টুকরো স্মৃতির ঝাঁপি

টুকরো স্মৃতির ঝাঁপি

নানারকম প্রতিকূলতা এবং ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যেও আমাদের জীবনে এমন কিছু মজার ঘটনা ঘটে থাকে, যা সেই সময়ে তো বটেই, পরবর্তীকালেও অক্সিজেন জোগায়। সেই সব ঘটনার রেশ ছড়িয়ে থাকে চিরকাল আমাদের জীবনে।

টুকরো টুকরো সেই মজার ঘটনাগুলো এখন শুধুই স্মৃতি।এই ঘটনাগুলোর সঙ্গে জড়িত কিছু মানুষ এখনও আছেন, কিছু মানুষ হারিয়ে গেছেন চিরতরে। মনের কোণে সযত্নে রাখা রয়েছে এই স্মৃতিগুলো ছবি হয়ে। হয়তো কালের নিয়মে সেই ছবি ঝাপসা হয়ে যাবে, কিন্তু ফেলে আসা আনন্দ ঝাপসা হবে না কখনো।

ছোটবেলায় আমি কারণে অকারণে এত হাসতাম, যে সবাই বিরক্ত হয়ে যেত। সামান্য ব্যাপারেই মজা খুঁজে পেতাম আর সেই মজার ঘটনাটি বলার আগেই আক্ষরিক অর্থে গড়াগড়ি খেতাম। দিদিরা বলত, “তুই আগে হেসে নে, তারপর বলবি।” 

‘লাফিং গ্যাস’ আখ্যা দিয়েছিল আমাকে দিদিরা।

একবার আমাদের বাড়িতে এক ভদ্রলোক এসেছিলেন, তাঁকে আমরা কেউ চিনি না। কাকুর সূত্রে তাঁর আমাদের বাড়িতে আসা। যথারীতি তাঁকে দুপুরে খাওয়ার আমন্ত্রণ জানানো হল। সকলে একসঙ্গে খেতে বসেছি। আমার আর কুট্টিদির কী যে হয়েছিল সেদিন, শুধু হেসে যাচ্ছিলাম। ভদ্রলোক ভাত চাইছেন, আমরা হাসছি। কাঁচালঙ্কা চাইছেন, আমরা হাসছি। আমরাও জানি না কেন হাসছি, অথচ হেসে যাচ্ছি সেই হ য ব র ল-র হিজিবিজবিজের মত। এই দেখুন, আপনাদেরও ঠোঁটের ডগায় হাসি ছড়িয়ে পড়ছে তো? জানি তো,সকলেই হাসবেন, অকারণেই।

অনেক গান আছে যেগুলো ভালো না লাগলেও আমরা গুনগুন করে গেয়ে যাই আর সেগুলো বেশ সংক্রামকও বটে। আমাদের ছোটবেলায় বা একটু বড় হওয়ার পরও দেখেছি বিজ্ঞাপনের যে গানগুলো ছিল সেগুলো বেশ ভালো হত, সে যে প্রোডাক্টের বিজ্ঞাপনই হোক না কেন।

সেই সময়ে আমি তখন কলেজে পড়ি, একটা বিজ্ঞাপন হত ‘মালা-ডি’ বলে কোনো গর্ভনিরোধক পিলের। সেই বস্তুটি কী, তখনো বুঝতে পারতাম না চিরকালের ‘ঢেঁড়স’ আমি, শুধু এটুকু বুঝতাম যে এটা বড়দের কোনও ব্যাপার।

একদিন শুনলাম কুট্টিদি ঐ বিজ্ঞাপনের গানটা বেশ গুনগুন করে গাইছে। এবার সেই গানটা আস্তে আস্তে করে কুট্টিদির থেকে সংক্রমিত হয়ে বাড়ির সবার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল। শুধু তাই নয়, আমার দিদিভাইয়ের বছর পাঁচেকের ছেলে ডোডো পর্যন্ত গানটি বেশ রপ্ত করে ফেলল। একদিন তো আবার আমার বাবার কোলে বসে জমিয়ে গানটা শোনাচ্ছিল ডোডো, ভাগ্যিস কুট্টিদির কানে গিয়েছিল। তড়িঘড়ি ওকে ভুলিয়ে ভালিয়ে চুপ করিয়ে দিল। দেখা গেল আমরা ছোট বড় প্রায় সকলেই মালা-ডি প্রোডাক্টের গানটা গেয়ে যাচ্ছি। কিছুতেই কন্ট্রোল করতে পারা যাচ্ছে না। শেষ পর্যন্ত মাসিমণির বকুনিতে কাজ হল, বন্ধ হল গানটা। 

বিয়ের আগেই জানতাম আমার বরটি সুরসিক, বিয়ের পর জানতে পারলাম ওর মাথায় সবসময় দুষ্টুবুদ্ধি গিজগিজ করে। তাই বাড়িতে কিছু অঘটন ঘটলে আমার বরের নামটাই আগে উঠে আসে।

পরীক্ষার ঠিক আগেই একটু আধটু যা পড়াশোনা করতেন তিনি, তাও দিদির পাল্লায় পড়ে। ভোরবেলা তাঁকে ডেকে দেওয়া হত পড়ার জন্য। তিনি দেখতেন সবাই ঘুমোচ্ছে আর উনি একা বসে বসে পড়াশোনা করছেন। ব্যাস, মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি খেলে যেত। এমন চিৎকার করে পড়তে শুরু করতেন যে আশেপাশের যত কুকুর ছিল সব আমার শ্বশুরবাড়ির সামনে এসে চিৎকার করতে লাগত। সবার ঘুমের দফারফা। 

আর পড়তে বসতে বলবে কেউ তাঁকে?

সারাদিন পর অফিস থেকে ফিরে যখন আমার শ্বশুরমশাই একটু ঘুমোতে যেতেন, ভাইবোনেদের হাসাহাসির ঠেলায় বিরক্ত হতেন। খুব বকাবকিও করতেন। তারকেশ্বরের লাঠির ডগায় যে ছোট ছোট ঘন্টি থাকে সেই ঘন্টিগুলো সিলিং এর উপর দড়ি দিয়ে চুপিচুপি বেঁধে রেখে দিয়েছিল আমার কর্তাটি। দড়িটা রেখেছিল সেই ঘরে যে ঘরে ওরা থাকত। বাবা যখনই বকতেন তখনই দড়ি ধরে টান দিত আর ঘন্টিগুলো একসঙ্গে বেজে উঠত। এরপরে যদি পিঠে ঘা কতক পড়ে তাহলে দোষটা কার?

আমার শ্বশুরমশাই অল্প বয়সে হোমিওপ্যাথি পরীক্ষা দেবেন বলে প্রস্তুতি নিয়েছিলেন, সাংসারিক চাপে পড়ে আর পরীক্ষা দেওয়া হয়নি তাঁর।কিন্তু বাড়িতে হোমিওপ্যাথি বই, ওষুধের বাক্স এবং তার মধ্যে প্রয়োজনীয় নানারকম ওষুধ মজুত থাকত। 

তখন আমার বিয়ে হয়েছে সবেমাত্র। একদিন সকালে আমার মেজ ননদাই বাড়িতে এসে কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলার পর দেখলেন তাঁর একমাত্র শ্যালক অর্থাৎ আমার কর্তাটি হোমিওপ্যাথি ওষুধের ছোট একটা শিশি নিয়ে কিছু একটা করছে। সঙ্গে সঙ্গে হাঁকডাক শুরু হয়ে গেল, “কী খাচ্ছিস রে সোমনাথ?”

গোবেচারা সোমনাথ জবাব দিল, “আর বোলো না পার্থদা, কাল রাত থেকে শরীরটা কেমন যেন ম্যাজম্যাজ করছে। তাই একটু ওষুধ খাচ্ছি।”

“আমারও শরীরটা কেমন যেন করছে, জানিস! আমাকেও দুফোঁটা ওষুধ দিয়ে দে তো।” পার্থদা, আমার মেজ ননদাইএর বক্তব্য।

“খাবে? আচ্ছা, হাঁ করো। আমি ওষুধটা ঢেলে দিচ্ছি।” সোমনাথ মানে আমার গোবেচারা বরটি পার্থদার মুখে শিশির ওষুধটা মুখের মধ্যে পুরোপুরি ঢেলে দিয়েছে। যেইমাত্র দেওয়া, সঙ্গে সঙ্গে পার্থদা ছিটকে উঠে মুখচোখ বিকৃত করে ছুটল রান্নাঘরে জলের সন্ধানে। না না, হোমিওপ্যাথি ওষুধের ঝাঁঝের জন্য নয়। ওষুধের শিশিতে চিরতার জল ভরা ছিল। ওষুধের প্রতি পার্থদার দুর্বলতার কথা আমার কর্তাটির জানা ছিল, তাই এত নাটক। আর সেই ফাঁদে অনায়াসে পা দিয়ে ফেলেছিলেন পার্থদা।

বেশ কয়েক বছর পরের কথা, একদিন সকালে পার্থদার অফিসে বেরোনোর আগে আমার কর্তাটি ওদের বাড়িতে গিয়ে হাজির। দেখে দুজোড়া জুতো পালিশ করে রাখা আছে, একটা গলানো আর একটা ফিতে বাঁধা। যথারীতি সোমনাথের মাথায় আবার একটা দুষ্টুবুদ্ধি খেলে গেল। দুটো জুতো পাল্টাপাল্টি করে রেখে দিয়ে দিব্যি ভালোমানুষের মতো কথাবার্তা সেরে বাড়ি চলে এল।পার্থদাও খুব ভালোমানুষের মত পাল্টাপাল্টি করা জুতো পরেই চলে গেলেন অফিসে। কোনো হুঁশ নেই যে একটা জুতো গলানো, আর একটা ফিতে বাঁধা। 

অফিস থেকে ফেরার সময় নজরে পড়ল ব্যাপারটা, তখন সোমনাথকে সামনে পেলে মনে হয় দুচার ঘা বসিয়ে দিতেন। কারণ সেদিন সকালেই সোমনাথের আগমন ঘটেছিল বাড়িতে, কাজেই দুয়ে দুয়ে চার করে নিতে অসুবিধা হয়নি পার্থদার।

এখন বয়সোচিত কারণে অনেক পরিবর্তন এসেছে সকলের, কিন্তু আচরণগত পরিবর্তন বিশেষ হয়নি।পার্থদা এখনো ওষুধ খেতে খুব ভালোবাসেন। নিজেই এখন ওষুধের শিশি নিয়ে ঘুরে বেড়ান সবসময়, বাড়িতে কেউ এলেই তাঁর পিছনে দৌড়ান ওষুধ খাওয়ানোর জন্য। আর আমার কর্তাটিরও লোকজনকে ব্যতিব্যস্ত করার স্বভাবটা এখনো যায়নি। 

এমনই থাকুন সকলে, ভালোয় মন্দে মিলে মিশে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *