অমিত দত্ত: ভারতীয় চলচ্চিত্রের এক জাদুকর
একদিন ‘ক্রমশ’ (২০০৭) দেখে চমকে গিয়েছিলাম। বিস্ময়কর স্টাইল! তখনও কিংবদন্তি মনি কাউল বা, সাম্প্রতিক পুষ্পেন্দ্র সিংহদের সঙ্গে পরিচয় হয়নি। পরে ‘আষাঢ় কা এক দিন’ (১৯৭১) থেকে ‘লাজবন্তি’ (২০১8) অবধি প্রদক্ষিণ সেরে অনুভব করলাম, এই যে নিরাবেগ সংলাপক্ষেপন ও ফ্রেমের অভিনবত্ব, এ একেবারে অন্য গ্রহের নয়। আসলে আমরা সচেতনভাবেই এ-সব অভিনবত্ব এড়িয়ে চলি। এগুলো আমাদের ছকে বাঁধা ভাবনা ও চোখ-কানকে এতদূর চ্যালেঞ্জ করে যে আমরা চমকে সরে যাই, পালিয়ে বাঁচি। ‘ক্রমশ’-র প্রতিটি ফ্রেম স্বয়ং-সম্পূর্ণ, কোনও সংলাপের বোধহয় প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু সেই সংলাপ এল কীভাবে? অনেকটা ধারাভাষ্যের মতো আত্মগত হয়ে! ‘Soliloquy’ বা ‘স্বগতোক্তি’-র এই চলনে সেই মনি কাউলের সময় থেকেই বোধহয় ইচ্ছাকৃতভাবে অপ্রচলিত সাধু শব্দের প্রয়োগ করা শুরু হয়। মনি কাউলের ছবির বিষয় অনুযায়ী এই সংলাপের ধরনে অবশ্য কিছু বদল ঘটেছিল। ‘ক্রমশ’-তে হয়তো সেক্ষেত্রে একটু আবেগ প্রয়োজন ছিল স্বগতোক্তিতে। কিন্তু এর দৃশ্যভাবনা ও ক্যামেরা-কোণ এতই অলৌকিক রকমের সুন্দর যে ২২মিনিটের শর্ট ফিল্মটি শেষ হওয়ার বহুক্ষণ পরেও ওই দৃশ্য-কাব্যের অনুরণন থেকে যায় মনে।
ভারতে এক্সপেরিমেন্টাল সিনেমার অন্যতম সক্রিয় পথিকৃৎ অমিত দত্ত ১৯৭৭ সালের ৫ সেপ্টেম্বর জম্মুতে জন্মগ্রহণ করেন। পুনের ‘ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউট’ থেকে ২০০8 নাগাদ তিনি গ্র্যাজুয়েশন সম্পূর্ণ করেন। আমেদাবাদের N.I.D.-তে পড়ানোর পাশাপাশি ফিল্ম মেকিং শুরু করেন। এরপর অমিত সিমলায় I.I.A.S.-এ যোগদান করেন ২০১৫ তে। মন্তাজ-শৈলীর অনুপম বৈশিষ্ট্য তাঁকে সমালোচক মহলে দ্রুত খ্যাতিমান করে তোলে। ‘কালজয়ী কমবখত্’ তাঁর লেখা একটি প্রশংসিত উপন্যাস। রূপদক্ষ অমিত দত্তর ‘গীত-গোবিন্দ’ একটি সংলাপহীন শর্ট ফিল্ম, Mise en scène ও সাউন্ড ডিজাইনের মৌলিকত্বে সেখানে শিল্প ও প্রকৃতির যুগপৎ নৈকট্যে আশ্চর্য কোলাজ গড়ে উঠেছে। ‘গীত-গোবিন্দ’ ছাড়াও ‘ফিল্ড ট্রিপ’ এবং ‘সীনস্ ফ্রম অ্যা স্কেচবুক’ শর্ট দুটিতেও অষ্টাদশ শতাব্দীর চিত্রকর নৈনসুখের সরাসরি প্রভাব বিদ্যমান। আবার ‘The Scent Of Earth’ (২০২১) মাত্র দু-মিনিটের শর্ট ফিল্ম, কিন্তু শৈশব-স্মৃতি ও একটি বিশেষ সুগন্ধের খোঁজ কী আশ্চর্য কৌশলেই না ধরেছেন পরিচালক! এককথায় বিস্ময়কর! জনৈক ফিল্ম-বাফ সাধে বলেননি, লোকটার মূর্তি বানিয়ে মন্দির প্রতিষ্ঠা করা উচিত! কখনও পেপার-কাটিং থেকে মেঘ বানিয়ে, কখনও হাতে আঁকা ছবির উপর গাছপালা, ফুলপাতা প্রতিস্থাপন করে, জং-ধরা ট্যাংক-এ ফুল ফুটিয়ে, ছুটন্ত ঘোড়ার পেপার-কাটিং সবুজ ঘাসপাতার ফাঁকে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে দূরত্ব ও দৃষ্টিপথের অভিমুখ বুঝিয়ে, অনবদ্য অভিজ্ঞতা উপহার দিয়েছেন অমিত। যেন এক স্বতোৎসারিত অ্যানিমেশন! ছবিটি দৃশ্যভাষার মৌলিকতায় দু-মিনিটেই বুঝিয়ে দেয়, ক্রাফট্ জানলে সিনেমা কতটা শক্তিশালী মাধ্যম।
সের্গেই পারাজানোভ আর্মেনিয়ায় বসে একটা ছবি বানিয়েছিলেন, নাম ‘The Color of Pomegranates’ (১৯৭৯)। কাব্যিক দ্যোতনা-মুখর সেই চলচ্চিত্র যাঁরাই দেখেছেন, অনুভব করেছেন, কোনও শিল্পীর জীবন ক্যামেরায় ধরার সেরা শিল্পিত পথ এটিই। সেখানে কবি ও সঙ্গীতজ্ঞ সায়াৎ নোভার জীবন-জিজ্ঞাসা ও শিল্প-দর্শন সিনেমায় ধরার জন্য পরিচালক ট্যাবলো-র সাহায্যে অনুবাদ করেছেন সায়াতের কাব্য-ভাবনাকেই, সেটা করতে গিয়ে সাহায্য নিয়েছেন আর্মেনিয়ার লোকশিল্প, সঙ্গীত, স্থাপত্য, ও চিত্রকলার। অনেকেরই ছবিটি ভীষণভাবে প্রিয়। অমিত দত্তর ছবি ‘নয়নসুখ’ (মতান্তরে ‘নৈনসুখ’, ২০১০) সম্ভবতঃ উপরোক্ত ছবিটি দ্বারা অনুপ্রাণিত, হওয়াই স্বাভাবিক। ওই পদ্ধতির অনেকাংশের সফল প্রয়োগ অমিত দত্ত করেছেন ‘নয়নসুখ’-এ।
অমিত দত্ত খুব খেটেখুটে যেটা করেছেন, সেটা আর কিছুই নয়, রঙ-তুলি-তে আঁকা একটা আর্ট ফর্ম-কে আরেকটা আর্ট ফর্মে জ্যান্ত করে, ছেড়ে দিয়েছেন। অর্থাৎ তিনি বায়োপিকও বানাতে চাননি, অহেতুক আর্ট-ও করতে যাননি। শিল্পীর আঁকায় যদি শিকারের দৃশ্য থাকে, সেখানে সিনেমায় তাঁর অভিনেতারা মঞ্চাভিনেতার মতোই সহজভাবে অস্ত্র হাতে কোনো অনুপস্থিত শিকার-কে লক্ষ্য করে দাঁড়িয়ে যায়। তারা কোনো এক্সপ্রেসন বা, শারীরিকভাবে আক্রমণাত্বক ভঙ্গি করে না। কারণ শিল্পীর ছবিতে যা চিত্রবৎ, তা প্রায় অভিব্যক্তিহীন। শুধুমাত্র জন্তুটিকে বোঝাতে বাঘের গর্জন আনা হয় আবহে। ব্যাস, রঙ্-তুলি জীবন্ত হয় অডিও-ভিস্যুয়ালে। আবার সবুজ ফসলে ভরা ক্ষেতের মধ্যে দিয়ে, ঘোড়ার পিঠে স-পারিষদ রাজা নর্তকী নিয়ে গেলে, সাউন্ডট্র্যাকে জুড়ে দেওয়া হয়, উচ্ছল রমণীর কলকল হাসি। ব্যাস, গুলের প্রদেশের ঐতিহ্যবাহী পাহাড়ি চিত্রকলায় দীক্ষিত, পুরুষানুক্রমে শিল্পী নৈনসুখের নিজস্বতা জীবন্ত হয়ে ওঠে সিনেমায়। এটুকুই করেছেন অমিত দত্ত। ডকুমেন্টারি আর ফিচার ফিল্মের মধ্যে একটা অদৃশ্য সাঁকো-তে বসে তিনি সঙ্গীতায়োজন আর দৃশ্যায়োজনের কাব্যিক সুষমায় মূর্ত করে তুলেছেন বিস্মৃত এক শিল্পীর শিল্প-ভাবনাকে। এই ছবিতে ফ্রেমের মাহাত্ম্য অপরিসীম, আর একমাত্র সমস্যা হল দৃশ্য নির্মাণের নিজস্ব আবেগে ভেসে যাওয়া। পরিচালক যেন মণি কাউল-ঘরানা থেকে প্রায় বেরিয়েই এসেছেন। দুই-মাত্রার (2D) চিত্রকলার নিয়ন্ত্রিত ব্যবহারে কীভাবে তিন-মাত্রার (3D) বিভ্রম রচনা করা সম্ভব, তা দেখিয়েছেন অমিত দত্ত! আর সেটা করতে গিয়ে তথ্যচিত্র এবং চলচ্চিত্র নামক দুই সমান্তরাল জমির মধ্যবর্তী বিভেদরেখাটিকে প্রায় মুছে, দুটিকে মিলিয়ে দিয়েছেন। চিত্রকর নৈনসুখ বা, নয়নসুখ-এর চিত্রগুলি স্বভাবতই স্থির, তা যতই অস্থির জীবন ও ইতিহাসকে গর্ভে ধারণ করে রাখুক না কেন! কিন্তু অমিত দত্ত যেন আশ্চর্য কৌশলে সেই স্থিরচিত্রগুলিকেই সচল করে তুলে, মিশিয়ে দেন বহমান সময়ে, মুক্তি দেন এক বন্দি মহাজীবনকে। আজ সেকালের সেই রাজাও নেই, সেই রাজপ্রাসাদও নেই। কিন্তু পরিচালক ফিল্মি সেট বানিয়ে কোনো কৃত্রিমতার মধ্যে ইতিহাসকে স্থাপন করতে যাননি। বরং তিনি ধৈর্য ধরে ক্যামেরায় ধরেছেন ভগ্ন ইমারতগুলিকেই, সেকালের জীর্ণ স্তম্ভ-খিলানগুলোই অধিকতর জীবন্ত হয়ে উঠেছে ক্যামেরায়। ‘খণ্ডর’ (মৃণাল সেন)-এ যামিনীর সাক্ষাৎ-প্রাপ্তির মতো সেখানে কোনও অভিমানী নর্তকীর দেখাও পেতে পারেন দর্শক! এবার এখানেও মজা, কারণ পরিচালক সেই বাস্তব ফ্রেমের মধ্যে ঢুকিয়ে দেন শিল্পীর হাতে আঁকা দ্বিমাত্রিক ছবি, যা ক্ষেত্র ও ক্ষেত্রভিত্তিক গভীরতার এক আশ্চর্য ব্যাখ্যা তুলে ধরে। চিত্রকর যে কোণ থেকে দৃশ্যগুলি দেখেছেন, ক্যামেরাও সেভাবেই ফ্রেম ভেবেছে, সংযোজন করেছে আঞ্চলিকতা। আরো চমকপ্রদ, কিছু ক্ষেত্রে চিত্রকরের দৃশ্যভাবনা ও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার মধ্যে পরিচালক প্রতিস্থাপন করেছেন নিজস্ব পছন্দ, একটি অঙ্কনের সামগ্রিকতাকে খণ্ড খণ্ড করে জুড়ে দিয়েছেন, বুনে দিয়েছেন নানা শটে। এভাবেই তৈরি হয়েছে, সিনেমার নিজস্ব প্রাণ। ১৭১০ থেকে ১৭৭০ খ্রিষ্টাব্দ, পাহাড়ি চিত্রকলার অন্যতম মৌলিক চিত্রকর নৈনসুখের জীবনকাল। প্রায় বিস্মৃত এই শিল্পীকে চিরস্মরণীয় করে রাখতে পারে অমিত দত্তর এই তথ্যচিত্রটি, এর মূল্যও নেহাৎ কম নয়।
অমিত দত্তর আরেকটি উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র ‘দ্য সেভেন্থ ওয়াক।’ পরিচালক এক্ষেত্রে অনেকটা সময় নিয়েছেন বক্তব্যের জমি-টা তৈরি করতে। সুতরাং ওইখানেই ধৈর্য হারিয়ে ফেললে চলবে না। চিত্রকর পরমজিৎ সিংহ স্বয়ং যেখানে হাজির, প্রত্যাশা তৈরি হয়, ফর্ম স্বাভাবিকভাবেই কথোপকথনে যাবে, যেমন সাধারণত ডকু-ছবিতে হয় আরকি। কিন্তু না! অমিত দত্ত এক্কেবারে নতুন ফর্ম নিয়ে এলেন, যেখানে চলমানতার সঙ্গে থাকবে শুধু অ্যাম্বিয়ান্স, সাউন্ড এফেক্টস্ আর আবহ সঙ্গীত। তাই জলের কলকল, পাখির ডাক আর সেতার-সরোদের অনুরণনে ক্ষণে ক্ষণে মিশে যায় প্রাকৃতিক আলো-ছায়া, শিল্পীর ক্যানভাসে তা কখনও ফুল ফ্রেমে, কখন মাত্রা বা, স্তরের খোঁজে জুম-ইন, অয়েল পেন্টিংয়ের ক্লোজ-আপ! বিস্ময়কর বইকি। উড়তে থাকা উপল, উড়ন্ত দু’পাটি রঙিন জুতো, তারাই শুধু জানে, দু’চোখে কত স্বপ্ন নিয়ে লোকটা রাতে শুতো?
ডকু-ছবিতে শিল্পীর জীবন নয়, শিল্প-ভাবনা এবং খিদেটাকে ধরতে চেয়েছেন অমিত। সুপার ইম্পোজ বা, ডিজলভের প্যাটার্ন যেমন এক্ষেত্রে এনেছেন অমিত দত্ত, তেমনই ক্যানভাসে রঙের সাথে রঙের আলিঙ্গন বোঝাতে তিনি ফ্রেমের উপর ফ্রেম এনে, সেগুলো ট্রান্সপ্যারেন্ট করে দিয়ে, সঙ্গীতের তালে তালে জন্ম দিয়েছেন দৃশ্যকাব্যের। একজন শিল্পীকেই শুধু নয়, মানুষটাকেও তিনি চিনিয়ে দেন একটাও কথা না বলে, কেবল পরমজিতের সংলাপহীন স্তব্ধ, নিবিড় চাহনিতে।
ভালোলাগার অপর নাম এখন অমিত দত্ত। গভীরে ডুব দিতে দিতে উনি যেন সিনেমার পানকৌড়ি। জলের অতলেও তাই তাঁর সুদূরসঞ্চারী দৃষ্টি খুঁজে নেয় জলজ শৈবালে মুখ গুঁজে থাকা ঝিনুক। গান খুঁজে নেন জলপ্রবাহে, মেঘের অপসৃয়মান ছায়ায় কেমন বায়ুর সাথে লাট খায় বৃক্ষচ্যুত পাতা – আক্ষেপ হয় এসব আমরা সিনেমাহলে দেখতে পেলুম না! শিল্পীর হাতে আঁকা ছবি থেকেই জ্যান্ত হয়ে ওঠে একটি পাথর খন্ড, ভেসে বেড়ায় বাতাসে ভরশূন্য হয়ে। দুয়ারে এসে দাঁড়ানো এক কিশোরী মেয়ে খুলে রেখে যায় তার নরম জুতোজোড়া, তারাও ভাসমান হয়। সাউন্ডট্র্যাকে সঙ্গত দেয় প্রকৃতি, আমরা অনুভব করি এভাবেই স্বতন্ত্র হয় সৃষ্টি – নিজস্ব হয় নির্মাণ, অমিত দত্ত আমাদের সে পথই দেখান।
—————
তথ্যঋণ
উইকিপিডিয়া।
মুবি।