তিনি আমার ‘সুজন’

তিনি আমার ‘সুজন’

অবসর-এ লিখব, চিন্তাটাই সুখের। কিন্তু অনেক দ্বিধা কাটিয়ে শেষমেশ যা নিয়ে লিখতে বসেছি, তার চেয়ে বেদনাদায়ক সাম্প্রতিক কালে আমার জীবনে কিছু মনে পড়ছে না।

কাহিনিটা বেশিদিনের নয়। এটাও মোটেই আশ্চর্যের কথা নয় আমার সম্পর্কে, কারণ সুখের সমতল আমার জীবনে কমই আসে। ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে যখন সদ্য পিতৃহারা হয়ে এলোমেলো হয়ে গেছি, ফেব্রুয়ারির শেষে সব ফেলে রেখে একদিনের নোটিশে বেরিয়ে পড়লাম উড়িষ্যার মঙলাজোড়ি— পূর্ব ভারতে পরিযায়ী পাখিদের সবচেয়ে বড় আস্তানা, আন্তর্জাতিক পক্ষী-অঞ্চল (International Bird Area), রামসর সাইট। চিল্কা হ্রদের অংশ, প্রায় দশ বর্গ কিলোমিটার অগভীর জলাভূমি (brakish water), শীতকালে দেশবিদেশের লক্ষ-লক্ষ পাখি এসে ভিড় করে সেখানে। বেরিয়ে পড়লাম তাদের দেখতে— পাখিদের সেই মহামিলনমেলার অনাবিল রঙবাহার আর কলকাকলিতে যদি খুঁজে পাই আমার সার্ভাইভাল এলিমেন্টস… পিতার সঙ্গে সঙ্গে আমি যে আমার অস্তিত্বের প্রধানতম খুঁটিটা যেন হারিয়ে ফেলেছি তখন!

কিন্তু জানি যে শুধু হারানো নিয়ে জীবন চলবে না। আবার নতুন করে গড়ে নিতে হবে নিজেকে, তাই ফিরে এসে ক্যামেরায় তোলা আর মনে-গেঁথে-যাওয়া ছবিগুলো সাজিয়ে নিয়ে লিখলাম মঙলাজোড়ির অবিশ্বাস্য বিবর্তনের কাহিনি— চোরাশিকারিদের গ্রাম কীভাবে জলার রঙবেরঙের পাখিদের রক্ষক হয়ে উঠল সেই স্থিতিশীল উন্নয়নের গল্প। এবার সেই লেখাটি কেন এবং কীভাবে, সাহস করে ও উদ্যোগ নিয়ে (দু’টোর অভাবই আমার মধ্যে অতি প্রকট) জুন মাস নাগাদ অতি বিখ্যাত ‘অবসর’ পত্রিকায় পাঠিয়েছিলাম, আমি আজ আর মনে করতে পারি না। কিন্তু স্পষ্ট মনে আছে অগাস্ট মাসের শুরুর দিকেই একদিন সন্ধ্যেয় একটি ফোন এল আমার মোবাইলে, আমি সেই সময় একটি গুরুগম্ভীর ঘরোয়া সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ছিলাম। নম্বরটি অচেনা, তবে বুঝলাম সুদূর আমেরিকা থেকে ফোন। বেশ খানিকটা বিস্ময় নিয়েই অনুষ্ঠান-প্রাঙ্গণের এককোণে সরে এসে ফোন কানে লাগিয়ে শুনি ফোনের ওপারে একটি সান্দ্র কন্ঠস্বর,— “প্রদীপ্তবাবু, আমি অবসর পত্রিকার সুজন দাশগুপ্ত বলছি, আপনার লেখাটি খুব সুন্দর হয়েছে। আমরা ওটি প্রকাশ করতে চাই। লেখাটির সঙ্গে দেবার মতো কয়েকটি ছবি যদি পাঠান খুব ভালো হবে!” গোটা ঘটনাটা আমার স্পষ্ট মনে আছে আরো এই কারণে যে, সেদিনটা ছিল বাইশে শ্রাবণ!

বইমেলাতে সুজনকাকুর সঙ্গে, ভাস্করদা, শেখরবাবুও আছেন

সেই প্রথম দিনটির ফোনালাপের “প্রদীপ্তবাবু” ও “সুজনবাবু স্যার” থেকে ফোনে-ফোনেই আমি “প্রদীপ্ত” ও উনি আমার “সুজনকাকু” হয়ে গেলেন কীভাবে তার আলোচনা বোধহয় কাকুর সঙ্গে যাঁরা অল্প একটুখানিও মিশেছেন তাঁদের কাছে একান্ত নিষ্প্রয়োজন। মানুষটি যখন আগাগোড়া সুজন, এবং সে সুজনত্ব মোটেও গুপ্ত নয়; সামান্য সান্নিধ্যেও যে কেউ অনায়াসে বুঝে যাবে সেটা— তখন এমনটাই তো হওয়ার কথা। ভীষণ আগ্রহে তাকিয়ে রইলাম পরের শীতে আসন্ন কোলকাতা বইমেলার দিকে, তখন মিলনমেলা প্রাঙ্গণে হতো বইমেলা। দেখা হলো, একেনবাবু-র বই স্রষ্টার সইসহ হস্তগত হলো, ‘গোয়েন্দা হাজির’ নামে বিদেশি গোয়েন্দাকাহিনির অনুবাদ সংকলনগ্রন্থেও সুজনকাকুর সই পেলাম। কেমন স্তব্ধ হয়ে দেখলাম, পঞ্চাশ বছরের বেশি আমেরিকায় চাকরি ও বসবাস করেও কীভাবে নিজের শিকড়ে সটান ও সগৌরবে এমনতর স্থিত থাকা যায়! বিস্ময়টা স্বাভাবিকভাবেই আমার তরফে, কারণ আমি সুজনকাকুর আগে আমার চেনাজানার মধ্যে এমন বড় একটা দেখেছি বলে মনে পড়ে না। কেউ কেউ তো মাত্র মাস ছয়েক আমেরিকায় কাটিয়ে ফিরে এসেই ‘জিরো’কে ‘ও’ বলা শুরু করে দেয়, কথায়-কথায় বিসদৃশ শ্রাগিং-টা বাদই রাখলাম। 

কথায় কথায় জেনে ফেলেছিলাম, সুজনকাকু আমেরিকায় চাকরি নিয়ে যান আমার জন্মের বছরে, আর আমি এখন পঞ্চান্ন। মাঝে নব্বইয়ের দশকের শুরুতে বছর দুই-এর জন্য দিল্লীতে টেলিকম দপ্তরের অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে এসে ছিলেন, তা বাদে ও দেশটাকেই নিজের আরেকটা দেশ করে ফেলেছিলেন।

অবসর-এ লেখা শুরু হলো, শুরু হলো সুজনকাকুর সঙ্গে জীবন। আমাদের অযোধ্যাপাহাড়ের ইস্কুলটি নিয়ে বিশেষ আগ্রহ দেখালেন কাকু আর শমীতামাসি। 

বইমেলাতে কাকু আর শমীতামাসীর সঙ্গে

পুরুলিয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চলের আট-দশটি গ্রাম থেকে আসা পৌনে দু’শোটি আদিবাসী শিশুর প্রাইমারি (কিশলয় ও অঙ্কুর) থেকে ক্লাস ফোর অবধি সেই ইস্কুল নিয়ে তাঁদের আগ্রহ ও উৎসাহ আমাদেরও আবার শিখিয়ে দিল, চন্দ্রহারা অন্ধকারে নক্ষত্রের আলোতেই বুঝে নিতে হয় কোনদিকে পথ বেঁকে গেছে। সরকারি সাহায্যহীন স্কুলটিকে আরো বড় করতে সহায়তা করা শুধু নয়, কীভাবে স্কুলটিকে ওই অঞ্চলে শিক্ষার অনির্বাণ আলোকবর্তিকা করে তোলা যায়, কী করলে এলাকার মানুষই স্কুলটাকে নিজেদের একান্ত প্রয়োজনীয় জিনিস বলে বিপদের দিনে বুক দিয়ে আগলাতে এগিয়ে আসতে পারে; কীভাবে বাচ্চাদের মা-মাসি-পিসিদের ক্ষমতায়নের মাধ্যমে শিক্ষাকে আরো সুস্থিত ও সংহত অভিলক্ষ্যে চালনা করা যায়, তা নিয়ে কত না বহুমূল্যবান পরামর্শ দিয়েছেন সুজনকাকু আর শমীতামাসি। 

একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক হবে না যদি জানাই, মাসি ২০১৯এর ডিসেম্বরে নিজে ঘুরে গিয়েছেন আমাদের সেই ইস্কুলে, আর স্কুলের একশ আশি-টা বাচ্চার জন্য নিজের হাতে উলের টুপি বুনে এনেছিলেন! কেন অপ্রাসঙ্গিক নয় তা বুঝিয়ে বলবার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। বরং শুধু এক কথায় বলি, শমীতামাসি বাদে সুজনকাকু হয় না। দু’জনেই নিজের নিজের বৃত্তে অত্যন্ত কৃতিত্বের সঙ্গে কাজ করে সাফল্যের শীর্ষে উঠেছেন আলাদা আলাদা পথে; আবার দু’জনে মিলে নানাভাবে এতটাই সামাজিক কল্যাণমূল্য সৃষ্টি করেছেন যার তুল্য নজির একান্ত বিরল।

এর আগে ২০১৮এ আমার জীবনে এসেছিল সেই চিরস্মরণীয় ক্ষণ, যখন সুজনকাকু আমায় অবসর পত্রিকার যুগ্ম সম্পাদনার দায়িত্ব দিলেন ভাস্করদার (ভাস্কর বসু) সঙ্গে। টিম বিল্ডিং অ্যান্ড ম্যানেজমেন্টেও কাকু যে চ্যাম্পিয়ন ছিলেন তা বুঝলাম, কারণ আমার মতো তেড়িয়া লোকের সকলের সঙ্গে বনে না, কিন্তু ভাস্করদার সঙ্গে আমার ফ্রিকোয়েন্সি যে অদ্ভুত মিলে যায়! কাকু সেটা কোন জাদুবলে বুঝে গিয়েছিলেন তা আর ওঁকে জিজ্ঞেস করা হয়ে ওঠেনি। আমার পরম সৌভাগ্য ভাস্করদার নেতৃত্বে অবসর-এর ‘ক্রীড়া’ ও ‘বাংলাসাহিত্যে প্রিয় চরিত্র’ বিষয়ক সংখ্যা দু’টির সম্পাদনার কাজ করে এমন অনেক কিছু শিখতে পেরেছি যা আমার সারাজীবনের অক্ষয় সম্পদ হয়ে থাকবে। গোটা প্রক্রিয়াটির পরিচালনায় মেঘের আড়ালে মেঘনাদের মতো ছিলেন সুজনকাকু।

সুজনকাকুর সঙ্গে গত আট বছরে দেখা হয়েছে খুব বেশি তো পাঁচবার, তার একবার ওঁরই আমন্ত্রণে কলকাতার বাড়িতে দ্বিপ্রাহরিক ভোজনসহ প্রচুর আড্ডাগল্পের সৌভাগ্য হয়েছিল। এই আটবছরের মধ্যেও প্রায় দুই বছর কেড়ে নিয়েছিল অতিমারী, ফোনে কথাবার্তাই ছিল সম্বল। আর এইবার দেখা হতে হতে হলো না।

তাও কাকু আমায় ভরিয়ে রেখেছিলেন, জানি না হয়তো সদ্য পিতৃহারা অবচেতন এমন স্নেহস্নিগ্ধ কাউকে প্রাণপণে খুঁজছিল। অথবা, এটাই কাকুর সেই আশ্চর্য ম্যাজিক যাতে অনেকেই সম্মোহিত হয়েছেন। আমায় উনি বলেছিলেন, লেখালেখির কাজটা আরো সিরিয়াসলি আর নিয়মিত করতে; মানে, সেই ইস্কুল-কলেজে লেখাপড়ার মতো করে করতে— আরেকটু যত্ন করে সেটা করলেই আমি নাকি পারব, এমনই ওঁর বিশ্বাস। আমি পারব কিনা তা আমি জানি না, কিন্তু আমার কাকু এখন জানেন। কারণ এখন উনি ত্রিকালজ্ঞ।

শুরুতেই বলেছিলাম, আমার ‘সুখের মাঠ জলভরা,’ দ্রুতই ‘আবার দুঃখের ধানে ভরে যায়।’ কাঙাল মন আরেকটু পেতে চাইছিল। নয় বছর হয়ে গেল, আমি আজও বিশ্বাস করি না আমার পিতা বেঁচে নেই। তিনি বেঁচে থাকতেও তাঁর শেষ কয়েক বছরে কি রোজ তাঁর সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা কইতাম, নাকি প্রতিদিন তাঁর পাশে গিয়ে একবারটি বসতাম নিয়ম করে? আমার জীবন তো তখন তাঁকে ছাড়িয়ে আরো বহুদূর অবধি বিস্তৃত হয়ে পড়েছে, আর সেই বিস্তারটাই তো স্বাভাবিক! তাই ভেবে নিয়েছি, বাবা ঠিকই আছেন, শুধু রোজ দেখা হয় না, কথা হয় না, এই যা। সুজনকাকু এখন সেই ‘লিগে’ জয়েন করেছেন— রোজ দেখা হবে না, তা সে আগেও তো হয়নি; শীতে উনি দেশে আসলেই কেবল দেখা হতো। না হয় এখন কথাও বড় একটা হবে না। তাতে কি? আমার ‘সুজন’ কি তাই বলে আমায় ছেড়ে চলে যাবেন নাকি?

অসম্ভব। বিশ্বাসই করি না।

পেশা - কলকাতার উপকন্ঠে একটি কলেজে অর্থনীতির অধ্যাপনা, নেশা - হিমালয় আর থিয়েটার। বাংলায় লেখালেখির অভিজ্ঞতা - না-থাকার মত, ইদানীং দু'চারটি পত্রপত্রিকায় অনিয়মিত কিছু লেখা ছাপা হয় বলে উত্তরোত্তর স্পর্ধা বাড়ছে। তবে সময়ের দাম সম্পর্কে ধারণা না থাকায় উত্তরণ হ'বার নয়। একটা পাহাড়-জঙ্গল জায়গায় হলুদ পাতায় ছাওয়া বনে মরবার ইচ্ছে।

1 Comment

Avarage Rating:
  • 0 / 10
  • সৌম্যকান্তি জানা , March 18, 2023 @ 7:45 am

    খুব সুন্দর লিখেছিস। তোর তো তবু ৫ বার দেখা হয়েছে। আমার দুর্ভাগ্য, একবারও হয়নি। ফোনালাপ, হোয়াটস অ্যাপ মেসেঞ্জারে যোগাযোগ হত। প্রথম ফোন পেয়েছিলাম কবে মনে নেই, সম্ভবতঃ ২০১২/১৩ সালে। যতদূর মনে পড়ে প্রয়াত ডঃ শংকর সেনের কাছে আমার লেখালেখির ব্যাপারে জেনেছিলেন। প্রথম আলাপে আমি ‘স্যার’ সম্বোধন করায় বলেছিলেন ‘দাদা’ বলতে। ওঁর বয়স জানার পর দাদা বলতে কুন্ঠা হওয়ায় উনি কুন্ঠা দূর করে দিয়েছিলেন, আর উনিও আমাকে ‘তুমি’ বলে আপন করে নিয়েছিলেন। মনে পড়ে, রবীন্দ্রনাথ ও রেডিও নিয়ে অবসর-এর দুটি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশের আগে আমার সাথে অনেকক্ষণ কথা হয়েছিল। …. যাক, আমার কল্পস্মৃতিতেই সুজনদা অমর হয়ে থাকবেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *