দ্রোহী মধুসূদন এবং তাঁর জীবনের দুই নারী
১৮৫৬ সাল, ম্যাড্রাস বন্দর থেকে কলকাতাগামী জাহাজে উঠলেন এক দেশি বাবু আর তাঁর সঙ্গিনী এক য়ুরোপীয়ান লেডি। জাহাজের খাতায় বাবুটির নাম মিঃ ডাট।
বাবুটির জলের মত ইংরেজির স্রোতে জাহাজের অন্যান্য য়ুরোপীয়ানরা মুগ্ধ হয়ে বাবুটিকে মিঃ হোন্ট নামেই সম্বোধন করতে লাগলেন। জাহাজ কোম্পানির খাতাও লিখে রেখেছে দুটি নাম – ম্যাড্রাস থেকে উঠেছেন জনৈক মিঃ ডাট আর কলকাতায় নামার সময় তালিকায় থাকলেন, মিঃ হোন্ট। নামলেন কলকাতা বন্দরে। উঠলেন গিয়ে বিশপস কলেজে। যে কলেজ থেকে মাত্র কয়েকবছর আগে প্রায় কপর্দকশূন্য অবস্থায় পাড়ি দিয়েছিলেন ম্যাড্রাস।
এসেই চিঠি লিখলেন বন্ধু গৌরদাসকে, “এসে গেছি। … ঢাকঢোল না পিটিয়ে যদি আসতে পারো, তা হলে চলে এসো।”
কবিবন্ধু গৌরদাস বসাক ফেব্রুয়ারিতে এ চিঠি যখন পেলেন তার মাত্র দুমাস আগে সম্পূর্ণ অন্য ভাবের চিঠি পেয়েছিলেন বন্ধু মধুর কাছ থেকে। জেনেছিলেন ম্যাড্রাসে স্ত্রী রেবেকা এবং চারটি সন্তান নিয়ে মধুসূদনের অত্যন্ত সুখী পরিবারের কথা।
কলকাতায় মিঃ হোন্টের সঙ্গে জাহাজ থেকে নামলেন যিনি, তিনি রেবেকা দত্ত নন। তাহলে কে এই সঙ্গিনী? উত্তর খুঁজতে গেলে সময়ের সঙ্গে পিছিয়ে যেতে হবে।
১৮৪৭ সালের ডিসেম্বর মাসে এই বিশপস কলেজ থেকে যখন ম্যাড্রাসের জন্য বেরিয়েছিলেন মধু, পকেটের অবস্থা তখন এমন যে মালবাহী জাহাজে যাওয়া ছাড়া গতি ছিল না। কুড়িদিন ধরে বিভিন্ন জায়গায় মাল ওঠা নামানোর পরে সে জাহাজ ‘লেডি সেল’ পৌঁছাল ম্যাড্রাস।
অজ্ঞাতকুলশীল মাইকেল মধুসূদন দত্তকে বিশপস কলেজের বন্ধু চার্লস এডগার কেনেট ছাড়া সেখানে প্রায় কেউ চেনে না। যদিও ম্যাড্রাসের বিশপের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়েছিল কলকাতার বিশপস কলেজে, বিশেষ সদ্ভাব হয়েছিল বলে বোঝা যায় না।
গ্রাম থেকে আসা মধুকে পিতা ভর্তি করে দিয়েছিলেন হিন্দু স্কুলে।
সে স্কুলে অধ্যাপকদের সাহচর্যে অতি কম বয়সে মধু শেক্সপিয়ের, মিল্টন পড়ে ফেলেছেন। এরপর দাঁতে, গ্যেটে থেকে বায়রন পড়ে চলেছেন। এই সমস্তই হচ্ছে যখন মধুর বয়েস কুড়ির অনেক নীচে।
মধুসূদনের হিন্দু স্কুলের বন্ধুরা এসময় তাঁকে পোপ বলে ডাকতেন। পোপ অর্থাৎ কবি আলেকজান্ডার পোপ। মধু শুধু তাঁর প্রিয় কবিদের কবিতাই পড়েন না, তাঁদের জীবন সম্পর্কে জানার চেষ্টা করেন এবং তা নিজের জীবনে প্রয়োগ করার চিন্তা ভাবনাও করেন। কবিতা সম্পর্কে পোপ কোথাও বলেছিলেন, কবিতার জন্য নিজের অতি প্রিয়জন এমনকি নিজের বাবা মা’কেও দরকারে পরিত্যাগ করতে হতে পারে। মধুসূদন এই বাক্যকে নিজের জীবনের আপ্তবাক্য হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন কবিতার জন্য সব কিছু ত্যাগ করা যায়।
রাজনারায়ণ নিজে ছিলেন সদর দেওয়ানি আদালতের উকিল। তখন তাঁর হাতে দেদার পয়সা। একমাত্র সন্তান মধুসূদনের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল প্রায় বন্ধুর মতন। যা কোনোভাবেই সেকালে ভাবা যেত না। মধুর বন্ধু গৌরদাস বসাক চমকে উঠেছিলেন একই নল থেকে পিতার পরে পুত্রকে, পিতার সামনেই হুঁকো টানতে দেখে। শিক্ষা, আরাম, বিলাস, সর্বক্ষেত্রেই পুত্রকে সর্বশ্রেষ্ঠটি দেবার চেষ্টা করেছেন রাজনারায়ণ দত্ত।
মধু তাঁর একমাত্র সন্তান অবশ্যই, কিন্তু সেটাই শুধু নয়। সে বয়সেই ইংরেজিতে তার দখল খুব বেশি। সে জলপানি পায়। হিন্দু কলেজে প্রবন্ধ লিখে প্রথম পুরস্কার পেয়েছে, সোনার মেডেল। এসব নিয়ে রাজনারায়ণের মনে গর্ব ছিল যথেষ্ট।
তিনি ভেবেছিলেন ছেলে নিঃসন্দেহে তাঁর থেকে অনেক বড় মাপের উকিল হবে। নাহলে হবে ডেপুটি।
তিনি বুঝতে পারেননি ছেলের সঙ্গে তাঁর মানসিক দূরত্ব কতখানি হয়ে দাঁড়িয়েছে। একবার দুর্গাপুজোর সময় ছেলেকে নিয়ে গেলেন তমলুক। রাজনারায়ণ তখন তমলুকের রাজপরিবারের উকিল। সেখানে কয়েকদিনের বসবাসকালে অনুভব করলেন, ছেলের সঙ্গে তাঁর মানসিক দূরত্ব তৈরি হয়েছে বিস্তর। ছেলের চিন্তাভাবনার কোনো থৈ করতে না পেরে মনে মনে ঠিক করে ফেললেন কলকাতায় ফিরেই ছেলের বিয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। ছেলের মন ফেরাতে বিয়ের যুগ্যি দাওয়াই হবে না – এটাই তাঁর ধারণা ছিল।
মধুসূদনের মনে তখন পাশ্চাত্যের কবিরা। তাঁদের লেখা কবিতা পড়ে মুগ্ধ মধু মনে মনে ঠিক করে রেখেছেন ইংল্যান্ড যাত্রার কথা। বন্ধু গৌরদাসকে তা জানিয়েছেন কিন্তু বাবা মায়ের কাছে কালাপানি পার হবার ইচ্ছার কথা বলার সাহস হয়নি তাঁর। ঠিক এরকম সময়ে বিয়ের কথা তাঁর কাছে ছিল এক অপ্রত্যাশিত আঘাত।
মধু যখন জানতে পারলেন, তখন মাত্র তিনমাস বাকি সেই বিয়ের।
পাশ্চাত্য সাহিত্য এবং কবিদের জীবনী পাঠ করে তিনি তখন এক মুক্তমনা মানুষ। ভালোবেসে বিয়ে করার আদর্শকে তিনি মনের গভীর থেকে বিশ্বাস করে ফেলেছেন। মধুর কল্পনার জগতে তখন পাশ্চাত্যের কবিদের লেখার নীলনয়না সুন্দরী।
পিতার আনা সম্বন্ধ দেখা মেয়েকে বিয়ের কথায় রাজি হওয়া আর নিজের হাতে পায়ে লোহার বেড়ি পরিয়ে জলে ফেলে দেওয়া প্রায় একই ব্যাপার তাঁর কাছে।
হিন্দু কলেজের শিক্ষা তখন সম্পন্ন হয়নি। তার বাকি প্রায় দুবছর। মধুর বয়স তখন প্রায় উনিশ। যে মেয়েটির সঙ্গে বিয়ের কথা হচ্ছে সে হয়ত দশ কি বারো। সে সময়ের হিসেবে এই বয়সে বিয়ে খুবই স্বাভাবিক একটি ঘটনা। মধুর বন্ধুদের বেশিরভাগেরই বিয়ে হয়েছে এভাবেই এবং অবশ্যই এ বয়সের আগে।
সেই বয়সেও মধুসূদন নিজের ব্যক্তিগত সমস্যার কথা খুব কম লোককেই বলতেন। সম্ভবত গৌরদাস একমাত্র বন্ধু ছিলেন, যাঁকে তিনি নিজের সমস্যার কথা বলতে পারতেন। সেই বন্ধুকে নিজের মনের চুড়ান্ত দোলাচল অবস্থা নিয়ে চিঠি লিখলেন। কিন্তু গৌরদাস বন্ধুর এই অদ্ভুত আচরণের কোনো অর্থ খুঁজে পেলেন না।
মধুসূদন ধ্যান ধারণায় ছিলেন যুগের থেকে অনেকখানি এগিয়ে। যার ফলে বিয়ে যে তাঁর জীবনের সংকট হয়ে দাঁড়িয়েছিল, তা তার বাবা রাজনারায়ণ দত্ত অথবা মা জাহ্নবী দেবী তো বটেই, বন্ধু গৌরদাসের পক্ষেও বুঝতে পারা খুব সহজ কাজ ছিল না।
অসমাপ্ত শিক্ষায় চাকরি সম্ভব নয় তা তিনি জানতেন। পরিত্রাণের কোনো উপায় বের করতে না পেরে অবশেষে তাঁর মনে হলো খৃষ্টান ধর্ম গ্রহণ করে পাদ্রী হয়ে বিলেত যাত্রা একমাত্র উপায় হতে পারে। এর ফলে বিবাহ থেকে পরিত্রাণ এবং ইংল্যান্ড যাত্রা দুই’ই সম্ভব।
দমে যাবার পাত্র তিনি ছিলেন না। চুপিসাড়ে কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে আলেকজান্ডার ডাফ পর্যন্ত সকলের সঙ্গেই যোগাযোগ করে চলেছিলেন। কেউই তাঁকে খৃষ্টান ধর্ম গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে বিলেত যাবার প্রতিশ্রুতি দিতে পারছিলেন না। এইসময় কৃষ্ণমোহন তার সঙ্গে আর্চডিকন ডিয়ালট্রির পরিচয় করিয়ে দেন। তিনি সম্ভবত মধুকে বিলেত যাবার ব্যাপারে আশ্বাস দেন।
খৃষ্টান মিশনারিদের পক্ষে সমাজের প্রভাবশালী ব্যাক্তিদের ধর্ম পরিবর্তন করা সেযুগেও খুব সহজ কাজ ছিল না। সেক্ষেত্রে রাজনারায়ণ দত্তের ছেলের খৃষ্টধর্ম গ্রহণ চার্চের কাছে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। মিশনারিরা জানতেন রাজনারায়ণ জানতে পারলে যেভাবেই হোক ছেলেকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবেন। তাই মধুকে তাঁরা নিয়ে গিয়ে রাখলেন ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গে। রাজনারায়ণ যখন জানতে পারলেন, তখন ছেলেকে ফিরিয়ে আনবার অনেক চেষ্টা করেছিলেন। বিলেত যাত্রার টাকা দিতে চেয়েছিলেন এবং বিয়ে করতে হবে না এ খবরও মধুর কাছে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু মধু ফিরে আসেননি। কেন, এ উত্তর মধুসূদন কোথাও লিখে জানাননি। এমনকি গৌরদাসকেও না।
১৮৪৩ সালের ৯’ই ফেব্রুয়ারি কলকাতার ওল্ড মিশন চার্চে গিয়ে মধুসূদন খৃষ্টান হলেন। নাম হল মাইকেল। আর্চডিকন ডিয়ালট্রি তাকে দীক্ষা দিলেন এবং বিশেষ অতিথি হিসাবে নিয়ে গেলেন তাঁর বাড়িতে।
খৃষ্টধর্ম গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর জীবনে দেখা দিল এমন কিছু পরিবর্তন, যা হয়ত তিনি আশা করেননি। আশু বিবাহ থেকে পরিত্রাণ পাওয়াই একমাত্র লক্ষ্য ছিল।
তখনকার হিন্দু কলেজে ধর্মান্তরিত কোনো ছাত্রের পঠন পাঠনের কোনো ব্যবস্থা ছিল না, ফলে অসমাপ্ত শিক্ষা হিন্দু কলেজ থেকে পূর্ণ করা কোনোভাবেই সম্ভব ছিল না।
হিন্দু কলেজের সমস্ত বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে গেল।
হয়ত এর কিছুদিন পর থেকে ধীরে ধীরে রাজনারায়ণ ও জাহ্নবী দেবীর সঙ্গে ছেলের সম্পর্ক বেশ খানিকটা স্বাভাবিক হয়ে এসেছিল কিন্তু সমাজের চাপে অথবা অন্য যে কোনো কারণেই হোক খিদিরপুরের বাড়িতে ধর্মান্তরিত মধুর জায়গা হয়নি। পিতার ইচ্ছা অনুযায়ী, মধুও প্রায়শ্চিত্ত করে হিন্দুধর্মে ফেরার ব্যাপারে কখনওই ইচ্ছুক ছিলেন না।
এর বেশ কিছুদিন পরে মধু মিশনারি ভাতা নিয়ে বিশপস কলেজে ভর্তি হতে চাইলেন। রাজনারায়ণ জানতে পেরে সে ব্যবস্থা পরিবর্তন করিয়ে মাস মাইনে দিয়ে ছেলেকে সেখানে ভর্তি করলেন। বিশপস কলেজে শুধু ধর্ম নয়, সাহিত্য বিষয়ক পড়াশোনাও যথেষ্ট ভালো হত। ভালো ছাত্র মধুসূদন আবার করে ডুবে গেলেন পড়াশোনার গভীরে।
কিন্তু কিছুদিন পর হঠাৎ করেই রাজনারায়ণ ছেলের কলেজের মাইনের টাকা বন্ধ করে দিলেন।
এরপর ছেলের জেদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়ে গেল পিতার জেদও। বংশধরের জন্য রাজনারায়ণ একের পর এক দ্বিতীয় বিয়ে (হয়ত বা তৃতীয় এবং চতুর্থও) করলেন।
মা জাহ্নবী দেবীর কাছে গিয়ে দাঁড়াবার সাহস বা শক্তি হয়ত মধু হারিয়ে ফেলেছিলেন এই ঘটনায়। এর আগেই পিতার বারণ শুনে ডিয়েলট্রির সঙ্গে বিলেত না গিয়ে বিলেত যাবার সুযোগও তিনি হারিয়েছেন। পিতা কথা দিয়েও তাকে ইংল্যান্ড যাবার ভাড়া দেননি।
ঘটনা পরম্পরায় মধুর মনে হয়তো তৈরী হয়েছিল অভিমানের পাহাড়।
বিশপস কলেজের এক বন্ধু চার্লস এগব্যর্ট কেনেটের কাছ থেকেই মধু ম্যাড্রাস সম্বন্ধে যা কিছু জেনেছিলেন তাতেই হয়ত তাঁর মনে হয়েছিল ভাগ্য পরীক্ষার জন্য ম্যাড্রাস যাওয়া যেতেই পারে। ঘটনা পারম্পর্য লক্ষ্য করলে মনে হয় সেসময় তাঁর কাছে এ ছাড়া রাস্তাও বিশেষ কিছু খোলা ছিল না।
কলকাতায় তখন বেশ কিছু ইংরেজি স্কুল থাকলেও, ম্যাড্রাসে একটিও ইংরেজি স্কুল ছিল না। স্বাভাবিক ভাবেই মধুসূদনের মতো গুণী ইংরেজির ছাত্রের সেখানে কদর হওয়া উচিত ছিল, কিন্তু সেখানকার ইংরেজদের কাছে তিনি এক নেটিভ হয়েই রয়ে গেলেন।
চার্লস এগব্যর্ট কেনেটের বাবা চার্লস কেনেট ছিলেন ম্যাড্রাসের ট্রেজারির ম্যানেজার এবং বহুবছর ধরে তিনি ছিলেন একটি দাতব্য প্রতিষ্ঠানের সেক্রেটারি। সম্ভবত তাঁরই সাহায্যে অনাথালয়ের স্কুলে মধু সহকারী শিক্ষকের চাকরি লাভ করেন।
নামে সহকারী শিক্ষক হলেও, মধুসূদন ছিলেন স্কুলের একমাত্র শিক্ষক।
তাঁর মাইনে ছিল ৪৬ টাকা। যেখানে কলকাতায় বিশপস কলেজে তাঁর জন্য রাজনারায়ণ মাস মাইনে দিতেন ৬৪-৬৫ টাকা। সম্ভবত মা কিছু হাতখরচাও দিতেন। যিনি মাত্র কিছুদিন আগে কলকাতায় ৮০ টাকা মাইনের চাকরি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, মাত্র ৪৬ টাকা মাস মাইনের চাকরিতে ম্যাড্রাসে শুরু হলো তাঁর জীবন।
অনাথালয়ের শিক্ষকের চাকরি আর থাকার জায়গা ব্ল্যাক কলোনি।
অনাথ আশ্রমের চাকরিতে ধীরে ধীরে তাঁর সুনাম বাড়ছিল, কিন্তু আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য বিন্দুমাত্র ছিল বলে মনে হয় না। ছেলেদের এবং মেয়েদের অনাথ আশ্রম মিলিয়ে ছাত্র সংখ্যা ছিল প্রায় দেড়শো। এদের হাতের কাজ শেখানোর জন্য অন্য শিক্ষক ছিলেন কিন্তু পড়াশোনার ক্লাস মধুকেই নিতে হত।
এখানেই মধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ হলো স্বপ্নে দেখা নীলনয়নার। মধুসূদনের জীবনের প্রথম ভালোবাসার নারীটি। নীলনয়না রেবেকা ছিলেন অনাথালয়ের এক ছাত্রী।
ছাত্রী রেবেকা অথবা যুবক শিক্ষক মধু কে কার প্রতি দুর্বল হয়ে ছিলেন প্রথম, এ কথা জানার কোনও উপায় নেই।
মধুর বিবাহ সম্পর্কিত রোম্যান্টিক চিন্তাধারা ছিল এক নীলনয়না সুন্দরীকে ঘিরে। অন্যপক্ষে রেবেকা ছিলেন অনাথ। রেবেকার মাত্র সাড়ে বারো বছর বয়সে তার বাবা মারা যাবার পর তার মা সম্ভবত যাঁর সঙ্গে ছিলেন সেই ম্যাকডাভিসের বাড়িতে কিছুদিন থাকার পর রেবেকার জায়গা হয় অনাথাশ্রমে। খুব স্বাভাবিক ভাবেই অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে একটি অনাথ যুবতী মেয়ে নিরাপত্তা খুঁজেছিল এবং সেই নিরাপত্তার আশ্বাস সে খুঁজে পেয়েছিল শিক্ষক মধুসূদনের চোখে।
অনুমান করা যায় এভাবেই দুটি মন কাছাকাছি এসে পড়েছিল। কিন্তু নেটিভ মধুসূদনের পক্ষে রেবেকাকে বিয়ে করা খুব সহজ ছিল না। অনাথাশ্রমে পালিত হলেও রেবেকার শরীরে বইছে য়ুরোপিয়ান রক্ত। ম্যাড্রাসের তৎকালীন ইংরেজ সমাজ পুরোপুরি এই বিয়ের বিপক্ষে চলে গেলেন।
ধর্মান্তরিত হবার পর হিন্দু কলেজ থেকে বহিষ্কৃত হবার কারণে বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ কমে গেছিল উল্লেখযোগ্য ভাবে। গৌরদাস, মধুর প্রাণের বন্ধু, যাঁর সঙ্গে মধু ছিলেন সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ, সেই গৌরদাসও মধুর কলকাতা ত্যাগ এবং ম্যাড্রাস যাত্রার ব্যাপারে কিছুই জানতেন না।
মধুর হঠাৎ উধাও হয়ে যাবার পরে রাজনারায়ণ দত্তও নিশ্চয়ই ব্যাকুল হয়েছিলেন এবং বিশপস কলেজে খোঁজ নিয়েছিলেন। জাহ্নবী দেবীকে হয়ত মধুসূদন জানিয়েছিলেন তাঁর ম্যাড্রাস বাস সম্পর্কে। যেখান থেকেই হোক খোঁজ করে বন্ধুর ঠিকানা জোগাড় করে বন্ধুকে চিঠি লিখেছিলেন গৌরদাস।
মধুও চিঠি লিখলেন গৌরদাসকে। লিখলেন রেবেকার কথা। ম্যাড্রাসের ইংরেজ সমাজের প্রভূত আপত্তি সত্তেও চার্চে গিয়ে এদের বিয়ে হয়েছে। এর প্রধান কারণ রেবেকার সম্মতি।
বিয়ের ঠিক পর পরই, মধুসূদনের চারটি কবিতা পর পর প্রকাশিত হয়েছে ম্যাড্রাস সার্কুলেটর পত্রিকায়। এই চারটি কবিতা তিনি লিখেছিলেন টিমোথি ছদ্মনামে।
টিমোথি নামে লেখার সঠিক ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না তবে এ অনুমান খুব শক্ত নয়, ম্যাড্রাসে তিনি ছিলেন অজ্ঞাতকুলশীল তাই নিজের নামে না লিখে য়ুরোপিয়ান নাম ব্যবহার করে পাঠকের প্রতিক্রিয়া বুঝতে চেয়েছিলেন।
রেবেকা তখন প্রথমবার গর্ভবতী। এইসময় কবি ব্ল্যাক কলোনি ছেড়ে স্ত্রীকে নিয়ে উঠে এসেছেন রয়াপুরমে সমুদ্রের ধারে এক বাড়িতে। স্বাভাবিক ভাবেই খরচ বেড়ে গিয়েছে অনেক। এরমধ্যে কাব্যচর্চা সহজ কথা নয় কিন্তু এই অবস্থায় সম্ভবত খানিক বাড়তি রোজগারের তাগিদে এক মাসেরও কম সময়ে তিনি লিখে ফেললেন একটি কাব্যগ্রন্থ ‘The Captive Ladie’.
সদ্য বিবাহিত যুগলের প্রেম যেন নিকষিত হেম। কাব্যগ্রন্থ ছাপল Madras Circulator, কাব্যের শুরু রেবেকা বন্দনা দিয়ে।
The heart which once had sigh’d in solitude
And yearn’d t’ unlock the fount where softly lie
Its gentlest feelings-well may shun the mood
Of grief – so cold-when thou, dear one! Art nigh
To Sun it with thy smile. Love’s lustrous radiancy?
মাত্র সাত মাস আগের কলকাতা থেকে আসা কবির মনের নিঃসঙ্গতাকে ভুলিয়ে দিয়ে রেবেকা তখন তাঁর জীবনপাত্র ভরে তুলেছেন। উছলিয়া পড়ে তা।
মধুসূদনের চোখে রেবেকাই তখন তাঁর একমাত্র প্রেরণা।
Tho’ ours the home of want,– I never repine
Art thou not there…
এই কাব্যের পরিচয় দিতে তিনি নিজেই গৌরদাসকে বলেছেন এতে আছে দুই সর্গের একটি আধা ঐতিহাসিক কাহিনি। ভালো মন্দয় মেশানো প্রায় বারোশো লাইন।
এ কাব্যের প্রসঙ্গে যেন কৈফিয়ত হিসেবেই কবি বলেছেন, “জীবনের যে নগ্ন বাস্তবতার মধ্যে এই কাব্য লেখা হয়েছে, তা থেকে মনকে সরিয়ে নিয়ে কাব্য সাধনা করবার জন্য অসাধারণ প্রয়াস দরকার। অভাব এবং অনটন তাদের সঙ্গে দুঃখ দুর্দশার যে কাহিনি নিয়ে আসে, তা তাদের শিকারকে সামান্যই প্রেরণা দিতে পারে।”
কিন্তু তা সত্ত্বেও এ কাব্যের মান দেখে শুধু পত্রিকার সম্পাদকই মুগ্ধ হয়ে যাননি, এ কাব্য যাঁকে মধুসূদন উৎসর্গ করেছিলেন, ম্যাড্রাসের তৎকালীন এডভোকেট জেনারেল সেই মিঃ নর্টন এ বইয়ের ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন। এ কাব্য মধুসূদনকে ম্যাড্রাসের এলিট সমাজে এক পরিচিতি এনে দিয়েছিল। যা তখন তাঁর কাছে ছিল ভীষণভাবে কাম্য।
এই সময় তিনি এই কাব্যটি পুস্তকাকারে ছাপানোর কথা ভাবেন। তখন ম্যাড্রাসে ছাপার খরচ বেশ বেশি। বইটি ছিল ১১ + ৮০ পৃষ্ঠার। কলকাতায় হিন্দু কলেজের এবং বিশপস কলেজের বন্ধুদের কাছে অনুরোধ করলেন বই বিক্রির উদ্যোগ নেওয়ার জন্য।
Captive ladie প্রকাশ হোল Madras Advertiser থেকে; এরপর তাকে জাহাজে কলকাতায় পাঠাতে খরচ হলো আরো বেশ কিছু টাকা। একদিকে প্রেসের পাওনা, অন্যদিকে বই বিক্রির চিন্তা।
মধুসূদন কোনোদিনই বৈষয়িক অথবা হিসেবি কোনওটাই হতে পারেননি। কবি হিসেবে যশ লাভই বোধহয় তাঁর জীবনের একমাত্র কাম্য ছিল।
এই কাব্য ম্যাড্রাসে তাঁকে বেশ পরিচিতি দিয়েছিল। নিজের সম্বন্ধে তাঁর ধারণা চিরকালই ছিল বেশ উঁচু। তিনি আশা করেছিলেন কলকাতায় বন্ধুদের থেকে এই কাব্যের পাঠ প্রতিক্রিয়া পাবেন। কিন্তু একমাত্র গৌরদাস ছাড়া কেউই বিশেষ কিছু লিখলেন না। বন্ধু ভূদেব মুখোপাধ্যায়ও না। অথচ ভূদেবের সমালোচনা পাবেনই এ ভরসা তাঁর যথেষ্ট ছিল।
বেশ কিছু বই অবশ্য বিক্রি হল বন্ধুদের সহায়তায়। তবুও কলকাতার কোনো কাগজে সেভাবে এর কোনো সমালোচনা ছাপা হল না। বরং যে সমালোচনা এল, তা একেবারেই অপ্রত্যাশিত এবং আঘাতের মতো।
এইসময় তিনি যে আরেকটি কাব্য লিখতে শুরু করেছিলেন, মনে আশা ছিল তা ছাপাবেন লন্ডন থেকে, সে আশাও অপূর্ণ রয়ে গেল।
বেথুন এর জনহিতকর কাজ কবিকে মুগ্ধ করেছিল। তাই বেথুনকে বইয়ের এক কপি দেবার অনুরোধ করেছিলেন গৌরদাসকে।
কিন্তু সে কাব্য পড়ে বেথুন গৌরদাসকে যা লিখলেন, তা হল এই –
“তাঁর কাব্য উপহার দেবার জন্য আপনার বন্ধুকে আপনি দয়া করে আমার তরফ থেকে ধন্যবাদ জানাবেন। আমার কাছে মনে হচ্ছে, তাঁর উপহারের আমি একটা রূঢ় জবাব দিচ্ছি।…
… আমি যতদূর জানি আপনাদের সাহিত্যের সেরা নমুনাগুলোও স্থূল এবং অশ্লীল। নিজেদের ভাষায় উচ্চতর এবং মহত্তর স্বাদের সাহিত্য গড়ে তোলার জন্যে একজন উচ্চাকাঙ্ক্ষী তরুণ কবির পক্ষে দেশবাসীদের মধ্যে নেতৃত্ব দেবার চেয়ে কোনো আশা থাকতে পারে না। তাছাড়া তিনি অনুবাদের মাধ্যমেও অনেক সেবা করতে পারেন। এভাবেই বেশির ভাগ য়ুরোপীয় জাতির সাহিত্য গড়ে উঠেছে।”
বেথুন সম্ভবত সাহিত্য সমালোচক ছিলেন না। এই চিঠির বক্তব্যে তাই মধু আঘাত নাও পেতে পারতেন কিন্তু এ চিঠির বয়ান, কবির আত্মশ্লাঘায় আগাত করেছিল। এছাড়াও বেশ কিছু রূঢ় সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছিল তাঁর Captive ladie। হয়ত এত কঠিন সমালোচনা তার প্রাপ্য ছিল না। নিজের প্রত্যয়ও খানিক আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছিল কি! নাহলে লন্ডন মিউজিয়মে Captive ladie পাঠানোর সময় নিজের নামের নীচে লিখে দিয়েছিলেন ‘of Bishop’s College Kolkata’ হয়তো ভেবেছিলেন একথা না লিখলে ব্রিটিশ মিউজিয়ম লাইব্রেরিতে এ বইয়ের স্থান নাও হতে পারে। কারণ এর বারো বছর পর যখন তাঁর মুদ্রিত সব বই ব্রিটিশ মিউজিয়মকে দান করেন, তখন নিজের নামের পাশে কোনো পরিচিতি লেখেননি।
ইংরেজিতে কবিতা লিখে বিশ্বখ্যাত হবার বাসনা হয়ত এই সময় থেকেই একটু একটু করে কমতে শুরু করেছিল তাঁর মধ্যে।
বেথুনের এই সমালোচনার আগেই ভবিষ্যৎ বাংলা কবিতায় অমিত্রাক্ষর ছন্দের পথ প্রদর্শক এবং চতুর্দশপদী কবিতার সৃষ্টিকর্তা মধুসূদন বন্ধু গৌরদাসের কাছে কৃত্তিবাসী রামায়ন ও কাশীদাসী মহাভারত চেয়ে পাঠিয়েছিলেন। বন্ধুকে জানিয়েছিলেন তামিল, তেলেগু ছাড়াও গ্রীক, হিব্রু, সংস্কৃত, ল্যাটিন – সবকটি ভাষা তিনি শিখছেন রীতিমতো শিক্ষক রেখে এবং ঘড়িধরা নিয়মানুবর্তিতায়।
এর মধ্যেই এসে গেল প্রথম সন্তান বার্থা। এরপর একে একে আরো তিনজন। অভাব তীব্রতর হচ্ছে তখন প্রতিদিন। এইরকম সময়ে Eurasian পত্রিকায় সম্পাদনার কাজ জুটে গেল কবির। অভাব একটু কমল।
এদিকে বহুদিন ধরে চেষ্টা করছিলেন ম্যাড্রাস স্কুলে চাকরির জন্য। সে চাকরি হল, কিন্তু স্কুল কমিটির চাপে পত্রিকা সম্পাদনার কাজটি ছাড়তে হল। আবার টানাটানি। প্রত্যেক বার সাংসারিক অভাব বাড়লেই কবি বাড়ি পরিবর্তন করেছেন। আবার একটু স্বাচ্ছন্দ্য দেখা দিলেই নতুন বাড়ি। হিসেবি হতে পারেননি কখনওই।
এই সময়েই মধুসূদনের জীবনে দ্বিতীয় নারীর আবির্ভাব। স্কুলেরই আরেকজন শিক্ষকের মেয়ে হেনরিয়েটার সঙ্গে জড়িয়ে পড়লেন কবি। হেনরিয়েটার মা মারা যাবার পর তাঁর বাবা হেনরিয়েটার সমবয়সী একটি মেয়েকে বিয়ে করে আনলেন। অসহায় হেনরিয়েটার প্রতি মধুসূদন সহানুভূতিশীল হয়ে পড়েছিলেন। হয়তো তাঁর নিজের পিতার পর পর একাধিক বিবাহ মনে পড়েছিল। এভাবেই হেনরিয়েটার সঙ্গে ধীরে ধীরে জড়িয়ে পড়েছিলেন মধুসূদন। হেনরিয়েটার পরিবার এবং কবি পরিবার তখন একই পাড়ায়। কবিপত্নী রেবেকা হয়ত সবই টের পেয়েছিলেন।
এই সময়ে বন্ধু গৌরদাসের চিঠিতে মধুসূদন জানলেন, এর মধ্যে তাঁর মা এবং বাবা দুজনেরই মৃত্যু হয়েছে। এবং সমস্ত সম্পত্তি জ্ঞাতিরা দখল করে নিয়েছেন।
যে ডিসেম্বরে বন্ধু গৌরকে লিখলেন তিনি একটি সুখী পরিবারের মালিক, তার দুমাসের মধ্যেই সব কিছু ছেড়ে চলে এলেন কলকাতায়।
মধুসূদন ম্যাড্রাস ছাড়লেন হেনরিয়েটার হাত ধরে।
আর কোনোদিনই তিনি ম্যাড্রাস ফিরে গেলেন না। রেবেকার সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদও হয়নি। রেবেকা কি কলকাতায় কবির সঙ্গে যোগাযোগের কোনো চেষ্টা করেছিলেন? কিছুই জানা যায় না এই ব্যাপারে।
শুরু হল নতুন যাত্রা। জন্ম হলো বাংলা ভাষায় অমিত্রাক্ষর ছন্দের।
এ যাত্রায় কোথাও রেবেকা বা তাঁর সন্তানেরা নেই।
মধুসূদন ম্যাড্রাস ছাড়ার ছত্রিশ বছর পরে রেবেকা দত্ত যখন মারা যান, তখন কবিও নেই। কবির পদবীকে সারাজীবন নিজের নামের সঙ্গে জুড়ে রেখেছিলেন তিনি। সে কি ভালবাসায়? না হেনরিয়েটাকে কোনোদিন নিজের জায়গা ছেড়ে না দেবার ইচ্ছায়? সেটুকু না হয় অজানাই থাক।
2 Comments