চলো বড়ন্তী

চলো বড়ন্তী

বড়ন্তী লেক

১ 

আড্ডা হচ্ছিল শিখার বাড়িতে। সন্ধেবেলা। দিবাকর, আমি, শুভব্রত, শর্মিলা, মঞ্জরি আর অবশ্যই শিখা। এরকম আড্ডা আমাদের মাঝেমাঝেই চলে। সৌজন্যে শিখা। আড্ডা পেলে আর কিছু চায় না। আড্ডা মানেই সান্ধ্য আড্ডা। তারপর দক্ষিণ হস্তের উত্তম প্রয়োগ। সবটাই শিখা সামলায়।  নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহ ছিল সেটা। সাড়ে ছ’টার মধ্যে সকলে চলে গেলাম। একেবারে নিপাট নির্ভেজাল আড্ডা। আমার প্রিয় কোল্ড কফি চলে এল। তার সঙ্গে… থাক, সেটা আর নাই বা বললাম। খেতেখেতেই সুড়সুড় করল ভেতরটা, “দ্যাখ ভাই, বহুদিন কোথাও যাওয়া হয় না। চল না, দুদিনের জন্য…”

ও বাবা! দিবাকর যেন তৈরিই ছিল। আমার কথাটা একেবারে লুফে নিল সঙ্গে সঙ্গে, “হ্যাঁ, হ্যাঁ, চল চল।”

ব্যস! শিখাও! সেও তাল দিল একইভাবে।

একটা কথা মনে পড়ে গেল সেই মুহূর্তে। কথাটা আমি বলে ওঠার আগেই দিবাকর এক দারুণ উচ্ছ্বাস নিয়ে বলে উঠল, “এরা সবসময়ই এক্সাইটেড লেভেলে থাকে।”

আমি হা হা করে হেসে উঠলাম। এটার পেছনে একটা ছোট্ট ইতিহাস আছে। আমরা যখন এম এস সি করছি, আমাদের একজন বয়স্ক শ্রদ্ধেয় স্যার ছিলেন। আমাদের ডিপার্টমেন্টের তরফ থেকে তখন শিক্ষামূলক ভ্রমণ-এর (Educational Tour) ব্যবস্থা ছিল। তো একবার অনুমতির ব্যাপারে ওঁর ঘরে যেতে হয়েছিল। উনি অত্যন্ত স্বল্পভাষী এবং গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। স্বভাবতই আমাদের সকলের একটু ভয় ভয় করছিল, যাওয়ার ব্যাপারে অনুমতি মিলবে কিনা, সেসব নিয়ে। এমনিতেই আমরা ছিলাম ভীষণ হৈ চৈ করা মানুষ। তো স্যারের কাছে গিয়ে কথাটা বলতে হবে। এ ওকে ঠেলছি, সে আবার আরেকজনকে ঠেলছে, এরকম একটা ব্যাপার। শেষে আমরা কয়েকজন মিলে স্যারের ঘরে দুরুদুরু বক্ষে ঢুকলাম। খুব বিনীতভাবে আমাদের আর্জি পেশ করা হল। স্যার সব শুনে অতি-সামান্য মৃদু হেসে হঠাৎ বলে উঠলেন, “এরা সবসময়ই এক্সাইটেড লেভেলে থাকে!”

আমরা হো হো করে হেসে উঠলাম। সেই মুহূর্তে আমাদের সব ভয়ডর কেটে গেল। আমরা অনুমতি পেলাম।

তো এটা ছিল পেছনের গল্প। শুভব্রত একটু চাপা স্বভাবের মানুষ। দুম করে শুরুতেই আমাদের মতন হৈ চৈ করে ওঠে না। কিন্তু একেবারে ছুপা রুস্তম। মজা করতে ওস্তাদ। ওকে ছাড়া আমাদের দু’একটা ট্যুর করতে হয়েছে ঠিকই। কিন্তু ও থাকলে একেবারে দুশো মজা হয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে বললাম, 

“কীরে, যাবি তো?”

শুভব্রত মুচকি হেসে বলল, “কবে?”

“আরে সেটাই তো ঠিক হবে গুরু। তোমার হাসি দেখে একটু ভরসা পেলাম।”

শিখা বলল, ”এবার গ্রুপটা একটু বড় হলে ভালো হয়।”

বললাম, “সে তো বটেই। তাহলে ঠিক হয়ে যাক, জায়গা, দিন।”

খুব বেশিক্ষণ আমাদের আলোচনা করতে লাগে না। দিবাকর মোবাইল ঘাঁটতে শুরু করে দিয়েছে। বুঝলাম, ও জায়গার সন্ধান করছে। শুভব্রতরও একই অবস্থা। মঞ্জরি চুপচাপ থাকা মানুষ। সবেতেই মোটামুটি সায় আছে।

আমি শুধু একটু ধুনো দিয়ে দিলাম, “যা হবে তা কিন্তু আজকেই। দিনক্ষণ, তারিখ, কারা কারা যাবে, সবকিছু।”

ব্যস! ফোনে ফোনে ঠিক হয়ে গেল। নভেম্বরের শেষদিকে তিনটে দিন। আজ গিয়ে পরশু ফেরা। লাগাও পানসি বড়ন্তী। দিবাকরের কথাটাতে বিশেষ আপত্তি আছে। কোনো একটা ভ্রমণে কোনও এক মুহূর্তে আমার এরকম কথার পরে গাড়ি নাকি থেমে গিয়েছিল। ফলে কথাটা শেষ করা মাত্র একেবারে হৈ হৈ করে উঠল, “চুপ, চুপ, একদম চুপ।”

যাই হোক, বড়ন্তী ঠিক হয়ে গেল। সবসমেত আটজন। আমি, দিবাকর, মঞ্জরি, শিখা, শুভব্রত, শর্মিলা, দীপক আর দোলন।       

ভোর ছ’টার শতাব্দী  এক্সপ্রেস ধরতে হবে। ফলে রাতে কি আর ঘুম হয়! তিনটের সময় অ্যালার্ম  দিয়ে রাখলাম। সবাই হাজির হবে হাওড়ার বিখ্যাত বড়ো ঘড়ির তলায়। তারপর সেখান থেকে একসঙ্গে যাওয়া। আমাদের কেয়ারটেকারকে বলে রাখতে হল, ভোর সাড়ে চারটে নাগাদ আমি বেরোবো।

মোটামুটি সাড়ে পাঁচটার মধ্যে আমরা সবাই হাজির হয়ে গেলাম হাওড়ায়। তারপর ট্রেনে চাপলাম যথাসময়ে। তিনঘণ্টার ট্রেন জার্নি। ন’টা নাগাদ পৌঁছে গেলাম আসানসোল স্টেশনে। সংস্থা থেকে গাড়ি পাঠিয়েছিল ঠিক সময়ে। কিন্তু সে-গাড়ি এতই ছোটো ছিল যে তাতে মালপত্র ঢোকালে আমরা আর ঢুকতে পারব না। শুরুতে একটু অসুবিধায় পড়তে হল। পরে আমরা নিজেরাই গাড়ির বন্দোবস্ত করে রওনা দিলাম বড়ন্তীর উদ্দেশে। দেড় ঘণ্টা লাগল বড়ন্তী পৌঁছতে। মোটামুটি এগারোটা তখন।

জায়গাটা দেখে সবকিছু ভুলে গেলাম আমরা। ঘর তো আগে থেকেই বুক করা ছিল। প্রায় পাহাড়ের গায়ে আমাদের গাড়িটা গিয়ে থামল। বিস্তীর্ণ ফাঁকা জায়গা। যে-যার ঘরে ঢুকে গিয়ে কোনোমতে জিনিসগুলো রেখে আমরা আবার বাইরে বেরিয়ে এলাম। আর, তারপরই শুরু হল আড্ডা আড্ডা আর আড্ডা।

আমাদের থাকার জায়গা

আমরা কে কোথায় ছিলাম তার একটা মোটামুটি ছবি দিলে কেমন হয়? সবুজ লনের ওপর দিয়ে কিছুটা হেঁটে বাঁদিকের দ্বিতীয় ঘরটাতে ছিল দীপক আর দোলন। বাঁদিকেই তার পরের ঘরটাতে আমি। লনের সোজাসুজি যে-ঘরটা, সেটাতে ছিল শুভব্রত আর শর্মিলা। আর, লনের ডানদিকের দুটো ঘরের একটাতে শিখা আর অন্যটাতে দিবাকর এবং মঞ্জরি।

ঘর থেকে শুধু বেরিয়ে

আড্ডা চলতেই থাকল। কখনও একসঙ্গে আড্ডা, কখনো বা ছাড়া ছাড়া। কখনও দু-তিন জন একত্রে আড্ডা। কখনো বা আড্ডা ছেড়ে কেউ উদাসভাব নিয়ে তাকিয়ে আছে পাহাড়ের দিকে, সে আর কথা বলার মধ্যে নেই। কেউ কেউ আবার নিবিষ্টমনে মোবাইল ঘেঁটে চলেছে। দিবাকর আর শিখা হুংকার দিচ্ছে মাঝে মাঝে, “এই হচ্ছেটা কী, বেড়াতে এসে মোবাইল ঘাঁটা বন্ধ করো!” মুহূর্তের মধ্যে সেই মানুষটি সামান্য হেসে একটু নড়েচড়ে বসল। কিন্তু কিছুক্ষণ বাদে আবার যে-কে-সেই। আমি তখন দিশেহারা। ছবি তুলে কূল পাচ্ছি না। হাতে দুটো ক্যামেরা। একটা ডি এস এল আর, অন্যটা নিকনের একটা ছোটো ডিজিটাল ক্যামেরা। কখনও ডি এস এল আর-এ ছবি তুলছি, কখনো বা ডিজিটালে।

ছবি তুলে আশ মিটছে না। কখনও ছবি তোলা বন্ধ রেখে শুধু দেখে দেখেই সময় কেটে যাচ্ছে। একটা কথা বারবার মনে হচ্ছে, যা ক্যামেরাবন্দী করছি আর খালি চোখে মন দিয়ে যা দেখছি, এই দুটোর মধ্যে যেন আকাশ-পাতাল পার্থক্য থেকে যাচ্ছে। ফলে একটা অস্বস্তি বয়ে বেড়াতে হচ্ছিল প্রায় সবসময়।

হঠাৎ লাঞ্চের জন্য হাঁকডাক শুরু হয়ে গেল। আমরা যার যার নিজেদের ঘরের দরজা বন্ধ করে লাঞ্চ রুমের দিকে এগিয়ে চললাম। সুন্দর ছিমছাম ব্যবস্থা। কিছু ছবি তুললাম সেখানেও।

দুপুর দুটো দশ নাগাদ বেরিয়ে পড়লাম আমরা। প্রথম দিনের প্রোগ্রাম শুশুনিয়া পাহাড় এবং বিহারীনাথ মন্দির দর্শন। পথে বড়ন্তী লেক। 

বড়ন্তী লেকের পাশে নিঝুম রাস্তা

গাড়ি দাঁড় করানো হল সেখানে, কয়েক মিনিট, শুধু ছবি তোলার জন্য। লেকের একদিকে উঠে গিয়েছে পাহাড়। বড়ন্তীর বোধহয় সবচেয়ে বড়ো ল্যান্ডমার্ক এই জায়গাটা। কিছু ছবি নিলাম লেকের এবং নিঝুম ছিমছাম রাস্তার।

কোনো বাড়ি নেই, বসতি নেই জায়গাটাতে, শুধু মন-ভালো করা প্রকৃতি। বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে ইচ্ছে করছিল আমার, হয়তো আমার মতো অনেকেরই, কিন্তু বাঁধা সময়, দুটো জায়গায় যেতে হবে। অগত্যা কম্প্রোমাইজ!

শুশুনিয়া পাহাড়ে ওঠার রাস্তা

শুশুনিয়া পাহাড়ের কাছে যেখানে আমাদের গাড়ি এসে দাঁড়াল, সেখান থেকে পাহাড়কে সেভাবে দেখা যায় না। শুধু একটা ঢালু খাড়াই রাস্তা উঠে গেছে এবড়োখেবড়ো ভাবে। পাহাড়ে উঠতে গেলে ওই পথ ধরেই যেতে হবে এবং সেটা অনেক উঁচুতে।

ঘড়িতে তখন তিনটে-সাড়ে তিনটে হবে। বুঝলাম, পাহাড়ে ওঠা সম্ভব নয় একেবারেই। সবেমাত্র লাঞ্চ করে বেরিয়েছি, তার ওপর সময় তাড়া দিচ্ছিল আমাদের। ফলে কিছু ছবি তুলেই শুশুনিয়া পর্ব শেষ করতে হল।

এরপর বিহারীনাথ মন্দির। তখন সন্ধে হয়ে এসেছে প্রায়। কেউ কেউ মন্দির দর্শনে ভেতরে ঢুকল। আমি আর দিবাকর বাইরে ঘোরাঘুরি করলাম কিছুক্ষণ। সন্ধের ছবি তুললাম কিছু, অবশ্যই মন্দিরকে সামনে রেখে।

ফিরে গিয়ে জমিয়ে শুরু হল আমাদের চিরাচরিত সান্ধ্যকালীন আড্ডা। এক এক করে সবাই হাজির হলাম শিখার ঘরে। কারণ, বেড়াতে গেলে ওটাই আমাদের অলিখিত রেজিস্টার্ড আড্ডার জায়গা হয়ে যায় বরাবরের মত। আমার সারাদিনের তোলা ছবিগুলো দেওয়ালে সেট করা মনিটরে ডিসপ্লে করা হল। সেই নিয়ে চলল হৈ চৈ, হাসি-ঠাট্টা, মজা। আর, সঙ্গে ছিল টুকটাক খাওয়াদাওয়া। বাইরে তখন প্রচন্ড ঠান্ডা। যেন বরফ পড়ছে।       

আগের দিন রাতেই ঠিক হল, পরদিন সকাল ন’টা নাগাদ ব্রেকফাস্ট সেরে আমরা রওনা দেব। পথেই কোনো একটা জায়গায় লাঞ্চ সারতে হবে। অনেক দেখার ব্যাপার আছে। মার্বল লেক, বামনী ফলস, তারপর আরও কত কী!  

সকাল ঠিক ন’টায় গেস্ট হাউসের বাইরে এসে দাঁড়ালাম। অসাধারণ মনোরম দৃশ্য! সামনেই পাহাড়। এর ছবি অনেক তুলেছি। কিন্তু তবুও বারবার মনে হচ্ছিল, বোধহয় তুলিনি, কিংবা নিশ্চয়ই তুলেছি, তবে এবারেরটা বোধহয় হয় আরও ভালো হবে। সেই মন নিয়ে আরও কয়েকটা স্ন্যাপ নিলাম পাহাড়ের। কখনও পুরোটা, কখনো-বা কিছুটা পাহাড় এবং অনেকটা আকাশ নিয়ে, কিংবা পাহাড়ের সামনের খোলা প্রান্তরটা বেশি থাকবে, তার সঙ্গে পাহাড়, আকাশ। এরকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে চলেছি, এমন সময় বাকিরা সবাই হাজির। দিবাকর তাড়া লাগালো, “চলো চলো, গাড়িতে ওঠো।” গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে সামনে। পেছন ঘুরে একটু হেসে দিবাকরের দিকে তাকিয়েই বললাম, “সবাই কি এসে গেছে?”

আমি কনফিডেন্ট ছিলাম, সবাই তখনো তৈরি হয়ে আসেনি। কারণ, দীপক আর দোলন একটু দেরি করবেই। এই বিশ্বাস জন্মাল, আগের দিনের সন্ধেবেলার ছোট্ট একটা অভিজ্ঞতা থেকে। আমরা জমিয়ে তখন ছবিগুলো দেখছিলাম মনিটরে। ছবি-দেখা যখন প্রায় শেষ, দীপক আর দোলন বেশ সাজুগুজু ফিটফাট হয়ে ঘরে ঢুকলো। আরেক দফা ছবিগুলো দেখানো হল ওদের। সুতরাং সেই অভিজ্ঞতাই আমার ভেতরে কাজ করছিল, তাই কথাটা বলতে পেরেছিলাম দিবাকরকে। তাছাড়া, আরও একটা ব্যাপার আছে। আমাদের দলের মধ্যে সবার আগে তৈরি হয় দিবাকর। কারণ, ওর মধ্যে ভয়ংকর একটা তাড়া থাকে যে-কোনো ব্যাপারে।

খেতে বসলাম একসঙ্গে, অথচ দিবাকরের খাওয়া শেষ কিছুক্ষণের মধ্যেই। কীসের এত তাড়া জানি না। একটা সেদ্ধ ডিম আমরা বেশ রসিয়ে হয় মাঝখান দিয়ে কেটে, কিংবা ওয়ান-থার্ড অংশ কেটে খাই, দিবাকর আস্ত ডিমটাই মুখে পুরে দিল। এসব দেখে দেখে আমাদের চোখ অভ্যস্ত হয়ে গেছে। মঞ্জরি তো উঠতে বসতে… না থাক, অবশ্য পুরো ব্যাপারটাই বেশ মিষ্টি মিষ্টি। আমরা সবটাই উপভোগ করি।

তো সত্যিই দেখলাম, সবাই এসে গেছে, গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু দীপক আর দোলন মিসিং। ফলে আমি আবার ছবি তোলাতে মন দিলাম। তারপর ওদের সবাইকে বললাম, “দাঁড়িয়ে পড়, একটা গ্রুপ ছবি নিয়ে নিই।“

ফলে সেই গ্রুপ ছবিতে দীপক আর দোলন বাদ পড়ে গেল।

গাড়ি ছাড়তে ছাড়তে সেদিন ন’টা পনের কুড়ি হয়ে গেল। অনেক দূরের রাস্তা। অসাধারণ প্রাকৃতিক দৃশ্য। তখন বেশ তাড়া আমাদের। একেই বেশ একটু দেরি হয়ে গেছে। মার্বল লেকে পৌঁছতে হবে তাড়াতাড়ি। আর, মজার ব্যাপার, যখন বেশি তাড়া থাকে, তখনই যেন রাজ্যের বাধা-বিপত্তি সামনে এসে হাজির হয়। বেশ ছুটছিল গাড়ি, হঠাৎ কোথা থেকে একপাল গরু-ছাগল-ভেড়া রাস্তা জুড়ে চলে এল সামনে। যথারীতি দাঁড়িয়ে গেল গাড়ি। সঙ্গী-সাথীদের মধ্যে অধৈর্য, বিরক্তি। কী আর করি! চুপচাপ বসে রইলাম। ওরা গদাইলস্করি চালে যেতে যেতে বিকট গন্ধ ছড়িয়ে চলে গেল। শিখা ড্রাইভারের পাশের সিটে বসা। ওর নাকে মাস্ক, তার ওপর নাকেমুখে কাপড় চাপা দিয়ে গন্ধ ঠেকানোর চেষ্টা করে গেল আপ্রাণ।

মার্বল লেকের পথ
মার্বল লেকের পথ

মার্বল লেকের দিকে গাড়ি ছুটছিল, সত্যিই দেরি হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু অনেক কিছুর হাতছানি থাকে জীবনে। তার ওপর অন্তহীন জলতেষ্টা আমাদের সকলকে পেয়ে বসেছিল। গাড়িতে বসেই প্রায় আর্তনাদের মতন চেঁচিয়ে বললাম, “দাদা, এখানে একটু গাড়িটা থামাবেন।”

আমাদের এবারের ড্রাইভার কেমন যেন একটু খিটকেল গোছের। গতকাল থেকেই তার একটু আভাস পেতে শুরু করেছিলাম। আমাদের মধ্যে সেটা নিয়ে একটু আলোচনাও হয়েছিল। কিন্তু আমার আর্তনাদে ড্রাইভারভাই বাধ্য হয়েই যেন গাড়ি থামাল। সঙ্গীসাথীরাও তেমন আপত্তি করল না। কী কারণে? অসাধারণ মন ছুঁয়ে যাওয়া দৃশ্য! আমার ক্যামেরা শেষ হয়ে যাবে সেসব ছবিতে! গাড়ি থেকে নেমে আমি পাগলের মত ছবির পর ছবি তুলতে থাকলাম। যতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে গাড়ি ততক্ষণই আমার লাভ। ছবি তুলেই চলেছি। বাকিরাও যোগ দিল ছবি তোলাতে। সবাই একসময় উঠে গেল গাড়িতে। আমি তো ছবি তুলেই চলেছি। আশ মিটছে না। ডাকাডাকি শুরু হয়ে গেল, “গাড়ি ছেড়ে দিল কিন্তু, আরে ওই…” আরও কত কী!

মার্বল লেক
মার্বল লেক
মার্বল লেক

মার্বল লেকে যখন পৌঁছলাম, তখন প্রায় পৌনে একটা। গাড়ি থেকে নেমে লেকের প্রবেশপথের মুখটায় দাঁড়িয়ে আমি মুগ্ধ, বাকরুদ্ধ। দূরে লেকটা দেখা যাচ্ছে। অনেকটা ঢালু পাথুরে পথ নেমে গেছে লেক পর্যন্ত। অনেক মানুষকে দেখলাম, লেকের কাছে দাঁড়িয়ে আছে (ছবি – মার্বল লেক–১,২,৩,৪,৫)।

তাদের সবাইকে ছোটো ছোটো রং বেরং-এর কাঠির মত মনে হচ্ছিল।  শিখা প্রথমেই সারেন্ডার করে দিল, “না, না, বাবা, আমি যাচ্ছি না, আমি এখানেই থাকি, তোমরা যাও।” আমি তখন প্রায় ছুট মারতে আরম্ভ করেছি লেকের দিকে। কে আসবে, না-আসবে জানি না, আমি তো যাই। ঢালু পথ যেন আমাকে ছুটিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল লেকের দিকে। একটু দাঁড়িয়ে পেছন ঘুরে দেখলাম, দিবাকর আর শুভব্রত আসছে হেঁটে হেঁটে। পেছনে আরও কেউ কেউ। আমি আর দাঁড়ালাম না। একেবারে লেকের কাছটায় গিয়ে থামলাম। সামনে টলটল করছে স্বচ্ছ জল। সাংঘাতিক রোদ তখন।  আমার মনে হল, আমি লেকের জলে গা ডুবিয়ে বসে আছি। মনে হল, এখানেই থেকে যাই সারাজীবন!

আমাদের পরের টার্গেট বামনী ফলস। মার্বল লেকে স্নান করিনি ঠিকই, কিন্তু মনে হচ্ছিল, নতুন উদ্যমে আবার যেন যাত্রা শুরু করলাম। তখন ক’টা হবে, সম্ভবত দেড়টার কাছাকাছি।  

গাড়ি ছাড়ল। বামনী ফলসের দিকে যাচ্ছি। রাস্তা বেশ খারাপ। হেলেদুলে চলতে লাগল গাড়ি। পেটে কিছু পড়েনি অনেকক্ষণ। তো সেসবে আমাদের মন নেই কারুরই। যদিও মার্বল লেক ছেড়ে আসতে মন চাইছিল না, তবু এবার ফলস দেখব, সেই আনন্দেই ভরপুর পুরোদমে। গাড়ি যখন এসে থামল বামনী ফলসের প্রবেশপথের সামনে, বেশ একটু অবাক হলাম। আশপাশে কয়েকটা ছোটোখাটো দোকান নজরে এল। কিন্তু ফলস কোথায়! সামনে কিরকম জংলা বনবাদাড়! তবে কিরকম একটা আওয়াজ ভেসে আসছিল যেন। একটানা। সবাই বলল, সামনে এগিয়ে গিয়ে নেমে যেতে হবে। ও বাবা! তাহলে নেমে যাওয়ার ব্যাপার আছে। শিখা যথারীতি হাত তুলে দিল। একটা জায়গায় বসে বলল, “আমি এইখানে আছি, তোমরা ঘুরে এসো।”

মঞ্জরি, দীপক, দোলন-ও ওই একই পন্থা অনুসরণ করল। আমি, দিবাকর, শুভব্রত, শর্মিলা সামনে এগিয়ে চললাম। এবার খটখটে পাথুরে রাস্তা, সমতল কিন্তু ঘুরে ঘুরে যাওয়া। আমরা এগিয়ে চললাম। কিছুটা যাওয়ার পর দেখা গেল, বেশ ঢালু পাথুরে রাস্তা। শুভব্রত এবং শর্মিলা ততক্ষণে নেমে গেছে ঢালু পথ ধরে। দিবাকর বলল, ও যাবে না। ফিরে গেল। আমি এগোব কিনা ভাবছি, কারণ, সঙ্গে দুটো ক্যামেরা। ডিজিটালটা পকেটে ভরে নিলাম। ডি এস এল আর গলায় ঝোলানো। দুটো হাত ফাঁকা রাখলাম। সাপোর্টের জন্য। তাড়াতাড়ি সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ঢালু পথ ঘুরে ঘুরে নেমে গেছে। শুভব্রত-শর্মিলা প্রায় অদৃশ্য হওয়ার পথে। পেছনে তাকিয়ে দেখলাম, দিবাকর নেই। ‘জয় মা’ বলে নেমে গেলাম ঢালু পথে। একটু দ্রুত পা চালালাম, যাতে ওদেরকে ধরতে পারি। শুভব্রত-শর্মিলাকে দেখলাম, বেশ চটপটে। ঘুরে ঘুরে বেশ নেমে যাচ্ছে। আমি অনুসরণ করলাম ওদের। দেখে দেখে পা ফেলতে হচ্ছে। একটু এদিক সেদিক হলেই স্লিপ করার সম্ভাবনা। ফলসের আওয়াজটা বেশ জোরালো হচ্ছিল ক্রমশ। মাঝে মাঝে একটু থেমে যাচ্ছি, তেমন কিছু দেখলেই ক্যামেরাবন্দী করব। আবার, নজর রাখতে হচ্ছে, শুভব্রতরা যেন দৃষ্টির বাইরে চলে না যায়। সামনে অচেনা একটি অল্পবয়সী মেয়েকে দেখলাম, ওপরে উঠে আসছে। ওকে জিজ্ঞেস করলাম, “আর কতদূর?”

বলল, “এখনও অনেকটা।”

সর্বনাশ! মন বলছে, আরও কত দূরে… আমার সামনে কেউ নেই। শুভব্রত দৃষ্টির বাইরে চলে গেছে। একটু বোধহয় স্লো হয়ে গিয়েছিলাম। গতি বাড়ালাম। কিছুটা নামতেই শুভব্রতকে দেখতে পেলাম। ওর ঠিক পেছনে শর্মিলা। শুভব্রতকে উদ্দেশ্য করে হাঁক মারলাম, “কীরে! আর কতটা নামবি?”         

বামনী ফলস
বামনী ফলস
বামনী ফলস
বামনী ফলস
বামনী ফলস

ও কিছু একটা বলল, শুনতে পেলাম, কিন্তু বুঝতে পারলাম না। নামতে থাকলাম। আর কোনোদিকে দেখব না। নেমে তো যাই, তারপর দেখা যাবে। নামছি আর ঘুরছি, ঘুরছি আর নামছি। হঠাৎ একটা জায়গায় এসে দেখলাম, আহা! কী অপূর্ব জলধারা! দাঁড়িয়ে গেলাম। দেখলাম, শুভব্রত আর শর্মিলাও দাঁড়িয়ে গেছে। জায়গাটা কিছুটা সমতল। ছবি তুললাম একের পর এক। শুধু এক জায়গাতেই নয়, জলধারার আরও কিছু কিছু অংশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে চারদিকে। আমার ভিডিও ক্যামেরা অন করলাম। শর্মিলা আমার কাছাকাছি এসে বেশ উত্তেজিত হয়ে কিছু একটা বলল ছবি তোলার ব্যাপারে। আমার কানে তখন কিছু শব্দ ঢুকছে, কিন্তু কোনো অর্থ বোধগম্য হচ্ছে না। দম বন্ধ করে ক্যামেরা ঘোরাতে থাকলাম খুব ধীরে ধীরে। তারপর কিছু স্থির ছবি নিলাম।

কিছু লোককে দেখলাম, ওপরে উঠে আসছে। জিজ্ঞেস করলাম, “নিচে আরও কতদূর?”

বলল, “আরও প্রায় দশ-পনেরো মিনিট লাগবে।”

তার মানে, প্রায় পাঁচ-ছ’তলা উচ্চতা। শুভব্রতর দিকে তাকালাম। বলল, “চল, ফিরে যাই, দরকার নেই।”

আমিও সায় দিলাম ওর কথায়। কী দরকার! এবার তো উঠতে হবে যতটা নেমে এসেছি। বেশি নীচে নামা ভালো নয়! একটু দাঁড়িয়ে চারপাশটা দেখে নিলাম। দূরে জঙ্গল, পাহাড়, কুয়াশাচ্ছন্ন। এই জায়গায় আর দ্বিতীয়বার জীবনে আসা হবে বলে মনে হয় না। ভাবলাম, জীবনে এরকম কী কী জিনিস আছে, যেসব দেখার পর সেই মুহূর্তে মনে হবে, সেসব জীবনে আর বোধহয় দেখব না। সেরকম কিছুই মনে পড়লো না। একটু আনমনা হয়ে গিয়েছিলাম। শুভব্রত বলে উঠল, “চল গুরু, ফেরা যাক। কী ভাবছিস?”

একটু হেসে বললাম, “না, কিছু না।”

ওপরে ওঠার রাস্তা ধরলাম তারপর। কারণ, জীবন একটাই। নীচে নামার একটা হাতছানি সবসময় থাকেই। কিন্তু শাসনে রাখতে হয় নিজেকে। নাহলে আরও অনেক কিছু মিস হয়ে যাবে জীবনে!  

৫ জানুয়ারী ১৯৫৩ কলকাতায় জন্ম। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যা নিয়ে পাঁচ বছর পড়াশোনা। নিউক্লিয়ার ফিজিক্স নিয়ে পি এইচ ডি। ১৯৯১ – ২০০২ কম্পিউটার অ্যাপ্লিকেশন বিষয়ে তারাতলার ইন্সটিটিউট অব হোটেল ম্যানেজমেন্টে অধ্যাপনা। ২০০২ – ২০১৩ কলকাতার নেতাজীনগর ডে কলেজের কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগে অধ্যাপনা। তারপর প্রথাসম্মত অবসর। অবসরের পর পাঁচ বছর ধরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গেস্ট লেকচারার। কলেজ জীবন থেকে লেখালেখি শুরু। প্রথমদিকে কবিতা, তারপর নিয়মিত গল্প লেখা বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়, বইয়ের রিভিউ। এখন পুরো সময়টা কাটে সাহিত্য চর্চায়। ‘কণিকামাত্র’ এবং ‘অণুরেণু’ অণুগল্পের দু’টি সংকলন। ‘গল্প পঞ্চদশ’ পনেরোটি ছোটোগল্পের একটি সংকলন। এছাড়া খুব সম্প্রতি প্রকাশিত একটি উপন্যাস ‘কোভিডের দিনগুলি’।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *