একটি পাঞ্জাবির দোকান, কিছু চরিত্র এবং এক হতভাগ্য ভামবেড়াল

একটি পাঞ্জাবির দোকান, কিছু চরিত্র এবং এক হতভাগ্য ভামবেড়াল

ঘটনাটার একটা জুতসই, মানে পাঞ্জাবিসই নাম দিলাম, বলা যায় না হয়তো নামেই কাটবে। ঘটনামঞ্চ হল গড়িয়াহাট অঞ্চলের একটা পাঞ্জাবির দোকান, দোকানের নামটির হয়ত কোনোকালে অভিনবত্ব ছিল কিন্তু কালক্রমে এর আশেপাশে এই একই নামে আরো চার পাঁচটা দোকান হয়েছে। এই দোকানের চারজন কর্মচারী এবং তাঁরা সবাই মাঝবয়েসি, ধরা যাক তাদের নাম হল যথাক্রমে ক, খ, গ আর ঘ! কর্মচারী ক দোকানের বাইরে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকেন, সম্ভাব্য ক্রেতাদের দোকানে আহ্বানের জন্য। যে কোনো কারণেই ক এর মেজাজটা একটু খিঁচড়ে ছিল, আমি যখন দোকানের রাস্তার ওপর সাজিয়ে রাখা পাঞ্জাবিগুলোর আণুবীক্ষণিক পর্যবেক্ষণ করছিলাম, উনি তখন আমার দিকে খুব কটমট করেই দেখছিলেন। প্রায় পাঁচ মিনিট পর ক এই নাছোড়বান্দা ক্রেতাকে খুব নির্লিপ্তভাবে বললেন, “আপনি ভেতরে যান, যা চাইছেন সব পাবেন।”  

আমি বললাম, “আপনি কি পাঞ্জাবির কথা বলছেন?”

উনি বললেন, “হ্যাঁ, এটা পাঞ্জাবিরই দোকান!”

দোকানে ঢুকতেই যাঁর ওপর চোখ পড়ল তিনি হলেন কর্মচারী খ। ওঁর কাজ হল পাঞ্জাবি নামানো, পাঞ্জাবি খুলে দেখানো আর তারপরে সেটিকে আবার ভাঁজ করে তুলে রাখা! ভদ্রলোকের মুখে এক অসম্ভব প্রশান্তির ছাপ আর দৃষ্টিটা খুব শূন্যতায় ভরা। উনি সমস্ত কাজ খুবই ধীর স্থিরভাবে করেন, তবে দৃষ্টিটা থাকে দোকানের বাইরে। দেখলাম তিনি দোকানের বাইরে ফুটপাথের দোকানগুলো দেখছেন না, তাঁর দৃষ্টি রাস্তা পেরিয়ে বহুতলেও না, দৃষ্টির প্রসার সুদূর, কিছুটা মহাজাগতিক। ভাঁজ করা পাঞ্জাবিগুলো নিতান্তই খুব ঠুনকো তাঁর মনোযোগ আকর্ষণের জন্য।

কর্মচারী গ হলেন একটু ম্যানেজার টাইপের, অন্যান্য কর্মচারীদের তুলনায় একটু চটপটে, ক্রেতা সংযোগের দায়িত্বটা সামলান উনি।  চোখ রক্তবর্ণ, খোঁচা খোঁচা পাকা দাড়ি, দাঁতগুলিতে বহু ধরণের নেশার ছাপ, কিন্তু হাসিটা বড় মিষ্টি। মনে হল, অবসর সময়ে ইনি ডাকাত সর্দারের অভিনয় করলে আশ্চর্য হব না। 

কর্মচারী ঘ বসেন দোকানের দরজার কাছে, তাঁর মাথায় বেশ পাটি করে আঁচড়ানো সাদা কালো মেশানো কিছুটা কোঁকড়ানো চুল, নাকটা খুব টিকোলো, চোখে পুরু চশমা, অনেকটা পাঠশালা বা প্রাইমারি স্কুলের মাস্টারমশাইয়ের মতো। এই ভদ্রলোকের প্রধান কাজ হচ্ছে ক্রেতার কাছ থেকে টাকা পয়সা আদায়, বিক্রির রশিদ কাটা এবং পাঞ্জাবির প্যাকেটে স্টেপল করা ।  

যে কোনো কারণেই হোক আমার দোকানে প্রবেশ করাটা দোকানের ভেতরের কর্মচারীদের ওপর বিশেষ কোনো প্রভাব বিস্তার করেনি, বেশ অনেকক্ষণ দোকানে ঢুকে দোকানের ভেতরে সাজানো পাঞ্জাবিগুলো দেখার পর কর্মচারী খ (পাঞ্জাবি ভাঁজকারী) আমাকে জিজ্ঞেস করলেন ”কিছু কি নামাবো?” 

এই প্রশ্নে কর্মচারী গ (ক্রেতা সংযোগকারী) কর্মচারী খ (পাঞ্জাবি ভাঁজকারী) র ওপর বেশ রেগে  গিয়ে বললেন, “খ, তোকে বলেছি না আগ বাড়িয়ে কোনো কাজ করবি না, যখন বলব তখন করবি।”

আমি একটু মিনমিন করে বললাম, “হ্যাঁ, এই তিনটে একটু নামিয়ে দিন।” এই শুনে কর্মচারী গ (ক্রেতা সংযোগকারী) কর্মচারী খ’কে (পাঞ্জাবি ভাঁজকারী ) বললেন, “হ্যাঁ, এবার স্যার যে যেগুলো নামাতে বলছেন সেগুলো নামিয়ে দেখা।” 

মোটামুটি একটা পাঞ্জাবি পছন্দ হল।  আমি ক্রেতা সংযোগকারীকে কিছু পাঞ্জাবি সংক্রান্ত প্রশ্ন করতেই  উনি বললেন, “এটা স্যার আপনাকে দারুন মানাবে।”

আমি বললাম ‘আপনি জানলেন কী ভাবে যে এটা আমার জন্য?”  

উনি গম্ভীরভাবে বললেন, “স্যার ওটা চাহনি দেখে বোঝা যায়।” 

আমি একটু হেসে ফেলে জিজ্ঞেস করলাম, “এখন বলুন তো আমার এই চুয়াল্লিশ সাইজ হবে তো?”   

গ বলে উঠলেন, “হ্যাঁ, হ্যাঁ, একেবারে ফিট করবে আর আপনার সাইজ আপনি দোকানে ঢুকতেই আমি মনে মনে মেপে নিয়েছি।”

যাই হোক পাঞ্জাবি পছন্দ করতে বেশি সময় নিইনি তার ওপরে একটু তাড়াও ছিল, বললাম তাড়াতাড়ি প্যাক করে দিতে। ক্রেতা সংযোগকারী তখন যাকে বিজনেস ম্যানেজমেন্টের ভাষায় upselling বলে তাতে একটু মনোযোগ দিয়ে বললেন, “কুর্তা পাজামা কিছু লাগবে স্যার? এই রংটা কিন্তু দারুন ম্যাচ করবে।” 

আমি আর কথা না বাড়িয়ে বললাম, “দিয়ে দিন, তবে শুনুন এটা কি ফিতে সমেত না ফিতে ছাড়া?” 

তাতে গ বললেন, “ফিতে লেগে যাবে স্যার।”

আমি একটু বিরক্ত হয় বললাম, “ফিতে তো এমনি এমনি লাগবে না, ফিতেটা লাগিয়ে দিন।” 

গ এবার খ এর উদ্দেশ্যে হাঁক দিয়ে বললেন, “এই ফিতের স্কেলটা দে।” 

ইতিমধ্যে কর্মচারী ঘ যিনি এখনো অবধি চুপচাপই ছিলেন আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “স্যার পেমেন্টটা কি ক্যাশে হবে না App এ হবে?” 

আমি কার্ডটা বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, “কার্ডে।”  

কর্মচারী ঘ (রশিদকারী) কাজে খুব পরিপাটি এবং নিখুঁত, আমার কার্ডটি নিয়ে একটা রুমালের মতন জিনিস দিয়ে প্রথমে কিছুক্ষণ বোলালেন তারপর কার্ড রিডার যন্ত্রে খুব সন্তর্পনে ঢোকালেন, এরপর যন্ত্রটি নিয়ে দোকানের দরজার কাছে অনেকটা ষাট ডিগ্রি কোণে ধরে রইলেন।  

আমি বললাম, “ওটা কী করছেন?” 

“সিগন্যাল ধরছি!” বলে যন্ত্রটাকে একটু গোল করে অনেকটা আরতি করার মতো ঘোরাতে থাকলেন, তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “বুঝলেন না, সিগন্যালটা পালিয়ে পালিয়ে যায়, সকালের দিকটা খুব ফোকাস করতে হয়।” 

আরো কিছুক্ষণ কসরত করার পর উনি যন্ত্রটা পিনকোডের জন্য এগিয়ে দিয়ে রশিদ কাটার দিকে মন দিলেন। উনি যখন তাঁর সুনিপুণ হাতের লেখায় রশিদ লিখছেন তখন কর্মচারী গ আমার পাজামার ফিতে অর্ধেকটা পরিয়ে ফেলেছেন। এমন সময় এক মধ্যবয়স্কা মহিলা খুব সম্ভবতঃ তাঁর নব্যযুবা ছেলেকে নিয়ে দোকানে ঢুকলেন। তাঁরা একটু টাঙানো পাঞ্জাবিগুলো দেখে টেখে কিছু টুকিটাকি প্রশ্ন করলেন কর্মচারী খ’কে, তাতে খ ইঙ্গিত করলেন যে তাদের কর্মচারী গ এর সঙ্গে কথা বলতে হবে। গ তখন ঘ-কে বললেন, “পাজামাটাতে ফিতেটা তুই তাহলে পরা।” 

বলে নতুন ক্রেতাদের সঙ্গে কথোপকথন শুরু করলেন। ঘ নির্বিকার। পাজামা আধখানা দড়ি পরে বসে আছে। আমি বিরক্তমুখে দাঁড়িয়ে আছি, দেরি হয়ে যাচ্ছে। সেটা বলাতে, গ খুব খেপে গেলেন ঘ এর ওপর, “ঘ তোকে বললাম না ফিতেটা পরাতে?”

ঘ। “হ্যাঁ, কিন্তু বলার পর তো তুই ফিতেটা হাতে নিয়ে বসে থাকলি, আমার দিকে এগিয়ে দিলি কই?”

গ। “তোর দিকে এগোতে হবে কেন? তোর হাত নেই? (আমার দিকে তাকিয়ে) আপনিই বলুন স্যার, আমাকে তো কাস্টমারকে দেখতে হবে, তাই না?”

ঘ। “তুই দেখছিলি না যে আমি রশিদ লিখছিলাম? আমি কি বসেছিলাম?”

গ। (আমার দিকে তাকিয়ে) “আপনিই বলুন স্যার, আমি যদি কাস্টমারের দিকে নজর না দিই, কাস্টমার থাকবে দোকানে?”

ঘ। (আমার দিকে তাকিয়ে) “আপনিই বলুন স্যার, ও কি আমার দিকে মালটা ঠেলেছিল? আমি বুঝব কী করে, কখন ও ধরবে আর কখন ও ছাড়বে?”

এর মধ্যে নতুন ক্রেতারা একটু বিব্রত হয়ে গুটিগুটি দোকানের বাইরে হাঁটা লাগালেন কিন্তু দোকানের ভেতরে তখনও ধুন্ধুমার কান্ড।

গ। “বুঝলেন স্যার, আমি কাজকে কখনো ভয় পাই না, সবসময় কাজ কেড়ে নিই।”

ঘ। “আমিও তো কাজ করতেই এসেছি, আমার বাবা ভাটপাড়ার জুট মিলে পঁয়ত্রিশ বছর কাজ করেছে।”

গ। “আপনিই বলুন স্যার আমি ঠিক বলেছি কিনা।”

ঘ। “হ্যাঁ, স্যারকেই বলতে দে না, উনি তো সব দেখেছেন!”

এ তো এক মহা বিপদের মধ্যে পড়লাম! গ এবং ঘ দুজনেই আমাকে সাক্ষী সাব্যস্ত করেছে আর দুজনেই নাছোড়বান্দা যে আমাকে একটা রায় দিতে হবে অথবা নিদেন পক্ষে মধ্যস্থতা। আমি একটু কর্পোরেট স্টাইলে বললাম, “দেখুন আপনাদের দুজনের কথাতেই কিছুটা যুক্তি আছে, কিন্তু একজন পুরোপুরি ঠিক আর আরেকজন ভুল, সেটা বলা যাবে না।” 

ভাবছি কীভাবে এই রায় দানকে মুলতুবি রেখে মানে মানে কেটে পড়া যায় দোকান থেকে। ঠিক এই সময় একটা ঝপাস করে ভীষণ শব্দ হল, তাকাতেই দেখি দেখলাম দোকানের শাটারটা বন্ধ হয়ে গেল। 

বললাম, “এটা কী হল? শাটারটা বন্ধ করলেন কেন?” 

উত্তর এল, “ভামবেড়াল, স্যার।”

আমি ভাম শুনেছি, বেড়ালও শুনেছি, কিন্তু ভামবেড়াল শুনিনি! এই অজ্ঞতা চেপে রেখে বললাম, “এখানে তো বেড়াল যত্রতত্র ঘুরে বেড়ায় তার জন্য ঝাঁপ বন্ধ করার দরকার কী?” 

গ বললেন, “স্যার, ডেথ হয়ে গেছে।”  

আমি আতঙ্কিত হয় বললাম, “কার?” 

উত্তর এল, “ভামবেড়ালের স্যার।”

আমি। “কী করে?”

গ। “স্যার, ভামবেড়াল তো এমনি বেড়াল নয়, একেবারে বুদ্ধি নেই। শীতের সময় এখন, একটু হিট পাওয়ার জন্য ও গ্লো সাইন বোর্ডে গিয়ে ঢুকেছে, আর কারেন্ট খেয়েছে আর কী!”

আমি। “তার জন্য শাটার বন্ধ করলেন কেন?”

গ। “স্যার, এখন ক নামাচ্ছে গ্লো-সাইন বোর্ডটা দোকানের দরজার ওপর থেকে। বুঝলেন না, কাস্টমার যদি গ্লো-সাইন বোর্ডে আমাদের নামের সাথে ভামবেড়ালের বডি দেখে, দোকানের একদম বদনাম হয়ে যাবে।” 

(এখন বুঝলাম ক এর মেজাজ কেন খিঁচড়ে ছিল কেননা উনিই দোকানের বহির্বিভাগ সামলান)  

আমি। “সে তো বুঝলাম, কিন্তু আমার এখন খুব তাড়া আছে, আমি বেরোব কী করে?”

ঘ। “স্যার আপনি কি একটু চাপতে পারবেন?”

আমি। “চাপব? কোথায় চাপব?”

ঘ। “না না স্যার, ঠিক চাপা নয়, একটু ঘষা।”

আমি। “আপনারা শুরু করেছেনটা কী? দোকানের মধ্যে আটকে রেখেছেন, তারপর একবার বলছেন চাপতে, একবার বলছেন ঘষতে!”

গ। “এই ঘ তোকে কথা বলতে কে বলেছে? স্যার দেখছি যদি শাটার একটু তোলা যায় আর আপনাকে একটু পাতলা করে নিচু হয়ে গলে যেতে হবে। এই ক, শাটারটা একটু তোলা যাবে? স্যার কে একটু সাইড করে দেব।”

ক। (শাটারের ওপাশ থেকে) “না।”

গ। “একটু দেখ না, একটু তুললেই স্যার ঘষে ঘষে বেরিয়ে যাবেন।”

ক। “দেখ, যতটা পেরেছি তুলেছি।”

গ। “আর একটু তোল, স্যার একটু ভারী আছে।”

এর পরের অধ্যায় কিছুটা সংক্ষিপ্ত। আমার জন্য কিছুটা শাটার তোলা হল, অনেকটা হামাগুড়ি দিয়ে এবং কিছুটা ভুজঙ্গাসন আর ধনুরাসন মেশানো অঙ্গপ্রক্রিয়ায় আমি ফুটপাথে বেরোতে সক্ষম হলাম। এই শীতের দিনেও আমি ঘর্মাক্ত, গড়িয়াহাটের দূষিত বাতাসে একটা প্রাণখোলা নিঃশ্বাস নিয়ে হাঁটার উদ্যোগ নিলাম। ঠিক তখনি কে একজন ডাকল, “স্যার!” 

দেখি এক ফুট উঁচু শাটারের নিচে গ এর উল্টো মুখ আর বেরিয়ে থাকা একটা হাত। আর সেই হাতে আমার নতুন কেনা মহার্ঘ পাঞ্জাবির প্যাকেটটি। হাসিমুখে গ বললেন, “আবার আসবেন স্যার।”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *