দুনিয়ার চাতাল এক হও
“পরশুর মধ্যেই রিটার্ন জমা দেবেন কিন্তু।”
গতকাল তালুকদারসাহেব কড়া গলায় জানিয়েছিলেন। অতএব আজ অফিস যাওয়ার আগে ব্যাঙ্ক থেকে এইচ. বি. এল. স্টেটমেন্টটা নিতেই হবে।
“স্যার ডাকছেন।”
গতকাল অফিসে পৌঁছে যথারীতি গ্লিনডার কার্গোর ফাইলটা নিয়ে নিবিষ্ট মনে কাজ করছিলেন। এমন সময়ে বেয়ারা এসে ডাকল।
“বসুন।”
ফাইলে নোট লিখছিলেন তালুকদারসাহেব। বিশ্বনাথবাবুকে দেখে গম্ভীর মুখে চেয়ারের দিকে ইশারা করলেন। একটু অবাকই হয়েছিলেন। চিফ অ্যাকাউন্টস অফিসার তালুকদারসাহেবের সঙ্গে এই মুহূর্তে তো কোন কাজ নেই!
“মিস্টার মিত্র, আজ কত তারিখ?”
এইবারে কানে জল গেল। কয়েকদিন ধরেই সেকশন অফিসার ইনকাম ট্যাক্স রিটার্ন জমা দেওয়ার জন্যে তাগাদা দিচ্ছিলেন। করছি করব বলে করা হয়নি।
“এই লাস্ট মিত্রদা, এরপর না দিলে সব ধরে তালুকদারসাহেবের কাছে পাঠিয়ে দেবো।”
যথারীতি পরশুদিনের সেই হুমকিটাও ভুলেছিলেন। ফলে সেকশন অফিসার যা করার করেছেন।
“ডেপুটি সেক্রেটারি চক্রবর্তী সাহেব,” আর্দালিকে ডেকে ফাইলটা দিলেন, “আর দু…, না এক কাপ চা।”
চায়ের কাপপ্লেট ছাড়া তালুকদারসাহেবের টেবিলটা কিরকম দেখতে হতে পারে সেটা অফিসসুদ্ধ স্টাফ বিস্তর গবেষণা করেও কোন সমাধান বার করতে পারেনি।
“মিত্রবাবু, রিটার্নটা কি দেবেন না?”
মনে মনে প্রমাদ গুণলেন বিশ্বনাথবাবু।
“কবে পাবো স্যার?”
“ছি ছি, এভাবে কেন বলছেন,” বিশ্বনাথবাবু আঁতকে উঠলেন, “অ্যাজ আর্লি…”
“অ্যাজ আর্লি…”
“না, মানে ইয়ে, ব্যাঙ্ক থেকে এইচ. বি. এল. স্টেটমেন্টটা…”
“এখনও তোলেননি, কয়লাঘাট স্ট্রিট ব্র্যাঞ্চ তো?”
“হ্যাঁ স্যার।”
“অফিসের পাশে ব্যাঙ্ক, এখনও স্টেটমেন্ট তোলেননি, আমার চাকরিটা কি খাবেন?”
“আসলে গ্লিনডার কার্গোর কাজটা নিয়ে একটু…”
“ব্যস্ত আছেন তাই রিটার্নটা…কতদিন চাকরি করছেন?”
“জুলাইয়ে তিরিশ কমপ্লিট হবে।”
“আর রিটায়ারমেন্ট?” বেয়ারার এনে দেওয়া চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে প্রশ্ন করলেন।
“পাঁচ বছর পরে।”
“তিরিশ বছর আগে রেল চলেনি, না কি পাঁচ বছর বাদে চলবে না?” মিঠেকড়া মন্তব্যের জন্য তালুকদারসাহেব বিখ্যাত। তাই চুপ করে রইলেন।
“বিশ্বনাথবাবু, আপনি যে কোন অফিসের অ্যাসেট। কিন্তু নিজের ব্যাপারগুলো যদি একটু না ভাবেন,” এবারে তালুকদারসাহেবের গলাটা একটু নরম, “অফিসের ইনকাম ট্যাক্সটা তো আমাকে দেখতে হয়। একশো ঊনপঞ্চাশ জনের ফর্ম সিক্সটিন কি একজনের জন্যে আটকে রাখব?”
“না স্যার, পরশু কনফার্ম।”
“মনে থাকে যেন।”
“ধাঁতানি খেলেন তো মিত্রদা,” সেকশন অফিসের মুখ বাড়িয়ে মুচকে হাসলেন, “এলোপ্যাথি ওষুধ ছাড়া কাজ হয় না।”
“কী করে হবে,” অরিজিৎ টিপ্পনি কাটল, “মিত্রদা অফিসে কোনদিন চা খান?”
চুপ করে শুনছিলেন বিশ্বনাথবাবু। এবারে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন। “দিনরাত ওই আলকাতরা গিলে গিলে তো…”
ঢকঢক করে খানিকটা জল খেয়ে আবার গ্লিনডার কার্গোর ফাইলে মন দিলেন।
একটা বড়ো ড্যামেজ ক্লেমের পেমেন্ট নিয়ে গত নভেম্বর তালুকদারসাহেবের সঙ্গে প্রথম কাজ করেছিলেন। ইউনাইটেড কর্পোরেশন লিমিটেডের অনেকগুলো যন্ত্রপাতি চারটে ওয়াগনে করে কলকাতা থেকে নাসিক যাচ্ছিল। তুমুল বৃষ্টিতে বেশ কিছু যন্ত্রপাতির ক্ষতি হওয়ায় কোম্পানি ড্যামেজ ক্লেম করে। সংশ্লিষ্ট অফিসার সমস্ত ঘটনাটি ফাইল নোটে বিশদে লিখে ক্লেম পাওয়া উচিত কিনা সে বিষয়ে মন্তব্য করেন। ক্লেমটি সঠিক কিনা সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে এই প্রাথমিক ফাইল নোটটির ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
কিন্তু বিশ্বনাথবাবুর বক্তব্য হল ‘রেল আমাকে মাইনে দেয়। সুতরাং যেভাবেই হোক রেলের খরচ আটকাব।’ এমনকি রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নরের সই করা ‘ইয়ে’র সামনেও সুখে বিগতস্পৃহঃ, স্থিতপ্রজ্ঞ, নির্বিকার। তাই মিত্রবাবুর কাছে ফাইল গেলেই কোম্পানিগুলো ধরে নেয় ক্লেমের ‘গয়া-গঙ্গা-গদাধর-হরি’ হয়ে গেছে।
এবারেও যেমন অবজেকশন দিয়েছিলেন – কোম্পানি রেলকে মেশিনের বিশদ বিবরণ না দেওয়ায় ওয়াটার প্রুফ কম্পার্টমেন্টের ব্যবস্থা করা হয়নি। সুতরাং এই ড্যামেজ ক্লেম গ্রাহ্য করার মতো কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই।
“বাঃ আপনার হাতের লেখাটি তো চমৎকার,” ফাইলটা খুলেই মন্তব্য করলেন, “একেবারে মুক্তোর মত।”
কথাটা শুনে একটু বিব্রত হয়ে পড়লেন। যদিও ঊর্দ্ধতন কর্তৃক্ষের এই রকম প্রশংসা ভালোই লাগে।
“ফাইল তো পুরো ছবির মতো সাজানো,” হাসিমুখে তাকালেন, “একটু স্টাডি করে নিই… আসুন…”
বেয়ারা চায়ের ট্রেটা রাখতেই বিশ্বনাথবাবুর দিকে ইশারা করলেন।
“থ্যাঙ্ক ইউ স্যার, আমি চা খাই না।”
“অ্যাঁ…,” পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য দেখার মতো তাকিয়ে রইলেন, “একদমই না?”
“ওই সকালে আর সন্ধ্যেবেলায়। তাও মিসেসের জন্যে।”
“সারাদিনে মাত্র দু’কাপ?”
“হ্যাঁ স্যার।”
“ঠিক আছে,” কথা না বাড়িয়ে গম্ভীরভাবে ফাইলে মন দিলেন, “পরে একবার বসে ফাইনাল করে নেব।”
তালুকদারসাহেবের মেজাজটা হঠাৎ বিগড়ে যেতে বিশ্বনাথবাবু অবাক হলেন। এর আগেও তো অনেকবার হায়ার অথরিটির সঙ্গে এইরকম হয়েছে। কই, কেউ তো কিছু মনে করেননি! তাহলে হঠাৎ…
উত্তরটা পেলেন তিনদিন বাদে। একঘন্টার মিটিংয়ে ড্যামেজ ক্লেমের পেমেন্টটা নিয়ে আলোচনার সময়।
“মিস্টার মিত্র অবজেকশনগুলো একদম জেনুইন। এই নিয়ম মানলে ক্লেম অ্যাকসেপ্ট করা সম্ভব নয়। কিন্তু একটা কথা ভেবে দেখেছেন কি?”
আশ্চর্য হলেন বিশ্বনাথবাবু। রেলওয়ে অ্যাক্টে দখল নিয়ে হায়ার অথরিটি কোনদিন কোন প্রশ্ন তোলেনি। এমনকি লিগাল সেলও মাঝে মাঝে পরামর্শের জন্য ডেকে পাঠায়। কিন্তু সমস্ত নিয়ম মেনে দেওয়া অবজেকশনে আপত্তি তুলছেন কেন তালুকদারসাহেব?
“দেখুন, রেলের একচেটিয়া ব্যবসার দিন কিন্তু আর নেই। এখন নেক টু নেক কম্পিটিশন। ইউনাইটেড হয়তো ট্রাইবুনালে মুভ করল না, পেমেন্টও বেঁচে গেল। কিন্তু তাদের ম্যানেজমেন্ট তো অন্য কিছু চিন্তা করতে পারে। রোড আর এয়ার ট্রান্সপোর্ট কিন্তু মারাত্মক হারে বাড়ছে। কয়েক’শ কোটি ফ্রেইট পেমেন্ট করা কাস্টমার যদি অল্টারনেট কিছু ভাবে তাহলে কিন্তু রেলেরই রেভিনিউ হ্যাম্পার করবে।”
তালুকদার সাহেবের কথাগুলো নিয়ে চিন্তা করছিলেন এমন সময়ে বেয়ারাকে চায়ের ট্রে নিয়ে ঢুকতে দেখে অবাক হয়ে তাকালেন। ইতিমধ্যেই চার কাপ চায়ের গতি করে ফেলেছেন। এটা পাঁচ নম্বর।
“এই রেটে চা খান, এ তো শরীরের পক্ষে ভালো না!”
কিন্তু কিন্তু করে কথাগুলো বলতেই তালুকদারসাহেবের ভ্রুদুটো জুড়ে সেকেন্ড ব্র্যাকেট হয়ে গেলো।
“আমি হলাম খানদানি চাতাল,” তালুকদারসাহেবের গলাটা কঠিন, “এর মর্ম বুঝবেন না। এটাকে বলে চা-প্ৰীতি। এইর’ম দেখেননি তো, তাই ভাবছেন?”
“দেখেছি স্যার,” বিশ্বনাথবাবু তৎক্ষণাৎ জবাব দিলেন, “শাশুড়ি ঠাকরুন রোজ সকালে স্নান করে পুজো সেরে একটা বড়ো পেতলের ঘটির এক ঘটি চা…”
“বলেন কী মিত্রবাবু,” তালুকদারসাহেব আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন, “ইনি তো তাহলে প্রণম্য ব্যক্তি। ইয়ে, মানে উনি কি এখনও…”
“হ্যাঁ হ্যাঁ, বহাল তবিয়তে! রোজ সকালে ওই একঘটি করে চা খেয়েই…আর সারাদিনে যখনই চা তখনই আদা দেওয়া ওই এক ঘটি।”
“থাকতেই হবে,” টেবিলে থাপ্পড় মারলেন, “শুনুন মিত্রবাবু, চিন, জাপান বা সাউথ ইস্ট এশিয়ার মানুষদের সুস্থ ভাবে বেঁচে থাকার কারণই হল চা। আর মিসেস?”
“তিনিও কিছু কম যান না,” একটা বড়ো দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, “দিনে পাঁচ ছ’বার খাওয়াই শুধু নয়, কাপের সাইজটা বিয়ার মগের।”
“আহা, এনাদের কথা শুনলেও ভালো লাগে।”
যত্তসব আদিখ্যেতা, মনে মনে গজগজ করলেন, এতবড়ো একটা পেমেন্টের আলোচনা হচ্ছে, এর মধ্যে চায়ের উপকারিতা নিয়ে লেকচার দেওয়ার কোন মানে হয়!
“মেয়ে?”
“মামারবাড়ির ধারা পেয়েছে।”
“এক্সেলেন্ট,” তালুকদাসাহেবের হাসি আরও চওড়া হল, “পেতেই হবে। শুনুন, চা খাওয়া অভ্যেস করে দেখুন, অনেক ভালো থাকবেন।”
“রক্ষে করুন স্যার, এমনিতেই অ্যাসিডিটির প্রবলেম। তার ওপর…”
“বেশ তো, লিকার চা খান।”
“ঘুম আসবে না।”
“নাঃ, চায়ের মর্ম বুঝবেন না। যাগ্গে, ফাইলটা ফেরত দিচ্ছি। একটু কনসিডার করে দেখুন।”
সেই প্রথম তালুকদারসাহেবের চা খাওয়ার অভ্যাস আর ‘চাতাল’ বলে একটা নতুন শব্দ জানতে পেরেছিলেন।
“আসব স্যার?”
বিকেলবেলা গ্লিনডার কার্গোর ফাইলটা নিয়ে চক্রবর্তী সাহেবের চেম্বারে এলেন।
“হ্যাঁ হ্যাঁ আসুন, বসুন।”
“হুঁ ঠিক আছে,” ফাইলে একঝলক চোখ বুলিয়ে নিলেন, “আজ আর সময় হবে না। কাল একবার দেখে নিয়ে ডিসকাস করব।”
“আচ্ছা স্যার।”
“আর শুনুন, কাল অফিসে আসার আগে অতি অবশ্যই এইচ.বি.এল. স্টেটমেন্টটা নিয়ে আসবেন,” চক্রবর্তী সাহেব মুচকি হাসলেন, “তালুকদারসাহেব কিন্তু আল্টিমেটাম দিয়ে রেখেছেন।”
দীর্ঘশ্বাস ফেলে চেম্বার থেকে বেরিয়ে এলেন।
আসলে পছন্দের কাজ হলে বিশ্বনাথবাবুর উৎসাহের সীমা থাকে না। কিন্তু অপছন্দের কাজ করানো যে কী সাংঘাতিক ঝক্কির ব্যাপার, সেটা যে না দেখেছে তার পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়।
যেমন বাজার করার কথাই ধরা যাক। ‘বাজার করায় হাজার ঠ্যালা’ এই কথাকে ষোল আনার জায়গায় আঠারো আনা ভুল প্রমাণ করে বাজার করতে বিশ্বনাথবাবুকে কোনদিন ব্যাজার হতে দেখা যায়নি। প্রত্যেকদিন বাজারে গিয়ে কাঁচা আনাজ দেখে, মাছের পেট টিপে, কানকো তুলে লাল রং যাচাই করে তবে কেনেন। সামনে কেটে না দিলে নেবেন না জেনে মাংসের দোকানদার মিত্রবাবুকে দেখলেই খাঁচা থেকে মুরগী বের করে কাটতে বসে।
আর স্বামীর বাজার করার এ হেন রিক্রিয়েশনের ধাক্কায় জেরবার হয়ে যান বিশ্বনাথবাবুর গৃহিণী।
শুধু সংসারের বাজার কেন, বিয়ের বাজার, তত্ত্বের বাজার, অনুষ্ঠানবাড়ির বাজার – সবেতেই বিশ্বনাথবাবুর অসাধারণ দক্ষতা। এই তো সেদিন, যখন ভাইঝির বিয়ের ঠিক হল…
“বিশেকে বলো, ও’সব বাজার ফাজার আমার কম্মো নয়!”
গৃহিণীকে হতভম্ব করে নির্বিকারভাবে সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে সান্ধ্য আড্ডার দিকে রওনা দিলেন বিশ্বনাথবাবুর দাদা। আর “দেখলে, তোমার দাদার কান্ডখানা,” বলে বিশ্বনাথবাবুর কাছে হাজির হলেন বৌদি।
অবশ্য বিশ্বনাথবাবুর কাছে সেটা কোন সমস্যাই নয়। আগে থেকেই প্রস্তুতি সেরে রেখেছেন – দাদা আবার বাজার করতে পারে নাকি! কী কিনতে কী কিনে বসবে! এবারে দাদার শালা, ভায়রাভাই আর ভাইপোকে নিয়ে তৈরি ব্যাটালিয়নের কম্যান্ডিং অফিসার হয়ে চললেন বাজার করতে। টালা থেকে টালিগঞ্জ, বালি থেকে বালিগঞ্জ ঘুরে কিনে আনলেন সেরা জিনিসপত্র। ধন্য ধন্য পড়ে গেল ভাইঝির শ্বশুরবাড়িতে।
“মিত্রমশাই, আমার মেয়ের বিয়ের বাজারের দায়িত্বও নিতে হবে কিন্তু!” বৌভাতের দিন বেয়ান নিজে আপ্যায়ন করে ফরমাশ দিলেন।
অফিস থেকে বেরিয়েই দেখেন ঝিরঝিরে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। ছাতাটা খুলতেই হল। এই ‘কেরানী ভেজানো’ বৃষ্টি বড়ো বিরক্তিকর।
“আসুন দাদা,” বিড়িতে শেষ কটা টান দিয়ে কন্ডাকটর হাসিমুখে ডাকল, “আর একটু দেখেই ছেড়ে দিতাম।”
তিরিশ বছর ধরে জি.পি.ও.-র সামনে থেকে মিনিবাস ধরেন। নিত্যযাত্রীদের সঙ্গে বাসের ড্রাইভার কন্ডাক্টরদের একটা সহজ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। নির্দিষ্ট সময়ে আসা ‘দাদা’ বা ‘কাকু’টির জন্যে দু’চার মিনিট অপেক্ষা করে, বসার জায়গা না থাকলে ড্রাইভারের সিটের পিছনে কাঠের তক্তাটার ওপরে একটা ভাঙ্গা চেয়ারের গদি রেখে দেয়। কে বলে কলকাতা নোংরা, ঘিঞ্জি, পুরোনো একটা শহর!
“সেন্ট্রাল, বৌবাজার, মেডিকেল, কলেজ স্ট্রিট, শিয়ালদা, শিয়ালদা…”
অন্যদিনের মতোই টি বোর্ডের বাড়িটার সামনে কন্ডাকটর হাঁক পাড়ছিল। কিন্তু তিরিশ বছরের ডেলি প্যাসেঞ্জারির পর আজ প্রথম মন দিয়ে দেখলেন বাড়িটাকে। আর তখনই তালুকদারসাহেবের ঘটনাটা মনে পড়ল।
রেলওয়ে অ্যাক্টের কয়েকটা ক্লজের উল্লেখ করে বিশ্বনাথবাবু পরবর্তী নোটটা লিখেছিলেন। তালুকদারসাহেব সহ আরও বেশ কয়েকজন উচ্চপদস্থ আধিকারিক সে প্ৰস্তাব চূড়ান্ত করার পর ক্লেম পেমেন্ট করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। তার সঙ্গে কোম্পানিকে একটা কড়া চিঠি – ভবিষ্যতে বুকিং করার সময় অতি অবশ্যই যেন কনসাইনমেন্টের বিশদ বিবরণ জানানো হয়।
“আসুন।”
‘মে বি অ্যাপ্রুভড,’ লিখে ফাইল ফেরত দিলেন। তার সাথে একটা প্যাকেটে ছটা কাঠের বাক্স। সবকটা বাক্সের ওপর গাঢ় সবুজ রং দিয়ে অনেককিছু লেখা।
“এটা কী স্যার?”
“মকাইবাড়ি টি।”
“কী বাড়ি,” বিশ্বনাথবাবু হতভম্ব। এতদিন সিল করা অ্যালুমিনিয়াম প্যাকেটে করে চা কিনেছেন। কিন্তু এই রকম জমকালো বাক্সে করে চা প্রথম দেখলেন।
“ম-কা-ই-বা-ড়ি, আপনি বুঝবেন না। মেয়ে, মিসেস আর মিসেসের মায়ের জন্য।”
প্যাকেটটা নিয়ে নিজের চেয়ারে এসে বসেছিলেন। হঠাৎ কী খেয়াল হওয়ায় একটা বাক্স বের করে দেখলেন। আর দেখেই মাথাটা ঘুরে গেল। একশো গ্রাম চা ষোল’শ টাকা! কিন্তু সে বস্তু বাড়িতে আনার পর হুলুস্থুলু পড়ে গেল।
“ম-কা-ই-বা-ড়ি…,” অবিকল সেই ভাবেই উচ্চারণ করলেন গৃহিণী, “বাঃ, তালুকদারসাহেবের টেস্ট আছে।”
“মা, মা, প্লিজ, এখনই এক কাপ…”
“করছি রে বাবা,” মেয়েকে মৃদু ধমক দিলেন, “আর শোন, দিদুনকে দুটো বাক্স দিয়ে আসবি।”
অন্যমনস্কভাবে অফিসের জামাকাপড় ছাড়ছিলেন। হঠাৎ একটা সুগন্ধ নাকে আসায় আশ্চর্য হলেন। বসার ঘরে এসে দেখলেন তিনকাপ চা রেডি। তারই গন্ধে সমস্ত ঘর ম ম করছে। আর সে চা’ও দেখার মতো। ক্রিস্টাল কাঁচের কাপ ভেদ করে সোনালী আভা ঠিকরে বেরোচ্ছে। ঢোঁক গিললেন বিশ্বনাথবাবু। কী জানি বাবা, এই চা’য়ে বোধহয় গোল্ড ডাস্ট মেশানো থাকে।
কিন্তু এক চুমুক দিয়েই বেশ ভালো লাগল। যেমন ফ্লেভার তেমন স্বাদ। সত্যিই এ চায়ের দাম ষোলশ টাকা হওয়াই উচিত।
বাজার করা যেমন পছন্দের ঠিক তেমনই অপছন্দের কাজ হল ইনকাম ট্যাক্সের রিটার্ন ফাইল করা। অঙ্কে অনার্স নিয়ে বি.এস.সি. আর এম.এস.সি.-তে ফার্স্টক্লাস পাওয়া বিশ্বনাথবাবু ইনকাম ট্যাক্স কষতে গিয়ে হিমশিম খান। এটা এত হলে সেটা তত, সেটা তত হলে ওটা এতর বেশি হবে না এই সব দেখলেই মাথা ঘুরতে শুরু করে। সমস্ত দরকারি কাগজপত্র সেকশন অফিসারকে দিয়ে দেন। উনিই সে সব কষে সই করিয়ে জমা দেন।
“আসুন মিস্টার মিত্র,” পরেরদিন ব্যাঙ্কে যাওয়া মাত্রই ম্যানেজারসাহেব হাসিমুখে আপ্যায়ন করলেন, “বসুন।”
বেশ কয়েকবার রেলের টিকিটের ব্যবস্থা করে দেওয়ার সুবাদে ব্র্যাঞ্চ ম্যানেজারের সাথে ভালো সম্পর্ক আছে।
“বলুন, কী সমস্যা?”
এইচ.বি.এল. স্টেটমেন্টের কথা শুনে ভদ্রলোকের মুখে চিন্তার ছাপ ফুটে উঠলো।
“হুঁ, কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ব্যাঙ্কের দুটো প্রিন্টারই আউট অফ অর্ডার। একটা দিয়েই সব কাজ করতে হচ্ছে। আধঘন্টা যদি সময় দেন…”
“আচ্ছা, ওয়েট করছি।”
“থ্যাঙ্ক ইউ,” এইচ.বি.এল.-এর দায়িত্বে থাকা অফিসারকে ফোনে জানিয়ে হাসিমুখে তাকালেন, “মিনিট পনেরোর মধ্যেই… ঠিক আছে, রেখে যাও, আর দুটো চা।”
কয়েকটা ফাইল নিয়ে বেয়ারা ঢুকেছিল। বিশ্বনাথবাবু কিছু বলার আগেই ম্যানেজারসাহেব হুকুম দিয়ে বসলেন।
“আচ্ছা স্যার,” টেবিলে থাকা কাপ প্লেট তুলে নিয়ে বেয়ারাটি মাথা নাড়ল।
সাড়ে দশটা, ইতিমধ্যেই এক রাউন্ড হয়ে গেছে, আবার চা! দুনিয়ার সমস্ত ‘চাতালে’র লক্ষ্য কি ‘বিশ্বনাথ মিত্র!’ মনে মনে গজগজ করলেও বারণ করতে পারলেন না। এখানে মুখের ওপর না বলাটা খুবই দৃষ্টিকটু।
বেজার মুখে চায়ের কাপে চুমুক দিলেন বিশ্বনাথবাবু।
কী আশ্চর্য, আজ এই তিতকুটে গরম জিনিসটাকে তো নেহাত মন্দ লাগছে না। দিব্যি আয়েশ করেই চা’টা শেষ করলেন। আর করেই চমকে উঠলেন।
শেষমেশ তিনিও ‘চাতাল’ হওয়ার দিকে এগোচ্ছেন না তো!
2 Comments