কণ্ঠ ছাড়ো জোরে

কণ্ঠ ছাড়ো জোরে

I am the first and the last
I am she who is honored and she who is mocked…
I am the mother and the daughter
I am she…
Do not be afraid of my power…’

(Trans: MacRae, G. W., “The Thunder: Perfect Mind”)

কিছুদিন আগে আমার এক সহকর্মীর সঙ্গে লাঞ্চ খেতে গিয়েছিলাম। শিকাগোর একটি স্কুল আমার কর্মস্থল। কর্মস্থলের কাছেই একটি মেক্সিকান রেস্তোরাঁ আমার আর আমার সহকর্মী বন্ধু দু’জনেরই প্রিয়। সেদিন সেখানে খেতে খেতে আমাদের মধ্যে যে কথোপকথন হল তা নিম্নরূপ:

স: বলো দেখি এই সপ্তাহান্তে আমার কার সঙ্গে হঠাৎ দেখা হয়ে গেল?
র: কার সঙ্গে?
স: মার্ক এর সঙ্গে। (মার্ক আমার সহকর্মীর প্রাক্তন স্বামী)
র: তাই নাকি? তা কেমন আছে সে?
স: একই রকম। তবে দেখা হয়ে ভালোই হল। আমরা একসঙ্গে লাঞ্চ খেলাম। নিজের ভুল কিছু কিছু বুঝতে পারলেও সে কিন্তু বদলায়নি বিশেষ। তার পরিণতির জন্যে এখনো আমাকে অনেকটাই দায়ী করে। (মার্ক ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছে বেশ কয়েক বছর আগে। সে পেশায় বাদ্যযন্ত্রী। কিন্তু অতিমারীর সময়ে তার পেশায় সেই যে মন্দা লেগেছিল তা আর কাটিয়ে উঠতে পারেনি।)
র: আচ্ছা। একটা প্রশ্ন – মার্ক কি তোমার মেয়ের সঙ্গে এখনো যোগাযোগ রাখতে চায়? আমার মনে আছে মার্ক তোমার মেয়েকে খুব স্নেহের চোখে দেখত।
স: হয়তো চায়, কিন্তু মেয়ে চায় না। সে বলে, ‘জানো মা, আমি বেশ বুঝতে পেরেছি একটি শিশুকে প্রতিপালন করে তার মা। আর বাবারা ইচ্ছেমতো তাদের জীবনে আসা যাওয়া করে।’ 
তারপর একটু থেমে আমার সহকর্মী বলল, ‘আসলে দু’জন বাবাকে হারাল তো আমার মেয়ে।’  

আমার সহকর্মী একজন একক মা। যথেষ্ট আত্মবিশ্বাস নিয়ে সে তার মেয়েকে বড় করছে। খুব পরিশ্রমী মহিলা। তার মেয়ের জন্মদাতা বাবা শুরু থেকেই অনুপস্থিত তাদের জীবনে। পরে আমার সহকর্মী বিয়ে করে মার্ককে। কিন্তু মার্ক-এর সঙ্গেও বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে যায় কয়েক বছরের মধ্যে। আমার সহকর্মীই তার সন্তানের জীবনে একাধারে মা ও বাবার ভূমিকা হাসিমুখে পালন করে চলেছে। 

সমাজে মেয়েদের অবস্থান নিয়ে অনেক লেখালেখি চলছে বিগত কয়েক দশক ধরে। সম্প্রতি কলকাতা শহরে ঘটে যাওয়া এক নির্মম ঘটনাকে কেন্দ্র করে জনমানস উত্তাল। এক লেখিকা বন্ধু তার নিজের নিউজলেটারে একটি প্রবন্ধ লিখেছেন। তার শিরোনাম হল, “No Country For Young Women।” সেখান থেকে একটি লাইনের উদ্ধৃতি দিতে চাই কারণ সেই বাক্যটি আমার মনে রেখাপাত করছে গভীরভাবে। “The cult of the Mother or Maternal is well and alive in India. The cult of the Woman is, as always, under serious threat” (Nandini Bhattacharya)। এই প্রসঙ্গে ভাবতে ভাবতেই আমার সাম্প্রতিক কালের পড়া কিছু বইয়ের কথা মনে এল। এক এক করে সে বইগুলি নিয়ে আগে একটু আলোচনা করা যাক।

নাইজেরিয়ায় আদুন্নির গল্প

প্রথম যে বইটির উল্লেখ করতে চাই তার নাম হল “The Girl With A Louding Voice” – লেখিকা আবি ডারে (Abi Daré)।[i] নাইজেরিয়ার রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বুহারি জয়লাভ করেছেন। উপন্যাসের শুরুতে কাহিনীর পটভূমি হল নাইজেরিয়ার ইকাতি গ্রাম। সেই  গ্রামে বাস করে আদুন্নি (Adunni), চোদ্দ বছরের মাতৃহীন এক মেয়ে। এ বইয়ের প্রধান চরিত্র সে। তার মদ্যপ বাবার কাছে সে এক মূল্যবান পণ্যসামগ্রী। মরুফু নামে এক ট্যাক্সি চালক ত্রিশ হাজার নাইরার বিনিময়ে তিন নম্বর বউ হিসেবে কিনে নিতে চায় তাকে। বিয়ের প্রস্তাবে রাতের অন্ধকারে মাদুরের ওপর বসে বসে আদুন্নি ভাবতে থাকে, “What is it meaning, to be the wife of a man with two wifes and four childrens? And Papa, why is he wanting to sell me to a old man with no any thinking of how I am feeling?” তার বুকের মধ্যে ভারী হয়ে ওঠে নানা প্রশ্ন। মা মারা যাওয়ার পর ছোট ভাইটি ও বাবার মুখ চেয়ে নিজের দুঃখ বুকে চেপে সে সংসারের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছে। কিন্তু সে দুঃখ কখনো কখনো উঠে আসে তার জিভের ডগায় – প্রশ্ন, প্রতিবাদ, আর ক্ষোভ ছটফট করে তার মুখেচোখে। নিজের অনুভূতি প্রকাশ করার জন্য সে চায় জোরালো কন্ঠস্বর। এ কাহিনী আদুন্নির নিজের কণ্ঠস্বর খুঁজে পাওয়ার গল্প।

মরুফুর সঙ্গে বিয়ের পরে এক দুর্ভাগ্যজনক ঘটনায় জড়িয়ে পড়ে আদুন্নি। আগান গ্রামবাসীদের জঙ্গুলে বিচার ও শাস্তি এড়াতে পালিয়ে যায় সে। এবারে নিজের দেশেই দাসপ্রথার শিকার হয়। লাগোসে এক ধনী পরিবারে গৃহভৃত্য হিসেবে তাকে বিক্রি করে দেয় দালাল। কিন্তু সেখানে গিয়েও চুপ করে থাকতে পারে না আদুন্নি। ধনীগৃহের রাঁধুনী ও গাড়ীর চালকের নিষেধ সত্ত্বেও আগের নিখোঁজ পরিচারিকা রেবেকার বিষয়ে সরাসরি প্রশ্ন করে বসে মালকিনকে। নানা নির্যাতন সহ্য করেও তার মনে জেগে থাকে এক অদম্য ইচ্ছা। সে স্কুলে যেতে চায়। ভবিষ্যতে ইস্কুলের দিদিমণি হওয়ার বাসনা তার। নিজের পরিস্থিতির সঙ্গে সম্পর্কহীন এই ইচ্ছের কারণ হিসেবে আদুন্নি তার এক শুভার্থীকে বলে, “My mama say education will give me a voice. I want more than just a voice, Ms. Tia. I want a louding voice.”

সে জানে কাজটি তার পক্ষে দুরূহ। জানে তার মূল্য নির্ধারিত হয়েছে চারটি ছাগল, দু’বস্তা চাল, কয়েকটা মুরগী, আর একটি টিভি সেট। তার মা ছাড়া পৃথিবীতে সকলেই তাকে বুঝিয়েছে তার অস্তিত্ব অর্থহীন। মানবিকতার ন্যূনতম অধিকারটুকুও দেওয়া হয়নি তাকে। চূড়ান্ত লাঞ্ছনার মধ্যে দিয়ে যেতে যেতেও আদুন্নি লড়াই চালিয়ে গেছে তার ‘louding voice’ খুঁজে পাওয়ার জন্য। কখনো ফিসফিস করে, কখনো বা গান গেয়ে, আবার কখনো ভাঙা ইংরাজীতে এ মেয়ে কথা বলেই চলে। যতক্ষণ না নিজের কথা জোরগলায় বলতে পারে, বলতে পারে রেবেকাদের (কাহিনীর আর এক খেটে খাওয়া নারী চরিত্র) মতো মেয়েদের হারিয়ে যাওয়ার নেপথ্যের কাহিনী সে চুপ করে না। সে বিশ্বাস করেঃ

A day will come when my voice will sound so loud all over Nigeria and the world of it, when I will be able to make a way for other girls to have their own louding voice, because I know that when I finish my education, I will find a way to help them to go to school.

হারিয়ে যাওয়া শব্দ নিয়ে উপন্যাস

দ্বিতীয় বইটির নাম “The Dictionary Of Lost Words,” লেখিকা পিপ উইলিয়ামস।[ii] বইয়ের মুখ্য চরিত্র এসমে (Esme) মাতৃহীন। তাই ছোট্টবেলা থেকে বাবার সঙ্গে সে যায় যেখানে Oxford English Dictionary লেখার কাজ চলছে, সেই আপিসে। কাহিনীর পটভূমি হল বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকের অক্সফোর্ড শহর। অভিধান সংকলনের কর্মকাণ্ড দেখতে দেখতে এসমে একসময় আবিষ্কার করে কিছু শব্দ ইচ্ছাকৃতভাবেই যেন অভিধানের অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে না। আর সেইসব শব্দ বেশির ভাগই মেয়েদের জীবন সংক্রান্ত। বিশেষত খেটে খাওয়া মেয়েদের ব্যবহার করা শব্দ কোনভাবেই স্থান পাচ্ছে না অভিধানে। এইরকম কিছু শব্দের উদাহরণ, Knackered, Latch keyed and dolly mop বা Bondmaid। ক্রমশঃ এইসব শব্দ সংকলন করাই এসমের জীবনের প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়াল। এরই পাশাপাশি চলতে থাকে মহিলাদের ভোটাধিকার অর্জনের আন্দোলন। শেষ পর্যন্ত প্রকাশিত হয় এসমের বই, “Women’s Words And Their Meanings” – মহিলাদের দৃষ্টিভঙ্গী থেকে বিভিন্ন শব্দের অর্থ। সেই অর্থ তারা নিজেদের জীবন দিয়ে উপলব্ধি করেছে। নারীসত্তার একান্ত নিজস্ব উপলব্ধি সেসব। 

এবারের বইটি হল “Lady Tan’s Circle Of Women,” লেখিকা লিসা সি (Lisa See)।[iii] কাহিনি আবর্তিত হয়েছে ট্যান ইয়ুঙ্কসিয়ান (Tan Yunxian) নাম্নী এক নারীর জীবনকে কেন্দ্র করে। চরিত্রটির ঐতিহাসিক সত্যতা থাকলেও তাঁর ব্যক্তিগত জীবন সম্বন্ধে তেমন কোন তথ্য পাওয়া যায় না। ইয়ুঙ্কসিয়ান-এর জন্ম হয়েছিল এক অভিজাত পরিবারে। তাই তার প্রথাগত শিক্ষাদীক্ষা বেশিদূর এগোয়নি। পুরুষদের ভাল লাগার জন্যে সেই সময়ের অন্যান্য সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়েদের মতো তাকেও সহ্য করতে হয় পা-এর পাতা মুড়ে বেঁধে রাখার যন্ত্ৰণা। যথাসময়ে ইয়ুঙ্কসিয়ান-এর বিয়ে হয় এক ধনী পরিবারে। তার শ্বশুরবাড়ির মহলের নাম The Garden Of Fragrant Delights -আসলে কারুকার্যময় এক খাঁচা। সেখানে রাতের বেলা হাওয়ায় ভাসে জুঁইফুলের গন্ধ, রেশমি ঘাঘরার মৃদু খসখস শব্দ ওঠে, আর সেই সঙ্গে শোনা যায় পরিবারের মেয়েদের চাপা কান্না। শ্বশুরবাড়ি নামক বন্দিশালায় হাজারও প্রতিকূলতার মধ্যেও ইয়ুঙ্কসিয়ান ক্রমশঃ নিজেকে প্রতিষ্ঠা করে ফেলে চিকিৎসক হিসেবে। পঞ্চদশ শতাব্দীর চীনে কোন মহিলার চিকিৎসক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ঘটনা ছিল বিরল। উপন্যাসের অন্যান্য নারী চরিত্রগুলির জীবনেও আছে সংগ্রাম – ধনীকন্যাদের সংগ্রাম একরকম, আবার খেটে খাওয়া মেয়েদের জীবনের ঘাতপ্রতিঘাত আর একরকম। শুধুমাত্র পুরুষ হয়ে না জন্মানোর জন্যে সমাজ তাদের ওপর অনেক বাড়তি দায়ভার চাপিয়ে দিয়েছে। আর বেশির ভাগ সময় বিনা প্রতিবাদে সে বোঝা তারা বয়ে নিয়ে চলে। ইয়ুঙ্কসিয়ান শৈশবে মাতৃহারা। পায়ের ক্ষত সংক্রমণে দারুণ যন্ত্রণা পেয়ে মারা গেছে তার মা। সে নিজে সেই যন্ত্রণার সাক্ষী ছিল। তাছাড়া চিকিৎসক হিসেবে পায়ের পাতা জোর করে মুড়ে রাখার ব্যাথা ও সংক্রমণের ঝুঁকির বিষয়েও সে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল। কিন্তু তা সত্ত্বেও নিজের তিন সন্তানকে ইয়ুঙ্কসিয়ান এই কষ্টকর পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে নিয়ে গেছে কোন প্রশ্ন না করে।

ট্যান ইয়ুঙ্কসিয়ান-এর জীবনের গল্প

এই তিনটি বইয়ের বিষয়বস্তুর মধ্যে একটা সংযোগ সেতু আছে। কাহিনির পটভূমি ভিন্ন, সময়কাল পৃথিবীর আলাদা আলাদা দেশ জুড়ে হলেও প্রতিটি গল্পের কেন্দ্রে আছে নারীর অসম্মান, অবমাননা, লাঞ্ছনা, ও শেষ পর্যন্ত তাদের লড়াই করে রুখে দাঁড়ানোর কথা। ব্যাপারটা তাহলে এই দাঁড়াচ্ছে – পঞ্চদশ শতাব্দীর চীন থেকে আজ এই মুহূর্তে শিকাগো-নারীদের যুদ্ধ ও যুদ্ধজয়ের ইতিহাসের একটা ধারাবাহিকতা আছে। ভারতবর্ষ, যে দেশে কিনা ভক্তি ও সমারোহেরর সঙ্গে মাতৃমূর্তির আবাহন হয়, সেদেশেও মহিলাদের দুর্গতির শেষ নেই। তাই আমার বন্ধুর যে প্রবন্ধের কথা শুরুতে উল্লেখ করেছি সেটার সূত্র ধরে বলতেই হয় মেয়েদের কোনও দেশ নেই। পৃথিবী জুড়ে মেয়েরা ঘরে ও বাইরে লিঙ্গ বৈষম্যের শিকার। এর শিকড় ছড়িয়ে গেছে সমাজব্যবস্থার গভীরে। এই পরিস্থিতির বদল আনার একমাত্র উপায় হল প্রতিবাদ – সরব বা নীরব, সংসারে বা চাকুরীক্ষেত্রে, নিজের দেশে এবং দেশের বাইরে।

প্রতিবাদ হচ্ছে বিভিন্ন স্তরে। লিসা সি’র উপন্যাসের নায়িকার মতো মেয়েরা নিঃশব্দে লাঞ্ছনা মেনে নিচ্ছে না আজ। বিনা শর্তে আত্মসমর্পণ করতে রাজি নয় তারা। আর সেটাই আশার কথা। নারী নির্যাতন ও তার সমাধানের বিষয়টি সরল নয়। নারী আন্দোলনের নানান দিক আছে। তবে আমার সহজ চিন্তায় একটা কথা বুঝতে পারি, তা হল মানুষ হিসেবে অধিকার অর্জনের দাবিতে মেয়েদের সোচ্চার হতে হবে আরও বেশি। 

পৃথিবীতে প্রকৃতির মতো নারীর অস্তিত্বও আদি ও অকৃত্রিম। আমাদের সমাজ-সংসারের পরতে পরতে তার দৃঢ় আর কোমল ছোঁয়া। নারীত্ব উদযাপনের তাই বিশেষ কোনও দিন বা ক্ষণ নেই। প্রতিপলেই চলুক উদযাপন। আমাদের ঘরে ঘরে যেসব আনন্দময়ী আছেন তাঁদের আবাহন হোক। কবীর সুমনের গানের শব্দ ধার করে বলি, ‘হাল ছেড়ো না বন্ধু, কণ্ঠ ছাড়ো জোরে।’ তাহলেই আসবে নতুন গানের ভোর। সেই ভোরের আলোয় ভাস্বর হয়ে উঠবেন চিন্ময়ী সব মায়েরা। 

———-

পাদটীকা

[i] Daré, A. (2020). The girl with a louding voice. NYC: Dutton Books.

[ii] Williams, P. (2021). The dictionary of lost words: A novel. NYC: Ballantine Books.

[iii] See, L. (2023). Lady Tan’s circle of women. NYC: Scribner.

ছবিঃ অন্তর্জাল থেকে সংগৃহীত। 

পেশায় শিক্ষিকা। নেশা বই পড়া আর লেখালেখি। বাংলা ও ইংরাজি, দুই ভাষাতেই পড়া ও লেখার চর্চা। ‘বাতায়ন ' নামে একটি সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত গত আট বছর ধরে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোর উন্মেষ সাহিত্যগোষ্ঠীর সদস্য।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *