দাওয়াইপানির দিনযাপন

দাওয়াইপানির দিনযাপন

বুদ্ধদেব গুহ লিখেছিলেন, “প্রকৃতির মধ্যে এলে মন পাপড়ি মেলতে থাকে। যে কথা, যে কাজ অন্য জায়গাতে করা যেত না, যা করার কথা ভাবাও যেত না, তাই করা যায়, ভাবা যায়। উই আর অলওয়েজ ইন আওয়ার এলিমেন্টস হোয়েনেভার উই কাম টু নেচার।”

এই কথাগুলোর প্রকৃত অর্থ অনুধাবন করা বড় সহজ কথা নয়। আমরা প্রত্যেকেই টুকরো টুকরো নানা ধরনের এলিমেন্টস নিয়ে তৈরি। এই এলিমেন্টগুলোর অনেকটা ইঁট, কাঠ, পাথরের শহরের ধুলোর আবরণে মরে যায়। সেই আবরণ ভেদ করে শরীরের ভেতরের ‘আমি’ টাকে খুঁজে বের করার জন্যই নিষ্কলুষ, অপাপবিদ্ধ প্রকৃতির কোলে আত্মসমর্পণের জন্য ছুটে যাওয়া বারবার। নাগরিক ক্লান্তি নিয়ে চোখ বুজে গাড়ির ফ্রন্ট সিটে শরীর এলিয়ে দিতেই মনে ভিড় করে আসে নানা কথা। পাহাড়ের ম্যাজিক শেষ হওয়ার নয় কখনও। প্রতিবারই রুদ্ধশ্বাস মুহূর্তের অপেক্ষা – এবার সে না জানি কোন চমক নিয়ে অপেক্ষা করছে! কিংবা পুরনো ম্যাজিকটাই কি আবার নতুন করে দেখতে পাওয়া যাবে! রাস্তা যতই খারাপ হোক না কেন চারপাশের দৃশ্যাবলীর কাছে এলেই মনে হয় এমন জায়গায় মৃত্যু হলেও সৌভাগ্যের কথা।

“অগর ফিরদৌস বার রু-এ জমিন অসত, হামিন অসত-ও হামিন অসত-ও হামিন অসত” – কাশ্মীরের অপরূপ প্রাকৃতিক শোভা দেখে কবি আমির খসরুর মুখ দিয়ে বেরিয়ে এসেছিল ফারসি ভাষায় এই পঙক্তি, যার সারমর্ম হল: পৃথিবীতে স্বর্গ বলে যদি কিছু থাকে, তাহলে সেটা এখানে, সেটা এখানে, সেটা এখানে। কিন্তু যে কোনও পাহাড়ি এলাকার সৌন্দর্যই আমার কাছে স্বর্গ বলে মনে হয়। এখানে একেক ঋতুতে চলে একেকরকমের রূপ বদলের খেলা।  যে কোনও ভয়াবহতাকেই তখন  তুচ্ছ বলে মনে হয়। জীবন-মৃত্যুর এই যে নিত্যদিনের আয়োজন, এখানে এসেই যেন তার যাবতীয় হিসাব নিকাশ শেষ হয়ে যায়। সেই ছোটবেলায় অপটু হাতে পাহাড় আঁকা থেকে শুরু। এলোমেলো কাটা দাগের কয়েকটি রেখা মনের কোন এক গহিন কোণে লুকিয়ে রইল গোপন প্রেমের মতো। কোনও এক মরচে রাঙা বিকেলে হয়ত খাতায় আঁকার চেষ্টা করতাম অসমাপ্ত ছবিটা। লাল, হলুদ, কমলা রঙের সূর্যোদয় কিংবা সূর্যাস্তের ছবি, কিংবা অরণ্যের সবুজের আভাস। এত রং, তবুও মনের মতো রং কেন ফুটিয়ে তুলতে পারি না! হঠাৎই কোন এক বিজন দুপুরে কানে কানে কে যেন ফিসফিসিয়ে বলে গেল, “ওই যে দূরে পাহাড়ের অবয়ব এঁকেছো ওর ওপরে নীল রং ঢেলে দাও আর তার সঙ্গে মিশিয়ে দাও একটু সাদা। তার কোল থেকে এঁকে দাও লাল বলের মতো একটা সূর্য আর ওর গায়ে লাল, কমলা, হলুদ রং ইচ্ছেমতন বুলিয়ে দাও। আশেপাশে ঢেলে দাও মনের মাঝে লুকিয়ে থাকা সব সবুজ। বৈদুর্যমণি! রুবি! পান্না!” 

সেই উজ্জ্বল নীল, লাল আর সবুজ রং যেন আমার সমস্ত সত্তায় মিশে গেল। সেই রঙের নাম আমার কাছে হয়ে গেল ‘মুক্তি’। প্রত্যেক ছুটিতেই তাই এই রং আমাকে কোন্ এক মন্ত্রবলে টেনে নিয়ে যায় কোনও এক পাহাড়ি ঠিকানায় অসমাপ্ত ছবিটা শেষ করার জন্য। কিন্তু এর শেষ কোথায়!

প্রতিবারের মতো এবারও তিলোত্তমার উচ্ছ্বাসকে পিছনে ফেলে ইট-কাঠ-পাথরের জঞ্জাল পেরিয়ে ছুটে চলেছি সবুজাভ প্রকৃতির বুকে আশ্রয় নিতে। কিশোরীবেলায় হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে শোনা “শোন বন্ধু শোন, প্রাণহীন এই শহরের ইতিকথা / ইটের পাঁজরে লোহার খাঁচায় দারুণ মর্মব্যথা” গানের ‘মর্মকথা’-র অর্থ তখন না বুঝলেও, যত বড় হয়েছি ততই বুঝতে পেরেছি শহর বড়ই নির্দয়। এখানে প্রকৃতিহন্তারক মানুষ শুধু সবুজ নিধনের নিষ্ঠুর যজ্ঞে মত্ত থাকে। কর্কশ শব্দ আর শুধুই অন্তবিহীন ছুটে চলা। আগ্রাসী সময় সবসময়ই যেন তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে আমাদের। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ‘কর্তব্য’ নামের ভারী পাথর মাথার ওপর চাপিয়ে দেওয়া আছে। পালাবার পথ খুঁজে নিতেই যতটুকু সময়-সুযোগ পাওয়া যায়, তার স্বাদ আস্বাদন করতেই তো বেরিয়ে পড়ার বছরভর আয়োজন বারবার।

নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে নামার পর গাড়ি ঠিক করে রওনা দিই। দু’পাশে সবুজ গাছগাছালি। পেরিয়ে যাচ্ছি একের পর এক চা-বাগান। মাঝে মাঝে ছায়াঘন গাছের সমারোহ। সবুজে সবুজ। ম্লান আলোয় ম্রিয়মান দৃশ্যপট। নিমেষেই দ্রুত অপসৃয়মান তারা। ঘুম ভাঙছে নতুন দিনের। পাকদণ্ডী পথের পাশে কোথাও দু-একটা ছোটো ছোটো দোকান, বসতবাড়ি। পেরিয়ে গেলাম সেবক পাহাড়। এখানে পাহাড়ের ধাপে আছে সুপ্রাচীন কালী মন্দির। আঁকা বাঁকা সাপলুডোর মতো পথ ক্রমশই ঊর্ধ্বমুখী। একপাশে উঁচু পাহাড়, অন্যপাশে গভীর, অতলান্ত খাদ। কিছুক্ষণ বাদে সঙ্গী হয় সুন্দরী তিস্তা। “মেঘ পিয়নের ব্যাগের ভেতর মনখারাপের দিস্তা / মন খারাপ হলে কুয়াশা হয়, ব্যাকুল হলে তিস্তা।” এপথে এসে করোনেশন ব্রিজ পেরোতেই এই গানের কথাই সবার প্রথমে মনে পড়ে। তার সঙ্গেই মনে পড়ে ঋতুপর্ণর কথা। আজ বেঁচে থাকলে ‘তিতলি”র মতো হয়তো আরও কত ছবিই না উনি করতেন! সব মহাপ্রাণ বোধহয় তাৎক্ষণিক! মেঘমুক্ত আকাশ বেশ পরিষ্কার, ঝকঝকে। সকালের আলোয় বানভাসি পাহাড়তলি, পথ, জনপদ। এটাই তো পাহাড়িয়া ম্যাজিক! মেঘ-বৃষ্টি-রোদ্দুরের নিরন্তর লুকোচুরি খেলা চলছে। পথের পাশে পাথরের গায়ে, সাইনবোর্ডে কত না সতর্কবার্তা। এই চুলের কাঁটা বাঁক, চড়াই-উৎরাই, এর পদে পদে বিপদের হাতছানি। মুহূর্তের অসাবধানতায় ঘটে যেতে পারে ভয়ংকর দুর্ঘটনা। নেশাগ্রস্ত অবস্থায় ড্রাইভ না করার জন্য কত সাবধানবাণী। বেশ লাগে লেখাগুলো। আর ওই ফোন করতে করতে স্টিয়ারিং ঘোরানো! প্রাণ শিউরে ওঠে। তবু এই বিপদসংকুল, ভয়ংকর সুন্দর পাহাড়ি পথের হাতছানি উপেক্ষা করা অসম্ভব। পাগলপারা ঝোরা, নদী, চা-বাগান, বাক্সবাড়ি, আলো-আঁধারিতে পূর্ণ পাইন ধুপির পথ, হিমেল চাদরে ঢেকে রাখা নিস্তব্ধ পরিবেশ, চপলমতি কিশোরীর ন্যায় চঞ্চলা নদী, মুহূর্তে মুহূর্তে পরিবর্তিত কাঞ্চনজঙ্ঘার অপার্থিব রূপ – প্রকৃতি উজাড়করা এই নজরানার কাছে নতি স্বীকার করতে প্রত্যেকবার সব বাধা-বিঘ্ন পেরিয়ে বেরিয়ে পড়ি। সবুজ অরণ্যের মধ্যে দিয়ে মাঝে মাঝে ঝলমলে রোদের আঁকিবুকি মেঘমুক্ত পরিষ্কার দিনের এক কাব্যময় সূচনা প্রকাশ করে। পাকদন্ডি পথ বেয়ে চলা সবজে নীলচে ধূসর পাহাড়ের বুকে হেয়ারপিন বাঁকে হঠাৎ এসে পড়ে স্কুলফেরত কলকাকলিরত কিশোর-কিশোরীর দল। শুধুমাত্র পথ জুড়ে বিরাজ করা পাইন, ধুপির পাতাঝরানো রাস্তা পেরোতে থাকি। সদ্যস্নাতা বর্ষার জলে সবুজ হয়ে উঠেছে চারপাশের প্রকৃতি। হঠাৎ করে হামলে পড়ে মেঘ গাড়ির কাচ ঢেকে দেয় সাদা ধোঁয়ার মতো কুয়াশায়। তাদের রাজ্যে প্রবেশ করার ছাড়পত্র দেখাতে সম্মতি জানিয়ে উধাও তারা। দূরে দেখা যায় আকাশছোঁয়া পাইন বনের ফাঁকে কনে দেখা আলোর মতো রাঙা রোদ্দুর। এসবই পাহাড়ের চিরন্তন ম্যাজিক যা ওয়াটার অফ ইন্ডিয়ার মতো কখনোই শেষ হয় না। নতুন জায়গায় নতুন মঞ্চ, নতুন ম্যাজিক, নতুন খুশির ছবি। গাড়ি যত ওপরের দিকে ওঠে হিমেল হাওয়ার দাপট ততই তীব্র হয়। দূরে দেখা যায় সবুজ পাহাড়ের চূড়া। রাস্তা মাঝে মাঝে হারিয়ে যায় পাইনবনের ছায়ায়। নিচে অতলান্ত খাদের মধ্য দিয়ে চা-বাগান কিংবা গাছেদের সবুজ রাজপাট। সদ্যস্নাত বর্ষায় পাহাড়ের লাবণ্য যেন চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে। যেদিকেই তাকাই মেঘ-কুয়াশা-রোদের খেলা চলছে পাহাড়ের গায়ে। দুহাত বাড়িয়ে এসে তারা যেন বলতে চায় “আমাদের এই খেলার সঙ্গী হও।” নিত্যদিনের  হাজার টেনশনকে বিদায় দিয়ে তাদের এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে মিশে যেতে থাকি মনখুশির ইচ্ছেযাপনের সেরা ঠিকানায়।

হঠাৎ গাড়ির ঝাঁকুনি। আধো ঘুম আধো জাগরণে গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতেই পাহাড়িয়া শরত তার চকচকে নীল আকাশের অনন্তসম্ভার নিয়ে আবার ম্যাজিক দেখানোর অপেক্ষায়। পাশ থেকে ড্রাইভার সিদ্দু ভাইয়া হাসিমুখে বলল, “ম্যাডামজি বোলা থা না তিন ঘন্টেমে পৌঁছা দেঙ্গে!” প্রতিবার পাহাড়ের শেষ বাঁকে ফেলে যাওয়া অসমাপ্ত কবিতার শেষ লাইনগুলো খুঁজে বের করার জন্য গাড়ি থেকে নামতেই চারপাশের প্রকৃতির অভ্যর্থনা “ওয়েলকাম টু দাওয়াইপানি।”

দার্জিলিং থেকে মাত্র ১৮ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত ভুটানি বস্তি দাওয়াইপানি আসলে হিমালয়ের কোলে শান্ত নিঝুম এক হিমেল ঠিকানা। ইদানিং দার্জিলিং, কালিম্পংয়ের মতো জনবহুল জায়গাগুলি থেকে পর্যটকদের কাছে জনপ্রিয় জায়গা হিসেবে প্রিয় হয়ে উঠছে যে গ্রামগুলি, তাদের মধ্যে দাওয়াইপানির নাম বিশেষভাবে উল্লেখ্য। এখানে গোটা গ্রাম জুড়ে কাঞ্চনজঙ্ঘার দখলদারি চলে। ডানদিকে সবুজ লামাহাটার পাইন গাছের বিস্তৃত বাহিনী, দূরে দেখা যায় নামচির শিবমূর্তি আর ঘাড় ঘোরাতেই দৃশ্যমান পশ্চিমবঙ্গের পাহাড়ের রানির ঝলকও। দার্জিলিং থেকে মাত্র ১৮ কিলোমিটার দূরে ৬৫০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত এই গ্রামে মাত্র ১২০-১৩০ ঘর সরলপ্রাণা ভুটিয়াদের বসবাস। নয়া বস্তি থেকে পুরনো বস্তি পর্যন্ত পুরো নির্জন পথটাই দোকান আর ছোট ছোট ঘর বাড়ি দিয়ে সাজানো। নিউ জলপাইগুড়ি থেকে সরাসরি গাড়িতে তো আসাই যায়। আবার শেয়ার গাড়িতে জোড়বাংলো থেকে ছ-মাইল হয়েও আসা যায়। তবে বেলা বাড়লে ছ-মাইল থেকে গাড়ি পাওয়া খুব মুশকিল হয়ে যায়।

দাওয়াইপানি নিয়ে একটি গল্প প্রচলিত আছে। আমাদের যেখানে আস্তানা ঠিক তার নিচে রয়েছে একটি প্রস্রবণ। দার্জিলিং শহরের গোড়াপত্তন ঘটে ব্রিটিশদের হাত ধরে। তখন এই জায়গার নাম ছিল বন্দীকামান টি-এস্টেট। এই জায়গা পরিদর্শনের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছিল একজন ব্রিটিশ কর্মচারীর ওপর। তিনি এখান থেকে নিত্যদিন যাতায়াত করতেন। একবার তাঁর পায়ে এক গভীর ক্ষতর সৃষ্টি হয়। কোন ওষুধই সেই ক্ষত নিরাময় করতে পারছিল না। কিছুদিন পর লক্ষ্য করলেন তাঁর পায়ের ক্ষত ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। একদিন সম্পূর্ণভাবে সেরেও গেল। কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে আবিষ্কার করলেন তিনি যে রাস্তা দিয়ে প্রতিদিন যাতায়াত করতেন সেই পথেই ছিল একটি পাহাড়ি ঝোরা, যার জল পেরিয়ে তাঁকে যাওয়া-আসা করতে হত। সেই জল স্পর্শ করে তাঁর পায়ের ক্ষত মিলিয়ে গেছে! এই ঝোরার জল তিনি পরীক্ষা করতে পাঠান এবং রিপোর্টে এক চাঞ্চল্যকর তথ্য দেখে চমকে ওঠেন। ঝোরার জলে রয়েছে নানা ধরনের খনিজ পদার্থ। ওপরমহলে তীব্র আলোড়নের সৃষ্টি হয়। তখন তারা এই জায়গার নাম পরিবর্তন করে রাখে মিনারেল স্প্রিং বস্তি। তারপর ধীরে ধীরে নাম পরিবর্তিত হয়ে স্থানীয় মানুষদের কাছে দাওয়াইপানি হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠে। ‘দাওয়াই’ মানে ওষুধ আর ‘পানি’ মানে জল। অর্থাৎ যে জলে ওষুধের সমস্ত গুণাগুণ রয়েছে। লুংডাম নামে একটি নদী বয়ে গেছে গোটা গ্রাম জুড়ে। এই নদীর জলই স্থানীয় বাসিন্দাদের পানীয় জল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। সৌন্দর্যে আর লাবণ্যে ভরপুর গ্রামটির আশেপাশে রয়েছে চা-বাগান। পাহাড়ি ঢালে জৈব সারে উৎপন্ন হয় নানা প্রকার সবজি, দারচিনি, এলাচের মতো মশলাও। গ্রামে পৌঁছে আশ্রয় নিই যাঁর কাছে, তিনি সেনাবাহিনীর একজন প্রাক্তন কর্মী। হোমস্টেতে প্রবেশ করেই এ যেন এক সোনার খনি আবিষ্কারের মত মনে হল। ঘর, বারান্দা এমনকি বিছানায় শুয়ে জানলা দিয়েই সপার্ষদ কাঞ্চনজঙ্ঘার দর্শন করা যাবে। মন বলে উঠল, এই সফর কখনোই ব্যর্থ হবে না। ঘরে এসে বসতেই চলে এল গরম গরম চা। হোমস্টের মালিক আর তাঁর স্ত্রী দূরের শিখরগুলি সম্পর্কে বলতে থাকেন। বেলা যেহেতু পড়ে এসেছে তাই তারা চলে গেছে মেঘের আবডালে। উল্টোদিকের দার্জিলিংয়ের অসংখ্য ঘরবাড়ি আর হোটেল দেখতে লাগছে ঠিক ছোট্ট ছোট্ট বাক্স বাড়ির মতো। নামচির শিবমূর্তিও দৃশ্যমান। পেডংয়ের খেলার মাঠটিও একদম সরাসরি দেখা যায়।

ছোট্ট গ্রামটি পায়ে হেঁটেই ঘুরে নেওয়া যায়। বৈকালিক ভ্রমণে বেরিয়ে পড়ি আশেপাশে। যেকোন জায়গায় পায়ে হেঁটে ঘুরে না বেড়ালে, সেখানকার লোকজনদের সঙ্গে কথা না বললে, তার প্রকৃত রূপমাধুরী অধরাই থেকে যায় আমার কাছে। একটু একটু করে ঘুরতে ঘুরতে চষে ফেলতে থাকি গোটা দাওয়াইপানির খাসমহল। পুরো গ্রামটাই যেন নিজেকে মেঘের কাছে সমর্পণ করেছে। কিছুদিন আগে বর্ষা পার হওয়ার ফলে চতুর্দিক সবুজে সবুজ। বুনো লতাপাতার বনজ গন্ধে ভরে গেছে চতুর্দিক। আর পাঁচটা পাহাড়ি গ্রামের মতোই রাস্তার আশেপাশে অযত্নে ফুটে থাকা বর্ণিল ফুল, অর্কিড, পাতাবাহার সাদর অভ্যর্থনা জানায়। দাওয়াইপানির ভালোবাসায় আবদ্ধ হচ্ছি ক্রমশ। এখানকার পানিতে সত্যি সত্যিই বোধহয় এক চমৎকার ম্যাজিক দাওয়াই আছে। খাবার খাওয়ার কিছুক্ষণ বাদেই খিদে পেয়ে যাচ্ছে। আশেপাশে কয়েকটা দোকানে মহিলা দোকানিরাই দোকানঘর আর সংসার সামলাচ্ছেন। খিদের হাত থেকে সাময়িক মুক্তি পেতে আর তাদের সঙ্গে গল্পগাছা করতে চা, ম্যাগি, মোমো নিয়ে সময় কাটাই। এখানকার মানুষ পাহাড়ের আর সব পাহাড়ি গ্রামের মতোই পরিশ্রমী। সারাদিন হাসিমুখে ঘরে-বাইরে কাজ করেন। মূলত কৃষিই জীবিকা। চাষবাস জৈবিক পদ্ধতিতে। নিজেদের প্রয়োজনেরটুকু রেখে অনেকেই বাজারে বিক্রি করেন জমির ফসল, শাকসবজি। কয়েকটি হোমস্টে হয়েছে এখন, জীবিকার এটাও এক উপায়। পথঘাটের বিকাশ তেমন হয়নি। বর্ষায় খুবই কষ্ট। এটা গ্রামের উন্নতির সবথেকে বড় অন্তরায়। দার্জিলিং কাছে, এটাই কিছুটা সুবিধা। পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার জন্য কষ্টেসৃষ্টে সেখানে যাওয়ার চেষ্টা করে এখানকার ছেলেমেয়েরা। স্বাস্থ্য পরিষেবার অবস্থাও তথৈবচ। চিকিৎসায় জড়িবুটি ভরসা। এছাড়া গুরুতর অসুখের চিকিৎসার প্রয়োজনে দার্জিলিং যান তাঁরা।। সেটাও সবার পক্ষে সম্ভব হয় না, বলাই বাহুল্য। কৃষিনির্ভর গ্রামে কোথাও বা ঢেউখেলানো উপত্যকায় কিছু কৃষিকাজ হচ্ছে। পাহাড়ি মরসুমী ফুল ফুটে আছে। এদিক-ওদিক ছড়িয়ে রয়েছে লতানো গাছের স্কোয়াশ, বিন। প্রতিটি বাড়িতে এগুলো এখানে অফুরন্ত হয়। এছাড়াও ছোট ছোট ক্ষেতে চাষ করা হয় লঙ্কা, মটর, ফুলকপি, বাঁধাকপি, আলু, মূলো, বিট, গাজর। শাক বলতে রাই শাকের প্রাধান্যই বেশি। তবে কোন অজৈব সার নয়, প্রাকৃতিক জৈবসারের মাধ্যমেই এগুলো উৎপাদন করা হয়। যার ফলে এখানকার অর্গানিক খাবার-দাবারের একটি বিশেষ আকর্ষণ রয়েছে। প্রায় সব বাড়ির পাশে রঙিন ফুলের সারিবদ্ধ গাছ। পথ চলতে চলতে পশ্চিম আকাশে চোখ রাখি। সেখানে তখন অস্তরাগের সুর। আকাশ লালে লাল। পাহাড়ের কোলে একটু একটু করে অস্তমিত হচ্ছে বেলাশেষের সূর্য। বাজপাখির মতো পাহাড়ি সন্ধে নেমে আসে অকস্মাৎ। তারই সঙ্গে হিমের আঁচল বিছিয়ে শীত গ্রাস করতে থাকে আমাদের। চারপাশে কোনও শব্দ নেই পাখিদের কিচিরমিচির ছাড়া। ফিরে আসি হোমস্টেতে। এই সফরে যত জায়গায় ছিলাম, এখানে সবচেয়ে বেশি ঠান্ডা অনুভূত হচ্ছে।

প্রচন্ড ঠান্ডায় হুডি চাপিয়ে চলে আসি রান্নাঘরে। মালিক আর মালকিনের পরিবার-পরিজনের সঙ্গে আলাপচারিতায় মগ্ন হই। গল্প জমে ওঠে। এক রহস্যময় রোমাঞ্চকর বন্যভ্রমণের গল্প শোনান তাঁরা। জঙ্গলের গল্প। হোমস্টে থেকে কিছুটা  গিয়েই গহিন অরণ্য। এই অরণ্যের সিঞ্চল ফরেস্টের মধ্যেই পড়ে। তার পেছনে রয়েছে অরণ্যের মূল চেকপোস্ট। ওখান থেকে বিশেষ পারমিট নিয়ে গভীর অরণ্যে প্রবেশ করা যায়। এখানে রানিচাপ, পাইন বিভিন্ন গাছের পাশাপাশি অসংখ্য ফার্ন আর মস দেখা যায়। বাঁশগাছের ঝাড়ও রয়েছে কিছুটা অন্তর অন্তর আর আছে নানা প্রজাতির বিভিন্ন ধরনের ঘাস। গল্পে গল্পে সন্ধে গাঢ় হয়। সন্ধে নামতে না নামতেই দূর পাহাড়ের গায়ে চিকচিক করে ওঠে ঝলমলে আলো আর তার সঙ্গে যোগ্য সঙ্গত দেয় ঝিঁঝি পোকাদের সম্মিলিত কনসার্ট। ধীর পায়ে রাত নেমে আসে দাওয়াইপানির বুকে।  

পরদিন ভোরবেলায় প্রকৃতি তার অপার রূপবৈচিত্র্যের পসরা খুলে বসল। ভোরের প্রথম আলোর স্পর্শে কাঞ্চনজঙ্ঘার লালচে লাজুক রূপ ধীরে ধীরে প্রস্ফুটিত হচ্ছে। ভাঙছে আঁধারের নিস্তব্ধতা। মিহি কুয়াশা ভেদ করে পূব আকাশে হালকা লালচে আভা ছড়িয়ে পড়ছে। হোমস্টের জানালা থেকেই দেখা যাচ্ছে এই মনোরম দৃশ্য। আলস্য ছেড়ে বেরিয়ে আসি বারান্দায়। উজ্জ্বলতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কাঞ্চনজঙ্ঘারও রূপের ঘনঘন পরিবর্তন ঘটছে। সূর্য-ওঠা ভোরের এই অপার্থিব দৃশ্য শুধুই দুচোখ ভরে দেখার। কোনও ক্যামেরায় এই ছবি সঠিকভাবে ধরে রাখতে পারবে না। আগের দিন রাতে যে দৃশ্যের সমাপ্তি ঘোষণা হয়েছিল পরদিন সকালে ঠিক সেখান থেকেই শুরু হল।

দ্রুত স্নান সেরে প্যাকিং করতে থাকি। রেডি হয়ে একবার ফুল-পাতা, মৌমাছি আর প্রজাপতিদের সঙ্গে দেখা করি। গাছেরা হাতছানি দিয়ে ডাকে। সূর্য উঠেছে অনেকক্ষণ। নীল আকাশের নিচে ঝলমল করছে পুরো গ্রাম। ব্রেকফাস্ট টেবিলে আজ ছিল আলুপরোটা, সঙ্গে আচার তো আছেই। চেটেপুটে খেয়ে কফির কাপ নিয়ে ব্যালকনিতে এসে বসি শেষবারের মতো। পরিবারের সবাই এসে দেখা করে। প্রতিশ্রুতি দিতে হয়, আবার আসব। এই আন্তরিকতা ভোলার নয়। গাড়ি চলতে শুরু করে। দু’পাশে গাছপালা সরে সরে যায়। বাচ্চারা স্কুলের পথে। হাত নাড়লে হাসিমুখে প্রত্যুত্তর দেয় ওরা। পিঠে বোঝা নিয়ে গ্রামবাসীদের কেউ নেই। কী কষ্টের চলা ! তবু হাসিমুখে অভিবাদন জানায়। অনেকটা ভালো লাগা পাহাড় এভাবেই ভরে দেয় ঝুলি। প্রত্যেকবার। মনে পড়ে Ruskin Bond-এর কথা “It is always the same with mountains. Once you have lived with them for any length of time, you belong to them. There is no escape.”

এর অর্থ একমাত্র তারাই উপলব্ধি করতে পারবে যারা পাহাড়ের প্রেমে বারবার পড়েছে। এ নেশা থেকে মুক্তির উপায় নেই। ভাগ্যিস ইংরেজ ভদ্রলোকটির পায়ের ক্ষত হয়েছিল! তাই তো সৌন্দর্যের এমন এক ঠিকানা খুঁজে পাওয়া গেল! পাইনবনে জরিবোনা রোদ, পাখিদের জলসা, অলস মায়াবী সকাল… ঠিকানাবিহীন এক নাবিকের মতো এখানে এসে নোঙর ফেলা। গ্রামের মধ্যে দিয়েই বয়ে যাওয়া নদীর জলে যাবতীয় অসুখ থেকে মুক্তি। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো পাহাড়ে কেনার স্বপ্ন অধরাই থেকে যায়। এই অধরা স্বপ্নকে ছুঁতেই তো বারবার ছুটে আসা! ভোরের আলো ছিটকে আসতে চায়। কাজে যেতে হবে যে তাদের! দূরে পাহাড়ের রেখা ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে উষ্ণতার পরশ মেখে। নিচের গ্রাম, জনমানবশূন্য নদীর পাড়, লাল নীল ছাদের শেড, রঙিন লুংদার… একের পর এক ক্যানভাস… দমদার দাওয়াইপানির দিলদরিয়া মেজাজের কাছে মন প্রাণ বন্ধক দিয়ে এগিয়ে যাই অন্য এক অস্থায়ী ঠিকানার দিকে।

পেশায় শিক্ষিকা। নেশা বিভিন্ন ধরনের বই পড়া, বেড়ান আর সিনেমা দেখা। পছন্দের ভ্রমণ তালিকায় প্রথম স্থানে আছে পাহাড়িয়া ছোট ছোট গ্রাম। আরও শখ সময় ও সুযোগ পেলেই পাহাড়ের সহজ-সরল মানুষগুলোর আতিথেয়তা গ্রহণ করার জন্য বেরিয়ে পড়ে নির্জন প্রকৃতির মধ্যে থেকে নিজেকে নতুন করে চিনতে শেখা। বেড়িয়ে এসে মনের আনন্দে টুকটাক ভ্রমণকথা লেখার চেষ্টা। লেখা প্রকাশিত হয়েছে আনন্দবাজার পত্রিকা, বাতিঘর অনলাইন ব্লগজিন, প্রবচন পত্রিকা, ‘পর্যটকের ডায়েরি’ নামক ভ্রমণ সংকলনে। পঙ্কজ উধাস, জগজিৎ সিং আর রশিদ খানের গান সুখ-দুঃখের সঙ্গী। সফট রোম্যান্টিক গান বিশেষ পছন্দ। ইংরাজি সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করলেও বাংলা সাহিত্য ও ইতিহাসের প্রতি প্রবল ঝোঁক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *