হে শিবনন্দিনী, দেহি জ্ঞানম্
এই প্রবন্ধের বিষয়বস্তু প্রাচীন ভারতবর্ষের তিন প্রখ্যাত দার্শনিক ও পণ্ডিত, উভয়া ভারতী ও মন্দন মিশ্রের সঙ্গে শঙ্করাচার্যের তর্কযুদ্ধ। এই তর্কযুদ্ধে মন্দন মিশ্রের স্ত্রী উভয়া ভারতী চরিত্রটি আমার আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছিল। আশা করি এই প্রবন্ধ পড়ার শেষে পাঠক পাঠিকারা তার কারণ বুঝতে পারবেন।
আগে সে তর্কযুদ্ধের প্রেক্ষাপট ও দৃষ্টিভঙ্গি স্বরূপ ভারতীয় দর্শনের একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়া আবশ্যক। জানি না আমার স্বল্প জ্ঞানে সে কাজে কতখানি সফল হব।
ভারতীয় দর্শনের মূল প্রসঙ্গে আসি। প্রথমে ‘দর্শন’ শব্দটিকে ব্যাকরণগতভাবে বিশ্লেষণ করা যাক।
‘দৃশ্’ ধাতুত্তর ‘অনট’ প্রত্যয় যোগে দর্শন শব্দটির উৎপত্তি। ‘দৃশ্’ ধাতুর অর্থ প্রেক্ষণ – প্ৰ + ঈক্ষণ, অর্থাৎ প্রকৃষ্টরূপে দেখা। তাহলে দর্শন বলতে দর্শনশাস্ত্রকেও বোঝায় কেন?
একটি উদাহরণের সাহায্যে ব্যাপারটিকে ব্যাখ্যা করা যাক। ধরুন সদ্যফোটা একটি লাল গোলাপ চোখের Retina-য় পড়ামাত্রই সে সেটিকে সঙ্কেতে রূপান্তরিত করে স্নায়ুর মাধ্যমে মস্তিষ্কে পাঠাল। মস্তিষ্ক তখন দৃষ্ট বস্তুটিকে বিশ্লেষণ করে তার ভেতরে রাখা স্মৃতির সঙ্গে মিলিয়ে, সেটিকে লাল গোলাপ হিসাবে চিহ্নিত করল।
এ পর্যন্ত যা ঘটল তা একটি যান্ত্রিক প্রক্রিয়া মাত্র। তারপরে সে সঙ্কেত যখন মনোজগতে পৌঁছে সেখানে আলোড়ন সৃষ্টি করল তখনই সেই সদ্যফোটা গোলাপ আমাদের অন্তঃকরণে মুগ্ধতা সৃষ্টি করল। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, “আমারই চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ…”
অর্থাৎ ‘দর্শন’ প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণ হল। তাই শুধুমাত্র ‘দেখা’ই, দর্শন নয়।
তাহলে যা কিছুই দর্শন করা হয় সবই কি দর্শনশাস্ত্রের তত্ত্ব বলে মেনে নিতে হবে? না, কারণ দর্শন সৃষ্টি করে ‘জ্ঞান’, যা সত্যি হতেও পারে আবার নাও হতে পারে। ‘জ্ঞান’ সত্যি কি না সেটা বুঝতে গেলে ‘প্র’ অর্থাৎ প্রকৃষ্ট পূর্বক ‘মা’ অর্থাৎ জ্ঞান ধাতুত্তর ‘অনট্’ প্রত্যয় (যা করণার্থে অর্থাৎ কিছু ঘটানোকে বোঝায়) যোগ, অর্থাৎ ‘প্রমাণে’র প্রয়োজন। এই ‘প্রমাণ’ সমর্থিত জ্ঞানই হল ‘প্রমা’ অর্থাৎ প্রকৃষ্ট জ্ঞান, জ্ঞানের সাক্ষাৎ সাধন বা করণ, যাকে ভারতীয় দর্শনশাস্ত্র তত্ত্ব বলে গ্রহণ করে।
ভারতবর্ষে আসার পর আর্যদের প্রথম সংগঠিত সাহিত্যকীর্তি হল বেদ। সিন্ধুনদের আশেপাশে স্থায়ী বসতি গড়ার ফলে ততদিনে তারা সিন্ধ>সিন্ধু>হিন্দু বলে পরিচিত হয়ে গেছে। তাই আর্য তথা হিন্দুদর্শন নিয়ে আলোচনা করতে গেলে প্রথমে এই বেদকে খুঁটিয়ে দেখা প্রয়োজন। মূলত বৈদিক দেবতাদের স্বরূপ নির্ণয় ও বর্ণনা এবং তাদেরকে তুষ্ট করে বাঞ্ছিত ফললাভের উপায় বলা আছে বেদে। প্রকৃতির বিভিন্ন রুদ্ররূপকে, যেমন বজ্রবিদ্যুৎকে ইন্দ্র, বৃষ্টিকে পর্জন্য, ঝড়কে বায়ু, দাবানলকে অগ্নি রূপে কল্পনা করে বিভিন্ন দেবতা বলে বর্ণনা করা হয়েছে এবং নানা ধরণের যাগযজ্ঞ, পূজা ইত্যাদির মাধ্যমে এদেরকে তুষ্ট রাখার উপায় বলা হয়েছে। আদিকাল থেকেই বেদকে বলা হয়েছে একমাত্র ‘সত্য।’
কিছুদিনের মধ্যেই বেদবিরোধী একটি মতবাদ দানা বাঁধতে শুরু করল। এই মতবাদের প্রবর্তকগণ নিম্নলিখিত কারণগুলি দেখিয়ে বেদকে একমাত্র ‘সত্য’ বলে মানতে অস্বীকার করলেন:
১. বৈদিক যাগযজ্ঞের মাধ্যমে অভীষ্ট ফল পাওয়া যাবে এমন কোন প্রমাণ নেই।
২. বেদের উক্তি পরস্পরবিরোধী।
৩. বেদ পুনরুক্তি দোষে দুষ্ট।
৪. যেহেতু জন্ম ও মৃত্যু থাকার কারণে মানবজীবন অনিত্য অতএব বেদনির্ভর বৈদিক দেবতারাও অনিত্য।
সৌভাগ্যবশত সেই সময় ভারতবর্ষে উপযুক্ত যুক্তি দিয়ে সমর্থিত যে কোন বিরুদ্ধমতকে যথাযথ গুরুত্ব সহকারে বিচার করার প্রথা ছিল। তাই বৈদিক ক্রিয়াকর্মের সমর্থনকারীরা প্রতিযুক্তির সন্ধান শুরু করলেন। ফলে মানুষ দুটি ভিন্নমতের দলে ভাগ হয়ে গেলেন। একদল আস্তিক, যাঁরা বেদোক্ত ক্রিয়াকর্মের সমর্থনকারী। অন্যদল নাস্তিক, অর্থাৎ বেদোক্ত ক্রিয়াকর্মের বিরোধী – নাস্তিক্যং বেদনিন্দাঞ্চ দেবতানাঞ্চ কুৎসনম্। এই দুই পক্ষই সসীমকে ছেড়ে অসীমের সন্ধান শুরু করলেন। যেহেতু অসীমকে ধারণা করা অত্যন্ত কঠিন, তাই বীজগাণিতিক সমীকরণের অজ্ঞাত X Factor এর মত সেই অসীমকে ‘ঈশ্বর’, ‘পরমাত্মা, ‘ব্রহ্ম’ প্রভৃতি নামে চিহ্নিত এবং ব্যাখ্যা করতে গিয়ে দার্শনিকরাও বিভিন্ন মতবাদে বিভক্ত হয়ে পড়লেন।
দর্শনশাস্ত্রের মূল আলোচনায় যেতে গেলে আমাদের দুটি মতবাদকে বুঝতে হবে – দ্বৈতবাদ এবং অদ্বৈতবাদ।
দ্বৈতবাদ:
দ্বৈত শব্দের অর্থ দুই। ঈশ্বর শব্দটিকে ভাঙলে আমরা পাই ‘ঈশ্’, যার অর্থ শ্ৰেষ্ঠ/স্রষ্টা/প্রভু, ও ‘বর’ অর্থাৎ শুভ/সুন্দর)। দুয়ে মিলে ‘ঈশ্বর’ কথাটির জন্ম। ‘ঈশ্বরে’র (স্ত্রী-লিঙ্গে ঈশ্বরী) প্রকৃত অর্থ শুভ/সুন্দরের স্রষ্টা/অধিকর্তা। জগৎ এক নয়, দুইটি জগৎ আছে – এটাই দ্বৈতবাদের মুল কথা। দ্বৈতবাদীদের মতে ঈশ্বর নিরাকার নন। ভক্ত তাঁকে যে রূপে দেখতে চায় তিনি সেই রূপ পরিগ্রহ করেন। তাঁর কোন সৃষ্টিকর্তা নেই, তিনি স্বয়ম্ভূ। তিনি কোনো একটি নির্দিষ্ট লোকে বাস করেন, যথা ব্রহ্মলোক, বিষ্ণুলোক, শিবলোক, প্রভৃতি। আবার তিনি সূক্ষ্ম আত্মা রূপে জীবের হৃদয়েও অবস্থান করেন। ঈশ্বর পঞ্চভূত দ্বারা এই জড়বিশ্ব ও জীবকুলকে সৃষ্টি করেছেন, তিনি একাধারে সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা ও ধ্বংসকর্তা। ভক্তিযোগই দ্বৈতবাদীদের প্রধান অবলম্বন। ঈশ্বরকে ভক্তি করলে তিনি সন্তুষ্ট হয়ে মুক্তি দেবেন এটাই দ্বৈতবাদীদের সাধনার মূলকথা।
অদ্বৈতবাদ:
অদ্বৈতবাদের প্রবর্তক শঙ্করাচার্য। বেদ পরবর্তী যুগে রচিত উপনিষদের ‘অমূর্তরূপ ব্রহ্মের’ ওপরে ভিত্তি করে এই মতবাদ গড়ে ওঠে। ‘ব্রহ্ম’ শব্দটির ব্যুৎপত্তি ক্লীবলিঙ্গ ‘ব্রহ্মন্’ শব্দ। ‘বৃঃ’(স্ফীত হওয়া/বিস্তারলাভ) + ‘মন্’(প্রকাশ) যোগ করে হয় ‘ব্রহ্মন্’। ‘ব্রহ্মন্’ শব্দের অর্থ ‘বৃহতের চেতনা, বা বৃহতের শক্তি, যা এক সর্বব্যাপী, চূড়ান্ত ও অখণ্ড সত্য’। ‘ব্রহ্ম’ সত্য, নির্গুণ, নির্বিকার, নিরাকার, এক এবং অদ্বিতীয়। শঙ্করের মতে “ব্রহ্ম সত্যং জগন্মিথ্যা ব্রহ্ম জীবো ব্রহ্মৈব নাপরঃ” – যার অর্থ ব্রহ্মই একমাত্র সত্য। ব্রহ্ম ও জীবাত্মা অভিন্ন।
ব্রহ্ম ছাড়া অন্য সমস্ত কিছুই উৎপত্তি ও বিনাশশীল, অতএব তা অনিত্য ও মিথ্যা।
সৃষ্টিরূপ বিশ্ব ব্রহ্মেরই বহুরূপে প্রকাশ। কিন্তু তা উৎপত্তি ও বিনাশশীল। এই প্রসঙ্গেই প্রপঞ্চ কথাটি আসে, যার অর্থ ভ্রান্তধারণা। অদ্বৈতবাদ বলে, এই যে আমরা বিশ্বকে প্রত্যক্ষ করছি, যা সতত পরিবর্তনশীল, সর্বদাই যা নাম ও রূপ এই দুই এর সমন্বয়ে পরিবর্তিত হচ্ছে, সেটি আসলে একটি ভ্রম ছাড়া কিছুই নয়। এ যেন রজ্জুতে সর্পভ্রম। এই ভ্রমটি ব্রহ্মের মায়াশক্তির প্রভাব।
তার মানে কী দাঁড়াল? বিশ্ব প্রকৃত সৃষ্টি নয়, ‘অবভাস’ মাত্র, যেন মরীচিকা। What appears is not real – যা দেখতে পাচ্ছি তা প্রকৃত সত্য নয়। কামনার ক্রীতদাস হয়ে বেদোক্ত কর্মের অনুষ্ঠান করলে কর্মফলভোগের জন্য এই মায়াময় পৃথিবীতে বারে বারে শরীর ধারণ করে আসতে হবে ও কর্মচক্রের আবর্তনে অনন্তকাল ঘুরতে হবে। তাই ইহবিশ্ব ও পরজগৎে কোনপ্রকার ফললাভের আকাঙ্ক্ষা ত্যাগপূর্বক জীবকে নিষ্কাম কর্মের অনুষ্ঠান দ্বারা চিত্তশুদ্ধি করে ব্রহ্মজ্ঞানের সন্ধান করতে হবে। একবার সেই জ্ঞানলাভ হলে জীব ও ব্রহ্ম, উভয়ের মধ্যে ঐক্য ঘটে। ‘অহং ব্রহ্মস্মি’ – আমিই ব্রহ্ম – এই চেতনা লাভ হয়। এটি বুঝতে পারলে জীবের মুক্তিলাভ হয়।
কিন্তু শুধু অদ্বৈত মতবাদ প্রবর্তন করেই শঙ্কর ক্ষান্ত হলেন না, তিনি চাইলেন আসমুদ্রহিমাচলের সমস্ত দর্শনিক তাঁর মতবাদকে অভ্রান্ত ও একমাত্র পথ বলে মেনে নিক। সেই উদ্দেশ্য সফল করার জন্যে তিনি একের পর এক বিরুদ্ধপক্ষীয় দার্শনিকদের তর্কযুদ্ধে ধরাশায়ী করতে লাগলেন। অচিরেই ভারতবর্ষের দার্শনিকদের মধ্যে তরুণ শঙ্করাচার্যের পাণ্ডিত্যের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ল। বেশ কিছু তরুণ দার্শনিক অদ্বৈতবাদ দর্শনের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করলেন।
তীক্ষ্ণধী শঙ্করাচার্য ক্রমশ বুঝতে পারছিলেন, যে বিরুদ্ধপক্ষীয় মতবাদের শ্রেষ্ঠ দার্শনিককে যদি তর্কযুদ্ধে পরাজিত করতে পারেন তাহলে সারা ভারতবর্ষে খুব সহজেই অদ্বৈতবাদকে প্রতিষ্ঠা করা যাবে। সেই সময় শঙ্করাচার্যের মতবাদের প্রধান বিরুদ্ধপক্ষ ছিল পূর্বমীমাংসক মতবাদে বিশ্বাসীরা। তাই শঙ্কর মীমাংসা দর্শনের সর্বাপেক্ষা প্রবীণ দার্শনিক কুমারিল ভট্টের সাক্ষাৎপ্রার্থী হয়ে তর্কযুদ্ধে প্রবৃত্ত হতে অনুরোধ করলেন। কিন্তু অতিবৃদ্ধ দার্শনিক কুমারিল ভট্ট বার্ধক্যজনিত কারণে সে অনুরোধ সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করলেন। বরং তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ শিষ্য মন্দন মিশ্রের সঙ্গে তর্কযুদ্ধে প্রবৃত্ত হওয়ার পরামর্শ দিয়ে বলেন যদি শঙ্কর মন্দন মিশ্রকে তর্কে পরাস্ত করতে পারেন তাহলে তিনিও সানন্দে পরাজয় স্বীকার করে নেবেন। শঙ্কর তখন মন্দন মিশ্রের সঙ্গে দেখা করে কুমারিল ভট্টের পরামর্শের কথা বললেন। বিস্মিত মন্দন মিশ্র স্ত্রী উভয়া ভারতীকে সঙ্গে নিয়ে তাঁদের শিক্ষক তথা গুরু কুমারিল ভট্টের সাক্ষাৎপ্রার্থী হলেন। এখানেই শুরু হল সবচেয়ে আকর্ষণীয় কাহিনিটি, এ লেখার প্রধান উপজীব্য বিষয়।
মন্দন মিশ্র ও উভয়া ভারতী – এই দম্পতির একটু পরিচয় দেওয়া প্রয়োজন। সমকালীন ভারতবর্ষে স্বামী-স্ত্রী জুটি তাঁদের পাণ্ডিত্যের জন্য প্রখ্যাত ছিলেন। স্ব স্ব ক্ষেত্রে বিদ্বান হওয়া সত্ত্বেও এঁরা একে অন্যের প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল এবং অনুরক্ত ছিলেন। অহং তাঁদের মধুর সম্পর্কের মধ্যে কোন সঙ্ঘাত সৃষ্টি করেনি, পাণ্ডিত্য কোনোভাবেই প্রেমে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। উভয়ে মিলিতভাবে একাধিক শাস্ত্র, টিকা এবং ভাষ্য রচনা করেছেন। পরিহাস করে সে সময়ের দার্শনিকেরা মন্দন মিশ্রকে আগুন এবং উভয়া ভারতীকে সে আগুনের তেজ বলে উল্লেখ করতেন। যথার্থ উপমা। এ যুগেও আশ্চর্য হতে হয় এমন একটি প্রীতিপূর্ণ দাম্পত্যের কথা জেনে, যা একে অন্যকে প্রতিনিয়ত সমৃদ্ধ করে।
গুরুর আদেশে মন্দন মিশ্র শঙ্করাচার্যের সঙ্গে তর্কযুদ্ধে সম্মত হলেন।
এ এক এক অভূতপূর্ব তর্কযুদ্ধ, দুই মহা দার্শনিকের দ্বৈরথ। তর্কযুদ্ধে সাক্ষী হওয়ার জন্যে ভারতবর্ষের তাবৎ বিদ্বৎসমাজ তখন কুমারিল ভট্টের কাছে উপস্থিত হয়েছেন। কিন্তু সমস্যা দেখা দিল এই তর্কযুদ্ধের মীমাংসক নির্বাচনের ব্যাপারে। বার্ধক্যজনিত কারণে কুমারিল ভট্টের পক্ষে মীমাংসক হওয়া সম্ভব নয়। অন্যান্য দার্শনিকেরাও নিজেদের সামর্থ্যের সীমা বিবেচনা করে অক্ষমতার কথা জানিয়ে দিলেন। অবশেষে কুমারিল ভট্টের নির্দেশে উভয়া ভারতীকে এই দ্বন্দ্বযুদ্ধের মীমাংসক নিয়োগ করা হল। বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত, সন্দেহ নেই। স্বামী তর্কযুদ্ধে প্রবৃত্ত হবেন, বিচারক তাঁর স্ত্রী। তাই দায়িত্ব নেওয়ার আগে উভয়া ভারতীকে কুমারিল ভট্ট সহ অন্য বেশ কিছু প্রবীণ দার্শনিকের কাছে নিরপেক্ষতা রক্ষার শপথ গ্রহণ করতে হল।
অবশেষে নির্দিষ্ট দিনে বহুপ্রতীক্ষিত সেই তর্কযুদ্ধ শুরু হল।
মন্দন মিশ্র তাঁর বক্তব্যে সাধকের ভক্তির ওপর গুরুত্ব আরোপ করলেন। তাঁর যুক্তি, একমাত্র ভক্তিই নিরাকার ঈশ্বরকে সাকারে পরিণত করে ভক্তের বাঞ্ছিত রূপে তাঁর কাছে প্রকট করেন। কোন দেবদেবীর পক্ষেই তীব্র ভক্তির আকর্ষণ উপেক্ষা সম্ভব নয়। আর সে ভক্তিকে যথাযথ ভাবে প্রকাশ করতে গেলে বেদোক্ত কর্মের অনুষ্ঠানই একমাত্র পথ। এইভাবে ভক্তিপ্রদর্শনের মাধ্যমেই ঈশ্বরকে প্রসন্ন করে তাঁকে উপলব্ধি করা যায়।
বক্তব্যের বিরোধিতা করে শঙ্কর জানালেন, একমাত্র ব্রহ্মই সত্য। এই জ্ঞান দৃঢ় না হওয়া পর্যন্ত জীবকে কর্ম এবং উপাসনার দ্বারা চিত্তের শুদ্ধি ও একাগ্রতা অর্জনের চেষ্টা করতে হয়। চেষ্টার ফলে ব্রহ্মকৃপা প্রাপ্তি ঘটে, তখনই সব প্রতিবন্ধকতা বিনষ্ট করে প্রকৃত জ্ঞানলাভ হয়। অজ্ঞানতার কারণেই জীব দুঃখমিশ্রিত সুখ কামনা করে থাকে। দ্বৈতবাদে বলা ব্রহ্মলোক, বিষ্ণুলোক, শিবলোক সে কামনারই চরমসীমা মাত্র। দ্বৈতবাদীদের ভক্তিমার্গের পথ ক্রমমুক্তির। কিন্তু অদ্বৈতব্রহ্মজ্ঞান সদ্যমুক্তির পথ। এমনকি ভক্তিমার্গে ক্রমমুক্তির শেষেও অদ্বৈতবাদের মাধ্যমেই মোক্ষ লাভ হয়। তখন জীব ও ব্রহ্ম এক, কোন ভেদ থাকে না।
দীর্ঘদিন ধরে চলল এই তর্কযুদ্ধ। শেষপর্যন্ত মীমাংসক উভয়া ভারতীর বিচারে তরুণ শঙ্করাচার্যের নিপুণ যুক্তির কাছে মন্দন মিশ্র পরাস্ত হলেন।
এরপরেই ঘটল এক অভিনব ঘটনা। উভয়া ভারতী মন্দন মিশ্রকে পরাজিত ঘোষণা করলেও শঙ্করাচার্যকে জয়ী ঘোষণা করতে অস্বীকার করলেন। জানালেন, বিবাহসূত্রে তিনি এবং মন্দন মিশ্র একাত্ম হয়েছেন। তাই মন্দন মিশ্রকে পরাজিত করে শঙ্করাচার্য অর্ধেক আত্মাকে পরাস্ত করেছেন, সম্পূর্ণ জয় পেতে হলে উভয়া ভারতীকেও তর্কে পরাস্ত করতে হবে।
তৰ্ক চলাকালীন উভয়া ভারতী নিরপেক্ষ মীমাংসক রূপে অত্যন্ত দক্ষতার পরিচয় দিলেও সম্ভবত তরুণ শঙ্করাচার্যের কাছে স্বামীর পরাজয় মেনে নিতে পারেননি। তাই কূটবুদ্ধি প্রয়োগ করে শঙ্করাচার্যের জয়ের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ালেন।
উপস্থিত পণ্ডিতরা হতবাক হয়ে গেলেও কুমারিল ভট্ট সহ অন্য প্রবীণ দার্শনিকেরা এই যুক্তিকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করে উভয় ভারতীর পাশে দাঁড়ালেন। ফলে নিরুপায় শঙ্করাচার্য এই তর্কযুদ্ধে প্রবৃত্ত হতে বাধ্য হলেন। কিন্তু মীমাংসক হবেন কে? উভয়া ভারতী ও শঙ্করাচার্যের তর্কযুদ্ধে আর কোন মীমাংসক নেই । তাই দুই তার্কিক নিজেরাই মীমাংসক হয়ে যুদ্ধে অগ্রসর হলেন। সমবেত পণ্ডিতমণ্ডলী অপেক্ষা করছেন এক অভূতপূর্ব তর্কযুদ্ধে সাক্ষী হবেন বলে।
শঙ্করাচার্যকে তর্কে আহবান করে উভয় ভারতী প্রথমেই প্রশ্ন করলেন কামশাস্ত্র থেকে!
উপস্থিত পণ্ডিতমণ্ডলী, যাঁদের মধ্যে মন্দন মিশ্রও ছিলেন, উভয়া ভারতীকে এ বিষয়ে প্রশ্ন না করার অনুরোধ জানালেন। স্বয়ং মন্দন মিশ্র বললেন, শঙ্করাচার্য প্রায় বালকাবস্থাতেই সন্ন্যাসধর্ম গ্রহণ করেছেন – সংসারধর্ম তথা নারীসঙ্গ সম্বন্ধে তাঁর কোন ধারণাই নেই। তাই উভয়া ভারতী যেন তরুণ সন্ন্যাসীকে সে বিষয়ে প্রশ্ন করে বিব্রত না করেন।
দৃঢ়কণ্ঠে প্রতিবাদ জানালেন উভয়া ভারতী। যুক্তি দিলেন:
১. কামশাস্ত্র কোন নিষিদ্ধশাস্ত্র নয়, বহু বিদগ্ধ পণ্ডিতের অবদানে এ শাস্ত্র তৈরী হয়েছে। শঙ্করের যদি সে কামশাস্ত্র সম্পর্কে জ্ঞান না থাকে তাহলে সেটা তাঁর অজ্ঞতা।
২. শঙ্কর স্বেচ্ছায় সন্ন্যাস নিয়েছেন, তার অর্থ এই নয় যে তাঁকে সংসারধর্ম তথা নারীসঙ্গ সম্বন্ধে কোন প্রশ্ন করা যাবে না।
৩. শঙ্কর যখন সন্ন্যাসী তাহলে তিনি অবশ্যই জিতেন্দ্রিয়। সেক্ষেত্রে এ শাস্ত্র তো তাঁর চিত্তবিক্ষেপ ঘটাতে পারবেই না!
কঠিন যুক্তি। ভেদ করতে না পেরে প্রতিবাদকারী পণ্ডিতসমাজ নিরুত্তর হয়ে রইলেন।
তীক্ষ্ণ বুদ্ধির অধিকারিণী উভয়া ভারতী তৰ্ক চলাকালীন মীমাংসকের দায়িত্বপালনের সঙ্গে সঙ্গেই শঙ্করাচার্যের জ্ঞানকে নিখুঁতভাবে পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন করে নিয়েছিলেন। বুঝতে পেরেছিলেন, প্রচলিত শাস্ত্র বা যুক্তি দিয়ে এই তরুণ তার্কিককে প্রতিহত করা যাবে না। তাই ধূর্তবুদ্ধি প্রয়োগ করে উভয়া ভারতী প্রতিপক্ষের জ্ঞানাতীত স্থানে আঘাত হানলেন। অসহায় শঙ্করাচার্য বুঝতে পারছেন উপস্থিত কোনো পণ্ডিতপ্রবরই এই বিদুষী নারীর হাত থেকে তাঁকে রক্ষা করতে পারবেন না। নিশ্চুপ শঙ্করাচার্যকে দেখে উভয়া ভারতীও কটাক্ষ করা শুরু করেছেন। অগত্যা শঙ্করাচার্য কামশাস্ত্র শিক্ষার জন্য এক মাস সময় চেয়ে নিলেন।
এরপরে নানা অলৌকিকত্বের মোড়কে আসল ঘটনা চাপা পড়ে গেছে। সেসবে না গিয়ে বলা যায় একমাসে শঙ্কর কামশাস্ত্র আয়ত্ব করেন। তাঁর মতো তীক্ষ্ণধী পণ্ডিতের পক্ষে একমাসে এ শাস্ত্রে পারঙ্গম হওয়াটা খুব একটা অসম্ভব বলে মনে হয় না। যুক্তির দিক থেকে এটাই সবচেযে সহজ এবং সম্ভাব্য সমাধান।
দ্বিতীয়বার তর্কযুদ্ধে শঙ্করাচার্য উভয়া ভারতীকে পরাস্ত করলেন।
এই বিখ্যাত তর্কযুদ্ধের পরেই শঙ্করাচার্য প্রবর্তিত অদ্বৈতবাদ সারা ভারতবর্ষে সুপ্রতিষ্ঠিত হল।
যদিও পরবর্তীকালে এই মতবাদও প্রবলভাবে সমালোচিত হয়। রামানুজ, মাধবাচার্য, বল্লভাচার্য, নিম্বার্কের মতো তীক্ষ্ণধী দার্শনিকেরা অদ্বৈতবাদের বিভিন্ন ত্রুটিবিচ্যুতির কথা উল্লেখ করে নিজেদের মতবাদ প্রবর্তন করেন। এঁদের মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক প্রশ্ন তোলেন রামানুজ, লোকশ্রুতি অনুযায়ী যিনি শঙ্করাচার্যের অন্যতম প্রধান শিষ্য ছিলেন। তাঁর মতে যদি ব্রহ্মই একমাত্র সত্য ও জগত মিথ্যা হয় তাহলে শঙ্করাচার্য তথা তাঁর বাক্যও মিথ্যা। রামানুজ প্রবর্তিত বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ তাই বহুত্বের অস্তিত্বে বিশ্বাসী।
আজকের ভারতবর্ষে সেই নারীদেরই দুর্দশা দেখলে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতে ইচ্ছে করে, মা কী ছিলেন আর মা কী হইয়াছেন!