, ছিল নৈতিকতার দিক থেকে সবচেয়ে জঘন্য সিদ্ধান্ত। কমিটির সদস্যরা প্রথমে পরামর্শ দিয়েছিলেন পারমাণবিক বোমার ব্যবহার হওয়া উচিত সামরিক লক্ষ্যবস্তুর উপর। বেসামরিক লক্ষ্যবস্তুর উপর ব্যাবহারের সম্ভাবনাও আলোচনা করা হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত কমিটি স্থির করে হিরোশিমা এবং নাগাসাকির উপর বোমাবর্ষণ করা হবে। ফলে প্রাণ হারায় কয়েক লক্ষ অসহায়, নিরপরাধ জাপানি নাগরিক।

শহর

তাৎক্ষণিক মৃতের সংখ্যা

বিকিরণের ফলে মৃত্যুর সংখ্যা

মোট মৃতের সংখ্যা

হিরোশিমা

৮০,০০০ – ১৪০,০০০

৬০,০০০ – ৮০,০০০

১৪০,০০০ – ২২০,০০০

নাগাসাকি

৪০,০০০ – ৭০,০০০

৩০,০০০ – ৫০,০০০

৭০,০০০ – ১২০,০০০

সরণি ১: হিরোশিমা এবং নাগাসাকির পারমাণবিক বোমা হামলায় নিহত মানুষের আনুমানিক সংখ্যার পাশে বিকিরণের ফলে মৃত্যুর সংখ্যা দেখানো হয়েছে। শেষের কলামে দেখান হয়েছে মোট মৃতের সংখ্যা। 

কিন্তু পরিষদ অনুমান করতে পারেনি পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ চুক্তির প্রবর্তন। প্রথম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল ১৯৬৩ সালে। এই আংশিক-পরীক্ষা নিষিদ্ধিকরণ চুক্তি (Partial Test Ban Treaty, PTBT) সেই বছরই কার্যকরী করা হয়েছিল। ফলে ভূগর্ভে ছাড়া পৃথিবীর অন্য কোথাও পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষা নিষিদ্ধ করা হল। বলা বাহুল্য, নিষিদ্ধ অস্ত্রের বিস্তার রোধ করা গেলেও PTBT সম্পূর্ণ সফল হয়নি।

পারমাণবিক অস্ত্রের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারী (Treaty on the Prohibition of Nuclear Weapons, TPNW) করা হল দ্বিতীয় চুক্তিতে। TPNWর জন্যে বিশ্বের সব রাষ্ট্রে পারমাণবিক অস্ত্র উন্নয়ন, পরীক্ষা, উৎপাদন, অধিগ্রহণ, মজুত, ইত্যাদি নিষিদ্ধ হয়েছে। চুক্তিটি ২০১৭ সালে অধিগ্রহণ করা হয় এবং ২০২১ সাল থেকে কার্যকরী হয়েছে। ১২৫-টি দেশ এ চুক্তি স্বাক্ষর করলেও মাত্র ৫৬-টি দেশ এটি সম্পুর্ণ অনুমোদন করেছে।

সন্দেহ নেই পারমাণবিক অস্ত্র প্রসার বন্ধের ব্যাপারে TPNW একটা উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ। তবে এ প্রয়াস শেষ পর্যন্ত সফল হবে কিনা সন্দেহ। উল্লেখয়োগ্য, পারমাণবিক অস্ত্রধারী রাষ্ট্রগুলো এই চুক্তি সই করেনি। ভবিষ্যতে করবে কিনা, বা মেনে চলবে কিনা, তাও বলা যায় না। তবে আশার কথা এই যে TPNW মাধ্যমে নিরস্ত্রীকরণের একটা কাঠামো রাষ্ট্রগুলোর হাতে এসেছে। কে জানে, সত্যি হয়তো একদিন পারমাণবিক অস্ত্র নির্মূল হবে পৃথিবী থেকে। মানুষ ফিরে পাবে তার শুভ চেতনা।

হিরোশিমা আর নাগাসাকির অভিজ্ঞতার পর পারমাণবিক বোমা আজ পর্যন্ত অন্য কোনও দেশে ফেলা হয়নি। এই ব্যাপারে চুক্তি দুটোর অবদান কী, তা বিচারের সময় এখনো আসেনি। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের প্রায় ষাট বছর পর ওপেনহাইমার সিনেমাটি নতুন করে আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে পারমাণবিক অস্ত্র কতটা বিপজ্জনক হতে পারে।

পারমাণবিক প্রযুক্তির উপকার

পারমাণবিক প্রযুক্তির বীভৎসতার পাশাপাশি একটি আশাপ্রদ দিকও আছে। ট্রিনিটি পরীক্ষার আগে পদার্থবিদ এডওয়ার্ড টেলার তাঁর প্রাথমিক গণনায় ইঙ্গিত করেছিলেন, পারমাণবিক বিস্ফোরণ নিয়ন্ত্রণের বাইরে গিয়ে পর্যুপরি চেইন প্রতিক্রিয়ায় পরিণত হতে পারে। এমনটি ঘটলে বায়ুমণ্ডলে ভয়ঙ্কর অগ্নিকাণ্ড ঘটে পৃথিবী ধ্বংস হওয়াও অসম্ভব নয়। গণনাটি আরও ভালো করে যাচাই করে বোঝা গিয়েছিল বিস্ফোরণ মাত্রা ছাড়াবার সম্ভবনা বস্তুত কম। তাই ট্রিনিটি পরীক্ষা পরিকল্পনামাফিক ঘটেছিল।

সৌভাগ্যক্রমে, শৃঙ্খলি (chain) প্রতিক্রিয়া নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব এবং তা বিদ্যুৎশক্তিতে পরিণত করে কাজে লাগান যায়। এই প্রক্রিয়া আবিষ্কার ও নিয়ন্ত্রণের কাহিনী মানবজাতির এক গৌরবময় অধ্যায়। কিন্তু সেই প্রক্রিয়া বুঝতে পদার্থ বিজ্ঞান সম্বন্ধে একটু ওয়াকিবহাল না থাকলে পুরোপুরি অনুধাবন করা সম্ভব নয়। সেটুকুই পরবর্তী অনুচ্ছেদে সংক্ষেপে লিখছি।

We can use nuclear energy to create a world
Of peace and plenty for all,
Or we can use it to destroy ourselves.
The future of the human race
Hangs in the balance.
It is up to us to decide
What kind of world we want to live in.
Will we be the masters of our destiny,
Or will we be enslaved by our own creations?
The choice is ours.
(অজানা কবি)

(আগামী সংখ্যায় সমাপ্য) 

———-

পাদটীকা
সেই সময় মহিলারাও দল বেঁধে নেমেছিলেন ম্যানহাটন প্রজেক্টের কাজে। কিন্তু ওপেনহাইমার সিনেমাতে তাঁদের অবদানের কথা একেবারেই উহ্য রাখা হয়েছে। ম্যানহাটন প্রজেক্টে অংশগ্রহণকারী অঞ্চলগুলোর মধ্যে কেবল মাত্র লস অ্যালামোসেই ৬৪০ জন মহিলা কর্মী ছিলেন, মোট কর্মী সংখ্যার ১১ শতাংশ। এঁদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন প্রশাসনিক ভূমিকায়, কিন্তু প্রায় অর্ধেক ছিলেন বিজ্ঞানী — গণিতজ্ঞ, পদার্থবিদ, রসায়নবিদ, জীববিজ্ঞানী এবং গণনা বিশ্লেষক (computer analysts)। এঁদের মধ্যে অনেকেই আবার নিজ নিজ বিষয়ের  বিশেষজ্ঞ। যেমন, তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী মারিয়া গোয়েপার্ট মেয়ার, যিনি ১৯৬৩ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন দু’জন পুরুষ বিজ্ঞানীর সঙ্গে। এঁদের মধ্যে একজন ছিলেন তাঁর সহকর্মী, একসঙ্গে কাজ করেছিলেন নিউক্লিয়ার শেল কাঠামোর (nuclear shell structure) বিষয়ে। উল্লেখযোগ্য যে ম্যানহাটন প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত যে তিরিশ জন বিজ্ঞানী পরবর্তী কালে নোবেল পুরস্কার লাভ করেছিলেন, তাঁরা প্রায় সকলেই পুরুষ। গোয়েপার্ট মেয়ার-কে পুরুষপ্রধান কর্মক্ষেত্রে বছরের পর বছর যুঝতে হয়েছিল নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করতে।

আর একজনের কথা এ প্রসঙ্গে উল্লেখ না করে পারছি না। সাইক্লোট্রন যন্ত্রের আবিষ্কারক এবং নোবেল বিজয়ী আর্নেস্ট লরেন্স-এর ছাত্রী, বিখ্যাত পারমাণবিক পদার্থবিদ, চিয়েন-শিউং উ। পরীক্ষামূলক গবেষণায় পারদর্শিতার জন্য মাদাম উ-কে বিশেষ সম্মানের আসনে বসিয়েছিলেন ওপেনহাইমার স্বয়ং। ১৯৩৩ সালে এনরিকো ফার্মির বিটা ক্ষয় (beta decay) তত্ত্বের প্রথম পরীক্ষামূলক প্রমাণ এঁরই তৈরি। ২০২১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উ-এর সম্মানে একটি ডাকটিকিটও ছাপিয়েছে। এছাড়াও ছিলেন গণিতজ্ঞ নাওমি লাইভসে। গোয়েপার্ট মেয়ার বা মাদাম উ-এর মত স্বনামধন্য না হলেও লাইভসের অবদান ম্যানহাটন প্রজেক্টে অনস্বীকার্য। পাঞ্চ কার্ড-এর যুগে আই.বি.এম কম্পিউটার ব্যবহারে লাইভসের জ্ঞান ছিল সুগভীর। এই যন্ত্রের সাহায্যে বোমার ইমপ্লোশন পদ্ধতি নকল (সিমুলেট) করায় নেতৃত্ব তিনিই দিয়েছিলেন। ওঁর দলই বোমার চূড়ান্ত নকশা নির্বাচনে সহায়তা করেছিল। ফলে,  নিউ মেক্সিকো মরুভূমিতে ১৯৪৫ সালের ১৬ই জুলাই তারিখে বোমার পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণ (ট্রিনিটি পরীক্ষা) সম্ভব হয়েছিল।

———-

ছবির জন্যে কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ 
ন্যাশনাল আর্কাইভস, অফিস অফ ওয়ার ইনফরমেশন রেকর্ডস; সায়েন্স হিস্ট্রি ইমেজ/ALAMY স্টক ফটো

কৌশিক সেনগুপ্ত একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। কিন্তু প্রশিক্ষণ পদার্থবিজ্ঞানে। প্যাশন হল পপুলার লেভেলে এ বিজ্ঞানভিত্তিক রচনা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের SUNY-বাফেলো এবং লুইসিয়ানা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে গবেষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু। গবেষণার ফল প্রকাশ করেছেন বহু নামি আন্তর্জাতিক জার্নালে। আর সহযোগিতা করেছেন সর্বদেশীয় এবং NASA বিজ্ঞানীদের সঙ্গে। ক্রমে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন গাণিতিক কম্পিউটিং এবং সফটওয়্যার ডিজাইনে। অবশেষে IBM সংস্থায় যোগদান এবং অবসর গ্রহণের পর ফুল টাইম লেখার কাজে হাত। প্রথম বই, 'Are We Alone? Humankind's search for extraterrestrial civilizations।' মহাবিশ্বে আমরা একা কিনা, অর্থাৎ মানবসদৃশ আর কোনো বুদ্ধিমান প্রাণীর অস্তিত্ব আছে কিনা, সে সব প্রাচীন প্রশ্নের উত্তরের খোঁজে জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের প্রয়াসের কথা এই বইয়ের বিষয়।

1 Comment

Avarage Rating:
  • 0 / 10
  • Salil Banerjee , October 26, 2023 @ 8:53 pm

    Read and enjoyed the excellent essay. I have previously read and enjoyed a number of articles written by Kaushik Sengupta, which were all written in English. The present article shows he is equally adept in writing about complex topics in Bengali. In these few pages, he has been able to cover very clearly many different aspects of Oppenheimer’s complex story…very well done.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *