বাস্তবের ক্ষিদ্দারা
বিশ্বশক্তি মহামিলন ব্যায়াম সমিতি। অপরিচিত নাম। কিন্তু নামটি আর অপরিচিত মনে হবে না যদি জানা যায় এটি অচিন্ত্য শিউলির আঁতুড়ঘর। বার্মিংহাম কমনওয়েলথ গেমস ২০২২-এ ভারোত্তোলনে ৭৩ কেজি বিভাগে স্বর্ণপদক বিজয়ী অচিন্ত্য শিউলি আজ সোশ্যাল-ইলেকট্রনিক এবং প্রিন্ট মিডিয়ার কল্যাণে বাংলার ঘরে ঘরে পরিচিত নাম। নিজস্ব দক্ষতা এবং ক্রীড়ানৈপুণ্যের সফল প্রদর্শনের মাধ্যমে তিনি বর্তমানে সেলিব্রিটি। অধুনা বঙ্গজীবন যখন অপার পঙ্কিল স্রোতে মলিন ও ক্লিন্ন তখন এক ঝলক টাটকা বাতাস এনে দিয়েছে অচিন্ত্যর বার্মিংহাম-সাফল্য। অচিন্ত্য যে সেলিব্রেটি স্ট্যাটাস এবং জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন তা সময়ানুগ তো বটেই, এটা তাঁর অবশ্যপ্রাপ্যও।
অষ্টম দাস বিশ্বশক্তি মহামিলন ব্যায়াম সমিতির মতো অপরিচিত নাম না-হলেও ক্রীড়ামোদী জনতার কাছে খুব যে পরিচিত নাম এমন নয়। ফার্গুসন-মরিনহো-টুহল-অ্যান্সিলেত্তি-আচরেকর-কার্স্টেন-নাম্বিয়ার-গোপীচাঁদকে নিয়ে আমজনতা মাথা ঘামান। কারণ তাঁরা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সফল দল অথবা ব্যক্তির ম্যানেজার বা কোচ হিসাবে সাফল্য পেয়েছেন। তবে সকল সফল প্রশিক্ষকের ভাগ্যে শিকে ছেঁড়ে না। তা-ই কমপক্ষে পাঁচজন বাঙালি ভারোত্তোলককে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পৌঁছে দেওয়া সত্ত্বেও এবং সেই জ্যোতি মাল, শম্পা শেঠ, সুপর্ণা আদক, শ্রাবণী দাস, অচিন্ত্য শিউলি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে একাধিক পদক জেতার পরও অষ্টম দাস পাড়ার ‘অষ্টাকাকা’ হয়েই থেকে যান; আন্তর্জাতিক বা জাতীয় ক্ষেত্রে তো দূরের কথা, রাজ্যস্তরেও ব্রাত্য হয়ে পড়ে থাকেন, কোথাও কলকে পান না।
হাওড়ার দেউলপুরের অষ্টম দাসের কোনও কোচিং ডিগ্রি নেই। ফলে তিনি রাজ্যস্তরে অথবা দেশীয় ভারোত্তোলক সংস্থায় কোচ হিসাবে নিযুক্ত হতে পারেননি। তা-ই তাঁর হাত ধরে উঠে আসা ভারোত্তোলকদের তিনি তুলে দিতে বাধ্য হন জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক প্রশিক্ষকদের হাতে। সেখানে আপন প্রতিভার স্ফুরণ ঘটিয়ে ভারোত্তোলকরা চমকপ্রদ সাফল্য অর্জন করলে প্রচারের লাইমলাইট এসে পড়ে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক প্রশিক্ষকদের উপর। আর খনির অন্ধকার থেকে তুলে নিয়ে আসা হীরের আকরকে ঘষেমেজে অষ্টম দাসের মতো যাঁরা উজ্জ্বল হীরকখণ্ড গড়ে তোলেন তাঁরা থেকে যান প্রদীপের নিচের অন্ধকারে। তাঁদের ভূমিকা শুধু কাব্যে উপেক্ষিত প্লেয়ার-সাপ্লায়ারের!
কিন্তু সেই সাপ্লাই লাইন বজায় রাখতে গিয়ে কীভাবে নিজেকে নিংড়ে দেন অষ্টম দাসের মতো প্রশিক্ষকেরা, তার খোঁজ ক’জন রাখেন! অষ্টম দাসের কথাই ধরা যাক। তিনি ২০০১ সালে রেলের চাকরির পরীক্ষায় ভারোত্তোলন করতে গিয়ে চোট পান। ফলে রেলে চাকরি তো তিনি পানইনি, উল্টে ভারোত্তোলক হিসাবেও তাঁর কেরিয়ার শেষ হয়ে যায়। তারপর থেকে বিএসএফ, সিআরপিএফ প্রভৃতি বিভিন্ন জায়গায় চাকরির চেষ্টা করে তিনি সফলকাম হননি। এখন চল্লিশোর্ধ্ব বয়সে পৌঁছে স্ত্রী এবং ছয় বছরের মেয়েকে নিয়ে দারিদ্র্যজ্বালায় তিনি জর্জরিত হচ্ছেন। তা সত্ত্বেও তিনি প্রশিক্ষকের ভূমিকা পালনে নিরলস। সর্বমোট ৬০-৬২ জন ছাত্রের তিনি গর্বিত প্রশিক্ষক। ছাত্রদের প্রশিক্ষণে যাতে বেশি সময় দিতে পারেন তার জন্য তিনি তাঁদের পারিবারিক কাঠের ফার্নিচার তৈরির ব্যবসায় মালিক হননি। স্বেচ্ছায় মালিকানা ছেড়ে দিয়েছেন অন্য দাদা-ভাইদের হাতে। একটু বেশি বয়সে তাঁর বিয়ে করার সিদ্ধান্ত সঠিক কি না এ নিয়ে অষ্টম দাসের নিজের মনেই প্রশ্নচিহ্ন রয়েছে। কারণ তাঁর মনে হয় সাংসারিক দায়দায়িত্ব না-থাকলে তিনি আরও নিশ্চিন্ত মনে ছাত্রদের প্রশিক্ষণে নিজেকে নিয়োজিত করতে পারতেন। ভারোত্তোলনের জন্য পুষ্টিকর খাদ্যের সবিশেষ প্রয়োজনীয়তার কথা উপলব্ধি করেন বলে তিনি দরিদ্র পরিবার থেকে আসা শিক্ষার্থীদের খাদ্যের পিছনে অর্থব্যয় করতে পিছপা হন না। নিজের বিশ্বশক্তি মহামিলন ব্যায়াম সমিতিতে বিনা পারিশ্রমিকে, এমনকি অনেককে খাইয়ে-পরিয়েও, তিনি প্রশিক্ষণ চালিয়ে যান। শুধু প্রশিক্ষণ দেওয়াতেই তাঁর দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। কম বয়সেই যাতে তাদের আর্মি ট্রেনিং সেন্টারে ভর্তি করিয়ে ভবিষ্যৎ গড়ে দেওয়া যায়, তার জন্য তিনি নিজের ট্যাঁকের পয়সা খরচ করে, প্রয়োজনে ধার দেনা করেও, ছাত্রদের নিয়ে পাড়ি দেন আর্মি ক্যাম্পে। যখন দেখেন তাঁর আখড়ায় অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতির অভাবে সঠিকভাবে প্রশিক্ষিত হতে না-পারা শিক্ষার্থীদের বেশিরভাগই সেখানে স্থান করে নিতে ব্যর্থ হচ্ছে, তিনি মর্মপীড়ায় ভোগেন এবং আক্ষেপ করেন। অবশ্য অচিন্ত্য শিউলি, বাদল বরেরা পরিকাঠামোগত সমস্ত প্রতিকূলতা অগ্রাহ্য করে নিজস্ব প্রতিভাবলে এবং তাঁর শিক্ষায় আর্মিতে স্থান করে নিলে তিনি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার অবকাশও পান।
প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে লেখা মতি নন্দীর ‘কোনি’ উপন্যাস (আনন্দ পাবলিশার্স থেকে গ্রন্থাকারে প্রথম প্রকাশ ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে)-এর ক্ষিদ্দা যেন বাস্তবে অষ্টম দাসের মতো প্রশিক্ষকের রূপ ধরে এসে দাঁড়ান আমাদের সামনে। আজও কোনির মতো অচিন্ত্যরা উঠে আসে সেই নিম্নবিত্ত পরিকাঠামো থেকে। কোনির দাদা কমলও যেন ছায়া ফেলে যায় অচিন্ত্যর দাদা অলোকের মধ্যে। বেলা-অমিয়ার মতো সাঁতার ছেড়ে দিয়ে সংসারে মনোনিবেশ করতে ইচ্ছুক শিক্ষার্থীদের বাস্তব প্রতিভূ হয়ে ওঠে ভারোত্তোলন ছেড়ে ঘোর সংসারী হয়ে ওঠা শম্পা-জ্যোতি। উপন্যাসে ক্ষিদ্দাকে যে নোংরা রাজনীতির শিকার হতে হয়, সেই একই স্বার্থান্ধ রাজনীতি পা টেনে ধরে অষ্টাকাকার। রাজ্য অ্যাসোসিয়েশনের হর্তা-কর্তা-বিধাতা এবং কোচেরা নিজ নিজ শিক্ষার্থীদের প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হিসাবে তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়ে তিক্তচিত্তে ঝাল ঝাড়েন চ্যাম্পিয়ন তৈরির সফল কারিগর অষ্টম দাসের উপর।
অষ্টম শ্রেণী পাস অষ্টম দাস এখনও চাকরির আশা করেন। আশা করেন এই জন্য, যাতে স্থায়ী রোজগারের বন্দোবস্ত হলে বিভিন্ন উপায়ে কায়িক পরিশ্রমের মাধ্যমে তাঁকে দিনাতিপাত করতে না হয় এবং আরও বেশি অর্থ যাতে তিনি শিক্ষার্থীদের পিছনে ব্যয় করতে পারেন। সরকারি স্তরে তিনি কোনও সাহায্য পাননি। সাংসদ-বিধায়ক-কোনও রাজনৈতিক দল— কেউ তাঁর পাশে এসে দাঁড়ানোর প্রয়োজন বোধ করেননি বা করেনি। পঞ্চায়েত স্তরের একটা চাকরিও তাঁর ভাগ্যে জোটেনি গ্রাম্য-পঞ্চায়েত স্তরের নোংরা রাজনীতির কারণে। তিনি দুঃখ পান যখন দেখেন তাঁর হাতে গড়া ভারোত্তোলকরা জাতীয় অথবা আন্তর্জাতিক স্তরে সাফল্য অর্জন করার পর বেমালুম তাঁর কথা ভুলে গেছেন এবং তাঁকে চিনতে পর্যন্ত অস্বীকার করেছেন। এই বিস্মরণ-অস্বীকৃতি এখন তাঁর অনেকটা গা-সওয়া হয়ে গেছে। অধুনা তিনি বেশি মনঃকষ্টে ভোগেন তাঁর ছ’বছরের মেয়ে এঞ্জেলা কিছুতেই বাবার কাছে এসে ভারোত্তোলনের প্রশিক্ষণ নিতে চায় না দেখে। অষ্টম দাসের সদা-সর্বদা ভারোত্তোলক গড়তে চাওয়া মননে ক্লান্তির ছাপ ইদানীং মাঝেমধ্যে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কিন্তু তা বললে কী হবে! ক্লিষ্ট-ব্যথিত চিত্তে তিনি থামতে চাইলেও ভিতরের একটা আদিম-দুর্নিবার ডাক তাঁকে থামতে দেয় না— ফাইট অষ্টাকাকা, ফাইট।
চিত্রঋণ –
পদক হাতে অচিন্ত্য শিউলির ছবি অন্তর্জাল থেকে গৃহীত। বাকি ছবিগুলি লেখকের সৌজন্যে।
4 Comments