আমাদের সুজনদা

আমাদের সুজনদা

আমার সঙ্গে সুজনদার প্রথম চাক্ষুষ দেখা ২০১৬ সালের বই মেলায়। যতদূর মনে আছে ফোনে বার্তালাপ করে ঠিক হয়েছিল উনি তিনটের সময় ব্রিটিশ কাউন্সিলের প্যাভিলিয়নের কাছে, দাঁড়াবেন। আমি যেন চলে আসি। এর আগে কেউ কাউকে দেখিনি। আমি অবশ্য তখন ফেসবুকে সবে নিজের দেওয়ালে ছবি টবি দিতে শিখেছি বলে ঘন ঘন ছবি দিই। কিন্তু সুজনদা তো তা দেন না, তাই তাঁর প্রোফাইল ছবি ছাড়া আর কিছু আমার তখন অবধি দেখা হয়নি। তাই আমার দিক থেকে একটু ভয় ছিল এত ভিড়ের মধ্যে ঠিক খুঁজে পাব তো? তবে ভরসা ছিল যিনি এতদিন ধরে আমেরিকার প্রবাসী, তাঁর চেহারার মধ্যে একটা চোরা সাহেবিয়ানা তো থাকবেই। ওটা দেখে চিনে নেবো ঠিক। কিন্তু ওই নির্ধারিত জায়গায় পৌঁছাতেই দেখি একজন দীর্ঘদেহী ভদ্রলোক একটা হ্যান্ডলুমের গেরুয়া পাঞ্জাবী, সাদা পাজামা এবং কাঁধে অতি সাধারণ শান্তিনিকেতনী ঝোলা। আমাকে দেখে হাসিমুখে এমন ভাবে এগিয়ে এলেন, যেন দু’দিন আগেই আমাদের দেখা হয়েছে। কেউ কাউকে পরিচয় দেবার দরকার হলই না। অতঃপর কিছুক্ষণ বই মেলায় ঘোরাঘুরি। তারপর সুজনদার নানান জায়গা থেকে ডাক আসছিল, বুঝতে পেরে আমরা সেদিন চলে এসেছিলাম।

সুজনদা যে খুব কম সময়ের মধ্যেই অনেককে আপন করে নিতে পারেন সে কথা তো সবাই জানে। তার কারণ বোধহয় এটাই যে, নিজের বৈদগ্ধ্যকে তিনি এক আশ্চর্য কৌশলে আড়াল করে রাখতে পারতেন। অন্তত আমার ক্ষেত্রে বলতে পারি আমি যদি তাঁর সব পরিচয়টা জানতাম তাহলে প্রথম আলাপে ঠিক এতটা সহজ হতে পারতাম না।

আমি কি ছাই জানতাম এই মানুষটি আসলে যাদবপুরের কৃতি ছাত্র, মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এ মাস্টার্স করে স্কলারশিপ নিয়ে সিনসিনাটি ইউনিভারসিটি থেকে স্টাকচারাল মেকানিক্সে নিয়ে ডক্টরেট করেছেন। এবং তার পর জগৎ বিখ্যাত বেল ল্যাবোরেটরিজ এর মত কোম্পানিতে একজন উঁচু দরের প্রযুক্তিবিদ হয়ে কাটিয়েছেন চাকরির বেশিরভাগ সময়। এই সময়ে নানান আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান পত্রিকায় অন্তত বাইশ তেইশটি লেখা প্রকাশিত হয়েছে। 

তার মধ্যে আছে ইলাস্টিসিটি, ইলেক্ট্রো-ম্যাগনেটিজম, ইনফাইনাইট এলিমেন্ট থেকে সাবমেরিন কেবল, ওয়ারলেস কমিউনিকেশনের জটিল বিষয় সব কিছুই আছে। ওঁর নামে একটি পেটেণ্ট আছে, সেটি আবার সার্কিট বোর্ড ডিজাইনের উপর। এই সব বিষয়ের কোনোটাই আমার দন্তস্ফুট হবার মত নয়। হ্যাঁ, আমরা জানি ওই মার্কিন দেশে বাঙালি বৈজ্ঞানিকের অভাব নেই। তাদের আবিষ্কার কাজে লাগিয়ে সে দেশ লক্ষ লক্ষ ডলার উপার্জন করে। সুজনদা তাঁদেরই একজন। কিন্তু যেটা আশ্চর্য লাগে এই সব কাজ করতে করতে সুজনদা, প্রবল ভাবে মাথায় রাখছেন বাংলা ভাষাকে। হয়ত একদিন সকালে ইনফাইনাইট এলিমেন্ট নিয়ে ভারি ভারি বই ঘেঁটেছেন, সেদিন সন্ধেবেলায় বসেছেন বাংলায় ছোটোদের জন্যে ধাঁধা নিয়ে বই লিখতে। একদিন হয়ত সারাদিন মোবাইল কমিউনিকেশনের আদি পর্বের আবিষ্কারের কাজগুলি নিয়ে ব্যস্ত থেকেছেন আর বাড়ি ফিরে ছড়া লিখতে বসছেন – ‘খিলখাবানার গাম্বিলো’ বইটির জন্য।

বাংলায় লেখাটা তাঁর নিছক পাসটাইম ছিল বলে মনে হয় না। এটা তাঁর একটি দায়বদ্ধতার জায়গা ছিল বলেই আমার বিশ্বাস। তা নইলে কি আর একটি বিশ্ববিখ্যাত সংস্থার গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে চাকরি অবসর নেবার বয়সে পৌঁছানোর আগেই, বাংলায় লেখালেখি করার তাগিদে দু’বছর আগেই অবসর নিয়ে বসলেন! এবং অবসর নিয়ে মন দিলেন আর এক ‘অবসর’এ। সুমিতদার সঙ্গে লেগে পড়লেন কমপিউটারের বাংলা ফন্ট গড়ে তোলার কাজে!

একজন মানুষ, একই সঙ্গে এত বৈচিত্র্যময় সব কাজের মধ্যে কীভাবে সানন্দে জড়িয়ে থাকতে পারেন, সেটা ভাবলে আশ্চর্য হতে হয়। নিজের সম্বন্ধে বিশেষ কোথাও কিছু বলতেন না, লিখতেনও না।

এখান ওখান থেকে খবর সংগ্রহ করে পেঁয়াজের খোসা ছাড়ানোর মত করে মানুষটিকে যত আবিষ্কার করেছি ততই মোহিত হয়েছি। এই জটিল সময়ে নিজেকে এত সহজ, এত অকৃত্রিম আর প্রাণবান কী করে রাখা যায় দেখে বিস্মিত হয়েছি বার বার। বিশেষ ওঁর মত একজন বৈজ্ঞানিক-অধ্যাপক-গবেষক মানুষের পক্ষে এটা কতটা কঠিন, তা আমরা ধারনাও করতে পারবো না। লেখা এবং কথাবলা দুই প্রায় একরকম ছিল। সরল, স্বছন্দ, মেধায় উজ্জ্বল, রসে টই-টম্বুর। একেবারে সেই পুরাতনী বাঙালির বৈঠকি আড্ডার ঝলক ফুটে উঠত তাঁর কলমে। ত্রৈলোক্যনাথ, রাজশেখর বসু, পরিমল গোস্বামী, মুজতবা আলি, নবনীতা দেবসেন হয়ে বাংলা wit এর যে ধারাটি প্রায় শুকিয়ে এসেছিল তার কিছু রেশ দেখা দেখা যেত তাঁর লেখায়।

অন্তর্জাল ঘেঁটে শ্রী অমিতাভ মুখোপাধ্যায়কে দেওয়া ওঁর একটি ইন্টারভিউতে তিনি কার দ্বারা তিনি জীবনে সব চেয়ে বেশি প্রভাবিত হয়েছেন, এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি প্রথমে তাঁর যাদবপুর ইউনিভারসিটির দুই শ্রদ্ধেয় অধ্যাপকের নাম করেন, তার পর বলেন –
“And of course, my wife, Shamita. She is a serious social activist, and I deeply adore what she does for the society. She has always been a great guiding force in my life, and has helped me to stay on the right track. In front of her, I am a “মেনিমুখো ম্যাদামারা শ্রীচরণের ছুঁচো।”

এই হচ্ছেন আমাদের সুজনদা।

ওঁর লেখা বইয়ের একটি তালিকা আমি অন্তর্জাল থেকেই পেলাম। সকলের জ্ঞাতার্থে তা এখানে দিয়ে দিলাম। 

১। নিখাদ ধাঁধার বই (সহ-লেখক প্রবুদ্ধ দে) — সেন্ট্রাল পাবলিশিং (১৯৮৪)
২। ভীমের বিভ্রান্তি ও অন্যান্য জটিল সমস্যা — সেন্ট্রাল পাবলিশিং (১৯৮৪)
৩। ধাঁধাপুরীর গোলকধাঁধা (উ) — আনন্দ পাবলিশার্স (১৯৮৬)
৪। সত্যি মিথ্যের গোলকধাঁধা — আনন্দ পাবলিশার্স (১৯৮৯)
৫। এই বইয়ের নাম অন্য মলাটে — আনন্দ পাবলিশার্স (১৯৯৩)
৬। গোয়েন্দা একেনবাবু — সুপ্রীম পাবলিশার্স (১৯৯৪)
৭। ধাঁধাঁ ও মজার খেলা — আনন্দ পাবলিশার্স (১৯৯৭)
৮। মহেঞ্জোদারোর শিলালিপি ও অন্যান্য কাহিনী — এ মুখার্জী অ্যান্ড পাবলিশার্স (২০১০)
৯। শান্তিনিকেতনে অশান্তি — দাশগুপ্ত অ্যালায়েন্স (২০১১)
১০। ম্যানহাটানে ম্যাডম্যান — দাশগুপ্ত অ্যালায়েন্স (২০১২)
১১। আসল খুনির সন্ধানে — দাশগুপ্ত অ্যালায়েন্স (২০১৩)
১২। হাউসবোটে নিখোঁজ ও অন্যান্য রহস্য — দাশগুপ্ত অ্যান্ড কোং (২০১৫)
১৩। ধাঁধাপুরী (সং) — আনন্দ পাবলিশার্স (২০১৬)
১৪। একেনবাবু সমগ্র (১) — দ্য কাফে টেবল (২০১৭)
১৫। (যৌথ সম্পা) গোয়েন্দা হাজির (১) (সং) — লালমাটি প্রকাশন (২০১৭)
১৬। একেনবাবু সমগ্র (২) — দ্য কাফে টেবল (২০১৮)
১৭। সুজনকথা — সৃষ্টিসুখ প্রকাশন (২০১৮)
১৮। (যৌথ সম্পা) গোয়েন্দা হাজির (২) (সং) — লালমাটি প্রকাশন (২০১৮)
১৯। একেনবাবু সমগ্র (৩) — দ্য কাফে টেবল (২০১৯)
২০। নিভৃতে — সৃষ্টিসুখ প্রকাশন (২০১৯)
২১। খিলখাবানার গাম্বিলো (ছড়া) — দ্য কাফে টেবল (২০১৯)
২২। একেনবাবু সমগ্র (৪) — দ্য কাফে টেবল (২০২০)
২৩। একেনবাবু সমগ্র (৫) — দ্য কাফে টেবল (২০২২)
২৪। একেনবাবু সমগ্র (৬) — দ্য কাফে টেবল (২০২৩)

চাকুরী জীবন বেসরকারি এবং আধা সরকারি কর্পোরেট জগতের বিভিন্ন পদে। এখন অবসরপ্রাপ্ত। লেখেন নেহাতই মনের খিদে মেটাতে। লেখেন নানান বিষয় নিয়ে। তবে যাই লেখেন বিষয় নির্বাচনে কিছু অভিনবত্ব থাকে। গান , চলচ্চিত্র, ভ্রমণ, দিন বদলের ছবি, বাঙ্গালিয়ানা এ রকম আরও অনেক বিষয় এবং অবশ্যই রবীন্দ্রনাথ। তথ্যকে কৌতুকের মোড়কে এবং ভাবনা কে স্বচ্ছতার আবরণে পরিবেশন করতে চেষ্টা করেন। বিষয় যাই হোক ভাষা সব সময়েই ঝরঝরে, রসস্নিগ্ধ এবং মনোগ্রাহী। বেশ কয়েকটি ওয়েব পত্রিকাতে লেখেন। দেশ বিদেশে অনেক গুণগ্রাহী পাঠক আছেন।

1 Comment

Avarage Rating:
  • 0 / 10
  • শেখর বসু , March 21, 2023 @ 5:11 am

    ভালো লাগল লেখাটি। হদয় থেকে লেখা। ওই বইপত্রের তালিকা একটি বাড়তি সম্পদ এই লেখাটির।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *