সে হল প্রায় আগের জন্মের কথা, তখনও অর্কুটের জমানা – টিভিতে ‘চিত্রহার’ হত, বাড়িতে ডায়াল করা ল্যান্ডফোন থাকত। তখন বাতাসে গুনগুন হলেই লোকে বুঝতো এসেছে ফাগুন। আর্চিস গ্যালারি ছিল, কিন্তু এতো প্রেম-প্রেম মোবাইল অ্যাপের রমরমা ছিল না। যাকে বলে প্রাগৈতিহাসিক যুগ। তখনও টলিউডের একটা বড় অংশে নায়িকারা ওড়নাওয়ালা বড়হাতা চুড়িদার ও বাটিক প্রিন্টের শাড়ী-ব্লাউজ পরতো, মাথায় বেড়াবিনুনী বা কলাবিনুনী বাঁধতো, বাংলা বা হিন্দি সিরিয়ালে তিনটে করে রিঅ্যাকশন সিন থাকত না। মোবাইলে তখনও কোনোমতে একটা নম্বর “দোস্তি” করিয়ে লোকজন কথা বলত, মোড়ে মোড়ে এসটিডি বুথ আর পাড়ায় পাড়ায় সাইবার ক্যাফের চল ছিল। তখনও সবার বাড়িতে ইনভার্টার আসেনি। লোডশেডিংয়ে ঘুটঘুটে অন্ধকারে, ঝিঁঝিঁ ডাকা উঠোনে, চা নিয়ে বসে এ বাড়ির লোক ও বাড়ির লোকের সঙ্গে গল্প করত। ট্রেনের লেডিস কামরায় ‘হরেক মাল পাঁচটাকা’য় বিক্রি হত, কিছু কিছু ট্রেনলাইনে শুধুই মোটামোটা হলুদ টিকিট বিক্রি হত, কাগজে ছাপা টিকিট তখনও অত চালু হয়নি। মেট্রোরেল তখনও দর্শনীয় বস্তু, চলত আদ্যিকালের টিকিট। স্টেশনে স্টেশনে তখনও ইলেক্ট্রনিক মিষ্টি মহিলাকণ্ঠ বলত না – “অনুগ্রহ করে শুনবেন…,” বরং কর্কশ পুরুষকণ্ঠ ততোধিক ‘নয়েজ’-সম্বলিত কর্কশ চোঙামাইকে ঘোষণা করতেন – “দু’নম্বর লাইন দিয়ে থ্রু-ট্রেন যাবে, দু’নম্বর থ্রু- দু’নম্বর!”
ঘুটঘুটে অন্ধকারে একা একা অটোস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে ওরা – স্টেশন যাবে বলে। এসেছিল সিনেমা দেখতে। গ্রাম-গ্রাম শহরতলির ছেলেমেয়ে, সেখানে মোটে দুটো সিনেমাহল, মাল্টিপ্লেক্সের তো গন্ধই নেই। শহরতলির এই অটোস্ট্যান্ড, রাত দশটা বেজে গেলে নির্জন হয়ে যায়। সারাদিন যে জায়গাটা গমগম করে, সেখানেও রাত দশটার পর একটা করে অটো আসে, সেটা ভরে – তবেই ছাড়ে। জায়গা এমনিতে নিরাপদ হলেও নির্জনতার অভাব আজকেও নেই। ল্যাম্পপোস্টের আলো টিমটিম করে জ্বলছে। বসন্তকাল, এপ্রিলমাস, মলয়বাতাস, সাড়ে-সব্বোনাশ!
মৃদুমন্দ হাওয়ায় ঝিঁঝিঁ ডাকছে, এদিক-ওদিক চামচিকে উড়ছে, চারিদিকে ফুটফুটে জোছনাও রেডি। ছোটোখাটো টাকমাথা চেকচেক শার্ট আর জিন্সপরা ছেলেটা ত্রিভঙ্গমুরারী হয়ে অটো আসার পথের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে। মেয়েটা বেশ ফর্সা, কালো চুড়িদার-ওড়না, মাথায় বিনুনি, ফোনে মগ্ন – বুকে লাবডুব কিন্তু মুখ নিরুত্তাপ। ছেলেটার এদিকে ল্যাকপ্যাকে চেহারা, তবে সাহসী – আগে মড়া কাটতো, এখন জ্যান্ত অবস্থাতেই কাটে। নিজে রক্ত দেখে ভয় পেলেও পেশেন্ট দেখলে অসমসাহসে বুক চিতিয়ে প্যাঁট করে ছুঁচ ফোটায়, ঝাঁটা দিয়ে আরশোলা মারে! মেয়েটা ডাকাবুকো, ছেলেটার চেয়ে লম্বায় অল্প বেশি, তবে আরশোলা ভয় পায়। ছেলেটা যে আজ প্রপোজ করবে মেয়েটা বুঝতে পারছিল।
খানিকক্ষণ নিঃশব্দে ঝিঁঝির ডাক শুনে ছেলেটা বলল, “বুঝলি, অটো লেট করছে।”
চিন্তিত ভঙ্গিতে মেয়েটা মোবাইল থেকে চোখ না তুলে বলল, “ক’টার ট্রেন?”
“হুম!”
“হুম কী? টাইমটেবিল দেখে বেরোসনি?”
মেয়েটার গলায় ঈষৎ ঝাঁঝ, মোবাইল থেকে চোখ তুলে ছেলেটার দিকে কটমটিয়ে তাকাল। ছেলেটা একটু থতমত খেল।
মেয়েটা চাঁদের দিকে তাকাল। বেশ লাগছে, তবে একটু ভয়ভয় করছে। সাড়ে দশটার ট্রেনটাও মিস হয়ে গেলে বাবা প্রচন্ড বকবে। ছেলেটা মেয়েটার দিকে ঘুরে প্রথমে মেয়েটার মুখ দেখল, তারপর চাঁদের দিকে তাকাল। মেয়েটা উল্টোদিকে ঘুরে চামচিকে দেখতে লাগল।
আসলে এরকমই হয় বোধহয়! মেয়েটা আর ছেলেটার মনে তখন খন্ডখন্ড ভাবনার ঝড়, যা বাস্তবে আনলে লাইনগুলো পরপর কিছুটা এরকম হবেঃ
“ইশ আরেকটু লম্বা হলে বড় ভালো হত!”
“খিদে পাচ্ছে।”
“বিয়েতে রাজি করাতে পারলে আমায় একটু হিল পরতে হবে আরকি!”
“ও যদি দুম করে চুমু খেয়ে দেয়!”
“চাঁটি মারবে না তো, যা ডাকাত মেয়ে!”
“হুঁহ চুমু খাবে, অত ধক আছে?”
সেদিন মেয়েটা তো ধক আছে কিনা জানার জন্যই বুদ্ধি করে লো-প্রেশার হবার ড্রামা করেছিল। মানে এমনিতে মেয়েটার লো-প্রেশারের ধাত, সেদিন প্রেশার ফলও করেছিল। কিন্তু তা হলেও মেয়েটা সেদিন মোটেই অজ্ঞান হবার মতো অবস্থায় ছিল না। কিন্তু মেয়েটার লাল চুড়িদারের হাতা সরিয়ে প্রেশার মাপতে গিয়ে ছেলেটারই প্রেশারের ন যযৌ ন তস্থৌ অবস্থা। ছোকরা প্রথমবার প্রেশার মেপে বলে “উপরে দুশো নিচে কুড়ি!” মেয়েটা রেগে গিয়ে এক ধমক দিয়ে বলেছিল, “যত্তসব!” ছেলেটা আরও ঘাবড়ে গিয়ে বলেছিল, “আচ্ছা আরেকবার দে, মাপি।”
মেয়েটা আজকে একটু নার্ভাস আছে। ডানপিটে বদনামওয়ালা মেয়েটা চিরকাল ছেলেদেরকে প্রপোজ করতে এলে থাবড়া, গাঁট্টা, কিম্বা নিদেনপক্ষে ধমকধামক দিয়ে এসেছে। কিন্তু কেসটা হল গিয়ে এ ছেলেটাকে মেয়েটার পছন্দ হয়ে গেছে! কী জ্বালা! একেও ধমক দিয়ে কাটিয়ে দেওয়াই যায়, কিন্তু ধমকটা দেবে কিনা ভাবতে লাগল মেয়েটা। মনে পড়ে গেল জীবনের প্রথম প্রপোজালের কথা!
মেয়েটা তখন গার্লস স্কুলের ক্লাস ফাইভ। পাশের বয়েজ স্কুলের ক্লাস সিক্সের লম্বা মতন ফর্সা মতন ছেলেটা প্রপোজ করতে এল। শনিবার নির্জন দুপুরে মেয়েটা সাইকেল চালিয়ে আঁকার মাস্টারমশাইয়ের বাড়ি থেকে ফিরছিল৷ ছেলেটা সাইকেল থামিয়ে জিজ্ঞেস করল, “একটা কথা বলব, একটু দাঁড়াবে?”
“কী ব্যাপার?” গলায় দিদিমণির ভারিক্কি।
“তোমায় আমার ভালো লাগে।” সাহস করে বলেছিল ছেলেটা!
“সে তো সবারই লাগে।” মেয়েটা জাস্ট চুপ করিয়ে দিল।
“তোমার নাম কী?” সোজা চোখ তুলে মেয়েটা জিজ্ঞেস করল।
“শঙ্খদীপ।”
“শুনতে তো ভালোই, মানে কী নামের?”
ছেলেটা আমতা আমতা করে বলল, “না মানে, দুটোই তো পুজোর উপকরণ…”
“হুম, তার মানে শঙ্খ ও দীপ, দ্বন্দ্ব সমাস।”
ছেলেটার পালাবার-পথ-না-পাওয়া মুখ ভেবে এত বছর বাদে মেয়েটা অন্ধকারে হেসে ফেলেছিল। ভাবছিল মেয়েটা, এই ছেলেটারও তো বেশ জটিল চার-অক্ষরী নাম। “হ্যাঁ” বলার আগে একটু ব্যাকরণ পড়া ধরলে কেমন হয়! ভাবতে ভাবতেই দূর থেকে দেখা গেল অটো আসছে।
“আমাদের বোধহয় এবার কনভার্জ করা উচিত।”
ছেলেটা বলে ফেলল, বলেই পিছন ঘুরে অটোর দিকে তাকাল, যেন জগতে অটোর চেয়ে বেশি ইন্টারেস্টিং আর কিছু নেই!
যাব্বাবা, প্রোপোজালটাও এরকম বেরসিক ম্যাথমেটিক্যাল! মেয়েটা যদিও অঙ্কে কাঁচা না, বরং ডিগ্রি হিসেবে দেখতে গেলে ডাক্তার ছেলেটার চেয়ে ইঞ্জিনীয়ার মেয়েটারই অঙ্কে বেশি ব্যুৎপত্তি, তাই বলে এরকম নিশিরাত থালাচাঁদ নিরিবিলি নিঃঝুম – একটা চুমুও খেলো না গো! পড়া ধরা মাথায় উঠল মেয়েটার। ঘেঁটে গিয়ে ভাবতে লাগল এ ছোকরা তো স্টেটমেন্ট দিল, প্রোপোজ তো করল না! হ্যাঁ-না কিছুই তো জানতে চাইল না!
অটো এসে দাঁড়াল, মেয়েটাকে পিছনের সিটজুড়ে একা বসতে দিয়ে ছেলেটা অটোওলার পাশে গিয়ে বসল। আর অটোয় বিয়ে-বিয়ে গন্ধ পেয়ে উড়ে আসা প্রজাপতি ছেলের গায়ে বসবে, না মেয়ের গায়ে বুঝতে না পেরে শেষে অটোওয়ালার গায়ে বসে পড়ল।
হা হতোস্মি!
3 Comments