সময় চলে যায় বেয়াড়া টাট্টু

সময় চলে যায় বেয়াড়া টাট্টু

টুকরো টুকরো কত কথা মনে পড়ে আজকাল। ফেলে আসা দিনের, নানান সময়ের, এলোমেলো সব ছবি। ‘পুরনো দোকানে বিগত আড্ডা / বিগত ঝগড়া বিগত ঠাট্টা…’

ইউনিভার্সিটিতে রাজীব ভাওয়ালের সঙ্গে আমার তেমন ভাব ছিল না। খুব অল্প ভাসা ভাসা আলাপ ছিল। নিয়তির নিষ্ঠুর প্যাঁচে পড়ে দুজনেই উলুবেড়িয়া কলেজে বিএড করতে এসে অবশেষে একটু ঘনিষ্ঠতা হল।আমি বিপ্রদাস আর রাজীব প্রায়ই একসঙ্গে গল্প করতে বসতাম, বা দোকানে চা খেতাম। রাজীবের জীবনে একটি গভীর প্রেম ছিল যেটা ওর বাড়ির লোকজন কেউ মেনে নিচ্ছিল না। এই নিয়ে অশান্তির কোনো সীমা-পরিসীমা ছিল না। একে বেকারত্বের জ্বালা তার ওপরে এই অশান্তি। বেচারা রাজীব খুবই ভুগছিল। ঘ্যান ঘ্যান করে বলছিল ওর মাথা ব্যথা করে রোজ। মাঝে মাঝেই বলত, “তুই তোর ডাক্তার বন্ধু সুকল্পকে জিজ্ঞেস কর এই মাথাব্যথা কী করলে সারবে।”

সুকল্প তখন ইন্টার্নশিপ করে। প্রচুর খাটে। মাস গেলে খুব কমই টাকা পায় হাতে। তাকে গিয়ে হঠাৎ করে মাথা ব্যথার ওষুধ দাও বললে খুব রেগে যাবে। দাঁত খিঁচিয়ে বলবে, “বিষ খা, সব সেরে যাবে!” রাজীবকে আমি কথায় কথায় সুকল্প স্টাইলেই জিজ্ঞেস করলাম মাথার কোনখানটা ব্যথা করে, কেমন ব্যথা, ইত্যাদি।

রাজীব বলল, “দাঁড়া তোকে ভালো করে বুঝিয়ে বলি।”
আমরা গুছিয়ে বসে তিনটে চা বললাম। চা হাতে নিয়ে রাজীব গম্ভীর মুখে বোঝানো আরম্ভ করল, “ধর তুই আমার ডান কানের ভেতর দিয়ে একটা উলেরকাঁটা গুঁজে দিলি!”
শুনেই আমি হিইঁইঁইঁইঁ করে শিউরে উঠলাম।
নির্লিপ্ত রাজীব বলল, “তারপর ধর তুই বাঁ কানের ভেতর দিয়ে আর একটা উলের কাঁটা গুঁজে দিলি! এই দুটো উলের কাঁটা মাথার ভেতরে যেখানে এসে ইন্টারসেক্ট করবে, মাথার সেই জায়গাটায় আমার ব্যথা করছে!”
আমি ভাবলাম সব্বোনাশ করেছে! সুকল্প শুনলেই বলবে, “ধুস! কিচ্ছু হয়নি। বিয়ে দিয়ে দে!”
আমি একটু মিনমিন করে বললাম, “তোর আলাদা অসুবিধা কি হচ্ছে কিছু?”
রাজীব বলল, “হচ্ছে বৈকি! যে কোনো ফাঁকা মাঠে আমি হাঁটতে পারি না। মাঠের মধ্যে হাঁটতে দিলেই আমি মাথা ঘুরে দুম করে পড়ে যাই। অথচ একটা লাইন দিলে সেই লাইন বরাবর আমি কিন্তু সোজা বহুদূরে চলে যেতে পারি!” দেখে মনে হলো ট্রেন লাইন পেলে এক্ষুণি সোজা চেন্নাই চলে যাবে।

রাজীবকে বাপ্পা পরে নিয়ে গিয়ে আমাদের আর এক ডাক্তার বন্ধু গুরুপ্রসাদকে দেখিয়েছিল। মোটের ওপর সাইকোসোম্যাটিক সমস্যা। কয়েক বছর পরে সংসারী হয়ে, মোটা হয়ে, সন্তানের পিতা হয়ে, তার এ সব সমস্যা একদম হাওয়া হয়ে গেল।

কথায় কথায় মনে হল, গুরুপ্রাসাদের গল্প তো ভালো করে করাই হয়নি।গুরু আমাদের ঠাণ্ডা মাথার ডাক্তার। ও আর সুকল্প সমবয়সী এবং সহপাঠী। গুরু ডাক্তার হবার বহু আগেই বন্ধুমহলে নাম করে ফেলেছিল জয়তির সঙ্গে প্রেম করে। সাইকেলে জয়তিকে বসিয়ে নিয়ে ত্রিভুবন ঘুরে বেড়াত। পরে প্রতিষ্ঠিত হয়েও, যখন তখন বারমুডা পরে বউ বাচ্ছা নিয়ে বেরিয়ে পরত গুরু। ওইজন্য পেছনে আমরা ওকে ইবন বতুতা বলে ডাকতাম! গুরুর সঙ্গে পরিচিত হবার আগেই তার সব গল্প আমাদের মুখস্থ ছিল। যেমন গুরুর একবার শখ হয়েছিল অপূর্ব বাগান করার। কে যেন ওকে বলেছিল আন্দুল থেকে ভালো গোবর এনে ঝুরো ঝুরো মাটির সঙ্গে মিশিয়ে ফুলগাছের চারা পুঁততে হবে। নিয়মিত পরিচর্যা করতে হবে। তবেই ইয়াব্বড় বড় তাক লাগানো ফুল ফুটবে। সাইকেলে করে হাফ প্যান্ট পরে বিকট এক বস্তাভর্তি গোবর নিয়ে আন্দুল থেকে গুরু যখন রামরাজাতলা ফিরছিল, ওকে খুব একটা চার্মিং দেখতে লাগছিল না মনে হয়। অর্ধেকের কম রাস্তা পেরোতে না পেরোতেই ওকে পুলিশে ধরে। বস্তায় করে কী চালান করছ? গুরু যত বলে কিছুই নেই স্যার, কেবলই গোবর, বিশ্বাস করুন… কা কস্য পরিবেদনা, বলে বস্তা খোলো, গোবর ঘেঁটে দেখাও। গুরু আপ্রাণ গোবর, ফুলগাছ, এম বি বি এস , মেডিক্যাল কলেজ, সব বলতে থাকে! কিন্তু সেই, পুলিশে ছুঁলে… তাঁরা বলেন গোবর আনতে আন্দুল? কেন? রামরাজাতলার গরুরা কী দোষ করেছে? এইভাবে দুষ্টু সব পুলিশেরা গুরুকেই ল্যাজেগোবরে করে ওর সুন্দর ফুল ফোটাবার স্বপ্নে গ্যামাক্সিন ঢেলে দিল।

গুরু ডাক্তারি পড়তে ঢোকার কিছুদিনের মধ্যেই ওর এক দিদির বিয়ে হল ছোট্ট করে আয়োজন করে। তাতে আমরা বন্ধুরা তেমন কেউই নিমন্ত্রিত ছিলাম না। হঠাৎ গুরুর গোটা সাতেক মেডিক্যাল কলেজের বন্ধু (তাদের মধ্যে সুকল্পও ছিল মনে হয়) বাক্স প্যাটরা নিয়ে একদম নতুন রাস্তার মোড় থেকে মহা কলরবে গুরুকে তোড়ে গালি দিতে দিতে বিয়েবাড়িতে উপস্থিত হল। এসে চারবেলা গুছিয়ে খেয়ে, থেকে, হাসিমুখে সব অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে, অনুষ্ঠান শেষে আবার পোঁটলা পুঁটলি বেঁধে পুনরায় গুরুকে যথেচ্ছ গালি দিতে দিতে নতুন রাস্তার পানে বিলীন হয়ে গেল। অসহায় গুরুর তেমন কিছুই করার থাকল না…

গুরু ছবি তুলতে খুব ভালোবাসত। প্রচুর ছবি তুলত ও। এখনো তোলে কিনা জানি না। বেশ পাকা হাত ছিল। এ হেন গুরু আমার সদ্য কেনা পোলারাইজারটা ধার নিয়ে গঙ্গাসাগর গেছিল ছবি তুলতে। কয়েকটা ছবি তোলার পরেই সেটি গঙ্গাসাগরের একদম পাড়ের কয়েক মিটার দূরত্বে হাত ফসকে জলে পড়ে টুপ করে ডুবে গেল। তখন আবার ভরা জোয়ার। আমি আপনি হলে মনে হয় ভেউ ভেউ করে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরে আসতাম নিজেকে কোন হাটে বেচে দিলে পাঁচশো টাকা পাব ভাবতে ভাবতে। কিন্তু গুরু কী করেছিল জানেন? ও চোখ সরায়নি, যে সম্ভাব্য জায়গায় পোলারাইজারটা পড়েছিল জলে সেখান থেকে। মাথা ঠান্ডা করে অপেক্ষা করেছিল ভাটার জন্য। ভাটায় জল পিছিয়ে যেতেই সেই সম্ভাব্য জায়গাটিতে কাদার ওপর কাঠি দিয়ে চারটে খোপ কেটে দিয়েছিলো। কাদায় খেলতে থাকা চারটে বাচ্চাকে ডেকে এক একটা খোপ খুঁজতে বলেছিলো। খুব সাবধানে। পেলেই চারজনকেই পয়সা দেওয়া হবে। সে চারজন শিশু পাঁচ মিনিটে পোলারাইজার খুঁজে গুরুর হাতে দিয়ে টাকা নিয়ে মহানন্দে হইহই করতে করতে চলে গেল! পরে এই দুর্ধর্ষ রোমাঞ্চকর কাহিনি শুনে হাঁ হয়ে যাই আমি!

আগে এক সময় কথায় কথায় গুরুর বাড়িতে উপদ্রব করতে যাওয়া হত। গুরু ব্যস্ত থাকলে ঘুমন্ত জয়তিকে জোর করে তুলে দিয়ে আড্ডা শুরু হত! টমটম আর কথাকলি খেলনা নিয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে খেলত মন দিয়ে। কোথা থেকে যেন টের পেয়ে দেবা আর রোগা সুজয়ও হাজির হত। তুমুল আড্ডা, তর্ক, চেঁচামেচি, কী না হত! আবার কখনো আড্ডার শেষে দেবার সেই ছোট্ট ঘরে গিয়ে বসা হত, যেখানে খামখেয়ালি দেবা নিজের ঘরের ছাত, একটা ল্যাপটপের মাপে কেটে, সেখানে একটা মোটা স্বচ্ছ কাঁচ বসিয়েছিল। ঘরে চাঁদের আলো ঢুকবে বলে!

তারপর কত দিন চলে গেছে। চলে গেছে কত মাস, বছর। জীবন যেমন আমাদের নানাসময়, নানাকাজে, নানাদিকে ছড়িয়ে দেয়, তেমনি প্রৌঢ়ত্ব, এবং একাকীত্ব আস্তে আস্তে নিপুণ হাতে আবার সুতো গুটিয়েও আনে। রক্তের তেজ কমে। চেনা নিরাপদ ঠাঁই খোঁজে মন। তো আবার একদিন বেলাশেষে, এই স্বতঃস্ফূর্ত আড্ডা জমে ওঠে কিনা দেখা যাক!

পেশায় শিক্ষিকা। 1999 থেকে। 2011 থেকে একটি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা। লেখাপড়া সবটুকু কলকাতাতেই। ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্রী। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম এ, এবং রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পি এইচ ডি করেছি। শখের মধ্যে বেড়াতে যাওয়া আর সিনেমা দেখা। শখের লেখক। ফেসবুকের লেখাগুলোই জড় করে দুটি রম্য গদ্য সংকলন আছে, প্রকাশক সৃষ্টিসুখ। 'এবং জলঘড়ি' নামে একটি পত্রিকাতেও (এপ্রিল-জুলাই 2022) লেখা আছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *